মুসলিম পোর্ট

থাইল্যান্ডে সংখ্যাগরিষ্ঠ থাই বৌদ্ধ ৯৪% আর সংখ্যালঘু মালয়- মুসলিম সম্প্রদাইয়ের সংখ্যা ৫%, যেখানে খ্রিস্টানসহ অন্য ধর্মাবলম্বীর অনুপাত ১%। অনেকটা বর্তমান চীনে খ্রিস্টান বা তাওবাদী ধর্মীয় চেতনার মানুষদের মতো। বৌদ্ধরা থাই ভাষায় এবং মুসলিমরা মালের ভাষায় কথা বলে। অর্থাৎ থাই  বৌদ্ধ পরিচয়কে তুলে ধরে তেমনি মালয়-মুসলিম সম্প্রদায়কে । মালয় মুসলিমরা একেবারে স্বতন্ত্র নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, ভাষা ও ধর্মীয় তহযীব-তমুদ্দিনের বাহক।

থাইল্যান্ডে ইসলাম প্রবেশ:

-১৩ ও ১৪ শতাব্দীতে আরব বণিকরা সর্বপ্রথম থাইল্যান্ডের দক্ষিণে ইসলামের দাওয়াত ছড়িয়ে দেন।

-১৫ শতাব্দীতে শিয়া পারসিক ও অযোধ্যাবন্দরে অবতরণ করা সুন্নি ইন্ডিয়াদের মাধ্যমে মধ্য থাইল্যান্ডে ইসলাম ধর্মের প্রসার ঘটে। যাদের অগ্রদূত সুলতান ইসমাইল শাহ। চম্পা রাজ্যের পতনের পর ১৪৯১ খ্রিস্টাব্দে অনেক মুসলমান অযোধ্যায় নোঙর করে।

-১৮৭০ থেকে ১৮৯০ এর দশকে ভারতীয় বাঙালি বা চাইনিজ মুসলিমদের মাধ্যমে উত্তর থাইল্যান্ডে ইসলাম পৌঁছে।

অন্যদিকে, দক্ষিণ থাইল্যান্ডের মুসলিমদেরকে দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়-

১. স্থানীয়

২. অভিবাসী মুসলিম

থাইল্যান্ডের বৌদ্ধরা থাই ভাষা এবং মুসলিমরা মালয় ভাষায় কথা বললেও অনেক মালয় মুসলিম থাই ভাষায়ও ব্যবহার করেন।

আধুনা পাত্তানির ইতিহাস

 ১৫ শতাব্দীতে পাত্তানি মুসলিমরা “দারুস সালাম কিংডম” প্রতিষ্ঠা করে । ১৭৮৫ সালে সিয়াম কতৃক “Vessel State of Siam” অধিকরণের মাধ্যমে এই অঞ্চলকে সাতটি ভাগে ভাগ করা হয়।

১৯০১ সালে থাই শাসক রাজা কুলাংকর্ন প্রদেশগুলোর সাথে শান্তি চুক্তি ভেঙ্গে সামরিক অভিযান চালু করে যা ১৯০৯ সালে অ্যাংলো সিয়াম চুক্তির মাধ্যমে শেষ হয়। স্বাধীন পাত্তানি মুসলিম সালতানাত প্রথমবারের মতো থাইল্যান্ডের অন্তর্ভুক্ত হয় তখন।

২০০১ থেকে ২০০৯ সাল নিয়মিত সামরিক অভিযান এবং ২০০৪ সালের সামরিক আইন জারি এবং ডিসেম্বর ১৪ তারিখ, ৪ জন মালয় মুসলিমকে মক্তব থেকে আটক করলে পাত্তানি অঞ্চলের মুসলিমদের ধর্মীয় , রাজনৈতিক,  অর্থনৈতিক ও সার্বভৌম স্বাধীনতার প্রশ্ন আবারও বৃহৎ পরিসরে উত্থাপিত হয়।

