মুসলিম পোর্ট

উসমানী খেলাফতের অধীনে মদীনার সর্বশেষ গভর্নর উমর ফখরুদ্দিন পাশা, যিনি মদিনাকে উসমানী খেলাফতের অধীনে রাখতে এবং আরব বিদ্রোহী, ব্রিটিশ ও ফ্রান্সের হাত থেকে রক্ষা করতে সর্বশক্তি দিয়ে সংগ্রাম করেছেন। মহান এই বীর ১৯৪৮ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। আজ নভেম্বর ২২, ২০২৩ তার ৭৫তম মৃত্যুবার্ষিকী।

তিনি ছিলেন অত্যন্ত চৌকস ও প্রবল সাহসী একজন সেনানায়ক। মুসলিম উম্মাহ তাকে ইংরেজ ও আরব বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রামের জন্য মদিরার হেফাজতকারী (রক্ষক) হিসেবে চিনেন। তার প্রবল সাহসিকতা ও রণকৌশলের জন্য ব্রিটিশরা তাকে কখনো মরুভূমির সিংহ বা কখনো মরুভূমির বাঘ নামে ডাকতেন।

উমর ফখরুদ্দিন পাশা ১৮৬৮ সালে রুসচুক নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তার মূল নাম ছিলো উমর ফখরুদ্দিন তুরকান। তবে তিনি ফখরি পাশা বা উমর ফখরুদ্দিন পাশা নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন। তার পিতার নাম মোহাম্মদ নাহিদ বে এবং তার মাতার নাম ফাতিমা আদিল হানিম। ১৮৭৮ সালে রুশ-উসমানী খেলাফত যুদ্ধের সময় তার পরিবার ইস্তাম্বুলে হিজরত করে, তিনিও তার পরিবারের সাথে ইস্তাম্বুল চলে আসেন। শৈশব থেকেই প্রবল সাহসী ও যুদ্ধের নানান কৌশলে পারদর্শী উমর ফখরুদ্দিন পাশা ইস্তাম্বুল এসেই উসমানীয় সেনা একাডেমিতে ভর্তি হন। ১৮৮৮ সালে তিনি উসমানীয় সেনা একাডেমি থেকে স্নাতক অর্জন করেন।

অত্যন্ত সাহসী,  বীর মুজাহিদ উমর ফখরুদ্দিন পাশা শুরুতে উসমানী খেলাফতের পূর্বাঞ্চলে আর্মেনিয়ার সীমান্তে দায়িত্ব পালন করেন। এখানে তার প্রতিভা আরো বিকশিত হতে থাকে, যা তাকে সামনের দিকে অগ্রসর হতে অনুপ্রেরণা যোগায়। এরপর তিনি ১৯০৮ সালে আবার ইস্তাম্বুলে ফেরত আসেন এবং রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনীতে (ফাস্ট রেগুলার আর্মি) যোগ দেন। এরপর তাকে লিবিয়া প্রেরণ করা হয় এবং তিনি ১৯১১-১৯১২ সাল পর্যন্ত লিবিয়াতে কর্মরত ছিলেন। এভাবেই তিনি হয়ে উঠেন একজন মহান সেনা নায়ক।

প্রথম বলকান যুদ্ধে বুলগেরিয়া, সার্বিয়া, গ্রিস ও মন্টেনিগ্রো সম্মিলিত জোট গঠন করে এবং উসমানী খেলাফতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। যা প্রথম বলকান যুদ্ধ (১৯১২ সালের অক্টোবর থেকে ১৯১৩ সালের মে পর্যন্ত) হিসেবে পরিচিত। এ যুদ্ধে বলকান রাষ্ট্রসমূহের সম্মিলিত সৈন্যবাহিনীর নিকট স্বল্পসংখ্যক সৈন্য ও কৌশলগতভাবে দুর্বল অবস্থানে থাকা উসমানীয় বাহিনীকে দ্রুত পরাজিত করে। এই যুদ্ধ চলাকালে তুরস্কের ইউরোপ অংশে অবস্থিত গ্যালিপলি উপদ্বীপে অবস্থান নেওয়া ৩১তম ডিভিশনের কমান্ডারের দায়িত্ব গ্রহন করেন উমর ফখরুদ্দিন পাশা। এর মাঝে যুদ্ধের ফলাফল অনেকটা নির্ধারণ হয়ে ছিলো। এ যুদ্ধে উসমানী খেলাফত পরাজয় বরণ করে, ফলে বলকান লীগ সদস্যরা উসমানী খেলাফতের ইউরোপীয় অংশে অবস্থিত প্রায় সকল অঞ্চল দখল ও নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয়।

