বৃহত্তর ককেশাস পর্বতমালার কোলে, কৃষ্ণসাগরের পাড়ে অবস্থিত পশ্চিম ইউরোপের দেশ জর্জিয়া। জর্জিয়ার উত্তর-পূর্বে রাশিয়া, দক্ষিণ-পূর্বে আজারবাইজান, দক্ষিণে সীমান্ত মিলেছে তুরস্ক ও আর্মনিয়ার সাথে। সুপ্রাচীন ইতিহাস ও সাগর-পাহাড়ের মায়াময়তায় ঘেরা এই দেশে হাজার বছর ধরে মুসলমানরা শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করে আসছে। জর্জিয়ার বেশিরভাগ মানুষ অর্থোডক্স খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী। যদিও তারা নিজেদেরকে সকল ধর্মবিশ্বাসের প্রতি প্রচন্ড সহনশীল বলে দাবী করে থাকে। কিন্তু বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ভিন্ন চিত্র! যেখানে দেখা যায়- দেশটির সংখ্যালঘু মুসলমানরা সেখানে নিপীড়ন ও বৈষ্যমের শিকার।
পরিসংখ্যান বলছে- জর্জিয়ার মোট জনসংখ্যার শতকরা ১০ ভাগ-ই মুসলিম। জাতিগতভাবে জর্জিয় মুসলমানরা সুন্নি-হানাফি। তারা তুরস্ক সীমান্তে স্বায়ত্ত্বশাসিত আজারা অঞ্চলে বাস করেন। আজারার অধীবাসীদের ৩০ ভাগ মুসলিম, ৬৪ ভাগ অর্থোডক্স খ্রিস্টান। অন্যান্য মুসলিম জনগোষ্ঠীর মাঝে আছে আজারবাইজান-সীমান্তে বসবাসকারী আজারবানি সম্প্রদায়ের শিয়া মতালম্বি ও নাকশবন্দী সুফি তরিকার অনুসারী চেচেন মুসলিমরা।
দুনিয়ার বুকে ইসলাম আবির্ভাবের পর ইউরোপের জর্জিয়াতে পৌঁছে যেতে বেশিদিন লাগেনি। ৬৪৫ খ্রিস্টাব্দে তৃতীয় খলিফা হযরত উসমান (রা.) এর পাঠানো মুসলিম সেনাবাহিনী জয় করে জর্জিয়ার একাংশ এবং তিবলিসীতে ( আল- তিফিলিস) প্রতিষ্ঠিত হয় মুসলিম শাসন। উমাইয়া ও আব্বাসীয় খেলাফাতের সময়কালেও তিবলিসী মুসলিম শাসনাধীনেই ছিল। আরব শাসনাধীনে তিবলিসী ইউরোপ ও মুসলিম দুনিয়ার মাঝে বাণিজ্যিক সংযোগ সেতু হিসেবে কাজ করেছে। ৮৫৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে একাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ্ব পর্যন্ত প্রতাপশালী সেলজুক সাম্রাজ্যের অধীনে সমৃদ্ধ মুসলিম শহর ছিল তিবলিসী।
উসমানীয়-সাফাভি চিরন্তন দ্বন্দ্ব বিস্তৃত ছিল ককেশাসেও। ককেশাসে প্রভাব বিস্তার ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তুরস্কের উসমানীয় সাম্রাজ্য ও ইরানের সাফাভি সাম্রাজ্যের অভিযান চলতে থাকে পনের-ষোল শতক জুড়ে। অবশেষে স্থানীয় খ্রিস্টান শাসকদের পরাজিত করে তারা জর্জিয়ার বড় একটি অংশ জয় করে নেয়। ১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দে উভয় সাম্রাজ্যের মধ্যে ‘আমাসিয়া চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয় এবং জর্জিয়া বিভক্ত হয়ে যায় দুই সাম্রাজ্যের মাঝে।
উসমানীয়রা জর্জিয়ার পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের জনসাধারণের ভেতর সুন্নী ইসলামের প্রচারপ্রসারে মনোযোগ দেয়। তাদের প্রচেষ্টায় প্রভাবশালী আজরা সম্প্রদায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। অন্যদিকে শিয়া মতালম্বী সাফাভিরা পূর্বাঞ্চলের সমাজের উচ্চ শ্রেণির ভেতর ইসলাম প্রচারে মনোযোগী ছিল। তাদের প্রচেষ্টায় শাসক শ্রেণির অনেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তাঁদের অন্যতম ছিলেন ১৭০৩ খ্রিস্টাব্দে ইসলাম গ্রহণ করা রাজা ষষ্ঠ ভাকতাং। এই দীর্ঘ কয়েক শত বছরের মুসলিম শাসনের ইতিহাসে কখনোই মুসলিম শাসকরা ইসলামের ধর্মীয় বিশ্বাসকে জনগণের উপর চাপিয়ে দেননি৷
