ভারতের ইতিহাসে ১৮ তম লোকসভা নির্বাচন শুরু হয়েছে গত শুক্রবার ১৯শে এপ্রিল। সাতটি ধাপে ভারতের অষ্টাদশ ‘লোকসভা নির্বাচন ২০২৪’ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সাতটি ধাপে সব আসনের নির্বাচন শেষ হওয়ার পর একসঙ্গে সব আসনের প্রাপ্ত ব্যালট গণনা করা হবে। ছয়টি বিরতিতে ৭টি ধাপের সব নির্বাচন ১ জুন পর্যন্ত এই ভোট গ্রহণ চলবে এর শেষে ফলাফল পাওয়া যাবে আগামী ৪ জুন। রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মনোনীত সংসদ সদস্যদের জন্য সংরক্ষিত ২টি আসন সহ ভারতের লোকসভার মোট আসন সংখ্যা ৫৪৫টি। ৫৪৩টি আসন সাধারণ ভোটে নির্বাচিত এবং ২টি আসন রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মনোনীত সংসদ সদস্যদের জন্য সংরক্ষিত। ভারতের মোট জনসংখ্যার একটি অনুমিত সংখ্যা ১৪৪ কোটি ১৭ লাখ ১৯ হাজার ৮৫২ তত্মধ্যে ভোটার সংখ্যা প্রায় ৯৭ কোটি। প্রথম ধাপের নির্বাচনে ১৭টি রাজ্য ও ৪টি ইউনিয়ন সহ মোট ১০২ টি আসনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। ১৯ এপ্রিল অনুষ্ঠিত প্রথম দফার ভোটে গড়পড়তা ৬৩% ভোটারের অংশগ্রহণ ছিল।
এবারের (২০২৪) নির্বাচন টানা গত দুবারের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জন্য তৃতীয়বার সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে হ্যাটট্রিক ও ইন্ডিয়া জোটের জন্য মোদিকে থামানোর চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে বলে জানিয়েছে ভারতীয় বিভিন্ন গনমাধ্যম।
ভারতের লোকসভা নির্বাচনী ফলাফলের ওপর বহু জরিপ নানা সংস্থা ও বিভিন্ন গণমাধ্যম চালিয়ে যাচ্ছে। ২০২৪ সালের মার্চ ও এপ্রিল এ দুই মাসের মধ্যে সম্পাদিত ৫টি সংস্থার ৮টি জরিপ পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, যে সব জরিপেই নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বের এনডিএ বা বিজেপি (ভারতীয় জনতা পার্টি) জোট বিপুল ব্যবধানে এগিয়ে আছে এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস মোট প্রাপ্ত ভোট ও আসন দুই দিক দিয়েই পেছনে রয়েছে। প্রতি আসনে এনডিএ জোটের ভোট প্রাপ্তির ইঙ্গিত সর্বোচ্চ ৫২% এবং সর্বনিম্ন ৪২ দশমিক ৬%।
সেখানে কংগ্রেস নেতৃত্বের ‘ইন্ডিয়া’ জোটের ভোটপ্রাপ্তির হার সর্বাধিক ৪২ ও সর্বনিম্ন ৩৯ দশমিক ৮%। আসনের হিসাবে এনডিএ জোটের অবস্থান ৫৪৩ আসনের মধ্যে ৪১১ থেকে ৩৭৩ -এর মধ্যে এবং ইন্ডিয়া জোট ১৫৫ থেকে ১০৫ মধ্যে ওঠানামা করেছে। এই দুই জোটের বাইরের দলগুলোর ভোট ২০-৬% এবং আসনসংখ্যা ৪১ থেকে ২১ -এর মধ্যে দেখা যাচ্ছে।
ভারতে এর আগের ১৭টি নির্বাচনের মধ্যে দুটি ছিল উল্লেখযোগ্য। একটি হলো ১৯৫১-৫২ সালের প্রথম নির্বাচন, আরেকটি ১৯৭৭ সালের নির্বাচন। এ বছরের নির্বাচনটাও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এর ফলাফলের ওপর নির্ভর করছে নরেন্দ্র মোদির কর্তৃত্ববাদের ইতি ঘটবে, নাকি সীমা ছাড়াবে।
