চেচনিয়া, আহত মুসলিম উম্মাহর বুকে সম্মান ও বীরত্বের এক টুকরো গর্বিত ভূমি। অর্থোডক্স খ্রীস্টশক্তির আগ্রাসন এবং কমিউনিস্টদের হাত থেকে স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে বীরত্ব ও আত্মত্যাগের যে অনন্য নজীর চেচেন মুসলিমগণ উপস্থাপন করেছেন বিশ্ব ইতিহাসে তার তুলনা মেলা ভার। প্রায় ৪ শতাব্দী ব্যাপী সম্মান, বীরত্ব ও আত্মত্যাগের এই সুদীর্ঘ পথে যারা জাতিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের অন্যতম হলেন- শেখ মনসুর, মাওলানা কাজী মোহাম্মদ, কিংবদন্তি বীর ইমাম শামিল এবং পরবর্তীকালে প্রেসিডেন্ট জওহর দুদায়েভ, আসলান মাসখাদভ, শামিল ভাসায়েভ, সেলিম খান এবং আমির খাত্তাব প্রমুখ বীরগণ। রক্ত দিয়ে এই বীরেরা লিখেছিলেন স্বাধীনচেতা এই জাতির গৌরবের ইতিহাস। অসীম ক্ষীপ্রতায় চূর্ণ করেছিলেন পরাশক্তিধর রাশিয়ার দম্ভ। ইমানী শক্তিতে বলিয়ান স্বল্প সংখ্যক চেচেন যোদ্ধা আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত রুশ বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করেছিলো ককেশাসের পথে প্রান্তরে, যা রাশিয়ানরা কখনোই ভুলতে পারবে না।
কিন্তু দৃশ্যপট আজ একেবারেই বদলে গেছে। শত শহীদের রক্তেস্নাত এই ভূমির উপরে দাঁড়িয়ে এই চেচেনরা আজ রাশিয়ার বন্দনায় মুখর। তারাই কিনা আজ প্রেসিডেন্ট পুতিনের আনুগত্য প্রদর্শনের জন্য র্যালি বের করে এবং তার জন্য জীবন বাজি রাখার অঙ্গীকার করে। ভীষণ রাশিয়া বিদ্বেষী স্বাধীনতাপ্রেমী চেচেনরা কিভাবে তাদের পূর্ব-পুরুষের রক্তের সাথে বেইমানি করে প্রেসিডেন্ট পুতিনের পোষা যোদ্ধায় পরিণত হলো তাই আজ বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন হিসেবে দেখা দিয়েছে। আজকে আমরা সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করব। সেই সাথে জেনে নেব চার-শতাব্দী ব্যাপি রাশিয়া-চেচেন সংঘাতের ইতিহাস।
চেচিনিয়ানরা একটি ধর্মপ্রাণ সুন্নি মুসলমান সম্প্রদায় যারা রাশিয়ার কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে অবিরাম সংগ্রাম, বীরত্ব ও আত্মত্যাগের কারণে বিখ্যাত। বর্তমান চেচেন প্রজাতন্ত্র উত্তর ককেশাস অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত রাশিয়ার স্বায়ত্বশাসিত একটি প্রদেশ। উমাইয়া খেলাফত আমলে সর্বপ্রথম এই অঞ্চলে ইসলাম প্রবেশ করে। এর প্রায় সকল অধিবাসী শাফে’য়ী মাযহাবের অনুসারী সুন্নী মুসলিম। রাশিয়ার দখলে যাওয়ার পূর্বে এই অঞ্চলটি উসমানী সাম্রাজ্যের প্রভাবাধীন ছিল। ইসলামী খেলাফতের কেন্দ্রভূমি উসমানী সাম্রাজ্যের প্রভাবাধীন থাকাতে চেচেনদের কোন সমস্যা হয়নি। ১৬’দশ শতাব্দীর শুরুর দিকে রাশিয়া মঙ্গলদের কাছে থেকে স্বাধীনতা অর্জন করার পর বাল্টিক সাগর ও মধ্য এশিয়া অভিমূখে এর সম্প্রসারণ ও উপনিবেশবাদ অব্যাহত রাখে ফলে তা এক বিশাল সাম্রাজ্যে পরিণত হয়। সেসময় থেকেই ঐ অঞ্চলের মুসলিম অধিবাসীদের সাথে সংঘাত চলতে থাকে।
ঐতিহাসিকদের মতে সর্বপ্রথম চেচেন-রাশিয়া সংঘাতের ঘটনা ঘটে প্রায় ৪০০ বছর আগে রাশিয়ান সম্রাট ১ম-পিটারের আমলে। এরপর দীর্ঘদিন রুশ-অটোমান সংঘাত সহ বিভিন্ন ফ্রন্টে যুদ্ধের কারণে উসমানী খেলাফত দুর্বল হয়ে পড়লে ককেশাস অঞ্চলে তার প্রভাব নষ্ট হয়ে যায়। ফলে রাশিয়া এসব অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার শুরু করলে অত্র অঞ্চলের মুসলিমদের জীবনে দুর্দিনের সূচনা ঘটে। কিন্তু দুর্বার ঈমানের শক্তিতে বলিয়ান এই অঞ্চলের মুসলিমদেরকে রাশিয়া কোনভাবেই দমাতে পারেনি। অষ্টাদশ শতাব্দীতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে দাগেস্তানের ইমাম শেখ মনসুরের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে দুর্বার জিহাদী আন্দোলন। আগ্রাসী খ্রিস্টান রাশিয়ার বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে ককেশাসের প্রতিটি মুসলিম সম্প্রদায় সর্বাত্মক যুদ্ধে লিপ্ত হয়। রাশিয়ান সম্রাজ্ঞী ২য়- ক্যাথারিন এর শাসনামলে শেখ মনসুরের