১৮৭৭-৭৮ সালে রুশ-তুর্ক যুদ্ধে তুরস্ক হেরে গেলে আজরা অঞ্চল রাশিয়ার অধীনে চলে যায়। ১৮৭৮ সালের বার্লিন চুক্তি অনুসারে রাশিয়া এই অঞ্চলের মুসলিমদের সহায়-সম্পত্তি বিক্রি করে দেশত্যাগের অনুমতি দেয়। তখন বিপুল সংখ্যাক মুসলিম জর্জিয়া ছেড়ে তুরস্কে চলে যান। তখন থেকেই ব্যাপকভাবে খ্রিস্টানধর্ম প্রচার শুরু হয় জর্জিয়াতে। ১৯২১ সালে সোভিয়েত শাসনের অধীনে মুসলমানরা ব্যাপক দমন-পীড়নের শিকার হন। কেড়ে নেয়া হয় তাদের ধর্মপালনের স্বাধীনতা, মুসলমানরা সমাজের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। ইসলাম ধর্মের কোন আচার-অনুষ্ঠান, রীতি-নীতি তারা প্রকাশ্যে পালন করতে পারতেন না। ইসলামী জ্ঞান মৌখিকভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম সঞ্চারিত হয়েছে।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর জর্জিয়া স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীন জর্জিয়ার সংবিধানের দাবী ছিল প্রত্যেক নাগরিকের ধর্ম ও বিশ্বাসের স্বাধীনতা থাকবে। কিন্তু মুসলমানদেরকে এই স্বাধীনতা দিতে পারেনি জর্জিয়া।
কারণ জর্জিয়ার জাতিয়তাবাদ ধর্মীয় গোষ্ঠী কেন্দ্রিক। জাতিরাষ্ট্র জর্জিয়ার জাতিয়তাবাদী বয়ানে খ্রিস্টবাদ খুবই শক্তিশালী জায়গা দখল করে আছে। এ দেশের জাতীয় চেতনাও গড়ে উঠেছে খ্রিস্টবাদকে কেন্দ্র করে। জর্জিয়ার জাতীয় পরিচয়ের সাথে খ্রিস্টবাদের প্রগাঢ় মিশ্রণের কারণে জর্জিয় আর খ্রিস্টান পরিণত হয়েছে সমার্থক শব্দে।
উনিশ শতকে জর্জিয়ার জাতীয় আন্দোলনের স্লোগান ছিল, “ভাষা, মাতৃভূমি, বিশ্বাস (খ্রিস্টবাদ)।”
তাদের বিশ্বাস অনুসারে, খ্রিস্টানরা জর্জিয় জাতিসত্ত্বা ও ভাষাকে সংরক্ষণ করেছে। তাই প্রকৃত জর্জিয় হতে হলে অবশ্যই একজন জর্জিয় নাগরিককে ধর্মপ্রাণ অর্থোডক্স খ্রিস্টান হতে হবে।
খ্রিস্টান অধ্যুষিত জর্জিয়ায় সংখ্যালঘু মুসলমানরা এজন্য ভয়াবহ বৈষম্যের শিকার। জর্জিয়ার জাতীয়বাদ ইসলামের প্রতি কোন উদারতা বা সহানভূতি দেখাতে পারেনি। সেখানে মুসলিম হওয়া মানে জর্জিয় পরিচয় ত্যাগ করে মুসলিম পরিচয়কে ধারণ করা। তারা এরকম কাউকে হুমকি হিসেবে দেখে।
উসমানীয় শাসকদেরকে জর্জিয় খ্রিস্টানরা মনে করতো বহিরাগত শত্রুপক্ষ। তাই তাদের কাছে একজন জর্জিয়ের মুসলমান হওয়া মানে শত্রুর রীতিনীতি লালন করা। আরব-পারস্য-তুরস্কের উপাস্যের উপাসনা করা। ফলাফল, এ দেশের মুসলিমদের জর্জিয়ার জাতীয়বাদী খ্রিস্টানদের কাছে প্রতিনিয়ত বিশ্বস্ততার পরীক্ষা দিতে হয় নিজের ধর্মীয় বিশ্বাস ও রীতিনীতি বিসর্জন দিয়ে, পূর্বপুরুষের ইতিহাস ভুলে গিয়ে৷
