মুসলিম পোর্ট

আজ ১৫ মে ২০২৫, ঐতিহাসিক নাকবার বয়স ৭৭ বছর পূর্ণ হলো।

ফিলিস্তিনিরা এখনোও তাদের দেশে ফিরে আসার স্বপ্ন দেখে।

১৯৪৭ থেকে ১৯৪৮ সাল—এ সময়টিতেই ইসরাইলের অস্তিত্ব শুরু হয়। তখন থেকে তারা ফিলিস্তিনিদের ওপর নিপীড়ন ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে আসছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে বাধ্যতামূলকভাবে ফিলিস্তিনকে ভাগ করে দেয়া হয়েছে। তখন মধ্যপ্রাচ্যের সীমান্তকে নতুন করে পুনর্বিন্যাস করে জাতিসংঘ ও বিশ্বশক্তিগুলো।

কিন্তু এই পরিকল্পনায় সাধারণ মানুষের মতামত গ্রাহ্য করা হয়নি। ফিলিস্তিনের মধ্যেই একটি ইহুদি রাষ্ট্রের ভিত্তি ধরে ১৯৪৭ সালের ২৭ নভেম্বর জাতিসংঘে একটি প্রস্তাব পাস করা হয়। প্রস্তাবটি পাস হওয়ার আগে ইহুদিদের ভূমি ছিল মাত্র ছয় শতাংশ। জনসংখ্যায় ফিলিস্তিনিরা ছিলেন ৬০ শতাংশ, ইহুদিরা ৩২ শতাংশ। বাকিরা আট শতাংশ। কিন্তু ভূখণ্ড ভাগ হওয়ার সময় ইহুদিদের দেয়া হয় ৫৫ শতাংশ, ফিলিস্তিনিদের ৪৫ শতাংশ, আর তিন শতাংশ থাকে আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণে।

নাকবায় ১৫ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত ও আট লাখ বাস্তুচ্যুত হন। ৪১৮টি গ্রাম ও শহরে জাতিগত নিধন চালানো হয়। আর দেড় লাখ ফিলিস্তিনি নিজ ভূখণ্ডের মধ্যেই বাস্তুচ্যুত হন। ৭৮ শতাংশ ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় ইহুদিদের হাতে।

ঐতিহাসিক ফিলিস্তিন থেকে যেসব বাসিন্দা তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে, তারা আর কখনো নিজ ভূখণ্ডে প্রবেশ করতে পারেননি। ৭৫ বছরেও তাদের বংশধরেরা গাজা, পশ্চিমতীর ও বিভিন্ন দেশের শরণার্থী শিবিরে বসবাস করছেন। ফিলিস্তিনি জনসংখ্যার ৭৪ শতাংশ বর্তমানে শরণার্থী জীবন যাপন করছেন।

স্থানীয় এক প্রবীণ ফিলিস্তিনির সাক্ষাৎকারে উঠে আসে-

গত ৭৫ বছর ধরে স্থানীয় উমর খাত্তাব দৌলা, গাজা শহরের পশ্চিমে আল-শাতি নামক ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় একটি শরণার্থী শিবিরে বসবাস করছেন।

৮৮ বছর বয়সী এই ব্যক্তি এখনও উপকূলীয় শহরে ফিরে আসার স্বপ্ন দেখেন।

এক সময় ‘সমুদ্রের বধূ’ নামে পরিচিত ফিলিস্তিনি শিল্প ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র “জাফা” যা ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের সময় সবচেয়ে বড় ফিলিস্তিনি শহর ছিলো।

জায়োনিস্টরা ১৯৪৮ সালে জাফার জনসংখ্যার ৯৫% মানুষকে বাস্তুচ্যুত করছে। নাকবা পরবর্তী যাদের বেশিরভাগই নৌকায় করে গাজা, মিশর বা লেবাননে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল।

উমর খাত্তাব স্মৃতিকাতর হয়ে বলেন “জাফা শহরের এমন কোন ভূমি ছিলোনা যেখানে আমাদের বিচরণ ছিলোনা! আমার এখনো মনে আছে, আমি ছোট থাকা অবস্থায় আমি আমার চাচাতো ভাইদের সাথে একটি নৌকায় চড়ে কাছাকাছি লেবাননের সাইদাতে যেতাম, সেখানে আমার আমার লেবানি দাদী বসবাস করতেন।

আমরা দাদীর সাথে সকালের নাস্তা করতাম এবং তারপর সন্ধ্যায় জাফাতে ফিরে আসতাম। এটা সত্যিই অসাধারণ একটি সময় ছিল।”

