অনুষ্ঠিত হলো “তুফান আল আকসা -এর বর্ষপূর্তি উদযাপন ও সংহতি সমাবেশ’২৪”
রাজধানীর আগারগাঁও -এ অবস্থিত জাতীয় আর্কাইভ অডিটরিয়ামে বায়তুল মাকদিস ফাউন্ডেশন কর্তৃক অনুষ্ঠিত হয়েছে অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় হামাসের পরিচালিত তুফান আল আকসা এর বর্ষপূর্তি উদযাপন ও সংহতি সমাবেশ। ১০ নভেম্বর সকাল ৯ ঘটিকা থেকে শুরু হয়ে দুপুর ৩ ঘটিকা পর্যন্ত এই সমাবেশ দীর্ঘায়িত হয়।
গত বছরের ৭-ই অক্টোবর অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকা থেকে হামাসের পরিচালিত তুফান আল-আকসার পর থেকে গাজায় চলছে শতাব্দীর ঘৃণ্যতম গণহত্যা। এরপর থেকে বহির্বিশ্বের সাথে সাথে বাংলাদেশেও ফিলিস্তিন, বায়তুল মাকদিস ও গাজা-কে নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন করে ভাবনা ও আলোচনা।
পাশাপাশি, চলতি বছরের ৩১ জুলাই হামাসের রাজনৈতিক শাখার প্রধান ও উম্মাহর মহান মুজাহিদ ইসমাইল হানিয়া এবং ১৬ অক্টোবর ইয়াহিয়া সিনওয়ারের শহীদ হওয়ার গাজা গণহত্যার বিষয়টি আলোচনার নতুন মাত্রা পায়।
এমন পরিস্থিতিতে হামাসের উক্ত অভিযানের একবছর পূর্তিকে সামনে রেখে বায়তুল মাকদিস, গাজা ও ফিলিস্তিন ইস্যুকে এদেশের সকল স্তরের মানুষের নিকট পৌঁছানোর জন্য আজ (১০ নভেম্বর) বায়তুল মাকদিস ফাউন্ডেশন “তুফান আল-আকসা এর বর্ষপূর্তি উদযাপন ও সংহতি সমাবেশ” -এর আয়োজন করে। যেখানে মিডিয়া পার্টনার হিসেবে ছিল বেসরকারী আন্তর্জাতিক নিউজ পোর্টাল মুসলিম পোর্ট।
উক্ত সমাবেশের শুরুতেই বায়তুল মাকদিস ফাউন্ডেশন-এর প্রেসিডেন্ট আকিব আহমেদ ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম সমূহ তুলে ধরার মাধ্যমে উদ্বোধনী বক্তব্য প্রদান করেন। প্রেসিডেন্টের পর ফাউন্ডেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট আব্দুর রহমান জামি বক্তব্য প্রদান করেন। তিনি বলেন,
“আজকের সমাবেশ শুধু কুদসের জন্য নয়, সমগ্র নির্যাতিত মানুষের জন্য। আজ গাজাবাসী এমন শিক্ষা দিচ্ছে, যা কোনো প্রতিষ্ঠান দেয় না। তারা আমাদের সংগ্রাম, ধৈর্য ধরা ও টিকে থাকার শিক্ষা প্রদান করে।”
সমাবেশে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, ঢাকা মহানগরী দক্ষিণ-এর সেক্রেটারি জেনারেল ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ। যিনি বলেন,
বাংলাদেশকে বিগত ১৫ বছর আরেকটি ফিলিস্তিন বানিয়ে রাখা হয়েছিলো। ফিলিস্তিন নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বাংলাদেশি ভাইয়েরা খুন, গুম, রিমান্ডের শিকার হয়েছে। ফিলিস্তিন আমাদের অস্তিত্ব। নবীজী (সা.) আমদেরকে উম্মাহ হিসেবে বলছেন, তাই ফিলিস্তিন আমাদের অংশ না, ফিলিস্তিন আমাদের অস্তিত্ব। /ফিলিস্তিন বিজয় না করে বিশ্বে কোথাও জয়লাভ সম্ভব না।বাংলাদেশকেও জয় করতে হলে ফিলিস্তিনের বিজয় প্রয়োজন। ফিলিস্তিন হচ্ছে আমাদের আত্মমর্যাদা ও সম্ভ্রম। ফেরাউনের যদি নীলনদে ডুবে আত্মহত্যা করতে হয়, মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিটি অঞ্চল ইসরায়েলের বধ্যভূমি হবে।”
ড শফিকুল ইসলাম মাসুদ বায়তুল মাকদিসকেই দুনিয়ার সকল কল্যাণের কেন্দ্রবিন্দু আখ্যা দিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংগ্রামকেও বৃহদার্থে আল আক্বসা মুক্ত করার সংগ্রামের প্রতি আহ্বান করেন।