সাধারণত মুসলমানদের মতো পোশাক না পরলে, ইসলামী সংস্কৃতির কোন চিহ্নবহন না করলে, আর দশজন জর্জিয় নাগরিকের মতো চলাফেরা করলে জর্জিয়ায় কোন সমস্যাই হয়না। সমস্যা হয় যদি তারা মুসলিম পরিচয়কে প্রকাশ্যে ধারণ করে বাইরে বের হয়, যেমন হিজাব পড়ে রাস্তায় বের হলে। মানুষ তখন অদ্ভুতভাবে তাকায়, কেউ কেউ গালিগালাজ করে। এই চিত্র রাজধানী তিবলিসিতে বেশি দেখা যায়। বাটুমিতে মুসলিম জনসংখ্যা বেশি হওয়ায় এই হয়রানি কম লক্ষ্যণীয়।
জর্জিয়ার ইসলামের প্রতি অসহনশীলতা ও ইতিহাসের ভুল চিত্রায়নের ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে নতুন প্রজন্মের মুসলমানদের উপর। স্বাধীনতার পর জন্মগ্রহণ করা তরুণ প্রজন্মের অনেকেই পারিবারিক বাধাকে উপেক্ষা করে ইসলাম ছেড়ে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছে।
জর্জিয়াতে এতগুলো বড় দালানকোঠা ঠাসা শহরে, দর্শনীয় স্থাপনার ভিড়ে, ৫ ওয়াক্ত নামাজের মসজিদ মাত্র দুইটি। তিবিলিসিতে একটি আর বাটুমিতে একটি। বাটুমির ছোট্ট মসজিদটিতে সুন্নী ও শিয়া – দুই ধারার মুসলিম জনগোষ্ঠীই নামাজ পড়ে। শুক্রবারে জুমার নামাজের মসজিদের ভেতরে জায়গা হয়না অনেক মুসল্লির, তারা বৃষ্টি ও তুষারে ভিজে, রোদে পুড়ে বাইরের চত্বরে নামাজ আদায় করেন। আর পুরো দেশে বাকি ৪ শুক্রবারের মসজিদ রয়েছে , সেগুলোও খুব জরাজীর্ণ।
২০১৫ সালে নতুন মসজিদ নির্মাণের জন্য আবেদন করে জর্জিয়া মুসলিম ইউনিয়ন। মেয়র প্রথমে সবুজ সংকেত দিলেও পরে কোন সাড়া মেলেনি কতৃপক্ষের কাছ থেকে। পরে জানা যায়, মসজিদ নির্মাণের অনুমতি দিয়ে খ্রিস্টানদের বিষনজরে পড়তে চায়না স্থানীয় সরকার।
এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য কাজ করছে তিবলিসী ভিত্তিক বেসরকারী প্রতিষ্ঠান টলারেন্স এন্ড ডাইভার্সিটি ইন্সটিটিউট (টিডিআই)। টিডিআই এর গবেষণা অনুযায়ী, জর্জিয়ার পাঠ্যবইতে মুসলমানদেরকে দখলদার জাতি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে কোন কারণদর্শানো ছাড়াই। জর্জিয়ার সংস্কৃতিতে অন্য ধর্মের অবদানকে খ্রিস্টানরা স্বীকার করেনা৷ অর্থোডক্স খ্রিস্টধর্মের নেতৃবৃন্দের মাঝে অন্য ধর্মবিশ্বাসের মানুষজন ও নেতৃবৃন্দের প্রতি যে সহযোগীতা ও সহনশীলতার মনোভাব থাকা দরকার ছিল, তা একবারেই অনুপস্থিত। দীর্ঘসময় একনায়কতান্ত্রিক সোভিয়েত শাসনাধীনে থাকার কারণে এই ধর্মীয় সহনশীলতা নষ্ট হয়ে গেছে।
জর্জিয়া এখনো সোভিয়েতে শাসনের সর্বগ্রাসী প্রভাব থেকে বের হতে পারেনি। টিডিআই এর মতামত, আস্তে আস্তে জর্জিয়াকে সোভিয়েত নির্মিত সাংস্কৃতিক শেকল থেকে বের হয়ে আসতে হবে আমাদেরকে। জর্জিয় মুসলিমদেরকে নিজেদের আত্মপরিচয়কে ধারণ করতে হবে, জর্জিয়ার যুবসমাজকে জানাতে হবে তাদের প্রকৃত ইতিহাস৷ জর্জিয়ার সমাজে ধর্মীয় বৈচিত্র্যের ধারণাটাকে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করতে হবে, এজন্য বেশি বেশি প্রচারণা ও সাথে সাথে মুসলমানদের বৈশ্বিক রাজনৈতিক বলয় প্রয়োজন।
সংকলক- সাবরিনা সুমাইয়া