দক্ষিণ থাইল্যান্ডের তিনটি প্রদেশ , যাদেরকে “Deep South” বলা হয়

১. নারাথিওয়াত

২.ইয়ালা

৩.পাত্তানি

৫ বা ৭ মিলিয়নের এই জনসংখ্যা থাইল্যান্ডের মোট মুসলিমের ৮০ শতাংশ।

তুরস্কের IHH ফাউন্ডেশন পাত্তানিতে নির্যাতিত জনগোষ্ঠীকে সহায়তা করে যাচ্ছে। পাশাপাশি, তারা শিক্ষামূলক প্রকল্পগুলিও অন্তর্ভুক্ত করে। তাদের প্রকল্প শুধু এতিমকে খাওয়ায় না, তাদেরকে বস্ত্র , এবং ঘুমানো জায়গা নিশ্চিত করে। এটি মুসলিম প্রজন্মেকে লালন-পালনের সুযোগ করে দেয়। সম্প্রতি তারা সেখানকার দারুসসিফা এতিমখানা, নারাথিওয়াত, মিসাসতানিশ এতিমখানা, পাওল, পাত্তানি দারুল ইনফাক সালেহিয়্যাহ দিনিয়্যাহ স্কুল ও এতিমখানা পরিদর্শনোত্তর Yusuf Kaplan,দৈনিক পত্রিকা “Yeni Safak”এ The journey of life and truth in Pattani শিরোনামে বলেছেন,

“আপনি পাত্তানির রাস্তায় সবচেয়ে বেশি যে দুটি জিনিসের সম্মুখীন হবেন তা হল  মহিলা মোটরবাইকার এবং সশস্ত্র সৈন্য এবং তাদের কনভয়। তার মতে, রাস্তায় ট্যাঙ্ক ও মোটরবাইকের আধিপত্য দেখায়, সেনাবাহিনী দেশে আধিপত্য বিস্তার করে এবং নারীরা ঘরে থাকে।”

দক্ষিণ এশিয়ার ফিলিস্তিন : পাত্তানি

বৈশ্বিক উপনিবেশবাদের দিক থেকে ব্রিটিশ রথ চাইল্ড অবৈধ ইসরাইলকে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে  তুলে দিয়েছিল ৪০ এর দশকে, তারও আগে বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে। তেমনি , উপনিবেশবাদী ব্রিটিশরা ১৯০২ সালে ইংল্যান্ড এবং থাইল্যান্ডের মধ্যে চুক্তির মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে পাত্তানির জমিগুলি বৌদ্ধ শাসনের কাছে হস্তান্তর করে।

মুসলিম স্বাধীনতাকামী সংগঠন Pattani United Liberation Organisation (PULO) বা‌ Burisan Revolusi Nasional(BRN) দক্ষিণ থাইল্যান্ডে  তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে।

মূলত ,১৯০৯ সাল থেকে শুরু হওয়া স্বাধীন ভূখণ্ড পাত্তানি মুসলিম সালতানাতকে জোরপূর্বক থাইল্যান্ডের অন্তর্ভুক্ত করার পর থেকেই তাদের উপর শুরু হয় থাই সংখ্যাগুরূদের অমানবিক অত্যাচার, নির্যাতন আর মানবিক অধিকার হরণ।

বিভিন্ন সময় উঠে আসা ডকুমেন্টস থেকে সংগ্রহোত্তর নিম্নোক্ত তথ্যগুলো উপস্থাপন করা হলো-

ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত পাত্তানি মুসলিমরা

মালয় মুসলিমদের স্বতন্ত্র ধর্ম, জাতীয়তা, ভাষাকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি আজ অবধি

গৃহাস্থলির কাজ থেকে শুরু করে নাগরিক মৌলিক অধিকার আদায়ের যেকোনো প্রয়োজনে তারা সামরিক বাহিনীর মুখোমুখি হয়

১৯৪৮ সালে দুসুন-ইর ঘটনা( যেখানে নারাথিওয়াতের ১০০ জন মুসলিমকে হত্যা করে থাই সরকার)