মুজাহিদ বাহিনী বিশাল রাশিয়ান বাহিনীকে প্রতিটি যুদ্ধে নাস্তানাবুদ করতে সক্ষম হয়। রাশিয়ান শিবিরে তিনি রীতিমতো এক আতঙ্কের নাম হয়ে উঠেন। ক্যাথারিন দ্য গ্রেট এর কানে এই খবর পৌঁছলে তিনি বুঝতে পারেন এখনই শেখ মনসুরকে দমন করতে হবে। ১৭৮৫ সালে ৫০০০ রুশ সেনা শেখ মনসুরকে ধরে আনতে চেচিনিয়ায় অভিযান চালায়। শেখ মনসুরের গ্রাম ‘আলদির’ সব বাসিন্দার ঘর-বাড়ি তারা পুড়িয়ে দেয়। এরপরেও শেখ মনসুরের অনুসারীদের সাথে কয়েক দফা লড়াই হয়। ১৭৯১ সাল পর্যন্ত শেখ মনসুরের বাহিনী রুশ বাহিনীর সাথে বিপুল বিক্রমে লড়াই চালিয়েছিল। কিন্তু ১৭৯১ সালে অটোমান দুর্গ “আনাপায়” শেখ মন্সুর রুশ সেনাদের হাতে বন্দি হন। ১৭৯৪ সালে বন্দী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। ককেশাসে জিহাদের মশাল প্রজ্বলনকারী এই বীর। চেচিনিয়ার রাজধানী গ্রোজনীতে বর্তমানে ‘আহমদ কাদিরভ’ স্কয়ার নামে যে ঐতিহাসিক চত্বর রয়েছে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত সেটির নাম ছিল ‘শেখ মনসুর স্কয়ার’। শেখ মনসুরের মৃত্যুর পর চেচেনদের স্বাধীনতা আন্দোলন কিছুটা ক্ষীন হয়ে আসলেও গাজী মওলানা মোহাম্মদের নেতৃত্ব পুনরায় আন্দোলন গড়ে ওঠে। এবারের আন্দোলন এবার পূর্বের চেয়েও শক্তিশালী আকার ধারণ করে।
গাজী মাওলানা মোহাম্মদ দখলদার রাশিয়ার বিরুদ্ধে জিহাদের জন্য রাত-দিন অনুপ্রাণিত করতে থাকেন। দীর্ঘ আট বছর যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়ার পর ১৮৩২ সালে তিনি শহীদ হন। তার শাহাদাতবরণের পর রাশিয়ান শিবিরে স্বস্তি ফিরে এলেও তারা ভাবতে পারেনি তিনি স্বজাতির হৃদয়ে স্বাধীনতার যে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে গেছেন তা এত সহজে নিভে যাবার নয়। ১৮৩৪ সালে যুদ্ধের নেতৃত্ব হাতে তুলে নেন চেচেন সিংহখ্যাত ইমাম শামিল। যিনি চেচেন প্রতিরোধ আন্দোলনের অন্যতম নেতা। বিস্ময়কর রণদক্ষতায় রাশিয়ানদের আক্রমণ প্রতিহত করে ককেশাসের এই মহান বীর প্রায় অর্ধশত বছর ধরে নাকানি-চুবানি খাইয়েছেন প্রতাপশালী জার-রুশ সম্রাটদের। ইতিহাস তাই তাকে করে রেখেছে অমর, অক্ষয়। তার অসাধারণ বীরত্ব মুসলিমদের আরও একবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল কাকা বিন আমর, বারা ইবনে আজিব, খালিদ ও মুসান্নাদের বীরত্বের ইতিহাস।
ইমাম শামিলের বীরত্ব ও সাহসের কথা নিয়ে ককেশাস অঞ্চলে বহু গল্প প্রচলিত আছে। দীর্ঘদিন যাবত অবিরাম লড়াই করে শেষে জার ২য় আলেকজান্ডারের আমলে ১৮৫৯ সালে রুশ বাহিনী তাকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বন্দী করতে সক্ষম হয়। তাকে মস্কোতে নিয়ে যাওয়া হয় এবং কঠোরভাবে নজরবন্দি করে রাখা হয়। ১০ বছর পর তাকে মুক্তি দিয়ে হজ্ব করার অনুমতি দেওয়া হয়। হজ্বের পর তিনি মদীনায় গমন করেন এবং সেখানেই অসুস্থ হয়ে ১৮৭১ সালে ৪’ঠা ফেব্রুয়ারি ইন্তেকাল করেন। মদিনার ‘বাকি’ কবরস্থানে রুশ আগ্রাসন প্রতিরোধের এই মহানায়ককে দাফন করা হয়। এই রথী-মহারথীদের তিরোধানের পরেও ‘চেচেন স্বাধীনতা আন্দোলন’ একেবারে দমে যায়নি। হাজী মুরাদ, হাজী আলি বেগ এবং ইমাম অনুদায়েফ এর মতো বীরসেনানীরা চেচেন ইতিহাসের পরতে পরতে রচনা করে গেছেন বীরত্বের মহাকাব্য ।
১৯১৭ সালে বলশেভিক বিপ্লবের পর চেচেনিয়া সহ আশেপাশের এলাকা সোভিয়েত ইউনিয়ন দখল করে নেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কমিউনিস্ট নেতা জোসেফ স্ট্যালিন হিটলারের পক্ষে কাজ করার অপবাদ দিয়ে ১৯৪৪ সালের ২৩’ফেব্রুয়ারি চেচিনিয়া ও ইয়াঙ্গুশ অঞ্চলের কয়েক লাখ মুসলিমকে বরফাচ্ছাদিত সাইবেরিয়ায় তাড়িয়ে দেয়। বরফের নিচে চাপা পড়ে সেখানেই প্রায় দুই লাখ মুসলমানের মৃত্যু ঘটে। ১৯৫৭ সালের আগ পর্যন্ত নির্বাসিত এই মুসলিমদের নিজ দেশে ফিরতে দেওয়া হয়নি। ৯০ এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর চেচেনরা আবারও স্বাধীনতা আন্দোলনের ডাক দেন। গণ-ভোটের আয়োজন করে স্বাধীন দেশের ঘোষণা দেন । ১৯৯১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সোভিয়েত বিমান বাহিনীর সাবেক জেনারেল জওহর দুদায়েভ- এর নেতৃত্বে চেচেন-ইঙ্গো প্রজাতন্ত্রের পতন ঘটানো হয়। জওহর দুদায়েভ চেচিনিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। দীর্ঘদিনের রুশ আগ্রাসনকে চাপিয়ে চেচেনদের জাতীয় জীবনে এটা ছিল অত্যন্ত আবেগঘন একটি মুহূর্ত। যেদিন প্রথমবারের মতো চেচেনরা স্বাধীনতার স্বাদ অনুভব করে।
