মুসলিম পোর্ট

আরব ‘ন্যাটো’ গঠনের মিশরীয় প্রস্তাব নাকচ, কাতার-ইউএই এর সহায়তায় নেপথ্যে যুক্তরাষ্ট্র

 সম্প্রতি দোহা সম্মেলনে মিশর কর্তৃক প্রস্তাবিত ন্যাটো-শৈলীর একটি আরব প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠনের পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে। মূলত কাতার এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) বিরোধিতার কারণে এই প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়, যা আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং দখলার ইজরায়েলি হুমকির মুখে আরব দেশগুলোর মধ্যকার গভীর বিভাজনকে স্পষ্ট করে তুলেছে। এই ব্যর্থতার পর মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি “গভীরভাবে হতাশ” হয়ে সম্মেলন ত্যাগ করেন বলে মিশরীয় কূটনীতিকরা মিডল ইস্ট আই-কে জানিয়েছেন।

প্রস্তাবের মূল লক্ষ্য বিরোধিতার কারণ

মিশরের এই প্রস্তাবটি ১৯৫০ সালের ‘যৌথ প্রতিরক্ষা ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা চুক্তি’র অধীনে ছিল। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে বাহ্যিক হুমকি, বিশেষ করে দখলদার ইজরায়েলের হাত থেকে রক্ষা করা। মিশরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বদর আবদেলাত্তি উপসাগরীয় দেশগুলোর কাছে এই প্রস্তাবটি বিদেশি শক্তির ওপর নির্ভর না করে এই অঞ্চলকে রক্ষা করার একটি আত্মরক্ষামূলক পদক্ষেপ হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন।

তবে প্রস্তাবটি কয়েকটি প্রধান বাধার সম্মুখীন হয়:

  • নেতৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব: জোটের নেতৃত্ব কে দেবে, তা নিয়ে মিশর ও সৌদি আরবের মধ্যে তীব্র মতবিরোধ দেখা দেয়। সৌদি আরব এর নেতৃত্বে থাকতে চাইলেও, মিশর তার দীর্ঘ সামরিক অভিজ্ঞতার কারণে নিজেদেরই সবচেয়ে যোগ্য বলে মনে করেছিল।
  • মার্কিন প্রভাব: সম্মেলনের ফলাফল নির্ধারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বড় ভূমিকা ছিল। এক মিশরীয় কূটনীতিক জানান, একটি কাতারি প্রতিনিধিদল ওয়াশিংটন থেকে এই বার্তা নিয়ে ফিরেছিল যে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে কোনো প্রস্তাব গ্রহণ করা উচিত হবে না। যুক্তরাষ্ট্র আশ্বাস দিয়েছিল যে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সংকট মোকাবিলা করবে এবং ইজরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে অন্য কোনো উপসাগরীয় দেশে হামলা চালানো থেকে বিরত রাখবেন। এই অবস্থানে সংযুক্ত আরব আমিরাতও জোরালো সমর্থন জানায়।
  • উপসাগরীয় দেশগুলোর ভিন্ন পরিকল্পনা: উপসাগরীয় দেশগুলো ইরান বা তুরস্ককে এই ধরনের কোনো জোটে অন্তর্ভুক্ত করতে রাজি ছিল না। শেষ পর্যন্ত তারা নিজেদের প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত বিষয়গুলো তাদের নিজস্ব ‘গাল্ফ ডিফেন্স কাউন্সিল’-এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়, যা কায়রোর কাছে একটি স্পষ্ট বার্তা ছিল যে তারা মিশরকে সমর্থন করতে অনিচ্ছুক। এর কিছুদিন পরই সৌদি আরব পারমাণবিক শক্তিধর পাকিস্তানের সঙ্গে একটি পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করে।

মিশরের হতাশা প্রকাশ

এই সম্মেলনটি দোহায় হামাস নেতাদের ওপর ইজরায়েলি হামলার কয়েকদিন পরেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যেখানে ছয়জন নিহত হয়। মিশর আশা করেছিল যে সম্মেলনে গাজায় ইজরায়েলি আগ্রাসন বন্ধ এবং ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক উত্তর সিনাইয়ে বাস্তুচ্যুত করার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া হবে। কিন্তু কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের অবস্থানের কারণে অন্য আরব রাষ্ট্রগুলো কোণঠাসা হয়ে পড়ে এবং ইজরায়েলের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া “বৃথা” বলে মনে করে। সম্মেলনের চূড়ান্ত বিবৃতিতে দোহায় ইজরায়েলি হামলার নিন্দা করা হলেও কোনো কার্যকরী ঘোষণা করা হয়নি, যা আরব বিশ্বের বিভেদকে আরও একবার সামনে এনেছে এবং মিশরকে জোটের মধ্যে বিচ্ছিন্ন করে।

ক্রমবর্ধমান মিশর-ইজরায়েল উত্তেজনা

এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মিশরের প্রেসিডেন্ট সিসি ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর প্রথমবার ইজরায়েলকে “শত্রু” হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যা কায়রোর ক্রমবর্ধমান হুমকির ভাবকেই প্রকাশ করে। একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতে, কায়রোতে হামাস নেতাদের নিশানা করার ইজরায়েলি হুমকি এবং ফিলিস্তিনিদের সিনাই উপত্যকায় ঠেলে দেওয়ার সম্ভাবনা মিশরকে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন করেছে। সম্প্রতি মিডল ইস্ট আই-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মিশর তার মাটিতে হামাস নেতাদের হত্যার একটি ইজরায়েলি চক্রান্তও উন্মোচন করেছে এবং তেল আবিবকে সতর্ক করে দিয়েছে যে কোনো ধরনের প্রচেষ্টা বলপ্রয়োগের মাধ্যমে প্রতিহত করা হবে।

ঐতিহাসিকভাবে, ১৯৫০ সালের আরব প্রতিরক্ষা চুক্তিটি রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং ভিন্ন জাতীয় স্বার্থের কারণে বারবার ব্যর্থ হয়েছে। ২০১৫ সালেও মিশর একটি সম্মিলিত আরব সামরিক বাহিনী গঠনের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিল, যার মূলে ছিল নেতৃত্ব এবং অর্থায়ন নিয়ে বিতর্ক। বিশ্লেষকদের মতে, এই বারবার ব্যর্থতা আরব সামরিক ঐক্যের দীর্ঘস্থায়ী চ্যালেঞ্জকেই তুলে ধরে।