মুসলিম পোর্ট

জাপানের ইসলামের ইতিহাস

জাপান মুসলিম সংখ্যালঘু দেশ হিসেবে পরিচিত হলেও দেশটিতে ক্রমেই ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। জাপানে গত এক দশকে মুসলিম জনসংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণের চেয়ে বেশি হয়েছে। এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে দেশটিতে মসজিদের সংখ্যাও বেড়ে গেছে।

পূর্ব এশীয় দেশগুলোর মধ্যে জাপানে ইসলাম সব থেকে দ্রুত গতিতে বিস্তার লাভ করার খেতাবপ্রাপ্ত। দেশটিতে মুসলিম  জনসংখ্যা আগে ছিল ১ লাখ ১০ হাজার তা বেড়ে বর্তমানে ২ লাখ ৩০ হাজার হয়েছে।

জাপানের সরকার দেশটিতে বিদেশি শ্রমিক ও শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে সুযোগ সুবিধা বাড়িয়ে দিয়েছে। 

জাপানের বৃহত্তম দ্বীপপুঞ্জের সবচেয়ে দক্ষিণের কিউশুর মেক্কা বেপ্পুতে একটি চারতলা বিল্ডিংয়ের প্রতি শুক্রবারে কয়েক হাজার মুসলিম পুরুষ ও নারী মসজিদে নামাজ আদায় করেন।

জাপানে পড়তে আসা বিদেশি শিক্ষার্থীরা অনেকেই রিতসুমেইকান এশিয়া প্যাসিফিক ইউনির্ভাসিটিতে পড়াশোনা করেন। পাশাপাশি তারা শহরের বিভিন্ন হোটেলগুলোতে খণ্ডকালীন কাজ করে থাকেন।

জাপানের ওয়াসেদা ইউনিভার্সিটির টানাডা হিরোফুমির এক জরিপ অনুযায়ী, ২০১০ সালে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১০ হাজার। কিন্তু ২০১৯ সালের শেষের দিকে সে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ৩০ হাজারে। এর মধ্যে ৫০ হাজারের বেশি মানুষ ধর্মান্তরিত হয়েছেন।

জাপানে ১১০টির বেশি মসজিদ রয়েছে।

ইতিহাসের সাক্ষী জাপানের সর্বপ্রথম মসজিদ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সেখানে ইসলামের বিস্তার শুরু হয়। যুদ্ধ চলাকালীন জাপানি সৈন্যরা বিভিন্ন মুসলিম দেশে অবস্থান করেছিলেন। তাঁরা সেখানে ইসলামের সৌন্দর্য উপলব্ধির পর ইসলাম গ্রহণ করতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ওমর বোকেনা নামের একজন সেনাপ্রধান জাপান ফিরে ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেন। এর পর থেকে ইসলাম গ্রহণকারীর সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকে। তা ছাড়া চাইনিজ মুসলিমদের জাপানে হিজরত করাও সে অঞ্চলে ইসলাম প্রচারে অনেক ভূমিকা রেখেছে। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিক থেকেই কোরআন ও অন্যান্য ইসলামী গ্রন্থ জাপানি ভাষায় অনূদিত হতে থাকে। মসজিদ ও ইসলামিক সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। এগুলোও জাপানে ইসলাম প্রচারে অনেক অবদান রেখে চলছে।

জাপানে নির্মিত প্রথম মসজিদ- মসজিদে কুবা বা কোবা মসজিদ

জাপানে প্রতিষ্ঠিত সর্বপ্রথম মসজিদটি ‘কোবে মসজিদ’ নামে প্রসিদ্ধ। মসজিদটি কোবে শহরে অবস্থিত। কোবে জাপানের ষষ্ঠ বৃহত্তম নগরী। এটি হনশো দ্বীপের দক্ষিণ দিকে ও অকাসা শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার উত্তর দিকে অবস্থিত। এটি ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহ্যময় একটি নগরী।