প্রেসিডেন্ট জওহর দুদায়েভ ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম। তার শাসনামলের শুরুতেই তিনি দেশ জুড়ে ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন এবং মুসলিম দেশগুলোর সাথে ঐক্য উন্নয়নে মনোযোগী হন। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর রাশিয়া বেশ কিছু দেশের স্বাধীনতা মেনে নিলেও ধর্মপ্রাণ এই অঞ্চলের স্বাধীনতাকে মেনে নেয়নি। প্রথমে তারা প্রেসিডেন্ট জওহর দুদায়েভের বিরোধীদের মদদ দিয়ে চেচিনিয়ায় গৃহযুদ্ধ লাগানোর মাধ্যমে তাদের স্বার্থ উদ্ধারের চেষ্টা করে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট জওহর দুদায়েভ বিরোধীদের দমন করে রাশিয়ার সকল ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দেন। এবার রাশিয়া ১৯৯৪ সালের ডিসেম্বরে স্বাধীন চেচিনিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ইতিহাসে এটিই ‘প্রথম চেচেন যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। এই যুদ্ধে রাশিয়া ভয়ংকরতম গণহত্যা চালিয়ে চেচিনিয়ার অধিকাংশ এলাকা দখল করে নেয়। এর প্রেক্ষিতে চেচিনিয়ার তৎকালীন প্রধান মুফতি আহমদ কাদিরভ এক জ্বালাময়ী বক্তব্যে রাশিয়ার বিরুদ্ধে জিহাদের ঘোষণা দেন। ফলে চেচেনরা বীরবিক্রমে লড়াই করে কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তোলে। রুশ নৃশংসতায় ক্ষিপ্ত হয়ে প্রেসিডেন্ট দুদায়েভের বিরোধীরাও রাশিয়ার বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে ধরে।
এই প্রতিরোধ যুদ্ধে জাতিকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন প্রেসিডেন্ট জওহর দুদায়েভ ও আসলান মাসখাদভ, সেলিম খান ইয়ান্দারবিয়েভ, রোসলান গালায়েভ, শামিল ভাসাইভের মতো বীর যোদ্ধারা। চেচেনদের শক্ত প্রতিরোধের মুখে কোনঠাঁসা হয় পড়ে রুশ বাহিনী। তবে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায় এক আরব বীরের বিস্ময়কর আবির্ভাবে। যিনি আয়েশী জীবনকে পায়ে ঠেলে হন্যে হয়ে ছুটে বেরিয়েছেন প্রতিটি নিপীড়িত মুসলিম জনপদে। তাদের পক্ষে গড়ে তুলেছেন শক্ত প্রতিরোধ। তিনি হলেন ‘সামের সালেহ আসসুয়াইলিম’, যিনি ‘আমির খাত্তাব’ নামে সর্বাধিক পরিচিত। আফগানিস্তান, বসনিয়া, তাজিকিস্তান হয়ে এবার তিনি পা রাখেন চেচানিয়া দাগেস্তানের মাটিতে।
সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে বিস্ময়কর রণনৈপুণ্যে তিনি প্রতিটি যুদ্ধে নাস্তানাবুদ করতে থাকেন রুশ বাহিনীকে। রাতারাতি তিনি চেচেনদের জাতীয় বীরে পরিণত হন। চেচেন সরকার কর্তৃক বিশেষ সম্মাননা লাভ করেন। প্রেসিডেন্ট জওহর দুদায়েভ ও তাকে সমীহ করেন। তার বিখ্যাত অপারেশন ‘Shatoy’ কাঁপিয়ে দেয় গোটা রাশিয়াকে। যেখানে তিনি গুটি কয়েক যোদ্ধা নিয়ে অসাধারণ রণদক্ষতায় বিশাল রুশ সেনা বহরকে গুঁড়িয়ে দিতে সক্ষম হন। এই যুদ্ধে শতশত রুশ সেনাসহ অর্ধশতাধিক সেনা অফিসার নিহত হয়। তাদের ব্যবহৃত সকল সাজোয়া যান ট্যাংক ধ্বংস করা হয়। ভয়াবহ এই যুদ্ধের কথা রাশিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলিৎচিন রুশ পার্লামেন্টে আলোচনা করেন। পরে আমির খাত্তাবের নির্দেশে গোটা অপারেশনের ভিডিও প্রচার করে রুশ সেনাদের দুর্বলতা ও অসহায়ত্ব গোটা দুনিয়ার সামনে তুলে ধরা হয়। তৎকালীন সময়ে মিডিয়ায় মুসলিমরা পিছিয়ে থাকায় কমান্ডার খাত্তাব এমন সিদ্ধান্ত নেন।
