ফিলিপাইন ও মোরো মুসলমান
চীনের উইঘুর, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ও ইন্দোচীনের চ্যাম মুসলমানদের মতোই মোরো একটি মুসলিম সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একমাত্র খ্রিস্টান রাষ্ট্র ফিলিপাইনের দক্ষিণ অঞ্চলের মুসলমান অধিবাসীরা ‘মোরো’ নামে পরিচিত। দেশটির অধিকাংশ অধিবাসি খ্রিস্টান হলেও ফিলিপাইনের দক্ষিণাঞ্চলের ১৪টি প্রদেশে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসেবে দীর্ঘদিন বসবাস করে আসছিল; কিন্তু বর্তমানে অধিকাংশ অঞ্চলেই মুসলমানরা সংখ্যালঘু জাতিতে পরিণত হয়েছে। (ত্রয়োদশ শতাব্দিতে আরব মুসলমান বণিকদের মাধ্যমে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ইসলামের আগমন ঘটে। অচিরেই দক্ষিণাঞ্চলসহ গোটা ফিলিপাইনের বিভিন্ন শ্রেণির জনগোষ্ঠী ইসলামে দীক্ষা গ্রহণ করে। মিন্দানাও ও সুলুসহ বেশ কয়েকটি অঞ্চলে ইসলামী সালতানাত প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রাজনৈতিকভাবেও ইসলামের আসন সুদৃঢ় হয়; কিন্তু স্পেনীয় ও আমেরিকান আধিপত্যবাদী কর্মকাণ্ডে সংখ্যাগুরু মুসলমানরা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয় ফিলিপাইন স্বাধীন হলেও সরকারিভাবে তাদের প্রতি অমানবিক ও বৈষম্যমূলক আচরণ করা হচ্ছে। ফলে মোরো মুসলমানরা নিজভূমিতেই পরবাসী হয়ে স্বাধিকার আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। তারা কখনো স্বাধীনতার আলো স্পর্শ করতে পারবে কি না সেটাও খানিকটা আশাতীত বিষয় হিসেবে দেখা দিয়েছে।
ফিলিপাইন প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় নাম রিপাবলিক অব দ্যা ফিলিপাইনস। ফিলিপিনো ভাষায় একে Repúblika ng Pilipinas বলা হয়। ৭,১০৭ টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত এ রাষ্ট্রটির মোট ভূখণ্ডের পরিমাণ প্রায় তিন হাজার বর্গকিলোমিটার বা ১,১৫,৬০০ বর্গমাইল। তবে মোট আয়তনের ৯৫ ভাগই মাত্র ১১টি দ্বীপের অন্তর্ভুক্ত। আয়তন অনুসারে দ্বীপগুলো হচ্ছে লুজন, মিন্দানাও, সামার, নেগ্রোস, পালাওয়ান, পানাই, মিন্দোরা, লেইতে, সেবু, বোহাল ও মাসবাতে। ফিলিপাইনের পূর্বে প্রশান্ত মহাসাগর, উত্তর-পশ্চিমে চীন সাগর, দক্ষিণ-পশ্চিমে সুলু সাগর এবং দক্ষিণে সেলেবেস সাগর। এশিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব উপকূল হতে প্রায় ৫০০ মাইল দূরে বিচ্ছিন্নভাবে অবস্থিত হলেও এই দ্বীপপুঞ্জ রাষ্ট্রের প্রায় ১১,০০০ মাইল দীর্ঘ উপকূল সব সময়ই বাইরের জগতের কাছে উন্মুক্ত থেকেছে। তবে এই দীর্ঘ উপকূলের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশই বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সুলু সাগর-বিধৌত অগণিত দ্বীপের অবস্থান লক্ষ করলেই বোঝা যায় যে, সামগ্রিকভাবে ফিলিপাইন মালয়জগতেরই ক্রমান্বয়ী ও অনবচ্ছিন্ন অংশ। স্মরণাতীতকাল হতে মানুষ এই অঞ্চল দিয়েই বিভিন্ন দ্বীপে এসে বসতি স্থাপন করে। এভাবেই ফিলিপাইনের ঐতিহাসিক ক্রমবিকাশের সূচনা হয় এবং এক পর্যায়ে সমগ্র দক্ষিণ অঞ্চল ধীরে ধীরে মোরো জনগোষ্ঠীর উদ্ভব হয়। দেশটি দীর্ঘদিন স্পেন ও আমেরিকার উপদেশ হিসেবে ছিল। ১৯৪৬ সালের ৪ জুলাই এটি স্বাধীন হয়। স্পেনের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপের নাম অনুসারেই এর নাম হয়েছিল ফিলিপাইন।
ফিলিপাইন প্রজাতন্ত্রের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় দশ কোটি। তবে মোরোদের সংখ্যা নির্ধারণের বিষয়টি বেশ জটিল। প্রজাতন্ত্রী সরকারের দিক থেকে যেমন মোরোদের সংখাকে কম করে দেখানোর একটা প্রবণতা লক্ষ করা যায়, তেমনি মোরোরাও সবসময় তাদের সংখ্যা বেশি করে দেখিয়েছে। ফলে মোরোদের সঠিক সংখ্যা কখনও পাওয়া সম্ভব হয়নি। একটি সমীক্ষণে ১৯৭৫ সালে মোরোদের সংখ্যা দেশের মোট জনসংখ্যা ৪৪.৪ মিলিয়নের ৫% অর্থাৎ ২.২ মিলিয়ন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এই হার ১৯৭১ সালে প্রকাশিত একটি গ্রন্থে প্রদত্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রখ্যাত ফিলিপিনো ঐতিহাসিক সিজার আদিব মাজুল ১৯৭৫ সালে মোরোদের সংখ্যা ফিলিপাইনের মোট জনসংখ্যা ৪২.