জাপানে অবস্থানরত বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা, বিশেষত ভারতীয় কয়েকজন নিষ্ঠাবান ব্যবসায়ীর প্রচেষ্টা ও অর্থায়নে এই কোবে মসজিদ নির্মিত হয়। কোবে মুসলিম সেন্টার নামেও এর বেশ পরিচিতি রয়েছে। মসজিদ নির্মাণের লক্ষ্যে ১৯২৮ সাল থেকে অর্থ সংগ্রহ শুরু হয় এবং ধীরে ধীরে কাজ চলতে থাকে। অবশেষে ১৯৩৫ খমসজিদটির নির্মাণকাজ সম্পূর্ণ হয়। তুরস্কের নির্মাণকৌশল অবলম্বনে নির্মিত মসজিদটি একটি দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যে পরিণত হয়।

সেই বছরের ২ আগস্ট শুক্রবার আনুষ্ঠানিকভাবে নিয়মিত নামাজ শুরু হয়। যেহেতু সময়টা ছিল গরমের তাই তাঁরা শীতকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। ১১ অক্টোবর স্থানীয় অমুসলিম বাসিন্দাদের মসজিদ পরিদর্শনের আমন্ত্রণ জানানো হয়। সেই অনুষ্ঠানে ছয় শতাধিক জাপানি উপস্থিত হয়েছিলেন। কোবে শহরের মেয়র মিস্টার গিনজিরো কাটসোদা ওই দিন তাঁর বক্তব্যে বলেছিলেন, আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস রাখি, মসজিদটি এখানকার মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যে সহাবস্থান, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি, সর্বোপরি একটি শান্ত ও সুশৃঙ্খল সমাজ বিনির্মাণে বিশেষ ভূমিকা রাখবে।’

মসজিদে কুবার অভ্যন্তরে

সূচনালগ্ন থেকে আজ অবধি মসজিদটি ইতিহাসের একটি বিরাট দলিল ও সাক্ষী হয়ে আছে। এটি জাপানের পুরনো ঐতিহাসিক নিদর্শনাদির অন্যতম।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ১৯৪৫ সালে আমেরিকান সৈন্যরা পুরো কোবে বোমা মেরে ধ্বংস করে দেয়। শহরের সবগুলো দালান ও স্থাপত্য তারা মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়। কিন্তু অবাক করার মতো ব্যাপার হলো, কোবে শহরের এই মসজিদ স্বমহিমায় টিকে রয়েছে। শুধু কাচের কয়েকটি জানালা ও কিছু আস্তর খসে পড়েছিল।

সে সময় আমেরিকান সেনাবাহিনীর এমন বর্বরতা ও আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্য জাপানের যোদ্ধারা এই মসজিদের ভূগর্ভস্থ কক্ষে আশ্রয় নিয়েছিলেন। মসজিদ ছাড়া লুকানোর মতো তাঁদের কোনো বিকল্প ছিল না। এভাবে মসজিদটি সব জাতির মানুষের জন্য আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছিল।

মসজিদটির দুর্লভ ইতিহাসের এখানেই সমাপ্তি নয়। ১৯৯৫ সালে জাপানে যে ভূমিকম্প হয়েছিল, বড় হেনশিন বা কোবে ভূমিকম্প নামক ওই দুর্যোগকে জাপানের ইতিহাসে দ্বিতীয় বৃহত্তম ভূমিকম্প হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। সেই ভূমিকম্পে আশপাশের সব বিল্ডিং মাটির সঙ্গে মিশে গেলেও এই মসজিদ স্বস্থানে নিরাপদে বহাল থাকে। যার কারণে আজও জাপানিরা এই মসজিদের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকায়।

