পাগলা নদী বয়ে চলছে আপনমনে। নদীর দু-পাড় ঘেষে সুবিশাল একেকটা আম-বাগান। আবার নদীর পাড় থেকে দেড়শ গজ পূর্বে ঘন জঙ্গল। সেখানে কিছু লোক অতি উৎসাহের সাথে যেন জঙ্গল পরিষ্কার করছেন। নেতৃত্বে আছেন, বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ‘খুরশীদ জাহান নুমা’ এর লেখক সৈয়দ এলাহী বকশ। হঠাৎ একজন, লম্বাটে বিশাল এক কালো কুচকুচে পাথরের সন্ধান পেল। এলাহী বকশ এগিয়ে এসে, পাথরটিকে সূক্ষ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করলেন। আরবি ভাষায় তোঘরা শিলালিপি এটা। দৈর্ঘ্যে মেপে দেখা গেল ১১ ফুট ৩ ইঞ্চি এবং প্রস্থে ২ ফুট ১ ইঞ্চি। অনুসন্ধান চলতে থাকল। তবে পরবর্তীতে আশাব্যঞ্জক আর তেমন কিছু পাওয়া গেল না। এই সমস্ত ঘটনাটি ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের। কিন্তু এরপর বিষয়টি অমিমাংসীত থেকেই শতবছর কেটে গেল…..
দেশ স্বাধীন হবার পর, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ কর্তৃক ৭০ এর দশকে আবিষ্কৃত হয় দরসবাড়ি মসজিদ। আবার মসজিদের পূর্বদিকে কিছু দূরেই আবিষ্কৃত হয় দরসবাড়ি মাদ্রাসার ভিত্তিভূমি এবং পরিত্যক্ত শিলা। এ দুই ঘটনার মাধ্যমে উন্মোচিত হয় শতবছরের গোলকধাঁধার৷ ১৯ শতকের শেষদিকে উদ্ধারকৃত শিলালিপি (যেটা বর্তমানে কলকাতা জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে) এবং অধুনা প্রাপ্ত শিলালিপি থেকেই নিশ্চিত হওয়া যায় মসজিদ এবং মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাকাল, প্রতিষ্ঠাতার নাম। যদিও বহু পূর্ব হতেই কিংবদন্তির ন্যায় দরসবাড়ি নামটি জীবিত ছিল। কিন্তু এলাকাবাসী জানত না এর প্রকৃত অর্থ। দরসবাড়ী অর্থ যে বিদ্যাপীঠ বা মাদ্রাসা এটি প্রমাণিত হয় মাদ্রাসার ভিত্তিভূমি এবং পরিত্যক্ত শিলালিপি উদ্ধারের পর।
দরসবাড়ি দেশের সর্বপশ্চিমের জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ এর সীমান্তবর্তী ওমরপুরের সন্নিকটে অবস্থিত। ঐতিহাসিক কোতোয়ালি দরজা হতে প্রায় অর্ধ কি.মি দক্ষিণে অবস্থিত দরসবাড়ি, গৌড় লাখনৌতির বাংলাদেশ অংশের সর্ববৃহৎ এবং সর্বপ্রাচীন মসজিদ। অনুমান করা হয়, সুলতান ইউসুফ শাহ গৌড় প্রাচীরের বাইরের এ অঞ্চলটি শহরের নতুন কেন্দ্রীয় অংশ হিসেবে নির্মাণ করেন। সেই আমলে গৌড়ের এই অংশে ব্যাপক আকারে অভিবাসন শুরু হয়। তাই এই অংশটি গৌড় উপনগরীর মর্যাদা লাভ করে। সুতরাং, এই মসজিদটি বাংলায় মুসলিম শাসন আমলের মধ্যযুগীয় মুসলিম স্থাপত্য কলার একটি অপূর্ব নিদর্শন।