যাই হোক, ১৯৯৬ সালের শুরু থেকে চেচেনদের ভয়াবহ আক্রমণের মুখে একের পর এক অঞ্চল থেকে পরাজিত হয়ে রুশ বাহিনী পিছু হটতে থাকে, সেই সাথে তাদের মনোবলও একেবারে ভেঙ্গে পড়ে। ১৯৯৬ সালের ২১’এপ্রিলে এক রুশ ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় রাষ্ট্রপতি জওহর দুদায়েভ শহীদ হলেও তারা চেচেনদের মনোবলে চিড় ধরাতে পারেনি। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সেলিম খান ইয়ান্দারবিয়েভ ও সেনা প্রধান আসলান মাসখাদোভের নেতৃত্বে চলতে থাকে যুদ্ধ। যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজয় ও ক্রমবর্ধমান সামরিক ক্ষয়ক্ষতির কারণে রাশিয়া যুদ্ধবিরতির উপায় খুঁজতে শুরু করে। ১৯৯৬ সালের আগস্টে আসলান মাসখাদভ ও শামিল ভাসায়েভ এর নেতৃত্বে ১৫০০ জন চেচেন যোদ্ধার একটি ইউনিট এক ভয়াবহ আক্রমণে রুশ বাহিনীকে গুঁড়িয়ে দিয়ে রাজধানী ‘গ্রোজনী’ দখল করতে সক্ষম হয়। অবশেষে ১৯৯৬ সালের ৩১ আগস্ট রাশিয়া শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে যুদ্ধবিরতিতে স্বাক্ষর করে। ফলে চেচেন রিপাবলিক অফ ইচকেরিয়া (Chechen Republic Of Ichkeriya) কার্যত একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবেই থেকে যায়। আর এভাবেই পরিসমাপ্তি ঘটে ‘১ম চেচেন’ যুদ্ধের।
যুদ্ধ পরবর্তী চেচনিয়াঃ
১৯৯৭ সালের জানুয়ারিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে শামিল ভাসায়েভ এবং সেলিম খান কে পরাজিত করে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন আসলান মাসখাদভ। শামিল ভাসায়েভ উপ-প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন এবং পরবর্তীকালে সেনা প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েই মাসখাদভ যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশটির সংস্কার এবং রাশিয়ার সাথে আলোচনার মাধ্যমে বিরোধ-নিষ্পত্তি করে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার চেষ্টা করেন। তবে রাশিয়া তাতে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি, বরং ভারি অস্ত্রসহ সেনা মোতায়েন করে চেচেন সীমান্ত অবরোধ করে রাখে। চেচেন সরকারকে কোনঠাঁসা করার লক্ষ্যে তীব্র অর্থনৈতিক অবরোধ করে রাখে যাতে করে সাধারণ জনগণ ইসলামপন্থী এই সরকারের উপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলে। অপরদিকে গৃহযুদ্ধ বাঁধিয়ে চেচেনকে অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে সরকার বিরোধীদের কে সর্বপ্রকার মদদ জোগাতে থাকে। যুদ্ধ পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে আমির খাত্তাব বলেন-
“বিগত বছরগুলোতে রাশিয়া যেভাবে যুদ্ধ পর্যদুস্ত হয়েছে তাতে এই মুহূর্তে চেচিনিয়ায় প্রবেশ করার সক্ষমতা তার নেই। তাই রাশিয়া এই মুহূর্তে চেচিনিয়াকে অর্থনৈতিকভাবে চাপে ফেলার চেষ্টা করছে এবং এর অভ্যন্তরে নানাবিদ সমস্যা তৈরি করে করতে চাইছে। যেমন গুপ্ত হত্যা, সরকার বিরোধীদের মদদ দেয়া, সরকারকে ব্যর্থ প্রমাণ করার চেষ্টা করা। যাতে করে সাধারণ জনগণ এ সরকারের উপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলে।”
এছাড়া আমির খাত্তাব ও শামিল ভাসায়েভসহ চেচেন যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী নেতাদের গোপনে হত্যার লক্ষ্যে রাশিয়ান গোয়েন্দা সংস্থার গুপ্তচররা ঝাঁকে ঝাঁকে চেচিনিয়ায় প্রবেশ করে।
অডিও সাক্ষাৎকারে আমির খাত্তাব জানান-
‘রাশিয়া সেনা প্রত্যাহারের সাথে সাথেই রুশ গোয়েন্দারা চেচিনিয়ায় ঢুকে পড়ে, চেচিনিয়ার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থান সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা ছিল তাদের মিশন। ‘দ্বিতীয় চেচেন’ যুদ্ধের ১৮ মাস আগেই তারা বলেছিল শীঘ্রই রুশ বাহিনী পাহাড়ের দিক থেকে আক্রমণ শুরু করবে। এর থেকে বড় আর কি প্রমাণ চাইবেন। আমাদের ক্যাম্পেই আমরা ৩৭ জনের অধিক রুশ গুপ্তচরকে গ্রেফতার করেছি। এদের মিশন ছিল আমাকে এবং শামিল ভাসায়েভসহ ও অন্যান্য সামরিক নেতাদের হত্যা করা। এগুলো তাদেরই স্বীকারোক্তি। তাহলে বলুন এটা কি সরাসরি যুদ্ধ নয়!!’?
