তিব্বতি মানুষের শত শত বছরের ঐতিহ্যবাহী মাতৃভূমি ‘তিব্বত’ এখন একটি স্বাধীন অঞ্চল। গণপ্রজাতন্ত্রী চীনে যা ‘তিব্বত স্বশাসিত অঞ্চল’ নামে পরিচিত। তিব্বতিরা তাদের স্বতন্ত্র ভাষা, ধর্মীয় বিশ্বাস, ধর্মীয় কর্মকান্ড, প্রথা এবং ঐতিহ্য নিয়ে এখন একটি জাতিগোষ্ঠী।
তিব্বতের মোট জনসংখ্যা প্রায় ৭.৮ মিলিয়ন। এর মাঝে আনুমানিক ২.২ মিলিয়ন মানুষ তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল এবং তিব্বতিয় শাসনাধীন গানসু, সাংহাই ও সিচুয়ান প্রদেশের অধিবাসী।
প্রায় ১,৮৮,০০০ তিব্বতি ভারতে বসবাস করছে, নেপালে ১৬,০০০ জন এবং ভুটানে ৪,৮০০ জন। তিব্বতি বংশোদ্ভূত বালতি জনগোষ্ঠী পাকিস্তানের বালতিস্তানে বসবাস করে, যাদের সংখ্যা আনুমানিক ৩,০০,০০০। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ব্রাজিল ও মঙ্গোলিয়ায় বিশাল সংখ্যক তিব্বতি অভিবাসীর বসবাস, যাদের সংখ্যা প্রায় ২৫,০০০।
তিব্বতকে চীনের সাথে সংযুক্তি এবং পরবর্তীতে তিব্বতিদেরকে অত্যাচারের কারণে হাজার হাজার তিব্বতি ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, মঙ্গোলিয়া, উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমায়।
তিব্বতিরা তিব্বতি ভাষায় কথা বলে, যা সিনো-তিব্বতিয় ভাষা পরিবারের তিব্বত-বর্মন শাখার অন্তর্গত। তিব্বতিদের সিংহভাগ বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। সপ্তম শতাব্দীতে এখানে বৌদ্ধ ধর্মের আগমন ঘটে। দালাই লামাকে তিব্বতের বৌদ্ধদের আধ্যাত্মিক ও পার্থিব গুরু মনে করা হয়।
তিব্বত ও মুসলিম বিশ্বঃ
মুসলিম ভূগোলবিদ ও ঐতিহাসিকদের রচনায় তিব্বতের উল্লেখ পাওয়া যায়; ইয়াকুত আল-হামাওয়ি, ইবনে খালদুন, আল-বেরুনী, তাবারী, ইবনে রুস্তাহ্, ইয়াকুবী এবং রাশিদুদ্দীনের রচনা এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।
মুসলিম ভূগোলবিদ ও ঐতিহাসিকদের কাছে তিব্বত ‘তেহবাত’ বা ‘থেবাত’ নামে পরিচিত ছিল। উমার বিন আবদুল আযীযের খিলাফতকালে (৭১৭-৭২০ খ্রিঃ) খোরাসানের গভর্নরের কাছে চীন ও তিব্বতের একটি প্রতিনিধি দল আসে, যারা তিব্বতে একজন ইসলাম প্রচারক পাঠানোর অনুরোধ করে। গভর্নর তখন সালিত বিন আবদুল্লাহ্ আল-হানাফীকে সেখানে পাঠান। এ ঘটনার মাধ্যমে বুঝা যায় অষ্টম শতাব্দীর গোড়ার দিকে তিব্বতে একটি ছোট মুসলিম সম্প্রদায় ছিল।
৭১২ সালে মুহাম্মাদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয়ের পর তিব্বত ভারত, চীন ও মালয় উপদ্বীপের সাথে মুসলিম বিশ্বকে সংযুক্তকারী বিস্তৃত বাণিজ্যিক যোগাযোগ ক্ষেত্রে পরিণত হয়। আব্বাসীয় আমলে মুসলিম বিশ্বের সাথে তিব্বতের কূটনৈতিক, রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিলো। অষ্টম শতাব্দীতে খলিফা আল মাহদীর (৭৭৫-৭৮৫ খ্রিঃ) ক্ষমতারোহনকে তিব্বতের রাজা স্বীকৃতি দেন। এ শতাব্দীতে তিব্বত থেকে স্বর্ণ আমদানি শুরু হয়, যা মুসলিম শাসকগণ স্বর্ণমুদ্রা (দিনার) তৈরীর কাজে ব্যবহার করতেন।