মোদির হিসাবের সাফল্য নির্ভর করছে দেশের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের ওপর, যা এখন পর্যন্ত বিজেপির হিন্দু সংখ্যাগুরুবাদী আকর্ষণের কাছে অনেকাংশেই অভেদ্য রয়ে গেছে: দেশের দক্ষিণাঞ্চল। দেশের জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশের আবাসস্থল, পাঁচটি দক্ষিণের রাজ্য তামিলনাড়ু, কর্ণাটক, অন্ধ্র প্রদেশ, কেরালা এবং তেলেঙ্গানা এবং পুদুচেরি ও লাক্ষাদ্বীপের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলি ভারতের সবচেয়ে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ অঞ্চল গঠন করে। দেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ৩০ শতাংশের বেশি অবদান রাখে দক্ষিণাঞ্চলের অবদান।
কিন্তু মোদির বক্তব্য যে তাঁর সরকার ভারতীয় অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে সাহায্য করেছে, তবুও বিজেপি ২০১৯ সালে এই অঞ্চল থেকে ১৩১টি আসনের মধ্যে মাত্র ৩০টি আসন জিতেছিল – এর বেশিরভাগই একটি রাজ্য কর্ণাটক থেকে পেয়েছিল। তামিলনাড়ু, কেরল ও অন্ধ্রপ্রদেশে ভোট পেয়ে পুদুচেরি ও লাক্ষাদ্বীপ আসনে হেরে যায় তারা। কিছু বিশ্লেষক মনে করেন, এর পুনরাবৃত্তি ও হতে পারে।
অন্য এক গবেষণায় এসেছে, অন্ধ্রপ্রদেশ ও দক্ষিণের অন্যান্য রাজ্যে বিজেপি খুবই জনপ্রিয় নয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং নয়াদিল্লিভিত্তিক থিংক ট্যাংক সেন্টার ফর পলিসি অ্যানালাইসিসের (সিপিএ) চেয়ারম্যান মোহন গুরুস্বামী বলেন, বিজেপির সঙ্গে যারাই জোট বেঁধেছে তারা এই নির্বাচনে খারাপ ফল করবে।
ভারতের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের স্বামী অর্থনীতিবিদ পরাকালা প্রভাকর বলেন, আসন্ন নির্বাচনে ‘উত্তর-দক্ষিণ বিভাজন’ প্রতিফলিত হবে। প্রভাকর সরকারের সমালোচক ছিলেন যার স্ত্রী একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য।
ভারতের দক্ষিণে বিজেপির এ লড়াই নতুন নয়। উত্তরের তুলনায় শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সহ উন্নয়ন সূচকগুলি যথেষ্ট ভাল হওয়ায় এই অঞ্চলটি ঐতিহ্যগতভাবে বিজেপির বৈশিষ্ট্যযুক্ত ধর্ম-চালিত রাজনীতি থেকে তুলনামূলকভাবে মুক্ত হয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, দক্ষিণের রাজ্য কেরালায় শিশুমৃত্যুর হার প্রতি এক হাজার জন্মের মধ্যে ছয়জন, যা প্রায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমান। অন্যদিকে বিজেপি শাসিত মধ্যপ্রদেশে এই সংখ্যা ৪৮, যা যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের সমান।
প্রভাকর আরো বলেন, এই আপেক্ষিক উন্নয়ন অর্জনগুলি বিজেপির হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠবাদী হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শকে দক্ষিণে কম টানতে বাধ্য করেছে। দক্ষিণে কয়েকশো বছর ধরে সমস্ত ধর্মের মধ্যে সম্প্রীতিপূর্ণ সহাবস্থানের ঐতিহ্য রয়েছে। সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের প্রচেষ্টা অবশ্যই দক্ষিণে বিপরীত ফল দেবে বলে বিশ্লেষকরা ধারণা করেন। মোদি এসব কারনে দক্ষিণের সর্ববৃহৎ রাজ্য তামিলনাড়ুকে বেশ বিভিন্ন কায়দায় ভাঙনের চেষ্টা চালিয়েছে। যেখানে রয়েছে ৩৯ টি আসন, যা দক্ষিণ থেকে জাতীয় আইনসভায় সংসদ সদস্যদের বৃহত্তম দল পাঠায়। তাই বলা যায়, মোদির এই হিন্দুত্ববাদের অবসান ঘটবে কিনা তা নির্ভর করছে দক্ষিনের উপর।