মসজিদটি প্রতিষ্ঠায় জাপানের প্রভাবশালী কিছু অমুসলিম ব্যক্তিও আর্থিক সহযোগিতা করেন। তারপর ১৯৩৮ সালে জাপানের অপর একটি শহর নাগোয়াতে একটি মসজিদ নির্মিত হয়। ১৯৭৭ ওসাকাতেও একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়।

জাপানের অন্যান্য মসজিদ পরিচিতি

১৯৩৬ সালের দিকে আরেকজন ভারতীয় মুসলিম পণ্ডিত ও ধর্মপ্রচারক আলীমুল্লাহ্ সিদ্দিকী জাপানে আসেন এবং একাধিক বক্তৃতা দেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান যখন এশিয়ার বিভিন্ন রাষ্ট্র দখল করে নেয় সেসব দেশে অনেক জাপানি নাগরিক বিভিন্ন কর্ম উপলক্ষে বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ এবং মুসলিম সংস্কৃতির প্রভাবে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে বিখ্যাত জাপানি ব্যক্তিরাও ছিলেন। যুদ্ধের পর জাপানের সঙ্গে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হতে থাকে। ১৯৫৬ থেকে ১৯৬০ সালের মধ্যে পাকিস্তান থেকে একাধিক তবলিগ দল ও দলনেতা জাপানে আসেন। আধ্যাত্মিক চিন্তা সঞ্চারকারী এই আন্দোলনে বহু জাপানি ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হোন।

সত্তর দশকের দিকে জাপানের দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের কারণে সৌদি আরব, ইরান, ইরাক, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি তেল উৎপাদনকারী মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় এবং আজও তা কার্যকর। এশিয়ার দুটি মুসলিম রাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার প্রভূত উন্নতির পেছনে জাপানের অবদান অনস্বীকার্য। ১৯৭০ সালে সৌদি বাদশাহ ফয়সাল বিন আবদুল আজিজ জাপান সফর করেন। এটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা।

আশি-নব্বই দশকে জাপানের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এশিয়া, আফ্রিকার প্রচুর মুসলিম ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক ও গবেষক উচ্চশিক্ষা গ্রহণে আসতে থাকেন। অনুরূপ পাকিস্তান, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া থেকে অসংখ্য শ্রমিক এসে এদেশের কলকারখানা ও সার্ভিস ক্ষেত্রে কাজ করছেন, গড়ে তুলছেন মসজিদ, ছড়িয়ে দিচ্ছেন মুসলিম সংস্কৃতি, রেখে চলেছেন জাপানিদের সঙ্গে মৈত্রীবন্ধনে জোরালো ভূমিকা।

এই সমস্ত তৎপরতার ফল এই হয়েছে যে, ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত জাপানে মুসলমানদের সংখ্যা ৩ হাজার বলা হতো, এখন সরকারী হিসাব মতে সেখানে মুসলমানদের সংখ্যা ৫০ হাজার। তাছাড়া যে সমস্ত মুসলমান অন্যান্য দেশ থেকে এসে এখানে অধিবাস গ্রহণ করেছেন,তাদের সংখ্যা দু’লাখে পৌঁছেছে। এর অর্থ এই যে, জাপানে সর্বমোট আড়াই লাখ মুসলমান রয়েছে।

যদিও গত কয়েক বছরে জাপানে মুসলমানদের সংখ্যা বেশ দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু তাদের ধর্মীয় প্রয়োজানাদি পুরো করার কাজ চলছে তার তুলনার বেশ মন্থরগতিতে। এখনও এখানে ধর্মীয় তৎপরতার সেই পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি, যা ইউরোপ ও আমেরিকার কতক দেশে আল্লাহর মেহেরবানীতে সৃষ্টি হয়েছে।

তারপরেও জাপানের বর্তমান মুসলমান প্রজন্ম জাপানে ইসলামের প্রচার ও প্রসারের আন্তরিক ইচ্ছা পোষণ করে। হয়তবা একসময় অন্যান্য দেশের মতো জাপানেও ইসলাম জনপ্রিয় ও প্রভাব বিস্তারকারী ধর্মে পরিণত হবে।

