আফ্রিকা মহাদেশের প্রান্তসীমায় অবস্থিত দক্ষিণ আফ্রিকার সর্বদক্ষিণ উপকূলে অবস্থিত শহর কেপটাউন, শহরটির চারপাশ ঘিড়ে থাকা সুউচ্চ পাহাড়শ্রেনী এবং দুই প্রান্তে দুটি মহাসাগরের উপস্থিতি একে দিয়েছে বহুমাত্রিক নিরাপত্তা। ১৭শ’ শতকে এখানে ডাচদের আগমনকাল থেকে এই অঞ্চলের ইতিহাসে প্রথম মুসলিম আগমনের নিদর্শন পাওয়া যায়। এখানে বিদ্যমান প্রথম দিকে আগমনকারী মুসলিমদের কবরই যার সাক্ষী..
ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তত্ত্ববধানে এখানে মুসলমানদের আগমন শুরু হয়। কারণ নেদারল্যান্ড এবং ভারতের মাঝে বাণিজ্যিক জাহাজগুলোর জন্য একটি টার্মিনাল হিসেবে ব্যবহৃত হতো কেপটাউন। সাংবাদিক ও ঐতিহাসিক শফিক মর্টনের মতে- ডাচ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের উস্কানি দেয়ার অভিযোগে তাদের কারাদন্ড দেয়া হতো। বাতাভিয়ার (বর্তমান ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপের অংশ) সুপ্রিমকোর্ট তাদের এই কারাবাস ও নির্বাসনের সাজা দিয়েছিল।
কেপটাউনে ভ্রমনে আসা কোন দর্শনার্থীই ‘বুখাব’ এর সৌন্দর্য্য থেকে নিজের চোখ সরাতে পারবেনা। কেপটাউন শহরের সুবিখ্যাত ‘টেবিল’ পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত এই এলাকাটি মুসলিম কোয়ার্টার হিসেবে পরিচিত সেই অষ্টাদশ শতকের শুরু থেকেই।
এখানকার প্রথম দিকের অধিকাংশ মুসলিমগণ ক্রীতদাস হিসেবে এসেছেন ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়া থেকে। এছাড়া এশিয়ার অন্যান্য অংশ থেকেও এসেছিলেন। আগতদের মধ্যে নির্বাসিত ও বিভিন্ন অপরাধে দোষী সাব্যস্ত রাজনীতিবিদ, পাশাপাশি দক্ষ কারিগর, ধর্মীয় নেতা এবং আলেমরাও ছিলেন- যারা দক্ষিণ আফ্রিকার নতুন প্রজন্মের কাছে তাদের জ্ঞান ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।
আল জাজিরা নেট’কে দেয়া সাক্ষাতকারে মর্টেন বলেন-
“দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসে প্রথম লিপিবদ্ধ মুসলিম হলেন রাজনৈতিক বন্দী হিসেবে আগত ইব্রাহিম বাতাভিয়া। তার পরে আরো অনেক মুসলমানগণের আগমন ঘটতে থাকে, যাদের বেশিরভাগই ছিলেন রাজনৈতিক বন্দী এবং বন্দীদের তাদের নিজস্ব ধর্মের প্রচার বা অন্যকে দাওয়াত দানে নিষেধাজ্ঞা প্রদান করা হয়েছিল। দাস হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকায় আগত মুসলমানরা কেবল ইন্দোনেশিয়া নয়, ভারত ছাড়াও পশ্চিম-উত্তর আফ্রিকা, মাদাগাস্কার এবং শ্রীলঙ্কা থেকেও এসেছিলেন। তিনি আরও বলেন, ব্রিটিশদের কলোনিয়াল এম্পায়ারের শেষের দিকে, মোট জনসংখ্যার ৫০% এর বেশি আফ্রিকান মুসলিম ছিল!”