১৯৭৭ সাল থেকে শুরু করে ২০১৪ সাল পর্যন্ত নয়াদিল্লীর গদিতে কোনো একক দল বা জোট পর পর দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। মোটের ওপর ভারতের গণতন্ত্রের জন্য সেটা আশীর্বাদই হয়ে দাঁড়ায়। কর্তৃত্ববাদের অনুপস্থিতিতে মুক্ত সংবাদমাধ্যমের বিকাশ ঘটে, আইন-আদালত স্বাধীনভাবে কাজ করতে থাকে। ভারতের আলাদা আলাদা রাজ্যগুলোও নিজ নিজ উন্নতির পেছনে মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ পায়। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই উন্নতির ধারা উল্টে দিতে পারে এ বছরের নির্বাচন।
নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টি তথা বিজেপি এবছর আবারও ক্ষমতায় আসছে, এ ব্যাপারে নিশ্চিত অনেকেই। এতে কী হবে? পরকাল প্রভাকর নামের এক বিশেষজ্ঞের মতে, এরপর দেশে আর কোনো নির্বাচন হবে না।
বিজেপির বিরুধী কংগ্রেস নেতা বলেন, মোদি এই ১০ বছরে একটা ‘স্কুল অফ করাপশন’ চালিয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ, বিজেপি যায়নবাদ ও হিন্দুত্ববাদের কঠোর নীতি চালিয়ে যাচ্ছে মুসলমান জনসংখ্যার উপর।
এটা ঠিক যে মোদিও ইন্দিরা গান্ধীর মতো কর্তৃত্ববাদী ছিল। কিন্তু এই দুই শাসকের শাসনামলের মাঝে পার্থক্য আছে। ইন্দিরা গান্ধীর সময়ে শুধু তামিল নাড়ু ছাড়া সব রাজ্যেই কংগ্রেস ক্ষমতায় ছিল। এমনকি তামিল নাড়ুর মুখ্যমন্ত্রীও কেন্দ্রের পক্ষেই ছিলেন। এদিকে ২০২৪ সালে এসে দেখা যাচ্ছে দক্ষিণ ভারতের কোনো রাজ্যেই ক্ষমতায় নেই বিজেপি। এমনকি পূর্ব ও উত্তর ভারতেও কিছু রাজ্য তাদের হাতছাড়া হয়ে আছে। এ কারণে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা হস্তগত করাটা মোদির জন্য অতটা সহজ হবে না।
মোদির সরকার লোকসভার পুরো ৩৭০টি আসন দখল করলেও তামিল নাড়ু, কেরালা, পশ্চিমবঙ্গ, তেলেঙ্গানা এমন কিছু রাজ্য তাদের ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে যাবে বলে বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তির বিশ্বাস। ক্ষমতা হস্তগত করতে মোদি এবং অমিত শাহের সামনে তখন দুটো পথ খোলা- এক, ৩৫৬ ধারা চাপিয়ে দিতে হবে অথবা দুই, টাকা দিয়ে নীতিনির্ধারকদের কিনে নিতে হবে।
তবে যে পথই তারা বেছে নিক না কেন, লাখ লাখ জনতা মোদির বিরুদ্ধে থেকেই যাবে। কারণ একটাই- বিজেপির হিন্দুত্ববাদ।
