মুসলিম পোর্ট

সুলতান সুলাইমান ছিলেন উসমানী খেলাফতের দশম ও সবচেয়ে দীর্ঘকালব্যাপী (প্রায় ৪৬ বছর) প্রভাবশালী সুলতান। তিনি ১৪৯৪ সালের ৬ নভেম্বর পূর্ব তুরস্কের তারবিজে, কৃষ্ণসাগরের উপকূলীয় অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। সুলতান সুলাইমানকে ইউরোপে সুলাইমান দ্যা ম্যাগনিফিসেন্ট (মহান সুলতান) বলে ডাকতেন। এছাড়াও বিভিন্ন অঞ্চলে তাকে একাধিক নামে ডাকা হলেও তিনি উম্মাহর নিকট কানুনি সুলতান নামেই সমাধিক পরিচিত। তিনি উসমানী খেলাফতের প্রায় সকল নীতিমালাকে নবায়ন করেন বলেই তার নাম কানুনী সুলতান হয়েছে। তিনি ষোড়শ শতাব্দীর অপরাজেয় এক মহান সুলতান, যিনি তার জীবদ্দশায় কোন অভিজানে ব্যার্থ হন নাই।

তৎকালীন সময়ে সুলতান সুলাইমান ছিলেন পৃথিবীর অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। তার সময়ে উসমানী খেলাফতের প্রায় এক-চতুর্থাংশ ব্যয় করে তিনি ১৩টি সৈন্যাভিযান পরিচালনা করেন৷ তিনি ১৫২০ সালে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার পরেই খেলাফতের নীতিতে বৃহত্তর পরিবর্তন সাধন করেন। প্রাচ্যের হয়ে ইরানের সাফাভিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পরিবর্তে পশ্চিমা শত্রু, যাদের কিনা তিনি দুর্বল ভাবতেন, তাদের বিরূদ্ধে উসমানী কৌশল পুনর্বিন্যাস করেন৷

১৫২১ সালে তিনি বেলগ্রেড জয় করেন। পরবর্তী বছর, ১৫২২ সালে ভূমধ্যসাগরের উপর উসমানীয়দের নিয়ন্ত্রণ আরও সুরক্ষিত করতে রোডসকে উসমানীয় খেলাফতের অন্তর্ভুক্ত করেন।

এরপ ১৫২৬ সালের ২৮ আগস্ট তিনি হাঙ্গেরীর মোহাকাসের যুদ্ধে হাঙ্গেরীয়দের পরাস্ত ও রাজা ২য় লুই এই যুদ্ধে নিহত হয়। এসময় রাজা লুইয়ের নিষ্প্রাণ দেহ সুলতানের সামনে রাখা হলে, তিনি দুঃখভরে বলেন: “আমি সত্যিই তার বিরুদ্ধে সশস্ত্র হয়ে এসেছি; কিন্তু আমার ইচ্ছা তো এটা ছিল না যে, তাকে পুনরায় প্রাণভিক্ষা আর রাজকীয়তার মিষ্টি স্বাদ দেওয়ার আগেই সে এভাবে মস্তকবিহীন হয়ে যাবে।” এটা ছিল সুলতান সুলাইমানের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজয় অর্জন।

১৫২৯ সালে, প্রায় দীর্ঘ ২ সপ্তাহ অবরোধের পরেও তিনি ভিয়েনা দখলে ব্যর্থ হন৷ এর কারণ ছিলো সাফাভীদের বিরোধপূর্ণ অবস্থা। কিন্তু ১৫৩৪ সালে তিনি সাফাভীদের থেকে বাগদাদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন। এরপর ১৫৪১ সালে হ্যাসবার্গকে পরাজিত করে বুদা জয় করেন।

অন্যদিকে তার নৌ-সেনাপতি হাইরেদ্দিন বারবারোসা ১৫৩৪ সালে তিউনিস জয় করেন৷ ১৫৩৮ সালে মিশরের গভর্নর সুলেমান পাশা ইয়েমেনের কিছু অংশ দখল করেন। বারবারোসার মৃত্যুর পর নৌ-কমান্ডার তুরগুত রেইস, যিনি ১৫৫১ সালে ত্রিপোলি জয় করেন, তার স্থলাভিষিক্ত হন।

১৫৫৪ সালে নাখিচেভান (বর্তমান আজারবাইজান) এবং ইয়েরেভেন (বর্তমান আর্মেনিয়ার রাজধানী) উসমানী খেলাফতের অধীনে নিয়ে আসেন৷