প্রথম বলকান যুদ্ধে অর্জিত অঞ্চল ভাগাভাগি নিয়ে বলকান জোটের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়, ফলে শুরু হয় দ্বিতীয় বলকান যুদ্ধ (১৯১৩ সালের ২৯ জুন থেকে ১০ আগস্ট পর্যন্ত)। তাদের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হলে এই সুযোগে উমর ফখরুদ্দিন পাশার নেতৃত্বে উসমানীয় বাহিনী বুলগেরিয়া আক্রমণ করে এবং প্রথম বলকান যুদ্ধে হারানো এন্ড্রিনোপল পুনরুদ্ধার করেন। এসময় উসমানী খেলাফতের সেনাপ্রধান আনোয়ার পাশার (যিনি পরবর্তীতে খেলাফতের সাথে গাদ্দারি করেন) সাথে উমর ফখরুদ্দিন পাশা পুনরুদ্ধারকৃত এন্ড্রিনোপল শহরে প্রবেশ করেন।

১৯১৪ সালের শুরুর দিকে উমর ফখরুদ্দিন পাশা ইরাকের উত্তর অঞ্চলীয় শহর মসুলে অবস্থানরত ১২তম করপসের কমান্ডার নিযুক্ত হন। এসময় প্রথম বিশ্বযুদ্ধও শুরু হয়। তার অসম দক্ষতার ফলে তাকে একই বছরে তাকে উসমানীয় সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ সম্মানিত পদ মরিলিভা পদে উন্নীত করা হয় এবং সিরিয়ার আলেপ্পোতে অবস্থানরত ফোর্থ আর্মির ডেপুটি কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯১৬ সালের ২৩ মে জামাল পাশার আদেশে তিনি মদিনা রক্ষার উদ্দেশ্যে হেজাজে রওনা দেন। এসময় ব্রিটিশ কমান্ডার টমাস এওয়ার্ড লরেন্স (টি.ই লরেন্স) এর দেখানো লোভে পা দিয়ে মক্কায় নিযুক্ত উসমানী গভর্নর শরিফ হুসাইন ১৯১৬ সালের জুন মাসে পক্ষত্যাগ করেন এবং উসমানী খেলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে ঘোষণা করেন। এই পরিস্থিতিতে ফখরুদ্দিন পাশা মদিনার গভর্নরের দায়িত্ব পালন করতে থাকেন, এবং একই সালের ১৭ জুলাই তাকে হেজাজ এক্সপেডিশনারি ফোর্সের কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। যেহেতু উসমানী খেলাফতের সাথে আরব অঞ্চলের যোগাযোগ পথ হিসেবে হেজাজ রেলপথ ব্যবহৃত হতো। এসময় ফখরুদ্দিন পাশা মদিনা রক্ষার পাশাপাশি হেজাজ রেলপথ রক্ষারও দায়িত্ব পালন করেন।

শরিফ হুসাইনের ইচ্ছা ছিল ইয়েমেন থেকে দামেস্ক পর্যন্ত এলাকা দখল করে একটি হাশেমি খিলাফত কায়েম করা। তাই তিনি ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সহায়তা নিয়ে মদিনা দখলের উদ্দ্যেশে রওনা দেন। ১৯১৬ সাল থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত (প্রায় তিন বছর) তিনি মদিনা অবোরোধ করেন। এছাড়াও হেজাজ রেলপথ যেহেতু এই লড়াইয়ের ভাগ্য নির্ধারণ করছিলো, কেননা এই রেলপথ দিয়েই খাদ্য, অস্ত্র সহ সবকিছু সরবারহ হত। তাই উসমানী বাহিনী একই সাথে এই রেলপথ রক্ষার দায়িত্বও পালন করে। এসময় আরব বিদ্রোহীরা হেজাজ রেলপথের উপর ১৯১৭ সালে প্রায় ১৩০টি ও ১৯১৮ সালে ১০০টি বড় হামলা চালায়। এবং ১৯১৮ এর ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ৩০০ এরও বেশি বোমা বিস্ফোরণ করে। এরপরও তারা হেজাজ রেলপথের খুব একটা ক্ষতি করতে সক্ষম হয়নি।