দশম শতাব্দীতে অজানা এক ব্যক্তি কর্তৃক রচিত গ্রন্থ ‘হুদুদ আল-আলম’ থেকে জানা যায়, তিব্বতের কেন্দ্রীয় শহর লাসায় একটি মসজিদ ছিল, যদিও সেখানে বসবাসকারী মুসলমানের সংখ্যা ছিল খুবই কম। দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে (১২০৫ খ্রিঃ) মুহাম্মাদ বখতিয়ার খলজী তিব্বত আক্রমণ করে এ অঞ্চলের কিছু অংশ জয় করে নেন।
পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ দিকে ও ষোড়শ শতাব্দীর শুরুর দিকে বালতিস্তানসহ বাদাখশান ও কাশ্মীরের মাঝে অবস্থিত তিব্বতের কিছু অংশ মুসলিম বাহিনী দখল করে নেয়। সপ্তদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় অর্ধাংশে তিব্বত মোঙ্গল-তুর্কী বংশোদ্ভূত ক্বালমাক শাসকদের অধীনে ছিল।
তিব্বতে মুসলমানগণঃ
চীন ও তিব্বত শুধু ভৌগলিকভাবেই পাশাপাশি নয়; ইতিহাস, অর্থনীতি ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও তাদের যোগসূত্র রয়েছে। চীন ও আরবের মাঝে সম্পর্ক চীনে ইসলামের উত্থানের পূর্বাভাসও দেয়। পণ্যদ্রব্য কেনা-বেচার উদ্দেশ্যে চীনা ব্যবসায়ী ও বণিকরা নিয়মিত আরবের বাণিজ্য মেলা পরিদর্শনে যেতেন।
চীনা সূত্রমতে, ৬৫১ খ্রিস্টাব্দে একদল আরব প্রতিনিধি চীনের ক্যান্টন (গুয়ানঝু) শহর সফর করেন। মুসলিম ঐতিহাসিকদের মতে, এই প্রতিনিধি দলটি খলিফা উসমান (রাঃ) কর্তৃক প্রেরিত হয়েছিলো, যার নেতৃত্বে ছিলেন সাহাবী সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস। তিনি গুয়ানঝুতে একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। চীন ও তিব্বতের প্রথম দিকের মুসলমান সম্প্রদায়গুলো আরব, ইরানী, মধ্য এশীয় ও মঙ্গোলিয়ার মুসলিম ব্যবসায়ী ও সৈনিকদের বংশোদ্ভূত, যারা ৭ম ও ১০ম শতাব্দীর মাঝামাঝিতে চীনের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে বসতি স্থাপন করেছিলো। তাদের অনেকেই চাইনিজ ও তিব্বতি মহিলা বিয়ে করেন, যারা স্বামীর ধর্ম গ্রহণ করেছিলো।
চীনা সমাজে যথেষ্ট পরিমাণে জাতিগত, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং ভাষাগত বৈচিত্র্য রয়েছে। হান সম্প্রদায় দেশটির বৃহত্তম নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী নিয়ে গঠিত, যা চীনের ১.৩৫ বিলিয়ন জনসংখ্যার ৯১.৫৯ শতাংশ। চীন সরকার ৫৫ টি সংখ্যালঘু নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীকে স্বীকৃতি দিয়েছে, যাদের আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় বা জাতীয় সংখ্যালঘু (মিনজু) হিসেবে মনোনীত করা হয়। এই সংখ্যালঘু মানুষদের সংখ্যা প্রায় ১২০ মিলিয়ন, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮.৪৯ শতাংশ।