১ মিলিয়নের ৭% অর্থাৎ ৩ মিলিয়ন বলে উল্লেখ করেছেন। সত্তরের দশকের প্রথমার্ধে ‘এশিয়ান সার্ভে’র দুটি সংখ্যায় মোরোদের সংখ্যা ৩.৫ মিলিয়ন দাবি করা হয়েছে। এই সংখ্যা মোটামুটি ঐতিহাসিক মাজুলের সংখ্যার কাছাকাছি। এ সময় জনসংখ্যা বৃদ্ধির বার্ষিক হার ছিল ২.৭%। ১৯৮১ সালে সৃষ্ট মিনিস্ট্রি অব মুসলিম এ্যাফেয়ার্সের হিসাবে মোরোদের সংখ্যা ছিল ৮%। ১৯৭৫ ও ১৯৮১ সালের মধ্যে ১% বৃদ্ধি অস্বাভাবিক নয়, সুতরাং ঐতিহাসিক মাজুলের হিসেবের সঙ্গে তা খুবই সঙ্গতিপূর্ণ। এ প্রসঙ্গে কয়েকটি বিষয় বিবেচনাযোগ্য। সাধারণভাবে মুসলমানদের ধর্মীয় ও নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়টি তো আছেই। তাছাড়া বিভিন্ন দেশের সংখ্যালঘু মুসলমানদের মধ্যে নিজেদের সংস্কৃতি বিপন্ন হওয়ার আশংকা, রাজনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা, দারিদ্র্যতা এবং সর্বোপরি নিজেদের আলাদা সত্তা রক্ষার ব্যাপারে উৎকণ্ঠা জন্মহার বৃদ্ধির প্রবণতার ক্ষেত্রে যে গুরুত্বপূর্ণ. উপাদান হিসেবে কাজ করে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। অতএব মোরোদের বর্তমান সংখ্যা ৮% ধরলে অত্যুক্তি হবে না।
ফিলিপাইনের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯০ ভাগ অধিবাসী হচ্ছে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। ধর্ম, সংস্কৃতি, পোশাক-আশাক, আচার-ব্যবহার ইত্যাদি ক্ষেত্রে যত পার্থক্যই থাকুক না কেন, আজকের ফিলিপিনো জাতিসত্তার বিকাশ ঘটেছিল মালয় জগৎ থেকে চতুর্থত, পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি জোলোর বুয়ানসায় মাওলানা শারিফ-উল-হামিম নামে একজন ইসলাম প্রচারকের আগমন সম্পর্কে জানা যায়। সুলুর উপকূলীয় এবং পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষের মধ্যে ইসলাম সুদৃঢ়করণে এই মাওলানার অবদান ছিল।
পঞ্চমত, (চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝি যখন ইসলাম সুলু দ্বীপপুঞ্জে সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত তখন থেকে অনেক ধর্মপ্রচারক মিন্দানাও দ্বীপের পূর্ব ও উত্তর উপকূলে যান এবং বিক্ষিপ্তভাবে স্থানীয়দেরকে ইসলামে দীক্ষিত করেন। এদের তৎপরতার ফলে মিন্দানাও-এ ব্যাপকভাবে ইসলাম প্রচারের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। শারিফ কাবুংসুয়ান পঞ্চদশ শতকের শেষ দিকে বা ষোড়শ শতকের প্রথম দিকে কিছু সহচরসহ মালয় উপদ্বীপের জোহর থেকে এসেছিলেন। তিনি ছিলেন জোহরের সুলতানের দৌহিত্র। তাঁর পিতা শারিফ আলী জায়নুল আবেদিন দক্ষিণ আরব থেকে জোহরে আসেন এবং নিজেকে রাসূলুল্লাহর বংশধর বলে দাবি করেন। সুলতানের কন্যার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। শারিফ কাবুংসুয়ান ছিলেন এঁদের কনিষ্ঠ পুত্র। শারিফ কাবুংসুয়ান মিন্দানাও-এর উপকূলে পুলাংগি বা রিওগ্রান্ডে নদীর মোহনায় উপস্থিত হলে স্থানীয়দের সঙ্গে তাঁর সংঘর্ষ হয়। এ সময় ঐ অঞ্চলে কয়েকটি বসতি ছিল যেমন স্পগান, মাগুইন্দানাও, লুসুদ, মাতামপাই, তাগিমান এবং কাতিতুয়ান। এগুলোর মধ্যে স্পগান এবং কাতিতুয়ান ছিল খুবই শক্তিশালী। এরাই শারিফ কাবুংসুয়ানকে বাধা দিলেও কাবুংসুয়ান এদেরকে পরাস্ত করেন। এক পর্যায়ে মাগুইন্দানাও প্রধান তাবুনাওয়ে এবং তার ভাই মামলু কিছু লোকজন নিয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। তারা কাবুংসুয়ানকে মাগুইন্দানাও শহরে নিয়ে যান এবং ঐ অঞ্চলের শাসনভার অর্পণ করেন। এ প্রসঙ্গে Najeeb M. Saleeby বলেন-
Islam was successfully introduced and firmly established in Mindanao by one man. This same man founded the Sultanate of Magindanao and reformed the whole system of government among his converts. His full name was Sharif Mohammad Kabungsuwan, generally known as Sharif Kabungsuwan.