১৯৫৪ সালে মালয় ইসলামিক স্কলার হাজী সুলকে গ্রেপ্তার এবং পুলিশি নিরাপত্তা হেফাজত থেকে তাকে গায়েব করে ফেলা হয়

২০০৪ সালের সামরিক সামরিক আইনে জারির পর থেকে দক্ষিণ থাইল্যান্ডের মুসলিম প্রদেশগুলোতে সৈন্যদের সর্বত্র উপস্থিতি( প্রতিটি দোকানের সামনে, রাস্তায়, রাস্তার ধারে, এমনকি খালি জমিতেও, রাস্তায় রয়েছে অতিরিক্ত চেকপয়েন্ট) এবং থাই সরকারের নির্বিচারে  মুসলিমদের হত্যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ২০০৪ সালে প্রায় ৭ হাজার ৪০ জন পাত্তানিকে তারা গ্রেফতার করে এবং ৭ হাজার  ৩ শত জনের অধিক মুসলিম নিহত হয়(VOA)।আহত হয় ১৪ হাজারেরও অধিক মালয় মুসলিম (DW)। আর সর্বমোট এ পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজারের অধিক।(YeniSafak)

এই অঞ্চলে মুফতি থেকে গভর্নর পর্যন্ত নিয়োগ করে কেন্দ্রীয় সরকার

বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনের নামে সরকার মালয় মুসলিমদের সকল ধরনের অধিকার হরণ করে তাদেরকে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক দিক দিয়ে কোণঠাসা করে রেখেছে

২ শতাব্দী ব্যাপ্ত পাত্তানি মুসলমান সালতানাতের ইতিহাসকে সরকারী ইতিহাসে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি

পাত্তানিতে কিভাবে ইসলাম চর্চা হয়?

সমস্ত শিক্ষা বৌদ্ধ থাই সরকারের নিয়ন্ত্রণে। এই কারণে, প্রতিটি অঞ্চলে মুসলিমরা নিজস্ব সংস্থান দিয়ে নিজস্ব প্রশিক্ষণ দেওয়ার চেষ্টা করে। পন্ডোকে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসা মাদ্রাসা শিক্ষা আজও অব্যাহত রয়েছে। এগুলি বনের মধ্যে ছোট কাঠের কুঁড়েঘর, এটিকে তারা ইসলামকে বাঁচিয়ে রাখার অন্যতম উপায় হিসাবে গড়ে তুলেছে এবং সংরক্ষণ করেছে। ধর্মতাত্ত্বিক পর্যায়েও নতুন ও বড় মাদ্রাসা রয়েছে। তারা তাদের ধর্মীয় মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যকে তাদের জীবনের মূল্য দিয়ে রক্ষা করে।

উদাহরণ হিসেবে, থাই সৈন্যরা কোরআনের একটি পান্ডুলিপি উদ্ধারের জন্য একই গ্রামে পাঁচবার অভিযান চালিয়েছিল। যদিও গ্রামবাসীদের আত্মরক্ষা করার মতো কিছুই ছিল না, তবুও তারা তাদের জীবনের মূল্য দিয়ে প্রতিরোধ করেছিল এবং কুরআন সমর্পণ করেনি।

উল্লেখ্য,একটি বিশদ হাতে লেখা কুরআন রয়েছে যেটি এই অঞ্চলে শতাব্দী ধরে বহমান ইসলামের অস্তিত্বের প্রতীক।  এটি আহমদিয়া মাদ্রাসা নামে একটি ছোট স্কুলের একটি কক্ষে রাখা হয়। বর্তমান সময়ে, তুর্কি সরকার এই কাজগুলো সংস্কার করে আবার সেগুলো বিতরণ করেছে।

বিশ্লেষকদের মতে, এই মুহুর্তে জাতিসংঘ সহ বিশ্বের বিভিন্ন চুক্তি প্রটোকল সমূহ বাস্তবায়নে এবং তাদের কার্যকরতা প্রমাণ করতে পাত্তানিদের অধিকারের পাশে তাই বিশ্ব বিবেককে দাঁড়াতে সব সবার আগে।

– আব্দুল্লাহ আল যুবায়ের