মুসলিম পোর্ট

কাশ্মীর নামটি শুনলেই ভেসে উঠে আর্তনাদ করা ভয়ানক এক নগরীর। যেখানে প্রতিটি সেকেন্ড কাটাতে হয় সীমাহীন অনিরাপত্তার মধ্য দিয়ে। কিন্তু আবার এই কাশ্মীরকেই বলা হয় ভূ-স্বর্গ! কেন কাশ্মীরের এই করুন পরিণতি.? এর পেছনে কারাদায়ী.? কেনই বা সৃষ্টি হয়েছে সংঘাতের.? 

বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে উত্তপ্ত, সংঘর্ষপ্রবণ ও বিক্ষত এক জনপদ হলো এই কাশ্মীর। গত প্রায় ৭১ বছর ধরে কাশ্মীর লড়াই করছে তাদের আত্নপরিচয়ের জন্য। কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের মতামত বা অংশগ্রহণ ছাড়াই এই কাশ্মীরের মালিকানা কিংবা নিয়ন্ত্রণ পরিবর্তন হয়েছে বহুবার। এত বছর ধরে কাশ্মীর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নানা সমস্যা চললেও কাশ্মীর সমস্যার কোনো সুরাহা হয়নি আজও। কাশ্মীরের সাধারণ মানুষেরা এখনো স্বপ্ন দেখেন এক স্বাধীন জন্মভূমির।

বর্তমানে কাশ্মীর বলতে একটি তুলনামূলক বৃহৎ অঞ্চলকে বোঝায়। বর্তমান ভারত-নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য (যেটি জম্মু, কাশ্মীর উপত্যকা ও লাদাখের সমন্বয়ে গঠিত), পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত আজাদ কাশ্মীর ও গিলগিত-বালতিস্তান অঞ্চলদ্বয় এবং চীন-নিয়ন্ত্রিত আকসাই চিন ও ট্রান্স-কারাকোরাম ট্র্যাক্ট অঞ্চলদ্বয় বৃহত্তর কাশ্মীরের অন্তর্ভুক্ত।

জম্মু ও কাশ্মীরের আয়তন ১৩,২৯৭ বর্গ কি.মি. এবং ২০১৭ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী এই অঞ্চলের জনসংখ্যা প্রায় ৪৪ লক্ষ ৫০ হাজার। ‘মুজাফফরাবাদ’ জম্মু ও কাশ্মীরের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর। শহরটিতে প্রায় দেড় লক্ষ মানুষের বসবাস। জম্মু ও কাশ্মিরের জনসংখ‍্যার ৯৯ ভাগের বেশিই মুসলিম, যদিও প্রায় ২০,০০০ থেকে ২৫,০০০ আহমদিয়া এবং প্রায় ৪,৫০০ খ্রিস্টান অঞ্চলটিতে বসবাস করে। জম্মু ও কাশ্মিরে গুজ্জার (বা গুর্জর), সুধান, জাঠ, রাজপুত, মুঘল, আওয়ান, আব্বাসি এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করে।

জম্মু ও কাশ্মিরের সরকারি ভাষা উর্দু এবং সরকারি কাজে ও উচ্চশিক্ষায় ইংরেজি ভাষা ব‍্যবহৃত হয়। কিন্তু উর্দু ছাড়াও অঞ্চলটিতে কমপক্ষে আধ-ডজন ভাষা প্রচলিত, যেগুলোর মধ‍্যে রয়েছে পাহাড়ি, গোজরি, পাঞ্জাবি, কোহিস্তানি, পশতু এবং কাশ্মিরী।

আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের অর্থনীতি মূলত কৃষিপ্রধান এবং অঞ্চলটিতে শিল্পায়নের হার খুবই সীমিত। কৃষি ছাড়া সেবা খাত, পর্যটন এবং প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিট্যান্স অঞ্চলটির আয়ের মূল উৎস। আজাদ জম্মু ও কাশ্মিরের পার্বত‍্য উত্তরাঞ্চল ও সমভূমির দক্ষিণাঞ্চল মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ এবং এটি পর্যটকদেরকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে।

খ্রিস্টপূর্ব তিন হাজার বছর আগে এখানে জনবসতি গড়ে ওঠে বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন। এই হিসাবে এখন থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে এখানে জনবসতি ছিল। সম্ভবত নুহ (আ.) এর বংশধররাই এখানে বসতি গড়ে তোলে। প্রত্নতাত্ত্বিকেরা কাশ্মীরে প্যালিওলাথিক, নিওলিথিক ও মেগালিথিক-সকল যুগের প্রত্ননিদর্শন খুঁজে পেয়েছেন। এসব নিদর্শন কাশ্মীরের জনবসতির প্রাচীনত্বের সাক্ষ্য দেয়। অনেকেই মনে করেন, আদি বাসিন্দাদের অনেকে বিভিন্ন সময়ে হত্যাকাণ্ড প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও রোগব্যাধির শিকার হলেও কাশ্মীরের এখনকার জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই আদি বাসিন্দাদের উত্তরাধিকার বহন করছে।

পঞ্চম শতাব্দীর পূর্ববর্তী সময়ে কাশ্মীর প্রথমে হিন্দুধর্ম এবং পরে বৌদ্ধধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়। পরবর্তীতে নবম শতাব্দীতে কাশ্মীরে শৈব মতবাদের উত্থান ঘটে। ত্রয়োদশ থেকে পঞ্চদশ শতাব্দীতে কাশ্মীরে ইসলাম ধর্মের বিস্তার ঘটে এবং শৈব মতবাদের প্রভাব হ্রাস পায়। কিন্তু তাতে পূর্ববর্তী সভ্যতাগুলোর অর্জনসমূহ হারিয়ে যায় নি, বরং ইসলামী সভ্যতার আগমনের মাধ্যমে ইসলামী সভ্যতার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি এগুলোকে বহুলাংশে অঙ্গীভূত করে নেয়, যার ফলে জন্ম হয় কাশ্মিরী সুফিবাদের।

