মুসলিম পোর্ট

‘এক চীন’ নীতিতে বিশ্বাসী পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম দেশ চীন। এরই প্রেক্ষিতে তার প্রতিবেশী ভূখণ্ড তাইওয়ানকে যেকোনো মূল্যে করায়ত্ত করতে চায় বেইজিং। এই দ্বন্দ্ব অবশ্য নতুন নয়। এর নেপথ্যে রয়েছে  ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, বিশ্ববাণিজ্য, প্রাকৃতিক সম্পদ ও জলপথের বিবিধ কার্যক্রম।

সতেরশ শতাব্দীতে কিং রাজবংশের শাসনামলে তাইওয়ান প্রথম পুরো চীনের নিয়ন্ত্রণে আসে। এরপর ১৮৯৫ সালে প্রথম চীন-জাপান যুদ্ধে চীন হেরে যাবার পর এই দ্বীপটি তুলে দিতে হয় জাপানের হাতে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান পরাজিত হলে হারানো অঞ্চলসমূহ ফিরে পায় চীন।

পরবর্তী সময়ে চীনা ভুখণ্ডে চিয়াং কাইশেক এর নেতৃত্বাধীন দেশটির জাতীয়তাবাদী সরকারি বাহিনী এবং মাও সে তুং এর কম্যুনিস্ট পার্টির মধ্যে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ।

১৯৪৯ সালে গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটলে চীনের ক্ষমতায় আসে ‘মাও সে তুং’ এর চীনা কমিউনিস্ট পার্টি। অন্যদিকে চিয়াং কাইশেক এবং তার জাতীয়তাবাদী দল (যারা পরিচিত ছিল কুয়োমিনটাং নামে) পালিয়ে চলে যায় তাইওয়ানে। এরপর চিয়াং কাইশেক এবং তার কুয়োমিনটাং সরকারের লোকজন ‘রিপাবলিক অব চায়না’ নামে এক সরকার গঠন করে এবং নিজেদেরকে সমগ্র চীনের প্রতিনিধিত্বশীল সরকার বলেও দাবি করে তারা। তখন থেকেই জাতিসংঘ সহ বিশ্বের অনেক দেশ চিয়াং কাইশেকের সরকারকেই চীনের সত্যিকারের সরকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলো।

১৯৭১ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে তাইওয়ানের সরকারই চীনের প্রতিনিধিত্ব করেছে। অর্থাৎ তাইওয়ান ভূখণ্ডটি চীন হিসেবে বিশ্ব দরবারে পরিচিত ছিলো। এমনকি এই সময়ে তারা পরিকল্পনা করতে থাকে মাও সে তুং এর কমিউনিস্টদের কাছ থেকে আবার পুরো চীনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেওয়ার।

কিন্তু ১৯৭১ সালে জাতিসংঘ বেইজিং এর সরকারকেই চীনের আসল সরকার বলে স্বীকৃতি দেয় এবং যুক্তরাষ্ট্র বেইজিং এর সাথে সব ধরনের সম্পর্ক উন্নয়নে মনযোগ দেয়। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের করা তাইওয়ান অ্যাক্ট অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানকে চীনের অংশ হিসেবে বিবেচনা করে। তারপর থেকে একে একে বিশ্বের প্রায় সব দেশই বেইজিং এর পক্ষে অবস্থান নিল এবং তাইওয়ানের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি কমতে থাকলো।

১৯৮০-এর দশক পর্যন্ত চীন আর তাইওয়ানের মধ্যে চলে তীব্র বাকযুদ্ধ। কিন্তু এরপর সামগ্রিক স্বার্থে বাধ্য হয়ে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে শুরু করে দুই দেশ। এই সময়ে ‘এক দেশ, দুই নীতি’ নামে চীন একটি প্রস্তাব দেয়। যেখানে উল্লেখ ছিলো তাইওয়ান মূল চীনে অন্তর্ভুক্ত হবে, কিন্তু তাদের স্বায়ত্বশাসন প্রদান করা হবে। কিন্তু তাইওয়ান সেই প্রস্তাব শক্তভাবেই প্রত্যাখ্যান করে।

