মুসলিম পোর্ট

রাশিয়ার মুসলিম অধ্যুষিত ককেশাসের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের এক প্রাচীন মুসলিম জনগোষ্ঠীর নাম সার্কাসিয়া। যারা অঞ্চলটিতে ইসলাম আগমন পরবর্তী সময় থেকে একটি সমৃদ্ধ মুসলিম প্রধান গোষ্ঠী হিসেবে বসবাস করে আসছিল। তবে ১৭২১ সালে রুশ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর থেকে ককেশাস ও সার্কাসিয়া বিশেষভাবে সাম্রাজ্যের চক্ষুশূলে পরিনত হতে থাকে। ফলে, মুসলিম সার্কাসিয়ানদের নির্মূলের রুশ সাম্রাজ্য ১৭৬৩ সালের ১০শে জুলাই এক দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সূত্রপাত করে। যে যুদ্ধটি পরবর্তী ১০১ বছর পর্যন্ত পরিচালনা করে রুশ বাহিনী।  ১৮৬৪ সালের ২২শে মে যুদ্ধটির আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটলে এই দিনটিকেই স্থানীয়রা সার্কাসিয়ান গণহত্যা দিবস হিসেবে স্মরণ করে থাকে।

ককেশাস অঞ্চলে রাশিয়ান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সার্কাসিয়ানদের দীর্ঘ এই ১০১ বছরের প্রতিরোধের পর অবশেষে রাশিয়ান সেনাবাহিনী এই অঞ্চলকে পরাজিত করতে দখল করে নেয়। ফলাফল যাই হোক না কেন, সার্কাসিয়ানরা এই সশস্ত্র বাহিনীর এমন অবিশ্বাস্য প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলো যা আজও গোটা বিশ্বকে ভাবিয়ে তুলতে বাধ্য করবে।

আর এইসকল কারণেই রাশিয়ানরা এই অঞ্চলে বিজিত হওয়ার পর সার্কাসিয়ানদেরকে বিতাড়িত করার জন্য একটি অভিযান শুরু করেছিলো যা সার্কাসিয়ান গণহত্যা নামে গোটা বিশ্বেই পরিচিত হয়ে আছে।

গোটা বিশ্বে ১৮৬৪ সালে সার্কাসিয়ানদের উপর চালানো এই গণহত্যাকে মানব সভ্যতার ইতিহাসের ভয়াবহ গণহত্যাগুলোর একটি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। রাশিয়ান সেনাবাহিনী সার্কাসিয়ানদের সম্পদের লুন্ঠন থেকে শুরু করে, নির্বাসন এবং নির্বিচারে হত্যা সকল কিছুই করেছে।

তাদের চিন্তাটা এমন ছিলো যেন “অঞ্চল বিজিত করো এবং অস্তিত্বকে বিলীন করো”

রাশিয়ান সেনাবাহিনী তাদের কার্যক্রমগুলোও এই ভাবনা থেকেই পরিচালনা করেছে এবং সেই আলোকেই কাজ করেছে।

গণহত্যার পূর্বে সেখানে প্রায় ১০লক্ষ মানুষ বসবাস করতো কিন্তু গণহত্যার পর সেখানে মাত্র ৮০,০০০ মানুষ ব্যাতীত সবাইকে জোড়পূর্বক নির্বাসনে পাঠিয়েছিলো না হয় হত্যা করেছিলো।

সেসময় প্রতিষ্ঠিত ওসমানী সালতানাতের এক সংরক্ষণাগার থেকে পাওয়া যায়-

১৮৭৯ সালের গণনাসূচক মোতাবেক, প্রায় ১৫ লক্ষ সার্কাসিয় মুসলিম নাগরিক ওসমানী অঞ্চলে শরনার্থী হিসেবে আশ্রয়াবস্থায় বসবাস করছিল।

সেখানে আরো আরো উল্লিখিত হয়, সেই ১০১ বছরে প্রায় সাড়ে পাঁচ লক্ষ সার্কাসিয়ান মুসলিমকে হত্যা করে রুশ সাম্রাজ্য।

রাশিয়া-সার্কাসিয়া যুদ্ধের চিত্র

★ গণহত্যা সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ ১০টি প্রশ্ন-

১। সার্কাসিয়ান কারা?

-সার্কাসিয়ানরা হলো ককেশাস অঞ্চলের মুসলিম জনগোষ্ঠী যারা পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে ইসলামকে একমাত্র ধর্ম হিসেবে মেনে আসছে। যদিও তার আগে এই অঞ্চলের বেশিরভাগই খ্রিষ্টান ধর্মের অনুসারী ছিলো।

২। ককেশাস অঞ্চলে রাশিয়ানরা কতদিন অভিযান চালনা করে?

-অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে ১৮৬৪ সাল পর্যন্ত রাশিয়ান সেনাবাহিনী ককেশাস অঞ্চলকে তাদের নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য অভিযান চালায়। এবং গণহত্যাটি বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে আছে- ৬ই মার্চ থেকে ২১ই মে ১৮৬৪ সালে রুশ বাহিনীর দ্বারা পরিচালিত ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের ফলে।

৩। সার্কাসিয়ানরা এত দীর্ঘ সময় ধরে কিভাবে প্রতিরোধ গড়েছিলো?

-সার্কাসিয়ানরা ছিলো মুসলিম ধর্মের অনুসারী তাই তারা একটি বিদেশি খ্রিষ্টান বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে নারাজ ছিলো।

এবং তারা পরবর্তীতে চেচনিয়া এবং দাগেস্তানের বাহিনীর সাথেও একত্রিত হয়ে জোট গঠন করে।

৪। ককেশাস অঞ্চলকে বিজিত করার জন্য কে এই গণহত্যার পরিকল্পনা করেছিলো?

-১৮৬১ সালে দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের যুদ্ধমন্ত্রী কাউন্ট দিমিত্রি মিল্যুতিন ১৮৫৪ সালের উপস্থাপিত কৌশলকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এই পরিকল্পনাটি গ্রহণ করা হয়েছিলো।

৫। কতজন সার্কাসিয়ানকে হত্যা করা হয়েছিলো?

-রাশিয়ান সরকারের তথ্য অনুযায়ী রাশিয়ান সেনাবাহিনীর চূড়ান্ত বিজয় অভিযানের জন্য পাঁচ লক্ষাধিক সার্কাসিয়ান মুসলিমকে হত্যা করা হয়েছিলো।

৬। কতজন সার্কাসিয়ান বাস্তুচ্যুত হয়েছিলো?

-গণহত্যার পাশাপাশি প্রায় পনেরো লক্ষ সার্কাসিয়ানকে জোড়-পূর্বক বাস্তুচ্যুত করা হয়েছিলো।

৭। সার্কাসিয়ানদের কোথায় পাঠানো হয়েছিলো?

-সার্কাসিয়ানদেরকে উসমানী খিলাফতের অধীনে পাঠানো হয়েছিলো, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ সোচি বন্দর থেকে বের হওয়ার পর বেশিরভাগই অনাহারে অথবা কৃষ্ণ সাগরে ডুবে মৃত্যুবরণ করে।

৮। কতজন সার্কাসিয়ান আজও বেঁচে আছে?

-তুরস্ক এবং সিরিয়ায় প্রবাসী এই জনগোষ্ঠীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।

গোটা বিশ্বব্যাপী প্রায় দশ লক্ষ সার্কাসিয়ান বেঁচে আছে।

৯। ১৮৬৪ সালকে রাশিয়া কিভাবে দেখে?

-রাশিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের এই অভিযানকে গণহত্যা বলে অস্বীকার করে থাকে।

তবে যাইহোক, রাশিয়ার অনেক নাগরিক এখনোও রাশিয়ার সার্কাসিয়ানদের উপর চালানো এই অভিযানকে অত্যন্ত ধ্বংসাত্মক একটি বিষয় হিসাবে স্বীকৃতি দেয়।

এমনকি, পৃথিবীর একমাত্র দেশ হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে এই গণহত্যার স্বীকৃতি দিয়েছে শুধুমাত্র জর্জিয়া।

১০। সার্কাসিয়ানরা কিভাবে তাদের এই ইতিহাসকে স্মরণ করে?

-সার্কাসিয়ানরা প্রতিবছর ২২ই মে তাদের এই এই ইতিহাসকে স্মরণ করে এবং বিভিন্নভাবে তারা তাদের এই দিনটিকে পালন করে থাকে।

এই ঘটনাগুলোকে আন্তর্জাতিকভাবে গণহত্যা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

এই ঘটনাগুলো থেকে স্পষ্ট হয় যে রাশিয়ান সেনাবাহিনীর গৃহীত পদক্ষেপগুলি মূলকারণ ছিলো ককেশাস অঞ্চল থেকে সার্কাসিয়ানদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া যাতে তারা (রাশিয়ান) একক রাজত্ব লাভ করতে পারে এবং কোন গোষ্ঠী যেন তাদের শাসনে বাধার সৃষ্টি করতে না পারে।

সার্কাসিয়ান গণহত্যাকে রাশিয়ান সরকারের স্বীকৃতি না দেওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে রাশিয়ার রাজনৈতিক ইস্যু।

কেননা যদি রাশিয়ান সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে সার্কাসিয়ান গণহত্যাকে স্বীকৃতি দেয়, তাহলে সম্ভবত সার্কাসিয়ান অভিবাসীরা তাদের পূর্বপুরুষদের দেশ থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল সেখানে ফিরে যাওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করবে।  এবং এর ফলে ককেশাস অঞ্চলের জনসংখ্যা ও ক্ষমতার ব্যাপক পরিবর্তন হতে পারে যা রাশিয়ার জন্য এক প্রকারের হুমকিতে পরিণত হবে।

অনুবাদঃ আব্দুল্লাহ আল মুঈন