মুসলিম পোর্ট

অতীতের গৌরবময় ইতিহাস ধারণ করে থাকা তিলেওয়ালি মসজিদ আজ একটি সংকটময় সময় অতিক্রম করছে। হিন্দুত্ববাদী প্রভাব এবং আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে, এই মসজিদ শুধু ধর্মীয় গুরুত্বই নয়, ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে একটি পরীক্ষার সম্মুখীন।

ভারতের লখনৌ শহরে গোমতী নদীর তীরে দাঁড়িয়ে আছে একটি সুন্দর ও বিশাল মসজিদ, যা তিলেওয়ালি মসজিদ নামে পরিচিত। মুঘল সম্রাট শাহজাহান ও আওরঙ্গজেবের শাসনামলে ১২৫ বিঘা জমি হজরত শাহ পীর মুহাম্মদ ও মসজিদের জন্য দান ও বরাদ্দ করা হয়। হজরত শাহ পীর মুহাম্মদ তার শিষ্য অওধের মুঘল গভর্নর ফিদা খান কোকাকে (মুজাফফর হোসেন) এই মসজিদ নির্মাণের নির্দেশ দেন। মসজিদটি ১৬৫৮ থেকে প্রায় ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দ (১০৬৮-১০৭০ হিজরি) পর্যন্ত মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলে ফিদা খান কোকা’র তত্ত্বাবধানে নির্মিত হয়।

মসজিদের নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পর প্রথম নামাজটি (জুমাতুল বিদার নামাজ) হজরত শাহ পীর মুহাম্মদ নিজে ইমামতি করেন। মসজিদের কাছেই হজরত শাহ পীর মুহাম্মদ ও হজরত মাওলানা সৈয়দ শাহ ওয়ারিস হাসানের মাজার অবস্থিত, যেখানে উভয়ের কবর রয়েছে।

ধর্মীয় ও ঐতিহ্যবাহী গুরুত্ব:

তিলেওয়ালি মসজিদ কেবল লখনৌ নয়, আশেপাশের শহর ও রাজ্যের মুসলমানদের জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় কেন্দ্র। পবিত্র রমজানের শেষ শুক্রবারের নামাজ (জুমাতুল বিদা), ঈদুল ফিতর, ঈদুল আযহা, ঈদে মিলাদুন্নবী ও শবে বরাতের সময় এখানে লক্ষ লক্ষ মানুষ জমায়েত হন।

এছাড়াও হজরত শাহ পীর মুহাম্মদের উরস ও সৈয়দ ওয়ারিস হাসানের সালানা ফাতিহায় বিভিন্ন শহর ও রাজ্য থেকে প্রচুর ভক্তগণ এখানে সমবেত হন।

ঐতিহাসিক ভূমিকা:

মসজিদটি মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলে নির্মিত প্রথম কয়েকটি স্থাপনার মধ্যে একটি। এটি মুঘল শাসকদের জন্য রাজকীয় মসজিদ হিসেবে ব্যবহৃত হত।

১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময় তিলেওয়ালি মসজিদের মাদ্রাসার শিক্ষক ও ছাত্ররা ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে ৮০ দিন লড়াই করেন। এই লড়াইয়ে ব্রিটিশরা মসজিদের মাদ্রাসা ও সীমানা প্রাচীর ধ্বংস করে, তবে মসজিদ ও শাহ পীর মুহাম্মদের মাজার অক্ষত থাকে। বিদ্রোহ পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশরা মসজিদটি দখল করে হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহার শুরু করে।

পুনরুদ্ধার:

১৯০১ সালে হজরত মাওলানা সৈয়দ শাহ ওয়ারিস হাসানের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় মসজিদটি ও এর আশেপাশের জমি পুনরুদ্ধার করা হয়। পুনরুদ্ধারের পর প্রথম নামাজটি ছিল জুমাতুল বিদার, যার ইমামতি করেছিলেন সৈয়দ শাহ ওয়ারিস হাসান।

স্থাপত্য:

তিলেওয়ালি মসজিদ মুঘল, ইসলামিক ও ইন্দো-ইসলামিক স্থাপত্যশৈলীর অপূর্ব নিদর্শন। মসজিদের ছাদে তিনটি বিশাল গম্বুজ রয়েছে, যা দুটি দৃষ্টিনন্দন মিনারের দ্বারা পরিবেষ্টিত। মিনার দুটি পাঁচতলা বিশিষ্ট। মসজিদের সামনে তিনটি এবং পেছনে চারটি ছোট বুরুজ রয়েছে। মসজিদের অভ্যন্তরে তিনটি জানালা ক্রস ভেন্টিলেশনের জন্য রাখা হয়েছে।

মসজিদ চত্বরে প্রবেশের জন্য সাতটি প্রবেশদ্বার রয়েছে। মসজিদটি আজও লখনৌ শহরের সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে ধর্মীয় অনুভূতির একটি কেন্দ্রস্থল।

বর্তমান সংকট ও হিন্দুত্ববাদী চাপ

সম্প্রতি মসজিদটি একটি আইনি বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছে। স্থানীয় কিছু হিন্দু সংগঠন দাবি করেছে, মসজিদটি একটি পুরাতন হিন্দু মন্দির ভেঙে তৈরি করা হয়েছে। ২০২৩ সালে মামলাটি দায়ের করা হয়, এবং ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে লখনৌ জেলা আদালত মুসলিম পক্ষের আবেদন খারিজ করে মামলাটির গ্রহণযোগ্যতা স্বীকার করে। মুসলিম পক্ষ এটিকে ভিত্তিহীন ও কাল্পনিক দাবি হিসেবে চিহ্নিত করেছে, কিন্তু আদালত সমস্ত দলকে প্রমাণ উপস্থাপনের সুযোগ দিয়েছে।

জাতীয় স্তরে প্রভাব

ভারতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মুসলিম স্থাপত্য নিদর্শনগুলোকে কেন্দ্র করে এমন বিতর্ক ক্রমশ বাড়ছে। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের কারণে তিলে ওয়ালি মসজিদের মতো ঐতিহাসিক স্থানগুলো এখন অস্তিত্বের সংকটে। মসজিদের পেছনে এসব চাপ ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতার মূলনীতির প্রতি চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে।

উপসংহার

তিলে ওয়ালি মসজিদ শুধু একটি স্থাপত্য নিদর্শন নয়; এটি বহু শতাব্দীর ধর্মীয় ঐতিহ্য এবং ঐক্যের প্রতীক। বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতিতে এই মসজিদ শুধু মুসলিম সম্প্রদায়ের নয়, সমগ্র ভারতের ইতিহাস ও সংস্কৃতির অংশ হিসেবে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। ঐতিহাসিক স্থাপত্য ও ধর্মীয় ঐতিহ্য রক্ষায় সবার দায়িত্ব একসঙ্গে কাজ করা। মসজিদের প্রতি হুমকি কেবল একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ওপর আঘাত নয়, বরং ভারতীয় সমাজের ধর্মনিরপেক্ষতার মূলে আঘাত। সময় এসেছে ঐক্যের শক্তি দিয়ে এই ঐতিহ্য রক্ষা করার, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মও এই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে পারে।

– হাসিবুল হোসেন শান্ত