২০০০ সালে তাইওয়ানের নুতন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন চেন-শুই-বিয়ান। ওয়ার্ল্ড পলিটিক্সে ক্রমেই জায়গা হারিয়ে এক পর্যায়ে ২০০৪ সালে তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট ঘোষণা দেন যে, তাইওয়ান চীন থেকে আলাদা হয়ে সম্পূর্ণ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। এতে চীন আরো কঠোর হয় এবং ২০০৫-এ স্পেশাল অধিবেশনে তড়িঘড়ি করে একটি নতুন এ্যাক্ট প্রকাশ করে। যা তাইওয়ান চীন থেকে আলাদা হতে চাইলে চীনের সামরিক প্রভাব বিস্তারে সহায়ক।

পরবর্তী সময় থেকে কমবেশি উত্তেজনা নিয়ে প্রতিনিয়ত উচ্চবাচ্য এবং সামরিক টহল চালাচ্ছে চীন। তাইওয়ানের দেয়া তথ্য অনুযায়ী ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে সর্বাধিক সংখ্যক একদিনে ৫৬ বার চীনা বিমান তাইওয়ানের ভূখণ্ডে প্রবেশ করে।

তাইওয়ানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী এতে বলেছেন, গত ৪০ বছরের মধ্যে চীনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক এখন সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় অবস্থান করছে।

বর্তমানে তাইওয়ানে অনেকগুলো দলের মধ্যে বড় দুইটি দল রয়েছে। যাদের মধ্যে ডেমোক্রেটিক প্রগ্রেসিভ পার্টি এখনো স্বাধীনতার পক্ষে, অন্যদিকে অপর দল কুওমিনটাং পার্টি চায় মূল চীনের সঙ্গে একত্র হয়ে সম্পূর্ণ চীন পুনরায় তাদের অধীনে নিয়ে আসতে।

এই এক রাষ্ট্র বা দ্বি-রাষ্ট্র বিতর্কের মধ্যেও ১৩টি দেশ এবং ভাটিকান ইতিমধ্যেই তাইওয়ানকে সার্বভৌম একটি দেশের স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে স্বয়ং তাইওয়ানের জনগণ বলছে ভিন্ন কথা। চলমান এই উত্তেজনায় একটি জরিপ বলছে যে তাইওয়ানের বহু মানুষ এ নিয়ে তেমন মাথা ঘামাচ্ছে না। তাইওয়ান পাবলিক ওপিনিয়ন ফাউন্ডেশন ২০২১ সালের অক্টোবরে একটি জরিপে মানুষের কাছে জানতে চেয়েছিল যে, ‘চীন তাইওয়ান দ্বন্দ্বে তারা আসলে কি মনে করে?- এই উত্তেজনার জেরে শেষ কি পর্যন্ত চীন ও তাইওয়ান দ্বন্দ্ব যুদ্ধে গড়াবে?’

এক্ষেত্রে তাদের দুই-তৃতীয়াংশের (৬৪.৩%) উত্তর ছিল যে তারা সেটা মনে করে না। অর্থাৎ এই দ্বন্দ্ব আসলে বাস্তবিক অর্থে তেমন উত্তেজনা বহন করেনা।

তাহলে কি চীন তাইওয়ান দ্বন্দ্ব নিছক কোনো ফাঁপা উত্তেজনা?- তা বোধহয় না। কারণ এই ঐতিহাসিক বাস্তবতা ছাড়াও রয়েছে দক্ষিণ চীন সাগরের আধিপত্য নিয়ে আরেক দৃষ্টিকোণ। সে আলোচনা নাহয় পরবর্তী সময়ে জন্য তোলা রইলো।

-মাহদী হাসান