কাবুংসুয়ান ছিলেন ইসলামের একনিষ্ঠ সেবক। তিনি ঐ অঞ্চলে ইসলামকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা তাঁর জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেন। পুলাংগির তীরে তাবুনাওয়ে এবং মামলু তাঁকে মাগুইন্দানাও-এ যাওয়ার জন্যে অনুরোধ করলে তিনি প্রথমেই সকলকে ইসলামে দীক্ষিত করেন, তারপর মাণ্ডইন্দানাও-এ যান। মাণ্ডইন্দানাও-এ দায়িত্ব গ্রহণ করার পর শারিফ কাবুংসুয়ান তাঁর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দ্বিমুখী নীতি গ্রহণ করেন। একদিকে তিনি মাগুইন্দানাও-এর সীমানা বাড়াতে সচেষ্ট হন, আর একদিক ধর্মান্তরকরণ প্রক্রিয়া জোরদার করেন। সীমানা বাড়াতে গিয়ে তাঁকে পার্শ্ববর্তী এলাকায় এমনকি পুলাংগি উপত্যকার উত্তরে দূরবর্তী অঞ্চলে অভিযান চালাতে হয়। অতি অল্প সময়ের মধ্যে অসংখ্য গোত্রপ্রধান এবং তাদের অধীনস্থ ব্যক্তিরা তাঁর বশ্যতা স্বীকার করে ইসলাম গ্রহণ করে। শারিফ কাবুংসুয়ানের আমলেই মিন্দানাও-এ একটি বড় অংশ মাগুইন্দানাও-এর অধীনস্থ হয় এবং ইসলাম সমগ্র এলাকায় সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। কাবুংসুয়ান শাসন ব্যবস্থাকেও সুসংগঠিত করেন। তিনি অবশ্য সুলতান উপাধি গ্রহণ না করে শারিফ উপাধিই বহাল রাখেন। পরবর্তীকালে তার পুত্র ‘শারিফ মাকাআলাং শারিফ’ উপাধি রাখলেও মাকাআলাং-এর পুত্র ও তিনজন পৌত্র ‘দাতু’ উপাধি গ্রহণ করেন। অতঃপর তার প্রপৌত্র দিপাতুয়ান কুদরাত সুলতান উপাধি গ্রহণ করেছিলেন।
দুশো বছরের অবিরাম প্রচেষ্টার ফলে ফিলিপাইনের দক্ষিণাংশে ইসলাম একটি সম্পূর্ণ জীবনব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। সুলতানরা অতিদ্রুত বিভিন্ন এলাকা নিজেদের দখলে এনে ইসলামের প্রচার ও প্রসারের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেন। ইসলাম প্রচারকরা স্থানীয়দের কাছে ইসলামের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন, বিশেষ করে তারা ইসলামের মানবিক আবেদনের ওপর জোর দেন। তারা অত্যন্ত ধৈর্য এবং সতর্কতার সঙ্গে অগ্রসর হয়েছিলেন। যেমন পুরানো রীতিনীতি বর্জনের ব্যাপারে কোনো চাপ সৃষ্টি করা হয়নি। এই কৌশলগত উদারতা ইসলামকে স্থানীয়দের কাছে ধীরে ধীরে গ্রহণযোগ্য করে তোলে। এ প্রসঙ্গে ফিলিপিনো প্রফেসর এ্যান্টনিও ইসিদরোর মন্তব্য উল্লেখ করা যায়-
The missionaries worked with dedication, lived among the people, married their women, adjusted themselves to their customs, and learned to speak the native language. In other words, they identified themselves with the people whom they converted.
ইসলাম প্রচারকরা স্থানীয় লোকসংস্কৃতি ও ইসলামের সাথে সরাসরি বিরোধ নেই এমন সাধারণ রীতিনীতি গ্রহণ করেছিলেন, তাদের ভাষা শিখেছিলেন, আর এভাবেই তাঁরা ধীরে ধীরে মোরো সমাজের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন। বস্তুত এটিই ছিল তাঁদের সাফল্যের প্রধান কারণ।