মির্জা আসাদুল্লাহ বেগ ডাক নাম গালিব এবং আসাদ। ইসলামী সভ্যতার মহান এই কবি ২৭ ডিসেম্বর, ১৭৯৭ সালে আগ্রাতে জন্মগ্রহণ করেন। ভারতবর্ষে মোঘল সালতানাতের শেষ ও ব্রিটিশ শাসনের শুরুর দিকের একজন ফার্সি এবং উর্দু ভাষার কবি । সাহিত্যে তার অনন্য অবদানের জন্য তাকে দাবির-উল-মালিক ও নাজিম-উদ-দৌলা উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
তার সময়কালে ভারতবর্ষে মোঘল সালতানাত তার ঔজ্জ্বল্য হারায় এবং শেষে ১৮৫৭ সালের সিপাহীবিদ্রোহের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশরা পুরোপুরিভাবে মোঘলদের ক্ষমতাচ্যুত করে সিংহাসন দখল করে। তিনি তার লেখায় মোঘলদের পতন, ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম জীবনের কালো অধ্যায় নিয়ে লিখেছেন। মহান মোঘল সালতানাত তার আভিজাত্য হারিয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে, তার লেখায় মোঘল সালতানাতের এসব দিক দারুন ভাবে ফুটে উঠেছে। মহাবিদ্রোহের সময়কার তার লেখা সেই দিনলিপির নাম দাস্তাম্বু। এছাড়াও তিনি জীবনবোধ নিয়ে গজল রচনা করেছিলেন যা পরবর্তীতে বিভিন্ন জন বিভিন্ন আঙ্গিকে বর্ণনা করেছেন ও গেয়েছেন। মোঘল সালতানাতের সর্বশেষ কবি মির্জা গালিব কেবল দক্ষিণ এশিয়ার কবিই নয়, আজ তার কবিতা মুগ্ধ করেছে সারা বিশ্বকে। তাকে উর্দু ভাষার সবচেয়ে প্রভাবশালী কবি বলে মনে করা হয়।
গালিব কখনো তার জীবিকার জন্য কাজ করেনি। সারা জীবনই তিনি হয় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় অথবা ধার কর্য করে নতুবা কোনো বন্ধুর উদারতায় জীবন যাপন করেন। তার খ্যাতি আসে তার মৃত্যুর পর। তিনি তার নিজের সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন যে, তিনি বেঁচে থাকতে তার গুণকে কেউ স্বীকৃতি না দিলেও, পরবর্তী প্রজন্ম তাকে স্বীকৃতি দিবে। ইতিহাস এর সত্যতা প্রমাণ করেছে।
চরম অর্থনৈতিক দৈন্যতা ও কষ্টের মধ্যেই কেটেছে গালিবের জীবন। তবে তিনি ছিলেন পরম বন্ধু প্রিয় এক ব্যক্তিত্ব। একবার তার খুব কাছের বন্ধু তার বাড়ির পাশে একটা কাজে এসে তার সাথে দেখা না করেই চলে যায়। এতে গালিব খুবই কষ্ট পান। পরবর্তী একটি চিঠিতে তিনি এ কষ্টের কথা তার বন্ধুকে বলেন। কবি তার এক ছন্দে বলেন,
“সব সম্পর্ক ছিন্ন করো না, বন্ধু;
আর যদি কিছু না থাকে
তো শত্রুতাই থাক”
কবি তার প্রিয় মানুষদের প্রতি এভাবেই তার ভালবাসা প্রকাশ করেছেন।
প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন কবি মির্জা গালিব চরম দুঃখ-দুর্দশার মাঝেও নিজের ব্যক্তিত্ত্বের যায়গায় বিন্দুমাত্র ছাড় দেন নাই। যেখানে কবির সম্মানে বিন্দুমাত্র আঘাত হতে পারে এমন স্থান তিনি মুহূর্তেই ত্যাগ করেছেন।
কবি তার দুঃখ ভুলতে গিয়ে শরাবের দারস্ত হন। একবার কবি মসজিদে নামাজ পরেই মদ খাওয়া শুরু করলে মুসল্লিরা বলেন, গালিব এটা আল্লাহর ঘর এখানে মদ না খেয়ে অন্য কোথাও খাও। কবি তাদের প্রত্যুত্তরে বলেন,
“আমাকে এখানেই মদ খেতে দাও
নইলে এমন জায়গা দেখাও যেখানে খোদা নেই”
কবির এমন জবাবে তো সবাই চুপ হয়ে গেলেন। এমন তো কোন যায়গা নেই যেখানে খোদা নেই। তার জবাব কেউ না দিতে পারলেও তার অনেক পরে মহান দার্শনিক কবি আল্লামা ইকবাল এর জবাব দেন। কবি বলেন,
“গালিব মসজিদ আল্লাহর ঘর
মদ খাওয়ার যায়গা না
কাফের অন্তরে যা
সেখানে খোদা নেই”
কবির জীবনে এরকম আরো একটি ঘটনা ঘটে যখন ব্রিটিশরা পুরো ভারত দখল করে নেয়ার পরে দিল্লির কেউ যাতে বিদ্রহ করতে না পারে তাই প্রভাবশালী সকল ব্যক্তিদের ডাকা হয়। একে একে তাদের সাথে কথা বলেন ব্রিটিশ জেনারেলরা। তখন মির্জা গালিবকেও ডাকা হয়। জেনারেল তাকে কবি হিসেবে অনেক সম্মানও দেন। এরপর তাকে জিজ্ঞেস করেন, আপনি কি হিন্দু নাকি মুসলমান? গালিব এর প্রত্যুত্তরে বলেন, আধা মুসলমান। জেনারেল তো অবাক। সে হিন্দু ও মুসলমান ধর্ম শুনেছে, আধা মুসলমান তো শুনেনি। তিনি কবিকে জিজ্ঞেস করলেন, আধা মুসলমান আবার কি? কবি জবাবে বলেন, মদ খাই কিন্তু শূকর খাই না। এভাবেই কবির শেষ জীবন ব্রিটিশ ভারতের শোষণের কালো অধ্যায় দেখে শেষ হয়েছে।
মহান এই কবি ১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৮৬৯ সালে ৭২ বছর বয়সে দিল্লিতে মৃত্যুবরণ করেন।
লেখক- মু. শফিকুল ইসলাম