মর্টন বলেন-মর্টন বলেন-“কেপটাউনের গৌরব ও সৌভাগ্যের প্রমাণ স্বরুপ- এখানকার মুসলিম – অমুসলিম নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের উপর আলিমদের অসামান্য নৈতিক প্রভাবের উপস্থিতিই যথেষ্ট। তাদের কবরগুলী এখনও বিদ্যমান রয়েছে এবং সেগুলোকে ইতিহাসের অংশ হিসেবে; মহানায়কদের জীবন ঘনিষ্ট স্মৃতিস্মারক হিসেবে হেফাজত করা হচ্ছে”।
ইব্রাহিম রসুল, কেপটাউনের সাবেক গভর্নর এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক রাষ্ট্রদূত বলেছেন- “ইন্দোনেশিয়া থেকে কেপটাউনে নির্বাসিত হওয়া মুসলমানদের ঢল নামার শুরুর সময়টাতে শেখ সায়েদ মাহমুদ এবং তার পরিবার এবং তার সঙ্গীরাও চলে আসেন। শায়খ মাহমুদ ইন্দোনেশিয়ার একটি গণিতজ্ঞ পরিবারের সন্তান ছিলেন। তিনি একটি সুফি তরিকতের শায়খ ছিলেন বলে তাকে বন্দী করা হয়নি। তিনি ইন্দোনেশিয়া ডাচ শাসনের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছিলেন বিধায় ডাচরা তাকে তার জন্মভূমি থেকে তাড়িয়ে দেয়াকেই উপযুক্ত মনে করেছিল। তাকে শহর থেকে নির্বাসিত করা হলো। যদিও তখনও তিনি নজরবন্দী ছিলেন!
এখান থেকেই দক্ষিণ আফ্রিকায় একটি ইসলামী সমাজের প্রথম উত্থান শুরু হয়েছিল।”
জনাব ইব্রাহীম রাসূল আরো উল্লেখ করেন- “ইংরেজদের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবদান রেখেছিলেন ইমাম আবদুল্লাহ বিন কাদির বিন আবদ-সালাম আল-সুফি। তাকে একই রববেন দ্বীপে বন্দী করা হয়েছিল, যেখানে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি নেলসন ম্যান্ডেলা নির্বাসিত হয়েছিলেন। সেখানে ইমাম ইবনে কাদির নিজ হাতে কুর’আনও লিখেছিলেন।
ইব্রাহীম রাসূল ওয়াশিংটনে দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রদূত হিসাবে কাজ করেছিলেন এবং জাতীয় সংসদের সংসদ সদস্য ছিলেন এবং স্বাস্থ্য ও মানবাধিকারের জন্য ম্যান্ডেলা পুরস্কার পেয়েছিলেন”।
পরবর্তী সময়ে ইব্রাহিম রাসূল নিজেই দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইকারীদের মধ্যে অন্যতম হয়ে উঠলেন এবং “বর্ণবাদ” বিরোধী লড়াইয়ে অংশ নিলেন, যার ফলে ১৯৯৩ সালে বর্ণবাদী শাসনের পতনের আগে তাকে বহুবার কারাবন্দি ও গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছিল, বিপ্লবোত্তর সময়ে তিনি ম্যান্ডেলার বিশেষ উপদেষ্টা হয়েছিলেন।
এটি লক্ষণীয় যে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম সত্যিকারের গণতান্ত্রিক নির্বাচন, যাতে ম্যান্ডেলা জয়লাভ করেন- যার প্রভাব মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর ইতিবাচকভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল। কারণ মুসলমানরা তাদের রাজনৈতিক এবং সামাজিক অধিকার আদায় করে নিতে শুরু করেছিল। ফলাফল স্বরূপ তাদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি সমাজের কাঠামোতে আরও বিস্তৃত হতে লাগল। বিগত শতাব্দীর ষাটের দশক, সত্তর দশক এবং আশির দশকের সংগ্রাম এবং সম্প্রতি বর্ণবাদী শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাদের অংশগ্রহণ এবং ত্যাগের কথা বিশেষভাবে প্রশংসার দাবীদার।
