মুসলিম পোর্ট

ভূস্বর্গ হিসেবে খ্যাত আটষট্টি হাজার বর্গমাইলের অঞ্চল কাশ্মীরের সঙ্গে ভারত, পাকিস্তান, চীন ও আফগানিস্তানের একটি অংশের সীমান্ত রয়েছে। এবং এটিই একমাত্র অঞ্চল যার সাথে তিনটি পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র – চীন, ভারত এবং পাকিস্তানের সীমান্ত রয়েছে।

বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড এবং লুক্সেমবার্গের সমন্বিত আয়তনের তিনগুণেরও অধিক বড় এই কাশ্মীর আয়তনের দিক থেকে ১০৩ টি স্বাধীন দেশের চেয়েও বৃহত্তর। কাতার, লেবানন, গাম্বিয়া ও ব্রুনাই সহ জাতিসংঘের ৩৫ টি সদস্য রাষ্ট্র থেকে বড় এই অঞ্চল।

পাকিস্তানে বসবাসরত ২ মিলিয়ন রিফিউজি এবং নির্বাসিত ২.৩ মিলিয়ন মানুষসহ কাশ্মীরের জনসংখ্যা প্রায় ২৩.৫ মিলিয়ন, যা ১২৯ টি স্বাধীন দেশের জনসংখ্যার থেকে বেশি।

কাশ্মীরের ইতিহাসের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় ১৮ শতকের শেষ এবং ১৯ শতকের প্রথমাংশের সংকটকালীন সময়টুকু ব্যতীত ঐতিহাসিকভাবে স্বাধীন এই অঞ্চলটি মৌর্য (খ্রিষ্টপূর্ব ৩য় শতক), মুঘল (১৬-১৮ শতক) এবং পরবর্তীতে ব্রিটিশদের (উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে বিশ শতকের মধ্যভাগ) দ্বারা শাসিত হয়েছে। শুধুমাত্র বর্তমান সময়ের পাক-ভারতেই নয়, বরং উপরোক্ত প্রত্যেকটি সাম্রাজ্যের শাসনামলে এমনকি ব্রিটিশ রাজ্যের অধীনেও কাশ্মীরের অভ্যন্তরীণ স্বায়ত্তশাসন বজায় ছিল।

বর্তমান পৃথিবীতে যে অঞ্চলগুলোর স্বাধীনতা প্রাপ্তি নিয়ে সবচেয়ে বেশি ধোঁয়াশা ও বিতর্ক হচ্ছে তার মধ্যে একটি হচ্ছে কাশ্মীর।

ভারত দাবি করছে কাশ্মীর তার অংশ। আর তাদের এই দাবির ভিত্তি কাশ্মীরের মহারাজার স্বাক্ষরিত একটি দলীল, যেখানে তিনি একটি গণবিদ্রোহ দমনে ভারতের সেনা সাহায্যের জন্য চুক্তি সম্পন্ন করেন।

কিন্তু ভারত এখানে চুক্তিটির একটি শর্ত সবসময়ই এড়িয়ে যাচ্ছে। এই চুক্তি কার্যকর হওয়ার শর্ত ছিল যে তাকে কাশ্মিরী জনগণের গণভোটের (যা এখনো অনুষ্ঠিত হয়নি) মাধ্যমে স্বীকৃতি পেতে হবে। ভারতের যে দাবি তা কাশ্মীরের জনগণ সবসময় প্রত্যাখ্যান করে এসেছে। একইসাথে এই দাবি না জাতিসংঘ গ্রহণ করেছে, না পাকিস্তান। আর না এই দাবি আইনীভাবে প্রমাণিত হয়েছে।

ভারত শুধু কাশ্মীর দখল করেই থেমে থাকেনি, তারা এই অঞ্চলে তাদের আগ্রাসনের সকল চেহারাই উম্মুক্ত করেছে। তাদের এই আগ্রাসন গুলোর একটি হলো জম্মু গনহত্যা। জম্মু গণহত্যা দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম ইতিহাসে অন্যতম দুঃখজনক একটি ঘটনা, যদিও তা জনমানসে বিস্মৃতপ্রায় একটি অধ্যায়।

১৯৪৭ এর শেষ সপ্তাহে জম্মুর প্রায় ২৫০,০০০ থেকে ৪০০,০০০ মুসলিমকে হত্যা করা হয় এবং বাকিদের পশ্চিম পাঞ্জাবে নির্বাসিত করা হয়। যার ফলে জম্মুর অন্তত তিনটি জেলার জনতাত্ত্বিক মানচিত্র ব্যাপকভাবে বদলে গিয়ে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় পরিণত হয়।

মহারাজা হরি সিং-এর বাহিনীর সহায়তায় উগ্রপন্থী হিন্দু ও শিখেরা এই হত্যাকাণ্ড ও তাণ্ডবলীলা ঘটায়। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) এর কর্মীরা দাঙ্গার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল।

