মুসলিম পোর্ট

এক.

চলমান গাজা ইজরায়েল যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে, ভবিষ্যতে বৈশ্বিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট কী হতে পারে বা কিভাবে বদলে যেতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই বলা যায় এই অসম যুদ্ধ আমাদেরকে একটি নতুন বিশ্বব্যবস্থার দিকে ধাবিত করতে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মাঠে বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলোর নতুন করে উত্থান এবং পারস্পরিক শক্তি প্রদর্শন তাই প্রমাণ করে।

ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস গত বছরের ৭ই অক্টোবর ইজরায়েলে কৌশলগত হামলা চালায়। এতে প্রায় ১০০০ জন নিহত হয়। এর বিপরীতে দখলদার ইজরায়েলের হামলায় এখন পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা প্রায় ৪২০০০ জন। আহতের সংখ্যা অন্তত তিন লক্ষ, যার বেশিরভাগ নারী ও শিশু। আর উদ্বাস্তু হয়েছে অন্তত ২০ লাখ বাসিন্দা।

এরই প্রেক্ষিতে গত ২৬ শে অক্টোবর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গাজায় মানবিক বিরতির জন্য একটি প্রস্তাব আনা হয়। যেই প্রস্তাবটির পক্ষে ভোট দেয় মোট ১২০ টি দেশ। অপরদিকে বিপক্ষে ভোট দেয় মাত্র ১৪ টি দেশ। আর ভোটদানে বিরত থাকে ৪৫ টি দেশ। এই ভোটাভুটির পরেই মূলত বৈশ্বিক রাজনীতির মেরুকরণ বড় আকারে শুরু হয়। কারণ জাতিসংঘের এই প্রস্তাবে বিপক্ষে ভোট দেয় স্বয়ং যুক্তরাষ্ট্র। যা পরোক্ষভাবে সমর্থন করে ইউরোপের সিংহভাগ দেশ। এতে গণহত্যার বিপক্ষে থাকা অন্যান্য দেশগুলো এবং দেশের সাধারণ জনগণ ক্রোধে ফেটে পড়ে। যার প্রভাব রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে শুরু করে বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানি এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও লক্ষ্য করা যায়।

দুই.

গাজা-ইজরায়েল যুদ্ধের সর্বোচ্চ প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। কারণ তারা সর্বপ্রথম এবং সবচেয়ে বেশি প্রভাব খাটিয়ে বন্ধু হিসেবে ইজরাইলের পাশে দাঁড়িয়েছে। তারা নিঃশর্তভাবে ইজরাইলকে সামরিক, মিডিয়া, অর্থনৈতিক সহ সব ধরনের সহায়তা করে আসছে।

এমনকি তারা ইজরায়েলেকে সহায়তা করার জন্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের মানবিক যুদ্ধ বিরতির দাবিতে ভেটো দিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দাবি করেন তিনি একজন ইহুদীবাদী। এমনকি ইজরায়েলের প্রতি ডেমোক্রেটিক পার্টির নিঃশর্ত সমর্থনও ব্যক্ত করেন তিনি। এতে শুধু দেশের অভ্যন্তরেই নয়, সমগ্র বিশ্বের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে এবং সমালোচনার মুখে পড়ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অস্বাভাবিক নিহতের সংখ্যার কারণে প্রতিনিয়ত এই সমালোচনা বেড়েই চলছে।

এই সমালোচনার ফলে নিকট ভবিষ্যতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এককভাবে এগিয়ে যাচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছেন স্বয়ং জো বাইডেন।

শুধু যুক্তরাষ্ট্রই নয়, ইজরায়েলের আগ্রাসনে যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি আকুণ্ঠ সমর্থন ব্যক্ত করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো। যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স ও পর্তুগাল সহ অন্যান্য দেশগুলো সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে সব ধরনের সহায়তা চালিয়ে যাচ্ছে। এতে কঠোর সমালোচনার মুখে পড়ে দেশগুলোর প্রশাসন এবং নেতৃবৃন্দ।

তরুণরা, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে র‍্যালি, সমাবেশ ও মানববন্ধনের মত বিভিন্ন মাধ্যমে প্রতিবাদ করে গণহত্যা বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে আসছে। কিন্তু বিপরীতে প্রশাসন এই গণহত্যা বিরোধী আন্দোলনগুলো সশস্ত্রভাবে দমানোর চেষ্টা করে, এতে জনসাধারণ সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলো নড়েচড়ে বসে। এতে অভ্যন্তরীণভাবেই প্রতিরোধের মুখে পড়ে গণহত্যাকে সমর্থনকারী দেশগুলো।

তিন.