চেচেন নেতৃবৃন্দের নিকট এটা দিবালকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে যায় যে এক অনিবার্য যুদ্ধ অপেক্ষা করছে। স্বয়ং প্রেসিডেন্ট আসলান মাসখাদভ এক টিভি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন রুশ জেনারেলরা তাকে বলেছিলেন তারা শীঘ্রই প্রতিশোধ নিতে ফিরে আসবে। এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে আমির খাত্তাব বলেন-
‘স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ও চেচেন জনসাধারণের নিকট এখন এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, রাশিয়া যেসব শর্তের উপর যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছিলো তার একটিও তারা মেনে চলেনি। সীমান্তগুলো এখনো অবরুদ্ধ, বিমানবন্দরগুলো বন্ধ, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা চলমান রয়েছে। তাই এখন পুরো ককেশাস এমন পরিস্থিতিতে রয়েছে যে এই ভূমির উপর থেকে সকল প্রকার আগ্রাসন থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হওয়া ছাড়া আর উপায় নেই।’
এই অনিবার্য বাস্তবতাকে সামনে রেখে চেচেন মুসলিমরা সামরিক ও ধর্মীয় প্রশিক্ষণ নিতে থাকে। এইসব প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধান করছিলেন কমান্ডার আমির খাত্তাব। এরইমধ্যে চেচিনিয়ার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল দাগেস্তানের পরিস্থিতি নাটকীয় মোড় নেয়। মুসলিম অধ্যুষিত এই ঐতিহাসিক অঞ্চলটি ঐতিহাসিক ভাবে চেচিনিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে মনে করে স্থানীয় মুসলিম অধিবাসীরা। ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভাষা, সভ্যতা ও সংস্কৃতির দিক থেকে উভয় অঞ্চলের মানুষ একই জাতিসত্তার অন্তর্ভুক্ত। ১৯২১ সালের ২০ জানুয়ারি সোভিয়েত ইউনিয়ন দাগেস্থান দখল করে স্বায়ত্বশাসিত প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করে। ১৯৯৯ সালে সেখানকার ইসলামপন্থীরা রাশিয়ার অনুগত সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং শরিয়াহ আইন বাস্তবায়নের ঘোষণা দেন। রাশিয়া তার অনুগত সরকারকে রক্ষার্থে এবং ইসলামপন্থীদের শায়েস্তা করতে দাগেস্তানে ভয়াবহ মুসলিম গণহত্যা শুরু করে। এই সময় তারা শতশত মুসলিমকে হত্যা করে এবং নির্বিচারে বোমাবর্ষণ করে নিরপরাধ মানুষের ঘরবাড়ি ধ্বংস করতে থাকে। দাগেস্তানের অসহায় মুসলিমরা চেচেন যোদ্ধাদের কাছে সাহায্যের জন্য ফরিয়াদ করে। ফলে চেচেন বাহিনী পরে মহাবিপাকে। মুসলিমদের সাহায্যার্থে দাগেস্তানে রুশ বাহিনীকে প্রতিহত করলে সেই অজুহাতে রাশিয়া নির্ঘাত চেচিনিয়ায় হামলা চালাবে। চেচিনিয়ার নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। আবার অসহায় মুসলিমদের রুশ গণহত্যার মুখে ছেড়ে দিয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকারও কোনো সুযোগ নেই। বিশেষ সাক্ষাৎকারে আমির খাত্তাব জানান-
‘দাগ স্থানের শীর্ষ সতেরো জনের অধিক আলেমের ফতোয়ার ভিত্তিতে এবং উপদেষ্টা পরিষদের পরামর্শক্রমে দাগেস্তান ও চেচিনিয়ার স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সাথে পরামর্শক্রমে এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে যে, দাগেস্তানের যেসব অঞ্চলে রুশ বাহিনী হামলা চালাচ্ছে চেচেন যোদ্ধারা সরাসরি সেসব অঞ্চলে অভিযান চালাবে। তাই প্রথমে চেচেন কমান্ডাররা রাশিয়া ও দাগেস্তান সরকারকে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে সমস্যা সমাধান করার অনুরোধ জানান। কিন্তু এতে কোন পক্ষই কর্ণপাত করেনি। ফলে চেচেন যোদ্ধাদের সামনে আর কোনো শরয়ী ওজর অবশিষ্ট না থাকায় ওলামা পরিষদের সাথে পরামর্শক্রমে ১৯৯১ সালের ৭ই আগস্ট আমির খাত্তাব ও শামিল ভাসায়েভের নেতৃত্বে ১৪০০ জন যোদ্ধা দাগেস্তানে প্রবেশ করে এবং রুশ আগ্রাসনের সমুচিত জবাব দিতে শুরু করে।
এর ফলে রাশিয়ার সামনে চেচিনিয়া আক্রমণের পথ উন্মুক্ত হয়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে দাগেস্তানে অভিযান চালিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েন আমির খাত্তাব। তিনি এই প্রসঙ্গে বলেন-