৫৫ টি জাতীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে ১০ টি ইসলাম ধর্ম অনুসরণ করে। এর মাঝে হুই, উইঘুর, কাযাখ, কিরগীজ, সালার, বাও’আন (বোনান), দংজিশিয়াং, উযবেক, তাজিক ও তাতার অন্তর্ভূক্ত। জনসংখ্যার দিক থেকে বৃহত্তর মুসলিম সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলো হলো হুই (১০.৫ মিলিয়ন), উইঘুর (১০ মিলিয়ন), কাযাখ (১.২ মিলিয়ন) এবং কিরগীজ (০.২ মিলিয়ন)। চীনের মুসলিম জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নিয়ে গড়ে ওঠা হুই সম্প্রদায় দেশটির উত্তর ও পশ্চিম প্রদেশগুলোতে বসবাস করছে, যারা ঐতিহ্যগতভাবে কৃষক, দোকানদার ও কারিগর। এরা আরব, মধ্য এশীয় ও পার্সিক বণিকদের বংশধর, যারা ৭ম শতাব্দী থেকে চীনে আসা এবং বসতি স্থাপন করা শুরু করেছিলো। তাদের অনেকেই স্থানীয় চীনা মহিলা বিয়ে করেছিলো, যার ফলে ক্রমান্বয়ে তারা চীনা সমাজের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। হুই মুসলিমরা সাধারণত মান্দারিন ভাষায় অথবা অন্যান্য অ-তুর্কী (non-Turkic) উপভাষায় কথা বলে। এ সম্প্রদায়ের ‘সিনিফাইড’ নাম মূলধারার চীনা সমাজে তাদের অন্তর্ভুক্তির ইঙ্গিত দেয়। নামকরণের এ ধারা অনুসারে ‘মুহাম্মাদ’কে ‘মা’ বা ‘মু’, ‘হুসাইন’ কে ‘হু’, ‘সাঈদ’কে ‘সাই’, ‘শামস’কে ‘ঝেং’ এবং ‘উসমান’কে ‘কারি’ (Cari) তে রূপান্তরিত করা হয়েছে।
তিব্বতি মুসলিমরা মিশ্র বংশোদ্ভূত। তারা কাশ্মীর, লাদাখ ও মধ্য এশিয়া থেকে আগত মুসলিম পুরুষদের বংশধর, যারা দ্বাদশ শতাব্দীর দিকে তিব্বতে আসে এবং তিব্বতি মহিলাদের বিয়ে করে। সপ্তদশ শতাব্দীতে চীনের মূল ভূখণ্ডের নিংজিয়া থেকে কিছু হুই মুসলিম তিব্বতে পাড়ি জমায় এবং এ অঞ্চলের উত্তর-পূর্ব অংশের সিলিং (জিনিং) এ বসবাস শুরু করে। তাদের অনেকে তিব্বতি মহিলা বিয়ে করে। লাসায় একটি হুই মুসলিম সমাজ রয়েছে, যেখানে তাদের নিজস্ব মসজিদ ও কবরস্থান রয়েছে।
ঐতিহাসিকভাবে তিব্বতের সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধরা, বিশেষত ধর্মীয় নেতৃস্থানীয়রা তিব্বতিয় মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয় ও অনুভূতির প্রতি খুবই সহনশীল ছিল।
পঞ্চম দালাই লামার রাজত্বকালে (১৬১৭-৮২) তিব্বতিয় মুসলমানদের ধর্মীয়, আইনী, শিক্ষাগত, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার সুষ্ঠুভাবেই প্রদান করা হয়েছিলো। সরকারের কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ ও চাপ ছাড়াই সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে তারা ধর্ম অনুশীলন, মসজিদ নির্মাণ ও ইসলামিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলো।