গাজা গণহত্যার বিপক্ষে সব ধরনের সমর্থন এবং সহযোগিতার দিক থেকে এগিয়ে আছে ইরান, দক্ষিণ আফ্রিকা, লেবানন, কলম্বিয়া, তুরস্ক, স্পেন ও ইয়েমেনসহ অন্যান্য দেশসমূহ।

বিশেষ করে সামরিক খাতে সহায়তা করছে ইরান, তারা তাদের প্রক্সি বাহিনী হিজবুল্লাহকে দিয়ে প্রতিনিয়ত ইজরায়েলে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে এবং ইয়েমেন হুথি বাহিনীকে দিয়ে ভূমধ্যসাগরে ইজরায়েলের নৌযান এবং ইজরায়েলকে সহায়তাকারী যে কোন জাহাজ আক্রমণ করছে। এতে করে বাধার সম্মুখীন হচ্ছে।

বিভিন্ন আমদানি ও রপ্তানির চালানসমূহ। এতে সামগ্রিকভাবে  বিশ্ব বাণিজ্যে পড়ছে অস্বাভাবিক প্রভাব।

এদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশ হওয়া সত্ত্বেও স্পেনের মতো দেশ ইজরায়েলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে। স্পেন অফিসিয়ালি বার্তা দিয়ে ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে গাজা উপত্যকায় গণহত্যার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে হাজির করা এবং ইজরায়েলের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানান। একই সাথে এই গণহত্যার জন্য স্পেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নকে অভিযুক্ত করে। এতে সমর্থন দিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা গণহত্যা জড়িত থাকার অভিযোগ এনে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করে। কিন্তু এক্ষেত্রে জার্মান সরকার আইসিজেতে (ICJ) ইজরাইলের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার গণহত্যার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে এবং ইজরায়েলের পক্ষে হস্তক্ষেপ করার ইচ্ছা প্রকাশ করে। এতেই নিজ দেশের জনগণের দ্বারা প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে জার্মান সরকার। সর্বশেষ একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, জার্মানির বর্তমান চ্যান্সেলরের পক্ষে জনগণের সমর্থন রয়েছে সাকুল্যে ৮ শতাংশ। অর্থাৎ এই ৯২% জনগণ বিপক্ষে থাকায় আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে জার্মানির একচ্ছত্র  পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ একপ্রকার নড়বড়ে অবস্থায় চলে গিয়েছে।

দক্ষিণ আফ্রিকা ও এশিয়ার অনেক দেশের পাশাপাশি লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর প্রতিক্রিয়া ছিল বিস্ময়কর। বিশেষ করে বলিভিয়া ইজরায়েলের সঙ্গে সকল ধরনের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ব্রাজিল গাজা যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব পেশ করে। শুধু তাই নয়, গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি সামরিক পদক্ষেপকে হলোকাস্টের সাথে তুলনা করেন ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি লুইস ইনাসিও। জাতিসংঘের নিযুক্ত মেক্সিকোর স্থায়ী প্রতিনিধি দখলদার শক্তি ইজরাইলের প্রতি ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য সরাসরি আহ্বান জানান।

চার.