‘সবাই আমাকে দোষারোপ করছে যে আমি কেন দাগেস্তানে গেলাম! অথচ কেউ এটা বলছে না যে রাশিয়া কেন হামলা চালালো? শুধু মুসলিমরা কিছু করলেই দোষ হয়ে যায়! অন্যদের বেলায় দোষ নেই? আজিব! কেউ কেউ বলছে, এটা আমাদের ভুল কিন্তু আমরা অসহায়দের সাহায্য না করে পারিনি আমরা সকল শান্তিপূর্ণ উপায়ে চেষ্টা করেছি, কোন সমাধান হয়নি। বারবার মিটিং করা হয়েছে। রাশিয়াকে অনুরোধ করা হয়েছে, দাগেস্তান সরকারকে অনুরোধ করা হয়েছে। অফিসিয়াল প্রতিনিধি পাঠিয়ে রাশিয়াকে যুদ্ধ বন্ধের জন্য বারবার অনুরোধ জানানো হয়েছে। রাশিয়া বা দাগেস্তান সরকার কেউ শোনেনি। রাশিয়া হামলা চালানোর এক সপ্তাহ পর আমরা গিয়েছি। দেখুন! আমরা এক সপ্তাহ অপেক্ষা করেছি।’
ততদিনে বরিশ ইয়ালিৎসি সরকারের ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দৃশ্যপটে আবির্ভূত হন ব্লাদিমির পুতিন। তিনি যে কোন মূল্যে চেচেন দখল করে রাশিয়ার আঞ্চলিক অখণ্ডতাকে ধরে রাখতে বদ্ধপরিকর। এদিকে পরেরমাসেই দাগেস্তানের কিছু সশস্ত্র গোষ্ঠী রুশ আগ্রাসনের প্রতিশোধস্বরূপ রাশিয়ার রাজধানী মস্কোতে সিরিজ বোমা হামলা চালায়। রাশিয়া এ হামলার জন্য আমির খাত্তাব, শামিল ভাসায়েভ এবং চেচেন সরকারকে অভিযুক্ত করে। যদিও তারা এ হামলার দায় সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করে। আমির খাত্তাব বিবিসির সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেন-
‘মুসলিমদের আদর্শই সঠিক। আমরা কখনো আগে আক্রমণ করি না। আমরা কখনো সাধারন মানুষের উপর আক্রমণ করি না। ইহুদি বা কমিউনিস্ট যেই হোক না কেন! আমাদের ধর্মে তা নিষিদ্ধ। আমরা কেবল তখনই আক্রমণ করি যখন কেউ আমাদের উপর আক্রমণ করে। যুদ্ধ করলে শেষ পর্যন্ত করি।’
অনেকে ধারণা করেন চেচিনিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার জন্য উপযুক্ত বাহানা তৈরির জন্য রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা নিজেরাই এই বোমা হামলার ঘটনাটি ঘটিয়েছে। ১৯৯৯ সালের অক্টোবর এর শুরুতেই ভ্লাদিমির পুতিনের নির্দেশেই রুশ বাহিনী চেচেনিয়া আক্রমণ শুরু করে। চেচেন প্রেসিডেন্ট আসলান মাসখাদভ রাশিয়ার কাছে শান্তি প্রস্তাব পাঠান এবং আলোচনায় বসার জন্য অনুরোধ জানান। কিন্তু পুতিন শান্তি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন ফলে প্রেসিডেন্ট আসলান মাসখাদভ রাশিয়ার বিরুদ্ধে জিহাদের ডাক দেন। এদিকে প্রথম চেচেন যুদ্ধের অন্যতম রুশ বিরোধী নেতা ও চেচিনিয়ার গ্র্যান্ড মুফতি আহমদ কাদিরভ আমির খাত্তাবসহ সকল বহিরাগত যোদ্ধাদের বহিষ্কার করে রাশিয়ার সাথে সমঝোতা দাবিতে প্রেসিডেন্ট আসলানের সাথে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন এবং প্রধান মুফতির পদ থেকে বহিষ্কৃত হন। ঐদিকে ব্রিটিশদের পুরনো পদ্ধতি অনুসরণ করে ভ্লাদিমির পুতিন চেচেনদের মধ্য থেকে এমন একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে খুঁজেছিলেন যাকে ক্ষমতা ও অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে সহযোদ্ধাদের কাছ থেকে ভাগিয়ে আনা যাবে। চেচেন প্রেসিডেন্ট আসলান মাসখাদভের সাথে গ্র্যান্ড মুফতির এই বিরোধে উপযুক্ত ব্যক্তিকে খুঁজে নিতে মোটেও ভুল করেননি ভ্লাদিমির পুতিন। অর্থ ও ক্ষমতার প্রলোভন দেখিয়ে পুতিন আহমদ কাদিরভকে নিজের দলে টেনে নেন। অথচ আহমদ কাদিরভ ছিলেন রুশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা এবং চেঁচেন গ্র্যান্ড মুফতির পদ অলংকৃত কারী গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব। যিনি ১ম চেচেন যুদ্ধে বজ্র কন্ঠে রাশিয়ার বিরুদ্ধে জিহাদের ঘোষণা দিয়েছিলেন। যাইহোক আহমদ কাদিরভ এর সহায়তা নিয়ে পুতিনের রুশ বাহিনী গ্রোজনীর উপর এমন ভাবে হামলা চালায় যা চেচিনিয়ার ইতিহাসে সমস্ত বর্বরতাকে চাপিয়ে যায়। গোটা গ্রোজনিকে আক্ষরিক অর্থে ধ্বংস করে দেয়া হয়। রাশিয়ার এমন ভয়াবহ আক্রমণের মুখে মাসখাদভ সরকারের পতন ঘটে। প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ ত্যাগ করে মাসখাদভ তার বাহিনী নিয়ে আমির খাত্তাব ও শামিল বাসায়েভের গেরিলা বাহিনীতে যোগ দেন এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক গেরিলা যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। প্রাথমিক পর্যায়ে স্বাধীনতাকামী চেচেন গেরিলারা আমির খাত্তাবের সুনিপুণ রণদক্ষতায় চেচিনিয়ার মাটিতে রুশ বাহিনীর কবর রচনা করতে থাকে। ফলে যে কোন মূল্যে আমির খাত্তাব শামিল বাসায়েভ, আসলান মাসখাদভসহ গেরিলা যুদ্ধের নেতৃত্ব দানকারী কমান্ডারদের হত্যা করতে রাশিয়া সর্বশক্তি নিয়োগ করে। কিন্তু তাদের প্রতিটি অভিযান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এক আমির খাত্তাবের রণনৈপূণ্যের কাছে দিশেহারা হয়ে যায় গোটা রুশ বাহিনী। প্রতিটি হামলায় শত-শত সৈন্যের লাশ ফেলে রেখে পিছু হটতে হয় তাদের। আমির খাত্তাব যেন একাই গোটা রাশিয়ার সামনে এক দূর্ভেদ্য প্রাচীর হয়ে ওঠেন যাকে রুশ বাহিনী কোনভাবেই ভেদ করতে পারছে না। এরই মাঝে এক ভিডিও বার্তায় আমির খাত্তাব বলেন-