উমর বলেন-
“জাফা ছিলো একটি মিশ্র মহাজাগতিক শহর। আমার খুব ভালোভাবে মনে আছে, আমরা আমাদের ইহুদি এবং খ্রিস্টান প্রতিবেশীদের সাথে একত্রে মিলেমিশে বসবাস করতাম। আমাদের একজন ইহুদি মহিলা প্রতিবেশী ছিলো যার নাম সোনিয়া, আমার মা যখন কোন কারণে বাসায় থাকতে পারতোনা বা বাহিরে থাকতো তখন সে আমার ভাই, বোন,এবং আমার দেখাশোনা করতো।”

তিনি আরও বলেন যে, জাফার জীবন আর গাজার জীবনধারা সম্পূর্ণ আলাদা ছিলো।

তিনি তার অভিব্যক্তি এভাবেই ব্যক্ত করেন,

“তোমাকে কি বলব, আমার ছেলে! শরণার্থী শিবিরের জীবন এমনই এক দুর্বিষহ এবং কষ্টে কেটেছে, যেখানে অবমূল্যায়ন এবং দারিদ্র ছিলো আমাদের নিত্যকার সঙ্গী…”

তিনি জাফা থেকে চলে যাওয়ার পর তার পরিবার মধ্য গাজার আল-মাগরাজি ক্যাম্পে পৌঁছানোর পূর্বে মিশরীয় উপকূলীয় শহর কানতারাতে এবং তারপরে আল-শাতিতে যায়।

তার পাঁচ ছেলে এবং দুই মেয়ে রয়েছে এবং তার এখন ৮০এর বেশি নাতি-নাতনি রয়েছে। তিনি জাফার আঞ্চলিক ভাষায় কবিতা আবৃত্তি করার জন্য অনেক সুপরিচিত। তার ছন্দময় আবৃত্তিতে তার নিজের শহর এবং ফিলিস্তিনের প্রতি নস্টালজিয়াকে সম্বোধন করে।

তার আবৃত্তির একাংশ এমন ছিলো,

“হে আমার ফিলিস্তিন! আমরা আপনার নিকট ফিরে যাচ্ছি, আমরা ফিরে আসছি, আপনার সূর্য, আপনার সমুদ্র এবং আপনার গাছ উপভোগ করতে।”

উমর খাত্তাব বলেন যে, ১৯৮০ বা ৯০ এর দশকের শুরুতে আমি জাফাতে আমার পরিবারের বাড়ি দেখতে গিয়েছিলাম কিন্তু আমি অবাক হয়েছিলাম যে এটি একদমই অপরিচিত ছিলো এবং বাড়িটি ছিলো ইজরায়েলিদের দ্বারা পরিপূর্ণ।

অনেক ফিলিস্তিনিদের মতো তিনি এখনো তার বাড়ির চাবিটি বহন করেন যা এখন নুজা পাড়ায় তার আগের বাড়িতে মরিচা পড়ে আছে।

ইহুদিবাদী মিলিশিয়াদের দ্বারা নাকবার সময় প্রায় ৫৬০ টি ফিলিস্তিনি গ্রাম এবং শহর ধ্বংস করা হয়েছিল এবং হাজারো ফিলিস্তিনিকে নিজেদের পৈতৃকভূমি ছাড়তে বাধ্য করেছিলো।

তিনি তার আক্ষেপ প্রকাশ করতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন এবং বলেন যে “এটা সত্য যে আরব দেশগুলোর আতিথেয়তা আমাদের মুগ্ধ করেছে এবং আমাদের সাথে অনেক ভালো ব্যবহার করেছে কিন্তু আমাদের মাতৃভূমি ফিলিস্তিনের চেয়ে বড় আর কোনো জায়গা আমাদের নেই।”

জাতিসংঘের তথ্য থেকে জানা যায় যে ১৯৪৮ সালে প্রায় ৭ লক্ষ ফিলিস্তিনি তাদের শহর এবং গ্রাম থেকে বাস্তুচ্যুত হয়েছিলো।

গাজা উপত্যকায়, অধিকৃত পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম, সিরিয়া, লেবানন, জর্ডান এবং মিশরে জাতিসংঘ-নিবন্ধনকৃত ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের সংখ্যা প্রায় ৫.৬ মিলিয়ন। যদিও প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি বলে ধারণা করা হয়।

ফিলিস্তিনিরা গোটা বিশ্বব্যাপী তাদের ব্যাপক বাস্তুচ্যুতির (নাকবা) ৭৫ তম বার্ষিকী উপলক্ষে ১৫ই মে একত্রিত হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে । তারা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে যে, যারা নাকবা থেকে বেঁচে গেছে, একদিন তারা আবার অবশ্যই তাদের স্বদেশে বিচরণ করবে।

উমর খাত্তাব বলেন, “আমি অবশ্যই কোন একদিন আমার মাতৃভূমি জাফায় ফিরে যাবো এবং সেখানে বিচরণ করবো, এমনকি

সেখানে ফিরে যেতে আমার কোনো সমস্যা হবে না।

আমি বিশ্বাস করি সেখানে ফিরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমি বেঁচে থাকব…”

সংকলক- আব্দুল্লাহ আল মুইন।