১৯৯৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার গণতান্ত্রিক উত্তরণের পরে প্রথম সরকার গঠনের ক্ষেত্রে একটি ইসলামী শক্তির সংমিশ্রণ বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়, যেখানে ইব্রাহীম রাসূল বলেন- “ঐ সরকারের মন্ত্রণালয়ে ৪০ জনেরও বেশি মুসলিম মন্ত্রী অন্তর্ভুক্ত ছিলেন এবং প্রায় ১০ জন মুসলিম রাষ্ট্রদূত হিসেবে বিদেশে তাদের দেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন।”
কেপটাউনের এই সাবেক গভর্নর আরো বলেন যে, কেপটাউনের এই সাবেক গভর্নর আরো বলেন যে, পার্লামেন্টে ইসলামী আইন থেকে বেশ কিছু মুসলিম পার্সোনাল ‘ল ও ইতিমধ্যে পাস করা হয়েছে।
ইতিহাসবিদদের মতে, প্রথম দিকের মুসলমানরা ইসলাম প্রবর্তনের শুরু ও এর বিস্তৃতিকালীন সময়ে দক্ষিন আফ্রিকার মুসলিম ও অমুসলিম সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান রাখেন। একদম শুরু থেকে নিয়ে বর্ণবাদী শাসনের অবসান অবধি এই সংগ্রাম জারী ছিল।
দেশের জনগণের সামনে লড়াইয়ের ময়দানে অন্যতম প্রধান প্রতীক হিসেবে ছিলেন ইমাম আবদুল্লাহ হারুন, যিনি ১৯২৪ সালে কেপটাউনের দক্ষিণাঞ্চলের আশেপাশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। পরবর্তীতে ইসলাম নিয়ে পড়াশুনার জন্য মক্কায় পাড়ি জমান। ইমাম হারুন ফাউন্ডেশনের পরিচালক কাসিম খান এর মতে, ইমাম আব্দুল্লাহ হারুনের এই সংগ্রাম বর্ণবাদবিরোধী সরকারের বিরুদ্ধে ইসলামী সংগ্রামের অন্যতম প্রতীক হিসাবে বিবেচিত।
আল জাজিরাকে দেওয়া তাঁর সাক্ষাৎকারে জনাব কাসিম খান বলেন- “দেশে সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও বর্ণবাদবিরোধী লড়াইয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার মুসলমানদের অংশগ্রহণ বৃহদাকার ধারন করেছে। তবে এর প্রভাব এত বেশি ছিল যে এখন মুসলমানদের বিরুদ্ধে সহিংসতা এবং তাদের বিরুদ্ধে বৈষম্য খুজে পাওয়া যাবে না। বর্তমান সময়ে কাজের মুসলমানদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ দেশবাসীর কাছে একটি মহৎ চিত্র উপস্থাপন করেছে বলে পরিলক্ষিত হচ্ছে”।
আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সকল ইস্যুতে মুসলমানদের সক্রিয় অংশগ্রহণ রয়েছে। পাশাপাশি ’আর্থ সামিট’ এ মুসলিম সম্প্রদায়ের স্পষ্ট ভূমিকা এবং এতে ইস্রায়েলের অংশগ্রহণকে মোকাবেলা করার জন্য তাদের মিথস্ক্রিয়াসহ প্রভাবশালী রাজনৈতিক উপস্থিতি লক্ষ্যনীয়। যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তেল আবিবের সাথে সংহতি প্রকাশকে প্রত্যাহার করতে বাধ্য করেছিল। সম্মেলন চলাকালীন- জাতিগত বৈষম্যের বিরোধিতাকারী সমিতিগুলির সহযোগিতায় মুসলমানগণ, ইস্রায়েল ও আমেরিকার বিরুদ্ধে বিক্ষোভের আয়োজন এবং ফিলিস্তিনের সমর্থনে সংহতি প্রকাশ করতে পেরেছিল ।
ঈদের জামায়াত
মুসলমানগণ বর্তমান ফেডারেল সরকারে মন্ত্রী, ডেপুটি এবং বেশ কয়েকজন রাষ্ট্রদূতের ভূমিকা পালন করছেন। অতীতে দক্ষিণ আফ্রিকা শুধুমাত্র খ্রিষ্টান দেশ ছিল। কিন্তু এখন দক্ষিণ আফ্রিকাকে বহু-ধর্মীয় দেশে পরিণত করার লক্ষে তারা দেশের সংবিধানকে সংশোধন করে চলেছেন।
অনুবাদ- হিশাম আল নোমান