মুসলিম পোর্ট

মিশরের ইসলামের ইতিহাস:

সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কারণে যে দেশটি আজও সমগ্র দুনিয়াবাসীর মনোযোগ আকর্ষণ করে বিশ্ব দরবারে টিকে আছে সেই দেশটির নাম হলো মিশর। মিশরের পশ্চিমে লিবিয়া, দক্ষিণে সুদান, দক্ষিণ পূর্ব অংশে ফিলিস্তিন অবস্থিত। স্থলসীমানার পাশাপাশি এই দেশটির রয়েছে বিরাট এক সমুদ্র সীমানা। এর উত্তর দিকে রয়েছে ভূমধ্য সাগর আর দক্ষিণে রয়েছে লোহিত সাগর। এই দেশের অভ্যন্তর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে নীল নদ-সহ আরো অনেক নদ-নদী। মূলত মানব সভ্যতার সূচনাকাল থেকে এই অঞ্চলে সভ্যতা গড়ে উঠে। মানব সভ্যতার ইতিহাসে অনেক বড় বড় সভ্যতা এখানে গড়ে উঠে এবং আল্লাহর অনেক নবীও এই দেশে প্রেরিত হয়ে তাওহীদের বাণীকে বুলন্দ করেন। এই সকল নবীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন হযরত মূসা (আ.), হযরত ইয়াকুব (আ.) ও হযরত ইউসুফ (আ.)। মানব সভ্যতার সূচনাকাল থেকেই এই অঞ্চলটি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় মুসলমানগণও এই অঞ্চলটির দিকে বিশেষভাবে নজর দেন এবং হযরত উমর (রা.) এর শাসনামলে হযরত আমর ইবনুল আসের নেতৃত্বে ৬৪০ সালে সমগ্র মিশর ইসলামী খেলাফতের অন্তর্ভুক্ত হয়। মিশরের বিজয় সম্পন্ন হলে হযরত আমর ইবনুল আস (রা.) মিশর বিজয়ীর খেতাব পান এবং হযরত উমর (রা.) তাকে মিশরের গভর্নর নিযুক্ত করেন। আমর ইবনুল আস গভর্নর হওয়ার পর এই অঞ্চলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা

প্রতিষ্ঠা করেন এবং মানুষের অর্থনৈতিক জীবনে অনেক বেশি সমৃদ্ধতা বয়ে নিয়ে আসেন। পরবর্তীতে হযরত উসমান (রা.) খলিফা নির্বাচিত হলে ৬৪৮ সালে আমর ইবনুল আসকে গভর্নরের পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে আব্দুল্লাহ ইবনে সা’দ বিন আবু সারহকে গভর্নর নিযুক্ত করেন। হযরত উসমান (রা.) শাহাদাতের পর হযরত আলী (রা.) ও হযরত মুয়াবিয়া (রা.)-এর মধ্যে যে দ্বন্দ্ব শুরু হয় এই সময়ে যারা হযরত আলী (রা.)-এর বিপক্ষে ছিলো তারাই মিশরে ক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হয়। যার ফলে হযরত আলী (রা.) সময়ে মিশর বিরোধীদের অন্যতম একটি শক্তিশালী কেন্দ্রে পরিণত হয়।)

উমাইয়া খেলাফতের সর্বশেষ খলিফা দ্বিতীয় মারওয়ান মিশরে সংগঠিত একটি যুদ্ধে আব্বাসী সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হলে মিশরে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। আব্বাসীগণ ‘আব্বাসী খেলাফত’ প্রতিষ্ঠা করার পর মিশরেও একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয় এবং মিশর ও এই অঞ্চলে যে সকল গভর্নর প্রেরণ করতেন তাদের অধিকাংশই ছিলো খোরাসানের। আব্বাসী খেলাফতের খলিফাগণ মিশরের গভর্নর পরিবর্তন করলেও উমাইয়াদের গড়া প্রশাসনিক ব্যবস্থায় খুব বেশি পরিবর্তন আনেননি। এমনকি উমাইয়া শাসনামলের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদেরকেও পরিবর্তন করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেননি। তবে তাদের নিয়োগকৃত গভর্নরকে ঘন ঘন পরিবর্তন করতেন। পরবর্তীতে সৃষ্ট বিভিন্ন সমস্যার কারণে মিশরকে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করাটা আব্বাসী খেলাফতের জন্য কঠিন হয়ে যায়। বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে দিয়ে হলেও আব্বাসীরা ৯৬৯ সাল/৩৫৮ হিজরি পর্যন্ত নিজেদের শাসনাধীনে রাখতে সক্ষম হন।