ভারত অধিকৃত কাশ্মীর বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সামরিকায়িত অঞ্চল। যেখানে ১২ মিলিয়ন স্থানীয় অধিবাসীর বিপরীতে ১ মিলিয়ন সক্রিয় সেনাসদস্য নিয়োজিত আছে। এমনকি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই অঞ্চলে নিয়োজিত প্রায় প্রত্যেক সেনাসদস্যই অমুসলিম, বেশিরভাগই হিন্দু। দখলদার ভারতীয় বাহিনী এখানে ভয়াবহ যুদ্ধাপরাধে লিপ্ত। তারা প্রতিদিনই মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ যাবতীয় অপরাধ করে যাচ্ছে।

১৯৪৭ এর কিছু আগে-পরে যখন ভারত কাশ্মীর দখল করতে তার বাহিনী প্রেরণ করে, তখন দোগ্রা, হিন্দু এবং পাঞ্জাবি সন্ত্রাসী বাহিনীর সমন্বিত অভিযানে প্রায় ২.৫ লক্ষ মুসলিমকে হত্যা করা হয়, যা ইতিহাসে জম্মু গণহত্যা নামে পরিচিত। দখলের পর থেকে ভারত প্রশাসন কাশ্মিরী সাধারণ জনগণের বিরুদ্ধে অলিখিত পূর্ণ যুদ্ধ ঘোষনা করে এসেছে, এবং ১৯৮০ এর শেষাংশ থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৯০,০০০ কাশ্মিরী জনগনকে হত্যা করা হয়েছে। এবং বলপূর্বক গুমের শিকার হয়েছে প্রায় ১০,০০০ কাশ্মিরী।

এখানকার শতশত নারীরা ‘অর্ধ-বিধবা’, এটি বিশেষত কাশ্মীর অঞ্চলে ব্যবহৃত একটি পরিভাষা। যার দ্বারা সেসকল নারীদের বোঝানো হয়, যাদের স্বামীরা ভারতীয় বাহিনীর দ্বারা গ্রেফতারের শিকার হয়েছে এবং যাদের বর্তমান অবস্থান, খবরা-খবর কেউই জানেনা। এসকল নৃশংসতার ফলস্বরূপ কাশ্মীরের ১২০,০০০ এরও বেশি মানুষ বর্তমানে পিতৃ-মাতৃহীন।

২০১০ থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী এখানে পেলেট আগ্নেয়াস্ত্র (বন্দুক) ব্যবহার করছে যার দ্বারা শতশত কাশ্মিরী মানুষের চোখ অন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের পর এটিই প্রথম যে কোন দখলদার বাহিনী যারা বেসামরিক জনগণের উপর এভাবে গণ অন্ধত্বকরণ অভিযান পরিচালনা করছে। অথচ পেলেট বন্দুক মানুষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা আইনত নিষিদ্ধ, যা শুধুমাত্র পশু-প্রাণী শিকারেই ব্যবহার করা হয়। এবং হাজার হাজার বেসামরিক কাশ্মিরী জনগনকে এখন পর্যন্ত অপহরণ এবং গ্রেফতার করে রাখা হয়েছে ভারতের এসকল সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলের বাইরে।

ভারত বেআইনীভাবে কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামী এবং প্রতিরোধ আন্দোলনের নেতৃবৃন্দকে অপহরণ এবং গ্রেফতার করেছে। কাশ্মীরের সর্বদলীয় স্বাধীনতাকামী কনফারেন্স (All Parties Hurriyat Conference) এর চেয়ারম্যান মাসারাত আলম ভাটকে ভারত সরকার গ্রেফতার করে নয়াদিল্লীর কুখ্যাত তিহার কারাগারে বন্দি রেখেছে।

‘সর্বদলীয় হুররিয়াত কনফারেন্স’ অধিকৃত কাশ্মীরের দুই ডজনের অধিক স্বাধীনতাকামী সংগঠনসমূহের একটি জোট যারা জাতিসংঘ কর্তৃক কাশ্মিরীদের জন্য সংরক্ষিত আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ফিরে পেতে লড়াই-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিচ্ছে। মাসারাত আলম ভাটের পাশাপাশি, ভারত সরকার শাবির আহমাদ শাহ, মুহাম্মাদ ইয়াসিন মালিক, পীর সাইফুল্লাহ, মুহাম্মাদ কাসিম ফাকতু, আয়াজ আকবার, নাইম আহমাদ খানসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দকে বন্দী করে রেখেছে।