১৯৭০ সালের দিকে টোকিওতে মসজিদের সংখ্যা ছিল মাত্র দুটি। এখন এখানে ২০০টি মসজিদ ও মুসাল্লা (অস্থায়ী নামাজঘর) আছে। জাপানে কবে ইসলামের আলো প্রবেশ করেছে সেটা অজানা।

জাপানে ইসলাম প্রচার ও প্রসারের ইতিহাস

জাপানে ইসলামের ইতিহাস খুব বেশী পুরনো নয়। ইসলামি ইতিহাসের প্রথম ও মধ্যযুগে এখানে কোন মুসলমানের আগমন কিংবা কোন দাওয়াতি তৎপরতার কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না। যতটুকু জানা যায় সম্ভবত উসমানি খেলাফতের সময় সুলতান আব্দুল হামিদ [Abdul Hamid II (reigned 1876-1909) ] সর্বপ্রথম ১৮৯০ সালে নৌপথে কিছু জাহাজ সৌজন্যমূলক এক মিশনের জন্য জাপানে পাঠিয়েছিলেন।

তার উদ্দেশ্য ছিলো এ অঞ্চলে ইসলামের দাওয়াতের সম্ভাবনা সম্পর্কে সমীক্ষা চালানো।

প্রতিনিধি দলটি জাপানে খুব ভালো প্রভাব সৃষ্টি করে। মূলত তারা এ অঞ্চলে ইসলাম কবুলের বীজ বপন করে যান। কিন্তু এটি একটি ট্রাজেডী যে, এ প্রতিনিধি দল যখন তুরস্কে ফিরে যাচ্ছিলেন তখন জাপানেরই সমুদ্রে প্রচণ্ড ঝড়ের আঘাতে জাহাজটি ডুবে যায়। ছয়শ’ নয় জন যাত্রীর মধ্যে মাত্র ৬৯ জন জীবিত ছিলেন।

অবশিষ্ট সবাই মারা যান। এদের মধ্যে সুলতানের ভাইও ছিলো।

দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল রাতের আঁধারে। নিকটবর্তী দ্বীপের জাপানী অধিবাসীরা দুর্ঘটনা কবলিত লোকদের অত্যন্ত আন্তরিকভাবে সাহায্য করেন। জাপানের বাদশাহ মেইজি আহতদের চিকিৎসা ও জীবিতদের তুরস্কে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। মৃতদেরকে দুর্ঘটনাস্থলের নিকটেই দাফন করা হয় এবং সেখানে একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়।

সে সময় থেকে প্রতিবছর এ দুর্ঘটনার স্মৃতি হিসেবে একটি অনুষ্ঠান করা হয়।

সৌজন্যমূলক মিশনের অধিকাংশ সদস্যদের মৃত্যু জাপানের লোকদের উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করে।

 চব্বিশ বছর বয়সী এক তরুণ যুবক তুরজিরু ইয়ামাডা (Torajiro Yamada) (যিনি একজন উচ্চ শিক্ষিত সাংবাদিক ছিলেন-)  এ দুর্ঘটনায় অনেক বেশী প্রভাবিত হন।

তিনি দুর্ঘটনা কবলিত শহীদদের পরিবারের লোকদের জন্য সারাদেশে চাঁদা সংগ্রহের অভিযান চালান। তিনি ৫৪০ জন শহীদের পরিবারের জন্য বিশাল অঙ্কের অর্থ সংগ্রহ করেন এবং জাপান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে আবেদন করে এ অর্থ তুরষ্ক পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাঁর আবেগের মূল্যায়ন করে এবং তাঁকেও সে অর্থ সহকারে তুরষ্কে পাঠিয়ে দেয়।