৯৬৮ সালের দিকে মিশরে খরার কারণে ব্যাপক খাদ্য সঙ্কট দেখা দিলে জনগণ তৎকালীন গভর্নর আবুল মিসাক কাফুর এর বিরুদ্ধে ফুসে উঠে। খাদ্য সঙ্কট চলাকালীন সময়ে মহামারীও দেখা দেয়। এমতাবস্থায় গভর্নর অসহায় হয়ে পড়লে রাজনৈতিক সঙ্কটও ঘনিভূত হয়। এটাকে দারুণ একটি সুযোগ হিসেবে কাজে লাগায় ফাতিমীরা। ফাতিমীদের সেনাপতি জাওহার আস সিকিল্লির সেনাপতিত্বে ফাতিমীরা (১৭ শাবান ৩৫৮/৫ জুলাই ৯৬৯) মিশরকে দখল করে নেয়। ফাতিমীগণ মিশরের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করার পর শাসন ব্যবস্থাসহ সকল ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন

নিয়ে আসে। সেনাপতি জাওহার ফুসতাতের উত্তরপূর্বে কায়রো শহর প্রতিষ্ঠা করেন এবং কায়রোর মধ্যবর্তী স্থানে মসজিদ ও রাজপ্রসাদ নির্মাণ করেন। মুদ্রার ক্ষেত্রেও সংস্কার নিয়ে আসেন এবং আল দিনারুল মুইজ্জি নামে নতুন মুদ্রা চালু করেন। এর পরের বছরই আল-আজহার মসজিদ নির্মাণের কাজ শুরু করেন এবং ৩৬১ হিজরি/৯৭২ সালে এই মসজিদের কাজ সমাপ্ত হয় । পরবর্তীতে এই মসজিদটিই ফাতিমী রাষ্ট্রের কেন্দ্রবিন্দুতে রূপান্তরিত হয়। ফাতিমীদের নেতা মুইজ লিদিনিল্লাহ আফ্রিকা থেকে এসে ৩৬২ হিজরি/৯৭৩ সালে কায়রোকে তার ফাতিমী রাষ্ট্রের রাজধানী ঘোষণা করেন। কায়রো শহরটি এইভাবে কর্ডোভা ও বাগদাদের মতো খেলাফতের গুরুত্বপূর্ণ একটি কেন্দ্রে রূপান্তরিত হয়ে একটি বিশ্ববিখ্যাত শহরে পরিণত হয়। ফাতিমী খলিফা আযিয বিল্লাহর সময়ে মিশরে সকল দিক থেকে ব্যাপক উন্নতি ও অগ্রগতি হয় এবং খলিফা মুসতানসির (১০৩৬-১০৯৪) এর সময়ে কায়রোতে বড় বড় স্থাপনা প্রতিষ্ঠা করা হয়। মিশরে ফাতিমীদের শাসন চলে ১১৭১ সাল পর্যন্ত। ১১৭১ সালে সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ফাতিমীদেরকে পরাজিত করে আইয়ুবী সালতানাত প্রতিষ্ঠা করেন।