মানবাধিকার প্রশ্নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের এমন ব্যর্থতার ক্ষেত্রে নতুন করে উত্থান ঘটে ব্রিকসের। ২০২৩ সালের আগস্ট মাসের দক্ষিণ আফ্রিকার রাজধানী জোহান্সবাগে যে ব্রিকস সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে সেখানে নতুন করে ২১ টি দেশ সদস্য হওয়ার আবেদন করেন। এই সম্মেলনে নতুন করে সদস্য হয় আর্জেন্টিনা, মিশর, ইথিওপিয়া, ইরান, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত।

ব্রিকস এখন ব্রিকস প্লাস। ব্রিকসের সদস্যভুক্ত ১১ টি দেশ বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৪৬ শতাংশ। অপরদিকে ব্রিকসের বিপরীতে দাঁড়ানো শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট ‘G-7’ বিশ্বের জনসংখ্যার ১০ শতাংশ।

৭ই নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন্টনি ব্লিংকেন জি-সেভেন জোটের সদস্য গুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এই বৈঠকের উদ্দেশ্য ছিল মধ্যপ্রাচ্য সংকট নিয়ে একটি ঐকমত্যে আসা। জাপানে গিয়ে তার আহ্বান ছিল, জোটের সদস্যরা যেন পশ্চিমের সমর্থনে সমর্থন দিয়ে যায়। কিন্তু এতে হিতে বিপরীত অবস্থা তৈরি হয়ে যায়। পশ্চিমা জোটগুলো যতই ইসরাইলের সমর্থনে একত্রিত হচ্ছিল, ততই বিপরীত দিকের জোটগুলোর কার্যক্রম বৃদ্ধি পাচ্ছিলো।

যেমন ব্রিকস নিয়ে সৌদি আরবের ইতিবাচক এগিয়ে যাওয়ার পরে সৌদি আরব ও ইরানের কুটনৈতিক সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণরূপে নতুন করে দাঁড় করানো হয়েছে। মিশর ও তুরস্কের নেতারা তাদের পারস্পরিক বৈরিতা কমাতে পদক্ষেপ নেয়। আরব রাষ্ট্রগুলো আঞ্চলিক অস্থিরতা কমাতে সিরিয়ার সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে শুরু করে। অক্টোবর পরবর্তী সময়ে মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই রাষ্ট্রগুলোর এমন গতিশীলতা আশ্চর্যজনকভাবেই আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন রূপ দান করছে।  

পাঁচ.

বর্তমান বিশ্বের রাজনৈতিক প্রভাব নির্ভর করে অনেকাংশে অর্থনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে। এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে ফিলিস্তিন ইজরায়েলে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে বৈশ্বিক অর্থনীতি তার স্বাভাবিক গতিতে হাঁটছেনা। সংঘাত শুরু হওয়ার পর থেকে বৈশ্বিক বাজারে তেলের দাম সাড়ে সাত শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে প্রতি সপ্তাহে।

লোহিত সাগরে বাণিজ্য জাহাজ চলাচল বেশ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে, যার ফলে শিপিং খরচ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে গিয়েছে। কারণ ফিলিস্তিনের সমর্থনে ইয়েমেন সমুদ্রে প্রভাব বিস্তার করার কারণে জাহাজগুলো সুয়েজ খাল এড়িয়ে চলতে বাধ্য হচ্ছে, ফলে ইউরোপ এবং এশিয়ার মধ্যে বাণিজ্যে ব্যাঘাত করছে। যেমন হুথিদের জলপথে ইসরায়েলের নৌযানগুলো আক্রমণের ফলে লোহিত সাগর এবং সুয়েজ খালের মধ্য দিয়ে নৌযান চলাচল অন্তত ৫০ শতাংশ কমে গেছে।  S&P গ্লোবাল কমোডিটি ইনসাইট অনুসারে, উত্তর এশিয়া থেকে ইউরোপে একটি ৪০ ফুট কন্টেইনারের জন্য মালবাহী জাহাজের ব্যয়ের হার ৬ শতাংশেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। যদি সংঘর্ষটি ইরানের মত মধ্যপ্রাচ্যের প্রধান তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে বৈশ্বিক অর্থনীতি মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হতে পারে। এই অঞ্চলগুলো থেকে এর সরবরাহে বিঘ্ন ঘটলে সমগ্র বিশ্বে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য হারে খরচ বৃদ্ধি পেতে পারে। যা অস্থিতিশীল করে তুলবে প্রতিটি দেশের অর্থনীতিকে। যার বিরূপ প্রভাব আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও সম্পর্কের ক্ষেত্রে অবশ্যম্ভাবী।

– মাহদী হাসান