শরিফ হুসাইন মদিনা দখল করতে আসলে উমর ফখরুদ্দিন পাশার নেতৃত্বে উসমানীয় বাহিনীর ব্যাপক প্রতিরোধে আরব বিদ্রোহীরা পিছু হাটতে বাধ্য হয়। এই যুদ্ধে বীরদর্পে ফখরুদ্দিন পাশা ব্রিটিশ, ফ্রান্স ও আরব বিদ্রোহীদের মোকাবিলা করছিলেন। এসময় তিনি মসজিদে নববীতে জুমার খুতবা প্রদানকালে নবীর কবর ও নবীর শহর মদীনাকে রক্ষার জন্য জিহাদ ঘোষণা করেন। তিনি বলেন,

“সৈনিকেরা! নবীকে সাক্ষী রেখে আমি তোমাদের প্রতি আবেদন করছি, শত্রু সংখ্যা যাই হোক না কেন শেষ গুলি ও শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করে নবীর কবর ও তার শহরকে রক্ষা করতে। আল্লাহ আমাদেরকে সাহায্য করুক, এবং মুহাম্মদ (স.) এর দোয়া যাতে আমাদের সাথে থাকে।”

মদীনার উসমানীয় কমান্ডার ফখরুদ্দিন পাশা আরব বাহিনী কর্তৃক অবরুদ্ধ থাকার পরও এই পবিত্র শহরকে রক্ষা করতে থাকেন। এবং ব্রিটেন, ফ্রান্স ও আরব বিদ্রোহী এবং ফখরুদ্দিন পাশার নেতৃত্বে উসমানী বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ চলতে থাকে। অপরদিকে ১ম বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তি চুক্তিবদ্ধ হলে উসমানী খেলাফতও যুদ্ধ বন্ধ করে দেয়। এবং উসমানীয় যুদ্ধ মন্ত্রণালয় থেকে ফখরুদ্দিন পাশার নিকট যুদ্ধ বন্ধের নির্দেশ পাঠানো হয়। কিন্তু তিনি যুদ্ধ বন্ধ করতে অস্বীকৃতি জানান। খলিফার আদেশ অমান্য করায় সুলতান ষষ্ঠ মুহাম্মদ তাকে পদচ্যুত করেন কিন্ত তিনি বিচলিত না হয়ে এরপরেও ৭২ দিন পর্যন্ত বীর দর্পে যুদ্ধ চালিয়ে যান, এবং উসমানীয় খেলাফতের পতাকা সমুন্নত রাখেন। এসময় সবচেয়ে নিকটবর্তী উসমানীয় সেনাদল মদীনা থেকে ১৩০০ কিমি. (৮০৮ মাইল) দূরে অবস্থা করছিল। কিন্তু, উসমানী খেলাফতের কোনরূপ সাহায্য ছাড়াই তিনি এই সময়ে যুদ্ধ চালিয়ে যান। তিনি বলেন,“হে আল্লাহর রাসুল (স.) আমি কখনো আপনাকে ছেড়ে যাব না।”

১৯১৮ সালের আগস্টে শরিফ হুসাইন বিন আলী যখন তাকে আরব বিদ্রোহীদের নিকট আত্মসমর্পণ করতে বলেন। তিনি এর প্রত্যুত্তরে বলেনঃ

“আমি পবিত্র শহর মদিনা’র রক্ষাকর্তা, রাসূলের সেবক, ফখরুদ্দিন পাশা,

বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম। তাকে উদ্দেশ্য করে বলছি, যিনি ইসলামের শক্তিতে আঘাত করেছেন, মুসলমানদের মধ্যে রক্তপাত ঘটিয়েছেন, বিশ্বস্ত খেলাফতকে কোনঠাসা করে দিয়েছেন এবং বৃটিশ আধিপত্যকে উন্মোচন করেছেন।