মোদি স্পষ্টত একটি বিপজ্জনক খেলা খেলছেন। নির্বাচনকে হিন্দু-মুসলমানের লড়াইয়ে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করছেন তিনি। আর বিজেপি নেতারা প্রকাশ্যে দলটিকে ‘হিন্দুদের দল’ বলছেন। মোদির বক্তব্যগুলো বিশ্লেষণ করলে এটাই বোঝা যায়, তিনি শুধু হিন্দুদের বিজেপির ভোটার হিসেবে ভাবছেন। দলের অন্য নেতারাও এমনটাই ভাবছেন। নরেন্দ্র মোদীর দল তথা ভারতে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) বিরুদ্ধে অতীতেও বহুবার দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু, বিশেষ করে মুসলিমদের আক্রমণের নিশানা করার অভিযোগ উঠেছে।
মোদি ও বিজেপির মতে, মুসলমানদের সঙ্গে মিলে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে বিরোধী দল কংগ্রেস। এর প্রধান উদ্দেশ্য হলো হিন্দুদের সম্পদ ও অধিকার কেড়ে নিয়ে মুসলমানদের হাতে তুলে দেওয়া। এ জন্য ভারতীয় ভূখণ্ডে হিন্দুরা বিপদের মুখে রয়েছেন। অথচ মোদি তাঁর ১০ বছরের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় মুসলমানদের উপর নানাভাবে অত্যচার নিপীড়ন চালিয়েছে।
৩২ বছর বয়সী সাদ্দাম হুসেন নামে একজন ভোটার বলেন, ‘আমরা ১০ বছর ধরে বিজেপিকে দেখেছি। আমরা শুধু ঘৃণামূলক বক্তব্য, মিথ্যা ও অপূর্ণ প্রতিশ্রুতি দেখেছি। তারা (বিজেপি) ধর্মের নামে দেশ ও মানুষকে বিভক্ত করেছে।’
গত দশ বছর মোদির ক্ষমতাকালে ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনতা, বিশেষ করে মুসলিমরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। জীবনের পদে পদে বৈষম্যের মুখে পড়ছে তারা। মুসলিমদের বিভিন্নভাবে কটাক্ষ করে বক্তব্য দেওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ উৎসাহ দেখা যায় বিজেপির নেতা কর্মীরা। এমনকি হিন্দু ছাড়া অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি বিদ্বেষ ছড়াতে পাল্টে ফেলা হয়েছে স্কুলের বইগুলোকেও।
তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এলে মোদির এই মুসলিমবিদ্বেষ বাড়বে বলে সবাই ধারণা করেন। অন্যদিকে কমবে সংবাদপত্র ও আদালতের স্বাধীনতা, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয়ে উঠবে হিন্দুত্ববাদের প্রোপাগাণ্ডা ছড়ানোর সূতিকাগার, মোটের ওপর ভারতের গণতন্ত্রে আঘাত পড়বে। মোদি আর বিজেপি ক্ষমতায় গেলে এই অনুপাত আরও কমবে, গণতন্ত্রের ক্ষয় হবে আরও কিছুদুর।
১৯৭০ এর দশকে ইন্দিরা গান্ধীর কর্তৃত্ববাদের সাথে যুক্ত হয়েছিল পরিবারভিত্তিক রাজনীতি। আর এখন মোদির কর্তৃত্ববাদের সাথে যুক্ত হয়েছে হিন্দুত্ববাদ। এর পরিণতি হতে পারে আরও ভয়াবহ। রাজনীতির ভেতরে ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে যেতে পারে ঘৃণা, বিদ্বেষ। এর প্রসার ঠেকাতে পারে এই নির্বাচন। আর সে কারণেই ১৯৭৭ সালের পর এটাই ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন।
নরেন্দ্র মোদীর দল তথা ভারতে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) বিরুদ্ধে অতীতেও বহুবার দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু, বিশেষ করে মুসলিমদের আক্রমণের নিশানা করার অভিযোগ উঠেছে।
– আলী মোর্শেদ সানী