তুরাজিরু ইস্তাম্বুল পৌঁছে তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বিশাল ও জাঁকজমকপূর্ণ এক অনুষ্ঠানে এ অর্থ তুরস্কের নৌ মন্ত্রণালয়ের নিকট হস্তান্তর করা হয় যাতে করে মন্ত্রণালয় এ অর্থ দুর্ঘটনাকবলিত লোকদের মধ্যে বণ্টন করতে পারে।

এ সময় সুলতান আদুল হামিদ স্বয়ং তুরাজিরুকে ডেকে নিয়ে দু’ বছর তুরস্কে অবস্থান করার এবং তুরষ্কের সেনা অফিসারদের জাপানী ভাষা শিখানোর প্রস্তাব দেন। তুরাজিরু তাঁর এ প্রস্তাব গ্রহণ করেন। তুর্কি অফিসারদের জাপানী ভাষা শিখানোর পাশাপাশি তিনি নিজেও তুর্কী ভাষা শিখেন । ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞানার্জন শুরু করেন। কিছুদিন পরে তিনি মুসলমান হয়ে নিজের নামের সাথে ‘সিঙ্গিতুস'(shingtsu) শব্দ যোগ করেন।

জাপানী ভাষায় এর অর্থ ‘চাঁদ’।

অন্য কিছু সূত্রে জানা যায় যে,

তিনি তাঁর ইসলামী নাম রেখেছিলেন ‘আব্দুল খলীল’। তুরষ্কে অবস্থানকালে তিনি যখন বাড়ীর লোকদের কাছে পত্র লিখতেন তখন তার ইসলামী নামও সাথে লিখে দিতেন।

এখন পর্যন্ত জানা তথ্যানুসারে তুরাজিরু ছিলেন জাপান ভূখণ্ডের প্রথম ব্যক্তি, যিনি ইসলাম কবুল করেছিলেন। তিনি ৯১ বছর জীবিত ছিলেন। ১৯৫৭ সালে তিনি ইন্তেকাল করেন।

তবে অপর এক সূত্র থেকে জানা যায় জাপানী প্রথম মুসলিম ছিলেন অসোতারো নোডা(Shotaro Noda) নামের একজন সাংবাদিক। তিনি ৬৯ জন বেঁচে যাওয়া যাত্রীর সাথে তুরস্কে গিয়েছিলেন এবং সুলতানের অনুরোধে সেখানে থাকেন। সেখানে অবস্থান কালে একজন ব্রিটিশ মুসলিমের সাথে তার সাক্ষাৎ হয়।

তাদের দুজনের মাঝে এক দীর্ঘ আলোচনা হওয়ার পর অসোতারো মুসলিম হয়ে যান এবং তার নাম রাখেন আব্দুল হালিম (Abdul Haleem Noda)।

তবে k.Olgun এর মতে তুরজিরু এবং অসোতারো একসাথে গিয়েছিলেন এবং মুসলমান হয়েছিলেন। বলা হয় যে, এই ঘটনার পর ১৯০৯ সালে অপর আরেক জাপানী ব্যক্তি ইয়ামাওকা ইসলাম কবুল করে নিজের নাম রাখেন ‘ওমর ইয়ামাওকা’। তিনি হজ্জ করার সৌভাগ্যও লাভ করেছিলেন।

তারপর আরো অনেক জাপানী লোক মুসলমান হয়। অপর দিকে তুর্কিস্তানে বলসেভিক বিপ্লবের সময় রাশিয়ানদের নির্যাতনে অসহ্য হয়ে উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, কাজাকিস্তান ও কিরগিজীস্তান থেকে বহু সংখ্যক মুসলমান পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। তাদের মধ্যে থেকে কিছু লোক জাপানেও ছড়িয়ে পড়ে এবং রাজনৈতিক আশ্রয় লাভ করে।