আইয়ুবী সালতানাত মিশরের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান দখল করে আছে। ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং ইসমাইলিয়া মাজহাবের (ইসমাইলি শিয়া) চিন্তাধারা ও তাদের প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে এসে মিশরে পুনরায় সুন্নি ধারা প্রতিষ্ঠা করে। সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী মিশরকে পুনরায় আব্বাসী খেলাফতের সাথে সম্পৃক্ত করে দেন এবং আব্বাসী খলিফার নামে খুতবা পাঠ করার আদেশ করেন। এর পর তিনি সেখানে সৃষ্ট বিদ্রোহকে দমন করে মিশরে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক স্থিতিশীলতা আনয়ন করেন। জ্ঞানের ক্ষেত্রেও সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ব্যাপক সংস্কার সাধন করেন এবং শিয়া ধারার পরিবর্তে সুন্নী সেলজুকী ধারা চালু করেন। এক অর্থে বলতে গেলে তিনি এক জ্ঞানের আন্দোলন শুরু করেন এবং তার প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে হানাফি, শাফেয়ী ও মালেকী মাজহাবের ফিকহ পঠিত হতে থাকে। এভাবে মিশরে এক নতুন ধারার সূচনা হয় ও জ্ঞানের ক্ষেত্রে কর্ডোভা ও বাগদাদকেও ছাড়িয়ে যায়। ৬৪৮ হিজরি / ১২৫০ সাল পর্যন্ত প্রায় ৮০ বছর মিশরে আইয়ুবী সালতানাত প্রতিষ্ঠিত থাকে।

৬৪৮ হিজরি/১২৫০ সালে মিশরের নিয়ন্ত্রণ মামলুকদের হাতে চলে যায়। ৬৪৮ হিজরি/১২৫০ সালে মামলুকীরা মামলুক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। মামলুকীগণ মিশরের ব্যাপক উন্নতি করেন এবং মিশরকে ইসলামী সভ্যতার প্রাণকেন্দ্রে পরিণত করেন। শুধু তাই নয় অপ্রতিরোধ্য ও সমগ্র মুসলিম উম্মাহকে নাস্তানাবুদকারী ও ধ্বংসপূরীতে পরিণতকারী মোঙ্গলদেরকে আইন জালুতের যুদ্ধে পরাজিত করলে মামলুকীদের গ্রহনযোগ্যতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। মামলুকীগন মিশর ও সিরিয়াসহ উত্তর আফ্রিকার বড় একটি অংশ ১৫১৭ সাল/ ৯২৩ হিজরি পর্যন্ত শাসন করেন। পরবর্তীতে তাদের মধ্যকার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও প্রশাসনে নৈরাজ্যের কারণে মামলুকী শাসনাধীন অঞ্চলসমূহ নিজেদেরকে স্বাধীন ঘোষণা করা শুরু করে।

এদিকে তৎকালীন সময়ে উসমানী সুলতান ছিলেন ইয়াভুজ সুলতান সেলিম। তিনি এটাকে সুযোগ হিসেবে ধরে নিয়ে ও সমগ্র দুনিয়াকে উসমানী সালতানাতের অধীনে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য উত্তর আফ্রিকায় অভিযান পরিচালনা করেন এবং মিশরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সেখানে মামলুকী শাসন ব্যবস্থার সমাপ্তি ঘটান।

উসমানী সালতানাতের সুলতান ইয়াভুজ সেলিম ১৫১৭ সাল তথা ৯২৩ হিজরিতে মিশরের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর থেকে মিশরে এক নতুন ইতিহাসের সৃষ্টি হয় এবং মিশর পুনরায় আফ্রিকার দেশসমূহের কেন্দ্রে পরিণত হয়।

অষ্টাদশ শতাব্দীতে এসে উসমানী খেলাফত দুর্বল হয়ে পড়লে বিভিন্ন অঞ্চলের উপর তার নিয়ন্ত্রণ হারাতে থাকে। উসমানী খেলাফতের এই দুর্বলতার সুযোগে ফরাসি কমান্ডার নেপোলিয়ান বোনাপার্ট মিশরে ১৭৯৮ সালে আক্রমণ করে মিশরকে দখল করে নেয়। কিন্তু ফরাসিরা মিশরে দীর্ঘদিন স্থায়ী হতে পারেনি। কয়েক বছরের মধ্যেই উসমানী রাষ্ট্র মিশরকে ফ্রান্সের দখলদারিত্ব থেকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। কিন্তু ফ্রান্স অনেক বড় বড় কিছু প্রভাব রেখে যাওয়ায় দীর্ঘদিন পর্যন্ত উসমানী রাষ্ট্র মিশরে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়নি।