“শীঘ্রই গেরিল যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটিয়ে নিয়মিত সম্মুখ যুদ্ধের সূচনা করা হবে। এভাবেই রাশিয়ার উপর মিডিয়াগত, সামরিক ও রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি হবে ইনশাআল্লাহ। ফলে রাশিয়া চেচেনদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হবে এবং চেচেন প্রজাতন্ত্র থেকে সেনা প্রত্যাহারে বাধ্য হবে ইনশাআল্লাহ।”
সম্মুখ সমরে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে রাশিয়া তার গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে ষড়যন্ত্র ও গুপ্ত হত্যার পথ বেছে নেয়। বহুবার রাশিয়া খাত্তাবের মৃত্যু সংবাদ প্রচার করলেও প্রতিবারই তা মিথ্যা প্রমাণিত হয় এবং আশ্চর্যজনক ভাবে তিনি মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যান। অবশেষে ২০০২ সালে রাশিয়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। ২০০২ সালের এপ্রিল মাসে কমান্ডার খাত্তাব এক ল্যান্ডমাইন দ্বারা আহত হন, আহত হবার পর বিশ্রামে ছিলেন তিনি। ‘ইব্রাহিম আলোরি’ নামে এক দাগেস্তানী ব্যক্তি চেচেন গেরিলাদের দুত হিসেবে কাজ করত। রাশিয়ান গোয়েন্দা সংস্থা ‘এফএসবি’ তাকে হাত করে। খাত্তাবের মায়ের পক্ষ থেকে খাত্তাবের কাছে চিঠি আসে যা ‘ইব্রাহিম আলোরি’ নামের ওই প্রতারকের হাতে এসে পড়ে। সে ‘এফএসবি’ এর নির্দেশনা মতে তাতে এমন এক প্রকার রাসায়নিক বিষ মাখিয়ে দেয় যা শোঁকার সাথে সাথে মানুষ নিজের অজান্তে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। ২০ মার্চ ২০০২ সালে এই চিঠি আমির খাত্তাবের কাছে আসে। খাত্তাব এই চিঠি পড়ার পরই রাতের আঁধারে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। চিরকালের জন্য ঘুমিয়ে পড়েন এই মূর্তিমান আতঙ্ক। যিনি গুটিকয়েক যোদ্ধা নিয়ে রাশিয়ার মতো বিশাল দৈত্যংদেহী বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করে চলেছিলেন। এক সময়ের সুপার পাওয়ার রাশিয়া তাকে মারার জন্য আর কোন বাহিনী পাঠানোর সাহস করেনি। অথচ তা এক প্রতারকের মাধ্যমে সম্ভব হল। খাত্তাবের মৃত্যু সংবাদ আল-জাজিরা, বিবিসি, সিএনএন সহ প্রায় সকল আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলো ফলাও করে প্রচার করে। আল জাজিরা তাকে নিয়ে বিশেষ প্রোগ্রাম প্রচার করে যেখানে আল জাজিরা কে দেওয়া তার সাক্ষাৎগুলো প্রচার করা হয়। এদিকে রাশিয়ায় খাত্তাব হত্যার বিষয়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য টেলিভিশনের অন্যান্য প্রোগ্রাম সম্প্রচার স্থগিত করা হয় এবং সেই রাতেই ও পরের দিন কয়েকবার দেখানো হয়। খাত্তাবের মৃত্যুকে রাশিয়ার মহাবিজয় হিসেবে উদযাপন করা হয়। প্রকৃতপক্ষে খাত্তাবের মৃত্যুতে চেচেন স্বাধীনতা যুদ্ধের এক অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যায়। তার মৃত্যু স্বাধীনতাকামী চেচেনদের জন্য এমনই এক ধাক্কা ছিল যা কাটিয়ে ওঠা আর সম্ভব হয় নি। তার মৃত্যুর পরেই চেচেন স্বাধীনতা যুদ্ধ ক্রমেই নিস্তেজ হয়ে পড়ে। রাশিয়া বিভিন্ন সময়ে যুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী চেচেন কমান্ডারদের একে একে হত্যা করতে সক্ষম হয়। এরই মধ্যে ২০০২ সালের অক্টোবরে ৪০ জন নারী ও পুরুষ গেরিলার একটি দল বিকল্প উপায়ে রাশিয়াকে সৈন্য প্রত্যাহারে বাধ্য করতে এবং চলমান রুশ আগ্রাসন এর প্রতিশোধ স্বরূপ মস্কোতে একটি থিয়েটারে হামলা চালিয়ে প্রায় ৯০০ জন রুশ নাগরিককে জিম্মি করে। চার দিন ধরে চলা এই জিম্মি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে রাশিয়া অজ্ঞাত এক বিষাক্ত গ্যাস ব্যবহার করে যার ফলে থিয়েটার এর ভিতর সবাই অচেতন হয়ে পড়ে। এই সুযোগে রুশ নিরাপত্তা বাহিনী সকল চেচেন গেরিলা কর্মীকে হত্যা করতে সক্ষম হয়। রাশিয়ার ব্যবহৃত বিষাক্ত গ্যাসের প্রভাবে ১৩০ জন রুশ নাগরিকও নিহত হয়। বিষাক্ত গ্যাস ব্যবহারের ফলে রাশিয়া বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়। মস্কোর এই জিম্মি সংকট তৎকালে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। দাবি পূরণের নির্ধারিত সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও রুশ নাগরিকদের হত্যা না করে চেচেন গেরিলারা চার দিন ধরে রাশিয়ার সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করায় অনেকে বিস্মিত হয়েছিলেন। পরবর্তীতে জিম্মি সংকট থেকে উদ্ধার হওয়া ব্যক্তিদের টিভি সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, গেরিলারা কোনোভাবেই সাধারণ নাগরিকদের হত্যা করতে চাইছিলোনা। তারা শুধুমাত্র তাদের দাবি আদায় করতে চেয়েছিলো তেমন কোন রক্তপাত ছাড়াই। তারা রহস্যজনক কাল ক্ষেপন ছাড়াই রাশিয়ার মিথ্যা আশ্বাসের অপেক্ষায় বসে থাকে যা শেষ পর্যন্ত তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। ওদিকে ২০০০ সালে মাসখাদভ সরকারের পতন ঘটলে পুরস্কার হিসেবে আহমদ কাদিরভকে চেচেন প্রশাসনের প্রধানএবং ২০০৩ সালে রাশিয়ান ফেডারেশনভুক্ত চেচিনিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাকে মনোনীত করে রাশিয়া। ২০০৪ সালের ৯ই মে আহমদ কাদিরভ চেচেন স্বাধীনতাকামী যোদ্ধাদের হামলায় নিহত হন। এরপর ২০০৭ সালে তার ছেলে বর্তমান প্রেসিডেন্ট রমজান কাদিরভ চেচিনিয়ার ক্ষমতায় বসেন। রমজান কাদিরভ পুতিন প্রশাসনকে ধন্যবাদ জ্ঞাপনের নিমিত্তে এক বিশাল সমাবেশে বলেন-
‘আজকে আমাদের গ্রোজনী শহর উন্নত। আমাদের দেশ আজ সুসংহত, আমাদের অর্থনীতি শক্তিশালী, দেশের জনগণের হাতেই দেশের প্রকৃত ক্ষমতা। আমাদের গর্বিত থাকতে হবে আজকে আমরা তাকে (প্রেসিডেন্ট ব্লাদিমির পুতিন) ধন্যবাদ জানাতে একত্রিত হয়েছি। তিনি এমন একজন যার কাছে আমরা চির ঋণী। আমাদের দেশ দরদী আমাদের জাতীয় নেতা প্রেসিডেন্ট ভলাদিমির পুতিন।
আমাদের এই অঞ্চলের মীরজাফরের সঙ্গে আহমদ কাদিরভ আর মীর জাফরের পুত্র মীরনের সঙ্গে রমজান কাদিরভ এর মিল পাওয়া যায়। ব্লাদিমির পুতিনের একান্ত বাধ্যগত হয়ে পিতা আহমদ কাদিরভ যে গদিতে বসেছিলেন সেখানে এখন পুত্র রমজান কাদিরভ বসেছেন। স্বদেশের স্বাধীনতা স্বপ্নকে মাটিতে পুঁতে স্বাধীনতাকামীদের দমন করে রাখার বিনিময়ে তিনি তার গদি পাকাপোক্ত করেছেন। রমজান কাদিরভ চেচিনিয়ার প্রেসিডেন্ট হবার পর রুশ বিরোধী চেচেন স্বাধীনতাকামীদের উপর নির্মম নির্যাতন নেমে আসে। তার এবং পুতিনের সমালোচনাকারীদের নির্দয়ভাবে হত্যা করা হয়।
‘Committiee Against Torture’ এর Oleg Khabibrakhmano বলেন-
“যদি রমজান বলে তাদের হত্যা করো তাহলে সকলকেই হত্যা করা হয়। এখানে তার কথাই আইন। তারা সকল আইনের ঊর্ধ্বে। রমজান এই গর্বিত জাতিটিকে এতটা ভীত সন্ত্রস্ত জাতিতে পরিণত করেছে যে এরা এখন নিজেদের ছায়া দেখলেও ভয় পায়।”
আতঙ্কে অনেক চেচেন ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পালিয়ে যান। এদের বড় একটি অংশ এখন ইউক্রেনের আশ্রয়ে রয়েছে। বর্তমানে ইউক্রেনে যুদ্ধরত চেচেনরা কয়েকটা ভাগে বিভক্ত। এক ভাগে রমজান কাদিরোভের চেচেন বাহিনী যারা রাশিয়ার পক্ষে যুদ্ধে নেমেছে। আরেকভাগ ইউক্রেনে সক্রিয় ‘শেখ মনসুর’ ব্যাটালিয়ান এবং আরেকবভাগ ‘জওহর দুদায়েভ’ ব্যাটেলিয়নে সক্রিয়। রমজান কাদিরভ ইউক্রেনে সক্রিয় ‘শেখ মনসুর’ ও ‘দুদায়েভ’ ব্যাটেলিয়নকে শেষ করে দিতে চান। এতে তার দুই দিক থেকে লাভ। প্রথমত, নিজের শত্রু শেষ হবে; দ্বিতীয়ত, এতে পুতিন খুশি হবেন। কারণ ওই দুই ব্যাটালিয়নের যোদ্ধারা চেচেনিয়ার স্বাধীনতা চান এবং তারা পুতিনের বিরুদ্ধে কাজ করছেন। বর্তমানে চেচিনিয়ায় রমজান কাদিরোভের নেতৃত্বে শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলেছে ঠিকই। তবে পূর্ব পুরুষদের রক্তে যে শত্রুর হাত রঞ্জিত তারই পদলেহন করে এবং তারই জন্য জীবন বাজি রেখে সেই শান্তি ও সমৃদ্ধি অর্জন করতে হয় তাহলে জাতি হিসেবে এর চেয়ে বড় আর লজ্জা কি হতে পারে!
তবে এই কথা অনুস্বীকার্য যে চেচেন পরিস্থিতিকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যে তুখর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন তা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। আগামীতে কখনো পুতিন কাদিরোভ মৈত্রীর অবসান ঘটলে চেচিনিয়ার পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয় সেটা সময়ই বলে দেবে।
সংকলন: মামুন মুজাহিদ