কর্দোভা, বর্তমান স্পেনের আন্দালুসিয়ায় অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক শহর, মুসলিম সংস্কৃতি ও সভ্যতার অন্যতম কেন্দ্র ছিল স্মৃতিবিজড়িত এই শহরটি। ৭১১ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম সেনাপতি তারিক বিন জিয়াদের নেতৃত্বে আন্দালুসিয়া বিজয়ের পর কর্দোভা মুসলিম শাসনের অধীনে আসে। এরপর থেকে শুরু হয় এই অঞ্চলের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক বিকাশ। যা কালক্রমে স্থানীদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের সাথে সাথে মহান আল্লাহর সাথে এক অনন্য সম্পর্ক স্থাপনের পর্যায় উপনিত করতে পেরেছিল। বর্তমান সময়ে অঞ্চলটিতে অবশিষ্ট থাকা মুসলিম স্থাপত্য সমূহ তাই প্রমাণ করে।
জীবনযাত্রা
কর্দোভার মুসলমানদের জীবনযাত্রা ছিল শৃঙ্খলাবদ্ধ এবং উন্নত। এখানে ছিল বহুজাতিক এবং বহু-ধর্মীয় সমাজ, যেখানে মুসলমান, খ্রিস্টান এবং ইহুদিরা একসঙ্গে বসবাস করতো। কর্দোভা ছিল বিজ্ঞানের কেন্দ্র, যেখানে চিকিৎসা, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, ভূগোল এবং অন্যান্য বিজ্ঞানচর্চা প্রসার লাভ করে মুসলমানদের হাত ধরে।
জ্ঞানচর্চার সূতিকাগার জামে কর্ডোভা
আন্দালুসিয়ার কর্দোভা জামে মসজিদ জ্ঞান প্রচারে দীর্ঘ সময় ধরে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। ১ হাজার ২০০ বছর আগে খলিফা আবদুর রহমান আদ-দাখিলের আমলে ৭৮৪ থেকে ৭৮৬ খ্রিষ্টাব্দে স্পেনের তৎকালীন রাজধানী কর্ডোভায় এই ঐতিহাসিক মসজিদ নির্মিত হয়। এটি ‘লা মেজকিতা’ কিংবা ‘দ্য গ্রেট মসজিদ অব কর্ডোভা’ নামেও পরিচিত। মহান দার্শনিক আল্লামা ইকবাল এখানে ভ্রমণ করেছিলেন। তিনি এ মসজিদের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে সাতটি কবিতা লিখেছিলেন। ‘বালে জিবরিল’ শিরোনামে দীর্ঘ কবিতাটি এই মসজিদে বসেই লিখেছিলেন তিনি।
খলিফা তৃতীয় আবদুর রহমানের (৯১২-৯২৯ খ্রি.) আমলে জামে কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়। এ সময় ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়া থেকে শিক্ষার্থীরা সেখানে আসতে থাকেন। প্রায় ৫ থেকে ৬ হাজার শিক্ষার্থী বিভিন্ন দেশ থেকে জ্ঞান অর্জনের জন্য এখানে আসেন।
তাফসির, ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, আরবি ব্যাকরণ, অভিধানশাস্ত্র, ইতিহাস, ভূগোল, জ্যোতির্বিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান, গণিত, আইন ইত্যাদি বিষয়ে এখানে পাঠদান করা হতো। কারিগরি, বৃত্তিমূলক শিক্ষা, বক্তৃতা চর্চা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
মুসলিম, ইহুদি, খ্রিষ্টান শিক্ষার্থীরা সমান অধিকার নিয়ে শিক্ষাগ্রহণ ও পাঠদানে নিয়োজিত থাকতেন।
এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদানের জন্য বিভিন্ন অভিজ্ঞ শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হতো। তাঁরা জ্ঞানে-গুণে ও তাকওয়ায় অনন্য ছিলেন। নম্র ভাষায় পাঠদান করতেন। শিক্ষার্থীরা নিজেদের ইচ্ছেমতো শিক্ষক নির্বাচন করতে পারতেন। কোনো নির্দিষ্ট শিক্ষকের কাছে পাঠ গ্রহণ বাধ্যতামূলক ছিল না। এখানকার শিক্ষকেরা অন্যান্য পেশায় যুক্ত ছিলেন। এ কারণে শিক্ষকদের সুবিধার্থে একটি সময় নির্দিষ্ট করা হয়েছিল; সেই সময়ে শিক্ষার্থীর পাঠ গ্রহণ চলত।
শিক্ষার্থীরা বৃত্তাকারে শিক্ষকের চারপাশে জড়ো হতেন। মহান রবের প্রশংসা, গুণগান এবং রাসুল (সা.)-এর ওপর দরুদ পাঠের মাধ্যমে পাঠদান শুরু হতো। শিক্ষক দুর্লভ শব্দগুলোর ব্যাখ্যা করতেন। শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞাসার উত্তর দিতেন এবং দোয়ার মাধ্যমে ক্লাস শেষ করতেন। আবু বকর ইবনে মুয়াবিয়া এই বিশ্ববিদ্যালয়ে হাদিস পাঠদান করতেন। বিখ্যাত আরবি ভাষাবিদ আবু-আলী প্রাচীন আরবদের ভাষা, কবিতা ও প্রবচন পড়াতেন। আন্দালুসিয়ান ইতিহাসবিদ ও দার্শনিক ইবনুল কুতিয়া ব্যাকরণ পড়াতেন।
জামে কর্ডোভার খ্যাতি কায়রোর আল-আজহার এবং বাগদাদের নিজামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সমপর্যায়ের। তবে স্পেনে মুসলমানদের পতনের পর মসজিদটি গির্জায় পরিণত হয়। এখনো তা গির্জা হিসেবেই ব্যবহৃত হচ্ছে।
কর্দোভার মুসলমানদের অর্থনীতিও ছিল খুবই শক্তিশালী। কৃষি, বাণিজ্য, এবং কারুশিল্প ছিল তাদের প্রধান আয়ের উৎস। কর্দোভা বাজার ছিল ব্যবসায়িক কার্যক্রমের কেন্দ্র, যেখানে বিভিন্ন পণ্য ও সেবা বিনিময় হতো।
কর্দোভার মুসলমানদের সামাজিক জীবন ছিল সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময়। সমাজে শিক্ষা, ধর্ম, এবং সংস্কৃতির গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। সামাজিক বন্ধন, পারিবারিক মূল্যবোধ, এবং ধর্মীয় রীতিনীতিগুলি মুসলিমদের জীবনের অপরিহার্য অংশ ছিল।
কর্দোভা মুসলমানদের জীবন ও সংস্কৃতি আজও ইতিহাসের একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে পরিগণিত হয়। তাদের অবদান এবং ঐতিহ্য আজও স্পেনের বিভিন্ন স্থানে দৃশ্যমান, যা তাদের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারকে প্রকাশ করে।
-মুসলিম পোর্ট