জাপানে বসবাস করায় মুসলমানরা সম্মিলিতভাবে কাজ শুরু করে। তাদের প্রচেষ্টার ফলে বহু জাপানী অধিবাসী ইসলাম গ্রহণ করে। একইসাথে ভারত,চীন ও দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ থেকেও অনেক মুসলমান জাপানে এসে বসবাস শুরু করেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে জাপানকে অনেক মুসলিম দেশের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে হয়।

যুদ্ধ শেষে শিল্পের উন্নতির জন্য তেল উৎপাদনকারী মুসলিম দেশের সাথে জাপানের সম্পর্ক বৃদ্ধি পায়। এর ফলে জাপানে মুসলমানদের যাতায়াত অনেকাংশে বেড়ে যায়। জাপানী অধিবাসীরাও মুসলিম দেশগুলোতে ভ্রমণ করে।

এমনিভাবে দু’ তরফাভাবেই জাপানে ইসলামের প্রসার ঘটে।

এ সময় জাপানী মুসলমানগণ কিছু সংগঠনও প্রতিষ্ঠা করেন।

জাপানী ভাষায় পবিত্র কুরআনের কয়েকটি অনুবাদ প্রকাশ করা হয়। ১৯৬৬ সালে একটি ইন্টারন্যাশানাল ইসলামিক সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হয় যা ১৯৭৪ সালে ‘ইসলামিক সেন্টার জাপানের’ সঙ্গে সংযুক্ত হয়। ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারটি এখনোও একটি বোর্ড অব ডিরেক্টর এর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে।

তার সদস্যদের মধ্যে আরবী,পাকিস্তানি,তুর্কী ও খোদ জাপানী অনেক মুসলমানগণ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে অনেক বই জাপানী ভাষায় প্রকাশ করা হয়েছে।

এর মধ্যে অন্যতম হলো পবিত্র কুরআনুল কারীমের তরজমা। এছাড়া ‘আসসালাম’ নামে কয়েকটি ত্রৈমাসিক পত্রিকাও প্রকাশিত হয়। প্রতিষ্ঠিত সেন্টারটি থেকে জাপানী শিশুদের প্রাথমিক ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা ও হজ্জ ইচ্ছুকদের হজ্জে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়।

এছাড়া ১৯৫৬ সাল থেকে তাবলীগ জামাতও জাপানে তাদের দাওয়াতী কাজ শুরু করেছে এবং অনেকাংশে সফলও হয়েছে। এছাড়া সংগঠনটির পক্ষ থেকে জাপানের টোকিওর শহরতলী এলাকা সাইতামার (saitama) একটি ভবন ক্রয় করে সেখানে একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেছে।

এই সকল কাজের ফলে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত যেখানে মুসলমানদের সংখ্যা ৩ হাজার বলা হতো সেখানে এখন সরকারী হিসাব মতে সেখানে মুসলমানদের সংখ্যা ৮০ হাজার ছাড়িয়েছে। তাছাড়া যে সমস্ত মুসলমান অন্যান্য দেশ থেকে এসে এখানে অধিবাস গ্রহণ করেছেন তাদের সংখ্যা দু’লাখে পৌঁছেছে।

যদিও গত কয়েক বছরে জাপানে মুসলমানদের সংখ্যা বেশ দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে সে তুলনায় তাদের ধর্মীয় কালচার গুলো অনেক মন্থর গতিতে চলছে।

এখনও এখানে ধর্মীয় তৎপরতার সেই পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি, যা ইউরোপ ও আমেরিকার কিছু কিছু দেশে সৃষ্টি হয়েছে। তারপরেও জাপানের বর্তমান মুসলমান প্রজন্ম জাপানে ইসলামের প্রচার ও প্রসারের আন্তরিক ইচ্ছা পোষণ করে। হয়তোবা একসময় অন্যান্য দেশের মতো জাপানেও ইসলাম জনপ্রিয় ও প্রভাব বিস্তারকারী ধর্মে পরিণত হবে।

সংকলন- আব্দুল্লাহ আল মুঈন