
আমিরা (ছদ্মনাম) সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা। এ অবস্থায় অজানা এক যাত্রা শুরু করেছিলেন সুদানের এই নারী। চারপাশে যুদ্ধ। শহরে অবশিষ্ট নেই কোনো হাসপাতাল, ওষুধের দোকান। আছে শুধু গুলির শব্দে আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তা।
সুদানের আধা সামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ) দখল করে নিয়েছে আমিরাদের শহর পশ্চিম কোরদোফান রাজ্যের এন নাহুদ। তাঁর সামনে একমাত্র পথ—শহর ছেড়ে পালানো। এ পরিস্থিতিতে অন্তঃসত্ত্বা হয়েও আমিরা প্রার্থনা করেছিলেন, ‘এই সময় যেন আমার সন্তান পৃথিবীতে না আসে।’
গত মে মাসে আমিরা সুদানের অন্যতম সক্রিয় যুদ্ধক্ষেত্র পেরোনোর সময় এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলেন। সেই কথা রেকর্ড করা অডিও ডায়েরিতে বলেছেন তিনি।
ওই সময় আরএসএফ এন নাহুদ দখল করে নেওয়ায় শহরটি থেকে বেরোনোর রাস্তা ছিল বিপৎসংকুল। তবু নিজে বাঁচতে, অনাগত সন্তানকে বাঁচাতে তাঁর আর কোনো উপায় ছিল না। সুদানের সেনাবাহিনী ও আরএসএফের যুদ্ধ দুই বছরের বেশি সময় ধরে সাধারণ নাগরিকদের ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এখন কোরদোফানের দক্ষিণাঞ্চল হয়ে উঠেছে সম্মুখসমর। সেই পথ দিয়েই পালিয়ে যান আমিরা।
পালানোর সময় আমিরা একটি অডিও ডায়েরি রেকর্ড করেন। এই ডায়েরি গ্লোবাল ক্যাম্পেইন গ্রুপ আভাজ (এভিএএজেড) বিবিসির কাছে সরবরাহ করেছে। পরে উগান্ডার রাজধানী কাম্পালায় ফোনে তাঁর সঙ্গে বিবিসির কথা হয়। সেখানে সন্তান জন্ম দেওয়ার অপেক্ষায় আছেন তিনি।
পালানোর পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে আমিরা বলেন, ‘শহরে আর কোনো হাসপাতাল নেই, নেই কোনো ফার্মেসি। আমার ভয় হচ্ছিল, যদি আরও দেরি করি, তাহলে হয়তো কোনো গাড়ি পাওয়া যাবে না। যানবাহন চলাচল তখন প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। যেটুকু ছিল, তা–ও অবিশ্বাস্য রকম কঠিন আর ভীষণ ব্যয়বহুল।’
বন্দুকের মুখে যাত্রা শুরু
যাত্রার শুরু থেকেই ঝামেলা হচ্ছিল আমিরার। বলেন, যাতায়াতের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছিল আরএসএফ ও তাদের সহযোগীরা।
এন নাহুদ থেকে পালানোর জন্য আমিরার স্বামী কোনো রকমে একটি ট্রাক ভাড়া করেছিলেন। সেই ট্রাকে চড়তেই বিপত্তি শুরু। চালক ছিলেন আরএসএফের সদস্য। তিনি ট্রাকটি আরেক তরুণের কাছে একই সময়ে ভাড়া দিয়েছিলেন। এ নিয়ে চালক ও ওই তরুণের মধ্যে ঝগড়া বেধে যায়।
আমিরা বলেন, ‘চালক সঙ্গে সঙ্গে বন্দুক বের করে ওই তরুণকে গুলি করার হুমকি দিলেন। সবাই তাঁকে থামানোর চেষ্টা করছিলেন, এমনকি তাঁর সঙ্গে থাকা আরএসএফের সঙ্গীও। তরুণের দাদি আর মা কাঁদতে কাঁদতে চালকের পা ধরে গুলি না করার অনুরোধ করেছিলেন। আমরা যাত্রীরা ভয়ে হিম হয়ে গিয়েছিলাম।’
আমিরা আরও বলেন, ‘মনে হচ্ছিল, যদি তিনি গুলি চালান তবে একজনকে নয়, অনেককেই মেরে ফেলবেন। কারণ, তিনি গাঁজা খাচ্ছিলেন, মাতাল ছিলেন।’
শেষমেষ চালক বন্দুক সরিয়ে রাখলেও ওই তরুণকে পরিবারসহ এন নাহুদেই নামিয়ে দেন। তাঁদের রেখেই আমিরাদের যাত্রা শুরু হলো। এরপরও যাত্রা ছিল শঙ্কায় পূর্ণ। খানাখন্দে ভরা রাস্তা, ট্রাকভর্তি লাগেজ আর গাদাগাদি করা ৭০ থেকে ৮০ জন, বারবার ছোট ছোট ঝিরি পেরোনোর ঝক্কি আর মাথার ওপর প্রখর রোদ্র—সব মিলিয়ে অস্থির যাত্রা। মায়েরা এক হাতে আঁকড়ে ধরছেন গাড়ি, আরেক হাতে আগলে রাখছেন সন্তান।