পরবর্তীতে আরব জাতীয়তাবাদী আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে এবং উসমানী রাষ্ট্র আরো বেশি দুর্বল হয়ে পড়লে ১৮৮২ সালে ব্রিটেন মিশর আক্রমণ করে দখল করে নেয়। এরপর উসমানী রাষ্ট্রের সাথে ব্রিটেন দর কষাকষি শুরু করে এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত ব্রিটেন যেভাবেই হোক মিশরে তার নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখে।

১৯১৪-১৯১৮ পর্যন্ত মিশরে ব্যাপক অর্থনৈতিক সঙ্কট দেখা দেয় এবং মিশরে স্বাধীনতা আন্দোলন দানা বেঁধে উঠলে জনগণও এই সকল স্বাধীনতা আন্দোলনে ব্যাপক সমর্থন প্রদান করে। মিশরের এই স্বাধীনতা সংগ্রাম চলে ১৯২২ সাল পর্যন্ত। অবশেষে ব্রিটেন বাধ্য হয়ে ১৯২২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি মিশরের স্বাধীনতাকে মেনে নেয়। মিশর স্বাধীনতা লাভ করলে মিশর নতুন একটি যুগে প্রবেশ করে এবং মিশরে রাজতন্ত্র শুরু হয়। কিন্তু এই সময়েও বার বার সরকার পরিবর্তন ও অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণে জনগণ রাজার উপর অতিষ্ঠ হয়ে উঠে। জনগণের এই অসন্তোষকে কাজে লাগিয়ে জামাল আব্দুন নাসের এর নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর একটি দল (আদ-দাব্বাতুল আহরার) সেনা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ১৯৫৫ সালে মিশরের ক্ষমতা গ্রহন করে নেয়। এভাবে মিশর রাজতন্ত্র থেকে সেনাশাসনের যুগে প্রবেশ করে। জামাল আব্দুন নাসের ১৯৭০ সাল পর্যন্ত মিশরের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকে এবং এই সময়টা মিশরের ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি সময়। মিশর ও আরব বিশ্বে সবচেয়ে প্রভাবশালী ইসলামী আন্দোলন আল-ইখওয়ানুল মুসলিমিনের উপর সবচেয়ে বেশি নির্যাতন হয় এই জামাল আব্দুন নাসেরের আমলেই।

১৯৭০ সালে জামাল আব্দুন নাসের মৃত্যুবরণ করলে আনওয়ার সাদাত মিশরের রাষ্ট্রপতি হন। আনওয়ার সাদাত ১৯৬৯ সাল থেকে মিশরের 4 উপ-রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর আনওয়ার সাদাত দেশের ভেতরে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব কমিয়ে আনার চেষ্টা করেন এবং বিশেষ করে ইখওয়ানের উপর জুলুম নির্যাতন কমিয়ে আনেন। আনওয়ার সাদাত সবচেয়ে বেশি জোর দেন মিশরের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির দিকে।

১৯৭৫ সালে আনওয়ার সাদাত বিমান বাহিনীতে কর্মরত হুসনি মোবারককে উপ-রাষ্ট্রপতি পদে মনোনীত করেন এবং আনওয়ার সাদাতের মৃত্যুর পর তথাকথিত নির্বাচনের মাধ্যমে হুসনি মোবারক মিশরের চতুর্থ রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। হুসনি মোবারক যখন ক্ষমতা গ্রহন করেন তখন মিশরের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ ছিলো। তিনিও তার পূর্বসূরী আনওয়ার সাদাতের মতো অর্থনৈতিক উন্নতির দিকে মনোযোগ দেন এবং তার সময়ে একটু হলেও মিশর অর্থনৈতিকভাবে উন্নতির দিকে যায় এবং বিশ্বায়নের প্রভাবে মিশরেও মুক্ত বাজার অর্থনীতি চালু হয়। হুসনি মোবারক মিশরের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে রাষ্ট্রপতি হিসেবে মিশরকে শাসন করার সুযোগ পান এবং ২০১০ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকেন।

– মুসলিম পোর্ট ।। ডি-৮ পরিবেশনা