লাসার কেন্দ্রীয় মসজিদ
পঞ্চম দালাই লামা একটি মসজিদ নির্মাণ ও কবরস্থান করার জন্য লাসার কিছু জায়গা মুসলিমদের দিয়েছিলেন। তিব্বতিয় মুসলমানরা তাদের ধর্মীয়, আইনী, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট পরামর্শসভা নির্বাচন করার স্বাধীনতা পেয়েছিলো। ইসলামিক আইন অনুসারে অভ্যন্তরীণ বিরোধ নিষ্পত্তির অনুমতি দেওয়া হয়েছিলো তাদের। তারা কর প্রদান থেকেও অব্যাহতি পেয়েছিলো।
পূর্ববর্তী সময়ে বৌদ্ধদের পবিত্র সাকাদওয়া মাসে তিব্বতে মাংস ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ ছিল। তিব্বতি মুসলমানদের এ নিষেধাজ্ঞা থেকেও অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিলো। সকল ধরণের সরকারি কার্যক্রমে মুসলিম নেতাদের যোগদানের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিলো।
১৬৮৪ সালে স্বাক্ষরিত তিব্বত-লাদাখ শান্তিচুক্তির অংশ হিসেবে তিব্বত সরকার লাদাখের মুসলিম বাণিজ্য প্রতিনিধিদের প্রতি তিন বছরে একবার তিব্বত আসার অনুমতি দেয়। প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে আসা লাদাখ ও কাশ্মীরের অনেক মুসলিম ব্যবসায়ী এই অঞ্চলে থেকে যায়। সপ্তদশ শতাব্দীর পর থেকে কাশ্মীর উপত্যকা থেকে মুসলিম বণিকেরা নেপালে পাড়ি জমায় এবং বসতি স্থাপন করে।
নেপালের শাসক পৃথ্বী নারায়ণ শাহ্ কাঠমান্ডু উপত্যকা জয় করার পর কাশ্মীরি মুসলমানদের বহিষ্কারাদেশ দিলে তাদের বেশিরভাগই তিব্বতে চলে আসে। ১৮৪১ সালে কাশ্মীরের ডোগরা সেনাবাহিনী তিব্বত আক্রমণ করেছিলো, কিন্তু দালাই লামার বাহিনী তাদের প্রতিহত করে। তিব্বতি বাহিনী ডোগরা বাহিনীর বহু কাশ্মীরি, লাদাখি মুসলিম সেনা ও হিন্দু সেনাদের যুদ্ধবন্দি হিসেবে আটক করে। পরবর্তীতে মুক্তি পেয়ে তাদের বেশিরভাগই তিব্বতে থেকে যায়। কিছু হিন্দু ডোগরা সৈন্য ইসলাম গ্রহণ করেছিলো এবং তিব্বতে ফিরে গিয়েছিলো। কাশ্মীরি ও লাদাখি যুদ্ধবন্দিরা তিব্বতে আপেল ও খুবানি (Apricot) চাষের প্রচলন করেছিলো।
১৯৫১ সালের চামদো যুদ্ধে চীন ‘তিব্বত’ জয় করে নেয়। ১৯৫৯ সালে তিব্বতের পূর্ববর্তী সরকার বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং তিব্বত পুরোপুরি গন-প্রজাতন্ত্রী চীনের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। তিব্বত বিজয়ের সাথে সাথে তিব্বতের মানুষের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অধিকার এবং ঐতিহ্যকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করা হয়। তিব্বতের মুসলিমরাসহ হাজার হাজার তিব্বতি ভারতে চলে যায় এবং হিমাচল প্রদেশ, কাশ্মীর, লাদাখ, কালিম্পং, দার্জিলিং ও গ্যাংটক এ আশ্রয় নেয়। প্রায় ২০০০ তিব্বতি মুসলিম জম্মু-কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগরে বসবাস করছে।
