মুসলিম পোর্ট

এলগরিদম, বীজগণিত এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান: মুহাম্মদ ইবনে মুসা আল-খাওয়ারিজমি

কখনো কি এই ভেবে বিস্মিত হয়েছেন যে – কোন সে ব্যক্তি যিনি বীজগণিতের যাত্রাকে সুশোভিত করেছিলেন?

তিনি ছিলেন নবম শতাব্দীর অনন্যসাধারণ মুসলিম প্রতিভা এবং একাধারে গণিতবিদ, ভূগোলবিদ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে মুসা আল-খাওয়ারিজমি। যিনি বীজগণিতের জনক হিসেবেও পরিচিত।

‘এলগরিদম’ পরিভাষাটিও ‘আল খাওয়ারিজমি’ শব্দের ল্যাটিন অনুবাদ। বিজ্ঞানী এবং গণিতবিদ মুহাম্মদ ইবনে মুসা আল খাওয়ারিজমি ( ৭৮০– ৮৫০ খ্রিস্টাব্দ) পারস্য এবং ইরাকের অধিবাসী ছিলেন।

গণিতের ক্ষেত্রে আল খাওয়ারিজমির সবচেয়ে বড় অবদান ছিল বীজগণিতের বিকাশসাধন। তার বই ‘কিতাব আল জাবর ওয়াল মুকাবালা’ ( The Compendious Book on Calculation by Completion and Balancing) প্রথম একঘাত এবং দ্বিঘাত সমীকরণ সমাধানের পদ্ধতিগত প্রক্রিয়ার ধারণা সামনে নিয়ে আসে।

‘Algebra’ পরিভাষাটি আল খাওয়ারিজমির বইটির নামে উপস্থিত আরবি শব্দ ‘আল-জাবর’ থেকে গৃহীত হয়েছে। যা সমীকরণের রাশিসমূহের এক পক্ষ থেকে অপর পক্ষে পক্ষান্তরিত হওয়ার প্রক্রিয়াকে নির্দেশ করে।

তার গ্রন্থটির নাম ‘কিতাব আল জাবর ওয়াল মুকাবালা’ সংক্ষেপে ‘আল জাবর’, যার অর্থ চলকের মান নির্ণয় এবং সহগ সমীকৃত করার কৌশল। বীজগণিত ছাড়াও আল খাওয়ারিজমি জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং ত্রিকোণমিতিতে গুরূত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।

খাওয়ারিজমির মহাকাশ সংক্রান্ত পর্যবেক্ষণ এবং হিসাব সৌরপঞ্জিকার সংস্কারে এবং নিখুঁত সময়ঘড়ি তৈরির ক্ষেত্রে অবদান রাখে। তিনি ‘জিজ আল সিন্দহিন্দ’ নামক একটি বিস্তৃত এবং নিখুঁত জ্যোতির্বিজ্ঞান -সংক্রান্ত ছক তৈরী করেন, যা সূর্য, চন্দ্র এবং গ্রহসমূহের চলন এবং গতিবিধির তথ্য দিতে পারত। ইসলামী বিশ্বের জ্যোতির্বিদদের দ্বারা এই ছকটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হত।

তাঁর এই জ্যোতির্বিদ্যা ছক ইউরোপের জ্যোতির্বিদদের মাঝেও প্রভাব সৃষ্টি করেছিল এবং মধ্যযুগের বৈজ্ঞানিক জ্ঞানতত্ত্বের অনুবাদ ও বিস্তারে গুরূত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

ত্রিকোণমিতির ক্ষেত্রে তিনি বস্তুর ছায়ার দৈর্ঘ্য নির্ণয়ের পদ্ধতি আবিষ্কার করেন, বস্তু এবং ভবনের উচ্চতা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে যার বাস্তবিক প্রয়োগ দেখা যেত।