দরসবাড়ি মসজিদটি স্থাপিত হয় ১৪৭৯-৮০ এই সময়ের মধ্যে, সুলতান ইউসুফ শাহ এর বাংলা শাসনকালে। অন্যদিকে মসজিদ এর পূর্বে ছোট দীঘির পূর্ব প্রান্তের (প্রায় ১০০ গজ পূর্বে) একটি বিশাল এলাকাজুড়ে, গৌড় বংগের অত্যন্ত জনপ্রিয় সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহর যামানায় ১৫০২ সালে নির্মিত হয় দরসবাড়ি মসজিদটি। স্থাপনকালে মসজিদের নাম ছিল ফিরোজপুর জামে মসজিদ, কিন্তু কিছুকাল পর দরসবাড়ি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা পেলে মসজিদের নামও পরিবর্তিত হয়ে দরসবাড়ি মসজিদ হয়।
মসজিদের কাঠামো :
মসজিদটি বহির্দেশে উত্তর-দক্ষিণে দৈর্ঘ্য ১১১ ফুট এবং পূর্ব-পশ্চিমে প্রস্থে সাড়ে ৬৭ ফুট। ট্র্যানসেপ্টের ডান ও বামের কক্ষের প্রশস্ততা ৪২ ফুট। পূর্ব দিকে রয়েছে ৭ টি খিলান দরজা। এবং সম্মুখে (পূর্বপ্রান্তে) সাড়ে ১৬ ফুট প্রশস্ত একটি বারান্দা ছিল। মসজিদের বাইরে ও ভেতরে টেরাকোটার ফলক অলংকরণ সহ ঈষৎ লাল বর্ণের ইট প্রদর্শন করছে। মসজিদটির সমস্ত গম্বুজ বিধ্বস্ত হয়েছে। সম্মুখের ভল্ট দেয়া ছোট গম্বুজ গুলি সহ এর মূল বারান্দাও বিধ্বস্ত হয়েছে। মূলত মসজিদের দুইটি অংশ। একটি সামনের বারান্দা এবং পশ্চিমে মূল প্রার্থনা কক্ষ। মসজিদের মূল কক্ষে সারিবদ্ধ ভাবে (উত্তর-দক্ষিণে) ৭টি করে তিনটি সারিতে ২১টি এবং বারান্দায় ছোট আকৃতির আরো ৭টি সর্বমোট ২৮ টি গম্বুজ এর চিহ্ন বিদ্যমান। ইট ও পাথরের স্তম্ভ গুলি যথাযথভাবে ভল্ট ও গম্বুজের ভার বহন করত। একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো- এটিরও আছে ছোট সোনামসজিদ এর মত উত্তর-পশ্চিম কোণে অবস্থিত রাজকীয় গ্যালারি। কেউ কেউ এটিকে মহিলা গ্যালারিও বলে থাকেন। রাজকীয় গ্যালারীতে প্রবেশের জন্য সিঁড়িযুক্ত প্ল্যাটফর্ম। যা সশস্ত্র প্রহরী দ্বারা সুরক্ষিত থাকতো। সামনে বিশাল সাতটি খিলানযুক্ত দরজা বিদ্যমান। সম্মুখে ৯ টি মিহরাব বিদ্যমান। কেন্দ্রীয় মিহরাবটি অপেক্ষাকৃত বড়।
মাদ্রাসার কাঠামো :
বর্গাকৃতির এ বিদ্যাপীঠে চতুর্দিকে ৩৭ টি বর্গাকার কক্ষ ছিল। এর প্রতি পার্শ্বে দৈর্ঘ্য ৫৫.৫০ মিটার। মধ্যের বর্গাকৃতির আঙিনার চতুর্দিকে ঘিরে ছিল কক্ষগুলি। মাদ্রাসার উত্তর-দক্ষিণ ও পূর্ব প্রান্তের তিনটি খিলানযুক্ত প্রবেশদ্বার ছিল। পশ্চিম দেয়ালের মধ্যস্থিত কক্ষে তিনটি মিহরাব থাকায় এ কক্ষটি মসজিদ হিসেবে ব্যবহৃত হতো তা স্পষ্টতই নির্দেশ করে। আঙিনার মাঝামাঝিতে ক’টি কক্ষ কাঠামোর ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে। এটির পরিচিতি স্পষ্ট না হলেও অনুমান করা যায় যে, আঙ্গিনার মধ্য স্থানে পাশাপাশি ছিল যথাক্রমে রন্ধনশালা, ডাইনিং রুম ও পাঠাগার। এটি নিয়ে মাদ্রাসাটির সর্বমোট ৩৮ টি কক্ষই ছিল সম্ভবত ভল্ট দেয়া ও ছোট ছোট ৩৮ গম্বুজবিশিষ্ট। সুপ্রশস্ত ভিত্তিযুক্ত দেয়ালের উপরই ক্ষুদ্র ভল্ট দিয়ে গম্বুজ গুলি তৈরি করা হয়েছিল বলে