বর্তমানে প্রায় ৪,০০০ তিব্বতি মুসলমান তিব্বতে বসবাস করছে, যাদের প্রায় অর্ধেকেরই বসবাস লাসায়। চীনের তিব্বত বিজয়ের পর কয়েক শতাব্দী ধরে চলমান তিব্বতের মুসলমানদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা, স্বায়ত্তশাসন মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ণ হয়। সরকার কর্তৃক সুপরিকল্পিতভাবে চীনা ও হুই মুসলিমদের স্থানান্তরিত করা হয়, যার ফলে এ অঞ্চলের জনসংখ্যা-কাঠামো যথেষ্ট পরিবর্তিত হয়। তিব্বতি মুসলমানরা সহ অন্যান্য তিব্বতিদের ধাপে ধাপে ধাক্কা খাওয়ানো হয়েছে।
দালাই লামা তিব্বতের বৌদ্ধদের অবিসংবাদিত ধর্মীয় নেতা। তিব্বতের মুসলমানেরা তাকে ধর্মীয় নেতা হিসেবে বিবেচনা না করলেও খুব সম্মান করে। তিনিও তাদের প্রতি খুব স্নেহশীল আচরণ করেন। হুই মুসলিম ছাড়া সরকারিভাবে স্বীকৃত অন্যান্য তিব্বতি মুসলমানদের কেবল তিব্বতি হিসেবেই অভিহিত করা হয়।
বালতিস্তানঃ
‘লিটল তিব্বত’ নামে পরিচিত তিব্বতের বালতিস্তান কারাকোরাম অঞ্চলের একটি পাহাড়ি জায়গা, যা ভারত-পাকিস্তান সীমান্তের মাঝামাঝিতে অবস্থিত। এর পশ্চিমে গিলগিট, উত্তরে জিনজিয়াং, দক্ষিণে লাদাখ ও দক্ষিণ-পশ্চিমে কাশ্মীর উপত্যকা অবস্থিত। মধ্যযুগের মুসলিম ভূগোলবিদ ও ঐতিহাসিকরা বালতিস্তানকে ‘লিটল তিব্বত’ ও লাদাখকে ‘গ্রেট তিব্বত’ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। পঞ্চদশ শতাব্দীতে বিশিষ্ট পার্সিয়ান সুফি সাধক সাইয়্যেদ আলী হামদানী ও তার কিছু অনুসারির মাধ্যমে বালতিস্তানে ইসলামের আগমন ঘটে। ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বালতিস্তান মুসলিম রাজাদের দ্বারা শাসিত হয়েছিলো। কাশ্মীরের রাজা গোলাব সিং ১৮৪০ সালে বালতিস্তান জয় করেন এবং ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত এটি জম্মু ও কাশ্মীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশ হিসেবে বিবেচিত হতো। দেশ বিভাগের প্রাক্কালে জম্মু-কাশ্মীরের শাসকরা ভারত চলে আসার পর গিলগিট স্কাউট ও পাকিস্তানের অনিয়মিত সেনারা বালতিস্তান আক্রমণ করে। তখন থেকে এটি পাকিস্তানের একটি অংশ এবং বর্তমানে এটি গিলগিট বালতিস্তান স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হিসেবে পরিচিত।
বালতিস্তানে বসবাসকারী মানুষদের বেশিরভাগই বালতি সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত, যারা তিব্বতি বংশোদ্ভূত। তারা ইসলাম অনুসরণ করে, কিন্তু সেখানে এখনো শতাব্দী প্রাচীন তিব্বতি রীতি-নীতি, ঐতিহ্য ও তিব্বতি ভাষা চলমান রয়েছে।
