মুসলিম পোর্ট

ইসলামী সংস্কৃতির এক অনন্য শিল্পশৈলী হলো তেজহিপ, যা মূলত আলংকারিক শিল্পকর্ম হিসেবে পরিচিত। তেজহিপ শব্দটি তুর্কি ভাষা থেকে এসেছে, যার অর্থ সোনার প্রলেপ দেওয়া। তেজহিপের মাধ্যমে কোরআন, ধর্মীয় পাণ্ডুলিপি, মসজিদ ও অন্যান্য ধর্মীয় স্থাপত্যকর্মে জটিল ও মনোমুগ্ধকর নকশা তৈরি করা হয়। এই শিল্পশৈলীর মূল বৈশিষ্ট্য হলো এর সূক্ষ্মতা ও প্রাচুর্য।

তেজহিপের : উৎপত্তি ও ইতিহাস

তেজহিপ শিল্পকলার ইতিহাস ইসলামিক সভ্যতার স্বর্ণযুগ থেকে উদ্ভূত, যা ৭ম থেকে ১৪শ শতাব্দীর মধ্যে ঘটে। এই সময়ে মুসলিম উম্মাহতে বিজ্ঞানের, সাহিত্যের, এবং শিল্পকলার ক্ষেত্রে এক অসাধারণ উন্নতি সাধন করে। তেজহিপের শিকড় প্রাচীন পারস্য, বর্তমান ইরানে প্রোথিত, যেখানে এটি প্রথম বিকাশ লাভ করে।

প্রাচীন পারস্য ও সাফাভি সাম্রাজ্য

প্রাচীন পারস্য ছিল তেজহিপ শিল্পকলার প্রধান কেন্দ্র। এখানে ইসলামিক শিল্পকলা এবং সংস্কৃতি ব্যাপকভাবে বিকাশ লাভ করে। ১৫০১ সালে সাফাভি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠার পর, ইরানে তেজহিপ শিল্পকলার ব্যাপক বিস্তার ঘটে। এই সময়ে ইস্পাহান শহরটি তেজহিপ শিল্পের কেন্দ্রস্থল হিসেবে পরিচিত হয়। সাফাভি শাসক শাহ আব্বাস এবং তার পূর্বসূরিরা তেজহিপ শিল্পের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। শাহ তামাসপের কোরআন, যা সাফাভি আমলের একটি বিখ্যাত পাণ্ডুলিপি, তেজহিপের এক অনন্য উদাহরণ।

উসমানীয় সাম্রাজ্য

তেজহিপ শিল্পকলা উসমানীয় সাম্রাজ্যেও ব্যাপক বিকাশ লাভ করে। উসমানীয় সুলতানরা তেজহিপ শিল্পকে রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় নিয়ে আসেন। বিশেষ করে, সুলতান সুলেমান দ্য ম্যাগনিফিসেন্টের সময়ে তেজহিপের উৎকর্ষতা দেখা যায়। উসমানীয় তেজহিপ শিল্পে সাধারণত স্বর্ণের পাত এবং জটিল নকশার ব্যবহারে সমৃদ্ধি দেখা যায়। তুরস্কের ইস্তাম্বুলে অবস্থিত টপকাপি প্যালেসে তেজহিপ শিল্পের উল্লেখযোগ্য নিদর্শন পাওয়া যায়।

 মুঘল সাম্রাজ্য

ভারতীয় উপমহাদেশে মুঘল সাম্রাজ্যের সময়ে তেজহিপ শিল্পের উল্লেখযোগ্য বিকাশ ঘটে। মুঘল সম্রাটরা পারস্যের শিল্পীদের আমন্ত্রণ জানান এবং তাদের তেজহিপ শিল্পকর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। মুঘল সাম্রাজ্যের সময়ে তেজহিপ শিল্পের বৈশিষ্ট্য ছিল জটিল ফুলের নকশা, আরবেস্ক, এবং জ্যামিতিক প্যাটার্ন। তাজমহলের অভ্যন্তরে তেজহিপ শিল্পের মনোমুগ্ধকর উদাহরণ দেখা যায়। এছাড়াও, মুঘল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন পাণ্ডুলিপি, বইয়ের প্রচ্ছদ, এবং হস্তশিল্পে তেজহিপের সুন্দর নিদর্শন লক্ষ্য করা যায়।

তেজহিপের ইতিহাস একটি ঐতিহ্যবাহী ও সমৃদ্ধ শিল্পকলার প্রতিচ্ছবি, যা ইসলামিক সংস্কৃতির সৌন্দর্য ও সৃষ্টিশীলতার এক অনন্য উদাহরণ। এই শিল্পকর্মের ইতিহাস এবং বিকাশ ইসলামিক সভ্যতার সৃষ্টিশীল মনোভাব ও সাংস্কৃতিক প্রাচুর্যের পরিচায়ক।

উপকরণ ও রং

তেজহিপ শিল্পে ব্যবহৃত প্রধান উপকরণগুলি হলো:

1. সোনার পাত : তেজহিপের প্রধান বৈশিষ্ট্য এটি। সোনার পাতের মাধ্যমে নকশায় এক অসাধারণ ঝলক ও সৌন্দর্য যুক্ত হয়।