অনুমিত হয়। মাদ্রাসার দেয়ালের বাহির ও ভেতর মনোরম অলংকরণে ছিল সুশোভিত।
প্রাচীনকালে বিশেষত সুলতানি শাসনামলে স্থাপত্য বিদ্যার যে অপূর্ব উন্মেষ ঘটেছিল, এ মসজিদ এবং মাদ্রাসার ধ্বংসস্তুপের ভিত্তিভূমিই এর পরিচয় বহন করে। সে যুগেও স্থাপত্য শিল্পের প্রকৌশলগত দিক, সুনিপূণতার ছাপ বিদ্যমান এ স্থাপনাদ্বয়ে। আবার মানসে এবং রুচিশীলতায় কতটা উন্নত ছিল বাংলার মুসলিম শাসনামল, তাও প্রকাশ করে দরসবাড়ি। যা সত্যিই অনন্য। যেমন দরসবাড়ি মসজিদের উত্তর পশ্চিম কোণে মহিলাদের নামাজের জন্য প্রস্তরস্তম্ভের উপরে একটি ছাদ ছিল। এর পরিচয় স্বরূপ এখনও একটি মেহরাব রয়েছে। এভাবে বর্তমান সময়ের সাথে তুলনায় সেই শাসনামলের রুচিশীলতার উৎকর্ষতা, দারুনভাবে অবাক করে আমাদেরকে।
মসজিদের দেয়াল শিল্পও রীতিমত আকর্ষণীয় ছিল। যেমন, মসজিদের মিহরাবগুলির খিলান লতা গুল্ম, পত্র সম্ভার গোলাপ, চারাগাছ ও ঝুলন্ত নকশায় সজ্জিত পোড়ামাটির ফলকের ফ্রেমের মধ্যে স্থাপিত।
মসজিদের বক্র কার্নিসে ধাবমান সারিতে পতাকার আকারে টেরাকোটা ফলক স্থাপনের মধ্যে একটি আকর্ষণীয় উদ্দেশ্য বিরাজিত। যা ঘোষণা করে মসজিদের নির্মাতা ছিলেন সেনাবাহিনীর প্রধান ও বিশ্ববাসীর নেতা (আমীর-উল-মুমেনীন)।
দরসবাড়ি দেশের সর্বপ্রাচীন মাদ্রাসা। জেনারেল ক্যানিংহাম তার নিজের ভাষাতে একে দারাসবাড়ি বা কলেজ বলেছেন। দরসবাড়ি মাদ্রাসার সবচেয়ে অনন্য বিষয় হল এর পাঠ্যক্রম। পাঠ্যক্রম বিবেচনায় আনলে, হাল আমলে এসেও তা আমাদেরকে অভিভূত করে।
সুবিশাল এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন অঞ্চল হতে শিক্ষার্থীরা শিক্ষার জন্য এখানে সমবেত হতেন এবং বাংলার বুকে সর্বপ্রথম এই বিশ্ববিদ্যালয় হতে বোখারি ও মুসলিমসহ সিহাহ সিত্তাহ হাদিস শিক্ষা দেওয়া হতো। হুসেন শাহ্ পরবর্তী সময়ে ঢাকার সোরগাঁয়ে মাদ্রাসা হতে সিহাহ সিত্তাহ হাদিস শিক্ষা দেওয়া হতো। মোহাম্মদ বিন ইয়াজদান বখশ নামক এক আলেমকে দিয়ে বোখারী শরীফ নকল করিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার গড়ে তোলা হয়।
আবার ইতিহাসের নানা বিবরণ থেকে এই মাদরাসার পাঠ্যক্রম অনুমান করা যায়। আবুল ফজল ও অন্যান্যদের বিবরণ থেকে জানা যায়, বাংলার মাদরাসাসমূহে কোরআন, হাদিস, ধর্মতত্ত্ব, আরবি, ফারসি, আইনশাস্ত্র, যুক্তিবিদ্যা, গণিত, রসায়ন, চিকিৎসাবিদ্যা, জ্যামিতি, জ্যোতির্বিদ্যা ইত্যাদি পড়ানো হতে।