১৫১৮ সাল থেকে ভারত মহাসাগরে উসমানীয় জাহাজ চলাচল শুরু করে। উসমানীয় অনেক নৌ-কমান্ডার খাদিম সুলাইমান পাশা, সাইদি আলি রাইস এবং কুর্তোগলু খিজির রইসরা থাট্টা সহ অনেক নৌ-কমান্ডার মুঘল সালতানাতের বন্দরগুলোতে ভ্রমণ করেছেন বলে জানা যায়। মহান মুঘল সুলতান আকবর উসমানীয় সুলতান সুলাইমানের সাথে ছয়টি নথি বিনিময় করেছেন বলে জানা যায়। সুলতান সুলাইমান পর্তুগিজদের অপসারণ এবং মুঘল সাম্রাজ্যের সাথে বাণিজ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার প্রয়াসে তাদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি নৌ অভিযান পরিচালনা করেন। মুঘল সালতানাতের পশ্চিম উপকূলে পর্তুগিজদের উত্থানের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর জন্য ১৫৩৮ সালে ইয়েমেনের অ্যাদেন উসমানীয়রা দখল করে। যাত্রাপথে, উসমানীয়রা ১৫৩৮ সালের সেপ্টেম্বরে দিউ অবরোধে পর্তুগিজদের বিরুদ্ধে ব্যর্থ হয়, এরপর তারা এডেনে ফিরে আসে, যেখানে তারা ১০০টি আর্টিলারি দিয়ে শহরটিকে সুরক্ষিত করে। এই ঘাঁটি থেকেই পরবর্তীতে, সুলায়মান পাশা সম্পূর্ণ ইয়েমেনের নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হন, এবং রাজধানী সানাও নিয়ন্ত্রনে নেন।

এভাবে লোহিত সাগরের শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে, সুলতান সুলাইমান সফলভাবে পর্তুগিজদের সাথে বাণিজ্য রুটের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে অভিযান পরিচালনা করতে সক্ষম হন এবং ১৬’শ শতক জুড়ে মুঘল সালতানাতের সাথে একটি উল্লেখযোগ্য স্তরের বাণিজ্য বজায় রাখেন।

সুলতান সুলাইমান আলেম, দার্শনিক, শিক্ষক এবং শিল্পকর্মীদের একটি দলকে পৃষ্ঠপোষকতা করেন, যারা সেসময় উসমানীয় খেলাফতের শিক্ষাব্যাবস্থাকে সর্বোচ্চ চূড়ায় নিয়ে গেছে। তিনি বহু মকতব ও মাদ্রাসা নির্মাণ করেন, যাতে জ্ঞান-বিজ্ঞানেরে সকল শাখার শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ ছিলো।

সুলতান সুলাইমা উসমানীয় খেলাফতের স্থাপত্য শিল্পকে সর্বচ্চ চূড়ায় নিয়ে গেছেন। তার সময়ে তৈরি মসজিদ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও পুল/সেতু এখনো মানবতার নিকট আশ্চর্য সৃষ্টি হিসেবে ইতিহাসের ঐতিহ্য হয়ে আছে। তিনি রাজধানী ইস্তাম্বুল সহ খেলাফতের অন্যান্য প্রদেশে স্থাপনা নির্মাণে বিভিন্ন প্রকল্প পরিচালনা করেন। মহান স্থপতি মিমার সিনান তার খেলাফতকালে নির্মাণ কাজে দায়িত্বরত ছিলেন। সুলতানের প্রধান স্থপতি মিমার সিনান দ্বারা নির্মিত ইস্তাম্বুল ও ইরিদনের সুলাইমানিয়া ও সেলিমিয়া মসজিদগুলো আজও তার স্বাক্ষী বহন করে। এখানে উল্লেখ্য, তাজমহল তৈরির পূর্বে যখন সম্রাট শাহজাহান সমগ্র পৃথিবীতে প্রকৌশলী আহ্বান করেন, তখন মিমার সিনানের ছাত্র মেহমেদ ঈসা এফেন্দী তাজমহল তৈরির দায়িত্ব পান।

তিনি মহান আলেম ও উসূলবিদ আবু হানিফার সমাধি এবং জেরুজালেম, মক্কা ও মদিনার মসজিদের মতো অনেক ধর্মীয় ভবন পুনরুদ্ধার করেন। তিনি বাগদাদ বিজয়ের পর বিখ্যাত সুফি ওস্তাদ শেখ আবদুল কাদরি জিলানির সমাধি নির্মাণেরও নির্দেশ দেন।

১৫৬৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর, মহান সুলতান সুলাইমান ইস্তাম্বুল থেকে হাঙ্গেরিতে একটি অভিযানের নেতৃত্ব দিয়ে যাত্রা করেন। হাঙ্গেরির সিগেটভারের যুদ্ধে উসমানীয়দের বিজয়ের আগেই অসুস্থ অবস্থায় তিনি যুদ্ধের তাবুতে মারা যান। উজিরে আজম তার মৃত্যু গোপন রেখেছিলেন যাতে যুদ্ধ চলাকালে কোন সমস্যা তৈরি না হয়।

অনুবাদঃ তাসনিম রহমান স্বর্না