আল খাওয়ারিজমি বাগদাদের বায়তুল হিকমাহর সাথে ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত ছিলেন, যা ইসলামী স্বর্ণযুগের সবচেয়ে গুরূত্বপূর্ণ জ্ঞানকেন্দ্র বলে বিবেচিত হতো। প্রাচীন গ্রীক, পারস্য এবং ভারতীয় জ্ঞানসমূহের সংরক্ষণ এবং অনুবাদের ক্ষেত্রে বায়তুল হিকমাহ অতুলনীয় ভূমিকা পালন করেছিল।

গণিত এবং জ্যোতির্বিদ্যায় খাওয়ারিজমির অবদান ইসলামী স্বর্ণযুগের বৈজ্ঞানিক অভিযাত্রায় ধারাবাহিকতা দান করে এবং ইউরোপের গণিত ও বিজ্ঞানের জ্ঞানতাত্ত্বিক বিকাশেও বড় ধরণের প্রভাব ফেলে। দ্বাদশ শতকে ল্যাটিন ভাষায় তাঁর কাজগুলোর অনুদিত হওয়ার মাধ্যমে ইউরোপীয় পন্ডিতরা তাঁর বৈজ্ঞানিক চিন্তার সাথে পরিচিত হন। যা পরবর্তীতে রেনেসাঁ এবং বিজ্ঞানের বিপ্লব যাত্রায় গুরূত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

একইসাথে আল খাওয়ারিজমির বীজগণিতের বইয়ে ব্যবহারিক প্রয়োগ যেমন উত্তরাধিকার সম্পত্তি এবং জমি-জমার বিভাজন পদ্ধতি, ব্যবসায়িক লেনদেনের আনুপাতিক হিসাবনিকাশ ইত্যাদির আলোচনা রয়েছে।

তাঁর জ্ঞানগত প্রভাব গণিত এবং জ্যোতির্বিদ্যাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। আল খাওয়ারিজমির ভূগোলের উপর লিখিত গ্রন্থ ‘কিতাব সুরাত আল-আরদ’ এ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল সম্বন্ধে মানচিত্রসমেত বর্ণনা দেওয়া ছিল, যা ভূগোলবিদ্যায় একটি দারুন প্রভাবশালী কাজ হিসেবে বিবেচিত হত।

আল খাওয়ারিজমের নামটিই ‘এলগরিদম’ এর সমর্থক হয়ে দাড়িয়েছিল, যা তার নামের ল্যাটিন রূপ ‘Algoritmi’ শব্দটি থেকে নেয়া। যা গণিত এবং কম্পিউটার বিজ্ঞানের সাথে জড়িত ‘এলগরিদম’ এর ভিত্তি প্রতিষ্ঠাকারী হিসেবে তার অবদানকেই নির্দেশ করে।

কম্পিউটার বিজ্ঞানের পরিভাষায় এলগরিদম শব্দটি একসেট সুনির্দিষ্ট নির্দেশনার সমষ্টি অথবা একটি সমস্যার সমাধান বা কোন কাজ সম্পন্ন করতে পর্যায়ক্রমিক প্রক্রিয়াকে নির্দেশ করে।

আল খাওয়ারিজমির গাণিতিক সমস্যা এবং সমীকরণ সমাধানের ধারণা আধুনিক বীজগাণিতিক তত্ত্বের ভিত্তিমূল রচনা করে দেয়, যা তাকে বীজগণিতের বিকাশায়নে একজন অতীব গুরূত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

আল খাওয়ারিজমি ইসলামী স্বর্ণযুগের অন্যতম সেরা গণিতবিদ এবং জ্যোতির্বিদদের একজন হিসেবে ব্যাপকভাবে স্বীকৃত। বীজগণিত এবং জ্যোতির্বিদ্যার ক্ষেত্রে তাঁর মৌল অবদান পরবর্তীতে গণিত এবং বিজ্ঞানের অগ্রগতির ক্ষেত্রে বুনিয়াদ নির্মাণ করে দিয়েছে।

লেখক- আব্দুল্লাহ আল মারজুক