সৈয়দা আসিয়া আন্দ্রাবি, নাহিদা নাসরিন, ফাহমিদা সোফি কাশ্মীরের নারীদের প্রতিরোধ আন্দোলনের প্রধান তিন নেত্রী। প্রতিরোধ আন্দোলনের সকল প্রধান প্রধান নেতৃবৃন্দকে ভারত সরকার অন্যায়ভাবে অপহরণ, গ্রেফতার করে তিহার সহ অন্যান্য কারাগারে বন্দী রেখেছে।

শহীদ সৈয়দ আলী গিলানী এবং শহীদ মুহাম্মাদ আশরাফ সেহরাই কাশ্মীর মুক্তি সংগ্রামের অন্যতম দুই নেতা যারা পুলিশি হেফাজতে কারান্তরীন অবস্থায় শাহাদাতবরণ করেছিলেন।

১৯৮০ এর শুরু দিকে ভারত সরকার বেআইনীভাবে মুহাম্মাদ মাকবুল ভাটকে গ্রেফতার করে এবং ১৯৮৪ সালে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে।

২০১৯ থেকে ভারত সরকার জামায়াত-ই-ইসলামী জম্মু এন্ড কাশ্মীর, তেহরিক-ই-হুররিয়াত জম্মু এন্ড কাশ্মীর, জম্মু এন্ড কাশ্মীর লিবারেশ্লন ফ্রন্ট, ডেমোক্রেটিক ফ্রিডম পার্টি, মুসলিম লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এসকল সংগঠন মাসারাত আলম ভাটের নেতৃত্বাধীন সর্বদলীয় হুররিয়াত কনফারেন্সের জোটভুক্ত দুই ডজনের অধিক সংগঠনসমূহের অন্তর্ভুক্ত কয়েকটি দল।

সর্বপ্রথম যখন কাশ্মীর সংকট নিয়ে জাতিসংঘে আলোচনা হয়, তখন নিরাপত্তা পরিষদ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ফ্রান্সের দৃঢ় সমর্থন নিয়ে এই সমাধানের দিকে আহবান জানায় যে কাশ্মীরের ভবিষ্যত নির্ধারিত হবে কেবলমাত্র এর জনগণের চাহিদা এবং ইচ্ছা মোতাবেক।

যুক্তরাষ্ট্র এই রেজুলেশনের ক্ষেত্রে প্রধান কর্তার ভূমিকা পালন করে। যা নিরাপত্তা পরিষদ ‘রেজুলেশন-৪৭’ নামে ১৯৪৮ সালের ২১ শে এপ্রিল গৃহীত হয়।

যদিও বিগত কিছু দশক ধরে একমাত্র চীনই কাশ্মীরের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের স্বপক্ষে জোরদার সমর্থন দিয়ে আসছে। ওয়াশিংটন ভারতের পক্ষে সমর্থন দিয়ে তার পূর্ব অবস্থান থেকে সরে এসেছে, কেননা ওয়াশিংটন নয়াদিল্লীকে বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে থাকে। ফ্রান্সও ভারত সরকারের সাথে ঘণিষ্ঠ হয়েছে, যদিও রাশিয়া এই ইঙ্গিত দিয়েছে যে সে তার পূর্বের কাশ্মিরবিরোধী অবস্থান থেকে সরে এসে তাদের সমর্থনে দাড়াবে।

সম্ভাব্য ভবিষ্যতের দিকটি চিন্তা করলে দুইটা দিক লক্ষ্য করা যায়। কাশ্মীরের ভবিষ্যতের ব্যাপারে তার জনগণের গণইচ্ছার নিশ্চিতকরণ অথবা দখলকৃত জম্মু কাশ্মীরে উগ্র দমন-পীড়ন, গণহত্যাসহ বর্তমান অবস্থাই জারি থাকা যা দক্ষিণ এশিয়ায় দীর্ঘস্থায়ী লড়াই এবং পরমাণু যুদ্ধের আশংকাকে বাড়িয়ে তুলবে।

এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে কাশ্মীরের অভ্যন্তরীন এই সংঘাত এবং দমন পীড়নের দ্রুত পরিসমাপ্তির ব্যবস্থা করতে হবে। কাশ্মীরের প্রকৃত নেতৃবৃন্দ এবং পাকিস্তান ও ভারত সরকারের মধ্যে রাজনৈতিক আন্তঃসংলাপের মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিক এবং শান্তিপূর্ণ সমাধান নিশ্চিত করতে হবে।

তাই দিনশেষে কাশ্মীরের পরিপূর্ণ বেসামরিকীকরণ (সকল বহিরাগত সেনাবাহিনী প্রত্যাখ্যানের মাধ্যমে) এবং অবিলম্বে নিরপেক্ষ গণভোটের মাধ্যমে কাশ্মীরের সংঘাতহীন ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা ব্যতীত অন্য কোনো পথ উম্মুক্ত নেই।

সংকলন- আব্দুল্লাহ আল মারজুক