আমিরা বলেন, ‘যাত্রার পুরোটা সময় ভয়ে ছিলাম। প্রার্থনা করছিলাম, যেন পেটের সন্তান এ সময় পৃথিবীতে না আসে। শুধু চেয়েছিলাম, সব ঠিকঠাক হয়ে যাক।’
ভয়ের শেষ নেই
অবশেষে আমিরারা পশ্চিম কোরদোফানের রাজধানী এল-ফুলায় গিয়ে পৌঁছান। কিন্তু এ শহরেও ঢুকে পড়ছেন সেনারা। এ কারণে আমিরা সেখানে বেশিক্ষণ থাকতে চাননি।
অডিও ডায়েরিতে আমিরা রেকর্ড করেছিলেন, ‘সেনারা এল-ফুলায় ঢুকলে কী হবে, আমি জানতাম না। কারণ, সেনারা, বিশেষ করে বাগারা, রিজেইগাতসহ কিছু নির্দিষ্ট জাতিগত গোষ্ঠীর লোকদের নিশানা বানানো শুরু করেছেন। সেনাদের ধারণা ছিল, এই জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা আরএসএফের সঙ্গে যুক্ত।’
অডিও ডায়েরিতে আমিরা বলেন, তাঁর স্বামী এমন সম্প্রদায়ের একজন। যদিও আরএসএফের সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি সরকারি চাকরি করেন, আইন পড়েছেন। কিন্তু এখন কিছুই আর বিবেচনা করা হচ্ছে না। শুধু জাতিগত কারণেই মানুষকে লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে।
জাতিসংঘ বলেছে, সুদানের সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে বন্দী বেসামরিক লোকদের বিচারবহির্ভূত হত্যা করার মতো অভিযোগগুলো বিশ্বাসযোগ্য। সেনাবাহিনী এসবকে কিছু সদস্যের ‘ব্যক্তিগত’ অপরাধ বলে দায় এড়ায়। চলতি বছরের শুরুর দিকে সেনাপ্রধান আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্তে একটি কমিটি গঠন করেছেন।
চেকপোস্ট, ঘুষ আর ভাঙা গাড়ি
তিনটি রাজ্য নিয়ে গঠিত কোরদোফান এখন প্রধান যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। সুদানের যুদ্ধের জন্য এ অঞ্চল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এটি গুরুত্বপূর্ণ তেলক্ষেত্র ও প্রধান পরিবহন রুটের এক কৌশলগত কেন্দ্র।
আরএসএফের পাশাপাশি অন্যান্য মিলিশিয়াদের সম্পৃক্ততা, বিশেষ করে শক্তিশালী এসপিএলএম-এন সহিংসতাকে তীব্র করে তুলেছে। এতে গুরুতর মানবিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে সহায়তাদানকারী গোষ্ঠীগুলোর পক্ষে ত্রাণ সরবরাহ করাও প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
এল-ফুলা থেকে দক্ষিণ সুদান সীমান্তে পৌঁছাতে আমিরার তিন দিন লেগেছিল। এ সময়ে তাঁদের একাধিকবার গাড়ি পাল্টাতে হয়েছে। আর পথে পথে ছিল বাধা।
আমিরা বলেন, ‘আরএসএফের চালকেরা নিজের ইচ্ছেমতো ঠিক করতেন কে যাবেন, কোথায় বসবেন, কত ভাড়া দেবেন। কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম ছিল না। আর তাঁরা সবাই ছিলেন সশস্ত্র।’
আমিরা বলেন, পথে প্রতি ২০ মিনিট পরপর তল্লাশিচৌকি। প্রতি চৌকিতে বাধ্যতামূলক ঘুষ দিতে হতো। অথচ তাঁরা আগে থেকেই আরএসএফের সদস্যদের অর্থ দিয়ে সঙ্গী হিসেবে নিয়েছিলেন।

সেখানে খাবারের দাম ছিল অনেক বেশি। ছিল পানির সংকট। এল-হুজাইরতা নামের একটি গ্রামে তাঁরা আরএসএফের স্টারলিংক ডিভাইস ব্যবহার করে ইন্টারনেটে সংযুক্ত হতে পেরেছিলেন, কিন্তু তা ছিল বেশ ঝুঁকিপূর্ণ।