2. ব্রাশ : সূক্ষ্ম নকশা তৈরির জন্য বিশেষ ধরনের সূক্ষ্ম ব্রাশ ব্যবহৃত হয়।

3. রঙ : বিভিন্ন ধরণের প্রাকৃতিক পিগমেন্ট থেকে তৈরি করা রঙ ব্যবহার করা হয়। সাধারণত লাল, নীল, সবুজ, এবং কালো রঙের প্রাধান্য থাকে।

4. কাগজ ও চামড়া : তেজহিপের নকশা সাধারণত উচ্চমানের কাগজ বা চামড়ার উপর তৈরি করা হয়।

নকশা

তেজহিপ শিল্পে ব্যবহৃত নকশাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য:

1. ফুলের নকশা : সূক্ষ্ম ফুল ও লতা-পাতার নকশা অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য।

2. জ্যামিতিক নকশা : ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ, পঞ্চভুজ ও অন্যান্য জ্যামিতিক আকারের নকশা।

3. আরবেস্ক নকশা : জটিল ও পুনরাবৃত্তিমূলক নকশা যা সাধারণত ফুল ও লতা-পাতার সমন্বয়ে তৈরি হয়।

তেজহিপের প্রয়োগ ক্ষেত্র

তেজহিপ মূলত কোরআনের পাণ্ডুলিপি অলংকরণে ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও, মসজিদের মিনার ও গম্বুজ, দরজার প্যানেল, এবং অন্যান্য স্থাপত্যকর্মে তেজহিপের নকশা লক্ষ্য করা যায়। তেজহিপের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার হলো বিভিন্ন ধরণের হস্তশিল্প, যেমন: ক্যালিগ্রাফি, মিনিয়েচার চিত্রকলা, এবং বইয়ের প্রচ্ছদ অলংকরণ।

 

উদাহরণ

ইরানে তেজহিপের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ:

1. শাহ তামাসপের পান্ডুলিপি : সাফাভি আমলের একটি বিখ্যাত পাণ্ডুলিপি যা তেজহিপ শিল্পের এক অসাধারণ নিদর্শন।

2. শাহ আব্বাসের মসজিদ : ইস্পাহানের এই মসজিদের অভ্যন্তরে তেজহিপ শিল্পের মনোমুগ্ধকর নকশা দেখা যায়।

 স্থাপত্যে তেজহিপের ব্যবহার

তেজহিপ শিল্প শুধু পাণ্ডুলিপি ও হস্তশিল্পে সীমাবদ্ধ নয়, বরং ইসলামিক স্থাপত্যেও এর সূক্ষ্ম ও বিস্ময়কর ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। কিছু উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো:

1. ইমাম মসজিদ, ইস্পাহান : এই মসজিদের মিহরাব, গম্বুজ ও মিনারের অভ্যন্তরে তেজহিপের জটিল ও সূক্ষ্ম নকশা দেখা যায়।

2. শেখ লুতফুল্লাহ মসজিদ : ইস্পাহানের এই মসজিদটি তেজহিপ শিল্পের এক অপরূপ নিদর্শন। মসজিদের গম্বুজ ও দেওয়ালের সোনালী নকশা তেজহিপের সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তোলে।

3. তাজমহল, ভারত : তাজমহলের অভ্যন্তরে ও বাহিরে তেজহিপের সূক্ষ্ম ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। সাদা মার্বেল পাথরের উপর সোনার প্রলেপ ও জটিল নকশার মাধ্যমে এই স্থাপত্যকর্মকে আরও মনোমুগ্ধকর করে তোলা হয়েছে। তাজমহলের বিভিন্ন দেয়াল ও গম্বুজে আরবেস্ক ও ফুলের নকশা তেজহিপের অনন্য উদাহরণ।

তেজহিপের আধুনিক প্রাসঙ্গিকতা

আধুনিক যুগে তেজহিপ শিল্পকলার গুরুত্ব কমে গেলেও এটি এখনো ইসলামিক সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়। সমসাময়িক শিল্পীরা তেজহিপের ঐতিহ্যবাহী নকশাগুলিকে নতুন আঙ্গিকে পুনঃআবিষ্কার করছেন। তেজহিপের মাধ্যমে তারা ইসলামের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরছেন।

উপসংহার

তেজহিপ একটি অনন্য ও মনোমুগ্ধকর শিল্পশৈলী, যা ইসলামিক সংস্কৃতির সৃষ্টিশীলতার একটি অপরূপ নিদর্শন। এর সূক্ষ্মতা, সৌন্দর্য, এবং ঐতিহ্যবাহী নকশা ইসলামিক শিল্পকলার একটি মহিমাময় দৃষ্টান্ত। ইরানের তেজহিপ শিল্পের সমৃদ্ধ ইতিহাস ও বিভিন্ন স্থাপত্যে এর অসাধারণ প্রয়োগ ইসলামিক সংস্কৃতির বৈচিত্র্য ও সৌন্দর্যের একটি অপরিহার্য অংশ। তাজমহলের মতো স্থাপত্যেও তেজহিপের ব্যবহার এই শিল্পকলার বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্বকে তুলে ধরে। তেজহিপ কেবল একটি শিল্পশৈলী নয়, বরং এটি ইসলামিক সংস্কৃতির ঐতিহ্য ও সৃষ্টিশীলতার একটি প্রতিচ্ছবি।

-হাসিবুল হোসেন শান্ত