মানাজির আহসান গিলানী ও আবদুল হাই হাসানী নদভীর লেখা থেকে যেমনটা জানা যায়, সেসময় হাদিসের উচ্চতর পাঠ কেবল মাশারিকুল আনোয়ার পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল। বাংলার মাদরাসাসমূহে যুদ্ধবিদ্যার পাঠও দেয়া হতো। এখানে ‘হেদায়াতুর রমি’ নামে একটি পুস্তিকা পাঠ্য ছিল, যা তীরন্দাজি শেখানোর জন্য পড়ানো হত।
মাদরাসা ও অন্যান্য স্থাপত্যের দেয়ালে যে ক্যালিগ্রাফি দেখা যায় তা থেকে অনুমান করা যায় ক্যালিগ্রাফি বা লিপিকলাও ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে মাদরাসায় পাঠ্য ছিল।
বাংলার মুসলিম ইতিহাসের চমকপ্রদ সংস্কৃতি এবং শৈল্পিক মানস নির্দেশ করে এই দুই স্থাপত্য। অথচ বর্তমান প্রজন্ম দরসবাড়ির ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক অবস্থান এবং গুরূত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। আমাদের দরসবাড়ির ইতিহাস কতটা সমৃদ্ধ, নগরসভ্যতার নিদর্শন স্বরূপ কতটা উচ্চমানের তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আমাদের আত্মপরিচয় আর পূর্ববর্তীদের সম্যক জীবনাচার উদঘাটনে বিস্তর গবেষণা আর পড়াশোনার প্রয়োজন আছে দরসবাড়ি নিয়ে। অথচ অবহেলা আর অযত্নের কারণে আজকে এই স্থাপত্য তার প্রাপ্য ঐতিহাসিক মর্যাদা থেকে বঞ্চিত।
এক্ষেত্রে সরকারের সদিচ্ছার অভাব আর সীমাহীন অবহেলাও স্পষ্ট। এ অঞ্চলের ৮ টি নিদর্শনের মধ্যে ৬ টির সংস্কার কাজ সম্পন্ন করলেও বাদ পড়েছে সর্বপ্রাচীন এই মসজিদটি। এ অঞ্চলের অন্যান্য ঐতিহাসিক মসজিদগুলো চলমান থাকলেও দরসবাড়ি অনেকটা পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। এছাড়া এর সংস্কার না হওয়া অত্যন্ত দূঃখজনক। এর সংস্কার না করলে আর ক’বছরের মধ্যেই এই নিদর্শনটির অবসান ঘটবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে দরসবাড়ি তার অস্তিত্ব হুমকির ভয়ংকর পর্যায়ে রয়েছে।
তাই এই নিদর্শনের প্রাপ্য মর্যাদা ও সম্মান রক্ষার্থে এবং এর ঐতিহাসিক গুরূত্ব ব্যাপকভাবে প্রচারের জন্য সরকারসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সুনজর এবং যথাযথ পদক্ষেপ প্রয়োজন। পাশাপাশি দরসবাড়ির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে এর আশু সংস্কার এবং অতিসত্ত্বর সংরক্ষণের জন্য যথাযোগ্য ব্যবস্থা নেওয়ার বিকল্প নেই।
লেখকঃ আব্দুল্লাহ আল মারজুক