আমিরা বলেছেন, ‘অনলাইনে ফিরলেই সতর্ক থাকতে হয়। যদি আরএসএফের সদস্যরা শুনতে পান আপনি সেনাবাহিনীর কোনো ভিডিও দেখছেন, কোনো গান বাজাচ্ছেন, এমনকি শুধু কথায় আরএসএফকে উল্লেখ করেছেন, তাহলেই আপনাকে গ্রেপ্তার করা হবে।’
আমিরাদের যাত্রাপথের রাস্তাঘাট ছিল ভাঙাচোরা। গাড়ি বারবার বিকল হয়ে যাচ্ছিল। যাত্রাপথে মোট তিনবার গাড়ি বিকল হয়ে যায়। একবার জঙ্গলের ভেতর গাড়ির চাকা ফেটে যায়। সে সময় সবচেয়ে ভয়ানক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। এমনিতেই পানি নেই। এর ওপর আশপাশের কেউ সাহায্য করতেও রাজি নন।
আমিরা বলেন, ‘আমি সত্যিই ভেবেছিলাম, আর কোনো দিন কোথাও পৌঁছাতে পারব না। এখানেই মরে যাব। হাল ছেড়ে দিলাম। শুধু একটা কম্বল ছিল, সেটি মাটিতে বিছিয়ে শুয়ে পড়লাম। সেদিন সত্যিই মনে হয়েছিল, এটাই আমার শেষ।’
কিন্তু শেষ হয়নি। একটি সবজিবোঝাই পিকআপে চড়ে অবশেষে সামনে এগোতে থাকেন আমিরা ও তাঁর স্বামী। সীমান্ত পেরোনোর সংগ্রাম
অবশেষে পরদিন আমিরারা পৌঁছালেন দক্ষিণ সুদানের সীমান্ত আবেইতে। কিন্তু বৃষ্টির কারণে কাদায় ভরে গেছে পথ। তাঁরা তখন তেলের ব্যারেলবোঝাই গাড়িতে। গাড়ি বারবার কাদায় ডুবে যাচ্ছিল।
বৃষ্টি আর কাদায় যাত্রা থমকে যায় বারবার। ব্যারেলবোঝাই গাড়ি কাদায় আটকে যায়। জামাকাপড় ভিজে একাকার। ব্যাগ ধুলো আর গরমে আগেই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, এবার পুরো ভিজে গেছে। ঠান্ডায় কাঁপছিলেন আমিরারা। প্রার্থনা করেছিলেন, যেন নিরাপদে পৌঁছাতে পারেন।
শেষমেশ আমিরা ও তাঁর স্বামী এন নাহুদ থেকে প্রায় ১ হাজার ৩০০ কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ সুদানের রাজধানী জুবায় পৌঁছালেন। সেখান থেকে বাসে উগান্ডার রাজধানী কাম্পালা। হাজার মাইলের দুঃসহ যাত্রা শেষে সাময়িক আশ্রয় পান তাঁরা।
আশ্রয় উগান্ডায়, মন সুদানে
আমিরার স্বজনেরা এখনো সুদানে। সেই দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে তাঁর। পাশাপাশি তিনি প্রথমবার মা হওয়ার ভয়ে উদ্বিগ্ন।
আমিরা বলেন, ‘সন্তান জন্ম দেওয়ার বিষয়টা নিয়ে আমি খুব ভয় পাচ্ছি। কারণ, এটাই প্রথমবার, আর আমার মা পাশে থাকবেন না। শুধু স্বামী আর এক বান্ধবী থাকবে। সবকিছু এত অগোছালো, এত বিশৃঙ্খল—আমি সামলাতে পারছি না।’
আমিরা একজন নারী অধিকারকর্মী ও গণতন্ত্রপন্থী কর্মী। যুদ্ধের সময় তিনি জরুরি সহায়তা দলের সঙ্গে কাজ করেছেন। সেনারা তাঁদের সন্দেহের চোখে দেখতেন, কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছিল।
আমিরা বলেন, ‘সেনাদের ভয় পেতাম। কারণ, তাঁরা তরুণদের ধরে নিয়ে যেতেন। আরএসএফ এসেও পরিস্থিতি ভালো হয়নি। তারা লুট করে, ধর্ষণ করে। সেনারা যা করে, এরাও কম কিছু নয়। দুই পক্ষই একই রকম।’
আরএসএফ অবশ্য বলেছে, তারা সাধারণ মানুষকে টার্গেট করে না। জাতিগত নিধনের অভিযোগ তারা অস্বীকার করে বলেছে, এগুলো গোষ্ঠীগত সংঘাতমাত্র। দুই পক্ষই (সরকারি সেনা ও আরএসএফ) যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
আমিরার জন্য এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আর আনন্দ হলো—মা হওয়া। কিন্তু তিনি কি সন্তানকে নিয়ে আবার কখনো সুদানে ফিরতে পারবেন?
আমিরা বলেন, ‘আশা করি, একদিন সুদানের যুদ্ধ থামবে, পরিস্থিতির উন্নতি হবে। তবে আগের মতো সব হবে না। কিন্তু অন্তত এভাবে মানুষ অকাতরে মরবে না।’