এরপর, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর কেন্দ্রীয় গবেষণা সম্পাদক শেখ ফজলুল করিম মারুফও সমসাময়িক ইসলামী আন্দোলন সমূহের অবস্থানের প্রেক্ষিতে গাজা গণহত্যা প্রসঙ্গে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে কঠোর থাকার আহ্বান করে। এছাড়াও তিনি জানান, “বর্তমান মুসলিম উম্মাহ জায়োনবাদদের প্রতিরোধ করতে পারছিলো না। আরবরাই বরং ইজরায়েলের কাজকে সহজ করছিলো। এমতাবস্থায় হামাস তুফান আল-আকসা নিয়ে আসে। জাতিসংঘ দ্বিরাষ্ট্রের সমাধান দেয়, কিন্তু আমরা দ্বি-রাষ্ট্র চাইনা, আমরা ইসরায়েলকে উৎখাত করতে চাই।”
পরবর্তীতে তিনি জাতীয় পরিসরে কিছু প্রস্তাবনাও তুলে ধরেন। যেখানে উল্লেখ করা হয়- আমাদের পাঠ্যবইতে কুদসের বিষয়ে কোনো আলোচনাই নেই, তাই দেশের পাঠ্যবইগুলোতে বায়তুল মাকদিস অন্তর্ভুক্ত করা জরুরী হয়ে পড়েছে। আর সেটা অন্তত ৫টা শ্রেণিতে বিন্যস্ত করতে হবে।
এছাড়াও, সমাবেশের অন্যতম প্রধান আলোচক হিসেবে বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং পবিপ্রবির সাবেক ভিসি প্রফেসর ড. আব্দুল লতিফ মাসুম উপস্থিত ছিলেন। যিনি ফিলিস্তিনের ইতিহাস, কাল পরিক্রমা ও বর্তমান অবস্থা তুলে ধরেছেন এবং বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, কুদস আন্দোলন আমাদের দ্বীন এবং দুনিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ। তিনি বলেছেন, “বায়তুল মাকদিস আমাদের ঈমানের অংশ। আমাদের ধর্মীয় অবস্থান থেকে বায়তুল মাকদিসের গুরুত্ব রয়েছে। কেননা, এখান থেকেই মিরাজে গমন করেছেন রাসূল (সা.) এবং এখানেই কেয়ামত সংঘটিত হবে। তাই বায়তুল মাকদিসকে শুধু ধর্মীয় অবস্থান থেকেই নয়, বরং রাজনৈতিক জায়গা থেকেও এর গুরুত্ব উপলব্ধি করতে হবে।”
এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী বিভাগের অধ্যাপক ড. ইফতিখারুল আলম মাসউদ। বিশিষ্ট এই শিক্ষাবিদ শিক্ষাঙ্গন থেকে শুরু করে বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গায় মাকদিসের চর্চার বৃদ্ধি ছাড়াও যুবমননে গাজা গণহত্যার বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ফিলিস্তিন অসংখ্য নবীর জন্মভূমিই নয়, এটি সভ্যতারও তীর্থস্থান। ফিলিস্তিনে শান্তি থাকলে পৃথিবীতে শান্তি থাকবে। বর্তমান হতাশাজনক পৃথিবীতে আমরা উম্মাহ চেতনার কারণেই আশাবাদী হতে পারি। ফিলিস্তিন সমগ্র উম্মতকে বার বার একত্র করেছে। এই যুদ্ধে পাশ্চাত্যের দ্বিচারিতা আমাদের সামনে ফুটে উঠেছে। তারাই গাজায় মানুষ হত্যা, রোগী হত্যা, হাসপাতালে বোম্বিং করছে, আবার মানবাধিকার নাম দিয়ে তারাই বিকৃত মানসিকতাকে প্রমোট করছে। আমরা সচেতন না হলে এই দেশ ফিলিস্তিন হতে বাধ্য।
তিনি আরো বলেন, ফিলিস্তিনের পাশে তো মুসলিম রাষ্ট্র আছে, আমাদের আশেপাশে তাও নেই। অথচ, আমরা কয়জন যোগ্যলোক তৈরি করেছি, যারা আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে যৌক্তিকভাবে ফিলিস্তিনকে তুলে ধরবে ও অধিকারের কথা তুলে ধরবে!? এজন্য, আমাদের পরিবারকে এভাবে তৈরি করতে হবে, যারা উম্মাহকে ধারণ করবে এবং ফিলিস্তিনকে ধারণ করবে।”
সমাবেশে বিশেষ অতিথি হিসেবে আরও বক্তব্য রাখেন বিশিষ্ট কবি সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও বিএনপি চেয়ারপার্সন-এর উপদেষ্টা সদস্য কবি আবদুল হাই শিকদার। তিনি বলেন, ”আরবরা মূলত তসবিহ’তে আল্লাহর নাম জপে না, জপে আমেরিকান প্রেসিডেন্টের নাম।” বাংলাদেশের বিগত সময়ের সাথে ফিলিস্তিনের তুলনা করে বলেন, আওয়ামীলীগ আর মানুষ একসাথে যায় না। লীগ আর ন্যায় একসাথে যায় না। দুটো পরস্পরের শত্রু। তরুণদের উচিত নিজেদের দায়িত্ব পালন করা। নিজেদের ভূমিকা পরিস্কার রাখা। আমাদেরকে রুখে দাড়ানো শিখতে হবে। কিন্তু, আমরা নিশ্চুপ কেন?”