যিলহজ্ব মাসের ১৪ তারিখ বৃহস্পতিবার রাতে আমি মদীনার নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার কথা চিন্তা করে ক্লান্ত ও জরাজীর্ণ হয়ে হাটছিলাম, হঠাত আমি একটা ছোট্ট জায়গায় কর্মরত কিছু অপরিচিত লোকের মধ্যে নিজেকে দেখতে পেলাম। তখন আমি আমার সামনে একজন মহৎ চেহারার একজন ব্যক্তিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। তিনি ছিলেন মুহাম্মদ সাঃ। তার বাম হাতটি পোশাকের ভেতর দিয়ে পেছনের দিকে ছিল। তারপর তিনি আমাকে একটি নিরাপত্তামূলক ভঙ্গিতে বললেন, “আমাকে অনুসরণ কর।” আমি তাকে দ্বিগুণ বা তিনগুণ গতিতে অনুসরণ করলাম, করতে করতেই জেগে উঠলাম। আমি অবিলম্বে মসজিদে নববীতে গেলাম এবং তার রওজার পাশে দু’আ দরুদ পড়ে মুনাজাত করলাম। আমি এখন আমার সর্বোচ্চ সেনাপতি “মুহাম্মদ সাঃ” এর নিরাপত্তায় আছি। আমি এখন মদীনায় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে রাস্তাঘাট নির্মাণে ব্যস্ত আছি। অযথা প্রলোভন দিয়ে আমাকে বিরক্ত করো না।”

খাদ্য সরবরাহের ঘাটতি সহ নানাবিধ জটিলতা থাকা সত্বেও ফখরুদ্দিন পাশা যুদ্ধ চালিয়ে যান। কিন্তু তার মদীনা রক্ষার এই সংগ্রাম বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯১৯ সালের ৯ জানুয়ারি তার নিজ সৈনিকেরা তাকে গ্রেফতার করে শরিফ হুসাইন বিন আলীর পুত্র আব্দুল্লাহ এর নিকট নিয়ে যান।

আবদুল্লাহ ও তার সৈন্যবাহিনী ১৩ জানুয়ারি মদীনায় প্রবেশ করে এবং ১২ দিন যাবত শহরে লুটপাট চালায়। এসময় তারা ফখরুদ্দিন পাশা কর্তৃক তালাবদ্ধ ও সিল করে দেয়া মোট ৪৮৫০টি বাড়ি জোরপূর্বক খুলে লুটপাট করে।

ফখরুদ্দিন পাশা সহ গ্রেপ্তারকৃত ৮০০০ উসমানী সৈনিককে মিশরের কায়রোতে সেনাবাহিনীর ব্যারাকে আনা হয়। পরে তাকে মাল্টায় নির্বাসনে পাঠানো হয় এবং ১৯২১ সাল পর্যন্ত (দুই বছর) তিনি মালটায় যুদ্ধবন্ধী হিসেবে আটক ছিলেন।

১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তির পর তিনি কামাল আতাতুর্কের অধীনে তুর্কি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং আনাতোলিয়া দখলকারী গ্রীক ও ফরাসিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ গ্রহন করেন। পরবর্তীতে উসমানী খেলাফত ভেঙে তু্রস্ক রাষ্ট্র গঠিত হলে তিনি আফগানিস্তানের কাবুলে তুরুস্কের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করেন। এরপর তিনি সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি পান এবং ১৯৩৬ সালে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন।

১৯৪৮ সালের ২২ নভেম্বর উম্মাহর মহান এই বীর তুরস্কের এসকিশেহিরে একটি ট্রেন ভ্রমণকালে হার্ট এটাকের কারণে মৃত্যুবরণ করেন। তার ইচ্ছে অনুযায়ী তাকে ইস্তাম্বুলে দাফন করা হয়।

সংকলকঃ মু. শফিকুল ইসলাম