তিব্বতি মুসলমানেরাঃ একটি মিশ্র উত্তরাধিকারঃ
বিশিষ্ট বৃটিশ সমাজবিজ্ঞানী, দার্শনিক এবং মুসলিম সমাজের একজন তীক্ষ্ম পর্যবেক্ষক আর্নেস্ট জেলনার মন্তব্য করেন যে, বিশ্বজুড়ে মুসলিম সমাজগুলোর একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হল ইসলামের মহান ঐতিহ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ধারাবাহিকতা ও সমন্বয় রক্ষা; যা ইসলামী বিশ্বাস ও রীতিনীতি, পাঁচটি স্তম্ভ, বিস্তৃত আইনী ও নৈতিক রীতিনীতি এবং ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, আঞ্চলিক সংস্কৃতি ও অনুশীলনের প্রতিনিধিত্বকারী ক্ষুদ্র ঐতিহ্য দ্বারা অনুকরণীয়। তিব্বতের মুসলমানদের সংস্কৃতিতে তিব্বত, কাশ্মীর, লাদাখ ও মধ্য এশিয়া থেকে প্রাপ্ত বৈশিষ্ট্য, ঐতিহ্য ও অন্য অনেক কিছুর সমন্বয় প্রতিফলিত। এই সমন্বয় তিব্বতি ভাষার ব্যবহার; মসজিদের স্থাপত্য শৈলী; তাদের রীতিনীতি, পোশাক ও খাদ্যাভ্যাসে স্বতন্ত্রভাবে প্রতিফলিত হয়।
বিশ্বের অন্যান্য মুসলমানদের মতো তিব্বতিয়দের জন্যও তাদের পরিচয়ের প্রাথমিক ও মূল উৎস হলো ইসলাম। তাদের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবন ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের আলোকে পরিচালিত। তিব্বতে চারটি প্রধান মসজিদ রয়েছে; একটি লাসায়, দুটি শিগাতসেতে এবং অন্যটি সেতাং-এ (Tsetang)। এই অঞ্চলে দুটি প্রধান মাদরাসা রয়েছে, যার একটি লাসায় ও অন্যটি শিগাতসেতে। তিব্বতের মুসলিম মহিলারা সাধারণত মাথায় স্কার্ফ পরেন।
জাতিগত ও সাংস্কৃতিক পরিচয় প্রায়শই বহুমুখী, সংকর প্রজাতির, পরিপূরক ও তরল ধরণের হয়। পরিচয়ের সংকরায়নের প্রক্রিয়া দীর্ঘ সময়ব্যাপী ঘটে থাকে। নিজস্ব সংজ্ঞা ও পছন্দ; অন্যদের উপলব্ধি, রায় ও আরোপনের দ্বারা পরিচয় গঠনের প্রক্রিয়া প্রভাবিত হয়। যার ফলে ব্যক্তি পরিচয় ও সামাজিকভাবে স্বীকৃত পরিচয়ের মাঝে একটি পার্থক্য গড়ে উঠতে পারে। পরিচয় গঠনের এই দুটি মাত্রা ভিন্ন হলেও এগুলো প্রায়ই পরস্পর সম্পর্কযুক্ত থাকে। তিব্বতে মুসলমানরা সাধারণত ‘কাচী’ নামে পরিচিত, যা ‘কাশ্মীরি’ এর অবিশুদ্ধ রূপ। এটি তিব্বতি মুসলমানদের কাশ্মীরি উৎসকে নির্দেশ করে। পূর্ববর্তী সময়ে কাশ্মীর উপত্যকা ‘কাচী ইউল’ নামে পরিচিত ছিল।
বর্তমানে কাশ্মীর উপত্যকায় বসবাসরত তিব্বতি মুসলমানদের কাশ্মীরি মুসলমানরা ‘তিব্বতি’ হিসেবে অভিহিত করে। তিব্বতের পাশাপাশি ভারত, নেপাল, ভুটান, আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া এবং ব্রাজিলে বসবাসকারী তিব্বতের মুসলমানরাও সেখানে তাদের মিশ্র পরিচয় লালন করছে, যা ইসলামি বিশ্বাস ও তিব্বতি ঐতিহ্যের সমন্বয়ে গঠিত।
লেখকঃ Professor A. R. MOMIN
অনুবাদঃ কাজী সালমা বিনতে সলিম