এছাড়াও, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র সমাজ-এর ছাত্র কল্যাণ সম্পাদক কাজী মাযহারুল ইসলাম বায়তুল মাকদিসের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা তুলে ধরেন। পাশাপাশি, বিশিষ্ট লেখক গবেষক ও আলেম মাওলানা সাইমুম সাদী বিভিন্ন ঘরানার দলগুলোর মধ্যে ঐক্য সংক্রান্ত বিষয়ে আলোকপাত করেন। বিশেষত দ্বীনি দৃষ্টিকোন ও আলেম সমাজের দায়িত্বের কথাও স্মরণ করে এই গবেষক।
এর বাইরে, ইসলামি ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশ এর সেক্রেটারি জেনারেল মুনতাসির আহমাদ বলেন, “আমরা এমন একটি দুনিয়া গড়তে চাই, যেখানে মাজলুমের আহাজারি থাকবে না। তারুণ্য একটি শক্তির নাম, যা কখনো পরাজিত হয় না।
পাশাপাশি, জাতিয় বিপ্লবী পরিষদের অন্যতম প্রতিনিধি কবি জেহাদী ইহসান বলেন, “ফিলিস্তিন আমাদের হৃদয়, তাই এই হৃদয়ের ক্ষত আমাদের সাড়িয়ে তুলতে হবে। বাংলাদেশে আমার জন্ম কিন্তু ফিলিস্তিন আমার দেশ। আমরা যে স্বাধীনতা দেখছি তা আসলে বিভ্রম।
সর্বশেষ এদিনের সমাবেশের সমাপনী বক্তব্যে বায়তুল মাকদিস ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট আকিব আহমেদ কিছু প্রস্তাবনাও তুলে ধরেন। প্রস্তাবনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো,
১. সন্তানদের মাকদিসের শিক্ষা দেয়া। বিভিন্ন পন্থায় গল্প, ইতিহাস, ঘটনাবলি তুলে ধরা।
২. দখলদার ইজরায়েল রাষ্ট্রকে অবৈধ ঘোষণা করা, যারা একে সমর্থন করবে তাদেরকেও অবৈধ ঘোষণা করা।
৩. ফিলিস্তিন থেকে আগত শিক্ষার্থীদের জন্য সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করতে সরকারের প্রতি আহ্বান।
৪. বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বায়তুল মাকদিস স্টাডিজ নামক ডিপার্টমেন্ট চালু করা।
৫. দখলদারদের পন্য বয়কট করা।
৬. ফিলিস্তিন শিক্ষকদেরকে গেস্ট টিচার হিসেবে আনা।
৭. সরকারিভাবে ফিলিস্তিন নিয়ে বই ও গবেষণা পত্র প্রকাশ করা।
৮. কুদসকে অস্তিত্বের অংশ মনে করে বাংলার মানুষের কাছে উপস্থাপনের জন্য ফাউন্ডেশনের করা কাজকে সমর্থন ও সহযোগিতা করা।
পরিশেষে তিনি বৃহৎ আয়োজনের স্লোগানের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি আঁকেন। উক্ত প্রোগ্রামের স্লোগান ছিলো,
“শুধু ফিলিস্তিনিরাই মাকদিসি নয়, মাকদিসি হচ্ছে তারা, যারা নিজ ভূখণ্ডে থেকেও মাকদিসের জন্য কাজ করে।”