প্রায় পাঁচশ’ বছর মুসলমান শাসকরা কাশ্মীর শাসন করেছেন। কাশ্মীরের সুদীর্ঘ ইতিহাসে মুসলিম শাসনামলটিই ‘স্বর্ণযুগ’ হিসাবে স্বীকৃত। কাশ্মীরে ইসলামের আগমন সম্পর্কে একজন ঐতিহাসিক বলেছেন, আরব থেকে উত্তর ভারত হয়ে ইসলাম কাশ্মীরে এসেছে। কাশ্মীরের একজন শাসক ইসলাম গ্রহণের পর কাশ্মীরিদের অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করে। এছাড়া সুফী-দরবেশদের প্রভাবে বিপুল সংখ্যক কাশ্মীরি ইসলাম গ্রহণ করে। এভাবে কাশ্মীর ইসলামী সভ্যতা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের গর্বিত পীঠস্থানে পরিণত হয়। গত শতকের মাঝামাঝি সময়ে দেখা যায়, কাশ্মীরের মোট জনসংখ্যার ৯৯ শতাংশই মুসলমান। এখনো সেটা বহাল আছে। জম্মুতে মুসলমানের সংখ্যা হিন্দুর প্রায় সমান থাকলেও বর্তমানে হিন্দুর সংখ্যা ৬৫ শতাংশ।

১৩৩৯ সালে শাহ মীর কাশ্মীরের প্রথম মুসলিম শাসক হিসেবে অধিষ্ঠিত হন এবং শাহ মীর রাজবংশের গোড়াপত্তন করেন। পরবর্তী পাঁচ শতাব্দীব্যাপী কাশ্মীরে মুসলিম শাসন বজায় ছিল। এর মধ্যে মুঘল সালতানাতের সময় ১৫৮৬ সাল থেকে ১৭৫১ সাল পর্যন্ত এবং আফগান দুররানী শাসনামলের ১৭৪৭ সাল থেকে ১৮১৯ সাল পর্যন্ত কাশ্মীর শাসন করেন। ১৮১৯ সালে রঞ্জিত সিংয়ের নেতৃত্বে শিখরা কাশ্মীর দখল করে। রঞ্জিত সিং এ এলাকার শাসনভার অর্পণ করেন রাজপুত্র গুলাব সিংকে। শিখ শাসন ছিল লাহোরকেন্দ্রিক। শিখ মহারাজা রঞ্জিত সিংয়ের মৃত্যুর পর শিখ শাসন দুর্বল হয়ে পড়ে। এ সুযোগে ব্রিটিশরা শিখদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। গুলাব সিং জম্মুর রাজা হিসেবে ব্রিটিশদের সহযোগিতা করেন।

রঞ্জিত সিংয়ের মৃত্যুর পর এ শাসনভারের দায়িত্ব অর্পিত হয় তার কনিষ্ঠ পুত্র দুলিপ সিংয়ের উপর এবং সেও তথাকথিত দূর্বল শাসকদের মধ্যে একজন ছিল। ঠিক ঐ মুহূর্তে ১৮৪৬ সালে ব্রিটিশরা আক্রমণ করে শিখ সাম্রাজ্যে। ব্রিটিশদের সাথে শিখদের এই প্রথম যুদ্ধে জম্মু ও কাশ্মীর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ১৮৪৬ সালে প্রথম ইস্ট ইন্ডিয়া বনাম শিখ যুদ্ধে ইংরেজদের নিকট শিখরা পরাজিত হয়। পরাজয় বরণের পর ১৮৪৬ সালের ৯ মার্চ তৎকালীন পাঞ্জাব শিখ রাজা দুলিপ সিংয়ের সাথে ব্রিটিশদের একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা লাহোর চুক্তি নামে পরিচিত। এই চুক্তির মধ্য দিয়েই প্রথমবারের মতো কাশ্মীর বিক্রি হয়ে যায়।

এই চুক্তির মাধ্যমে পরাজিত শিখ সাম্রাজ্য কাশ্মীর, জম্মু, হাজারাসহ বিভিন্ন এলাকা দিয়ে দিতে বাধ্য হয় ব্রিটিশদের হাতে। সেই সাথে যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেড় কোটি নানকার শাহী (শিখ সাম্রাজ্যের প্রচলিত মুদ্রা) দাবি করে ব্রিটিশরা। রাজা দুলিপ সিং ৫০ লাখ নানকার শাহী দেন এবং বাকি এক কোটি নানকার শাহীর বিনিময়ে কাশ্মীর ও এর আশেপাশের এলাকা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে দিয়ে দেন।

প্রথম চুক্তির ধারাবাহিকতায় দ্বিতীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা অমৃতসর চুক্তি নামে পরিচিত। এই চুক্তির ফলে দ্বিতীয়বারের মতো কাশ্মীর বিক্রি হয়। প্রথম চুক্তি বাস্তবায়নের ক’দিন পরই ১৮৪৬ সালের ১৬ মার্চ এই চুক্তি হয় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে জম্মুর স্থানীয় শাসক গুলাব সিংয়ের। এই ‘অমৃতসর’ চুক্তির মাধ্যমে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কাশ্মীর ও আশেপাশের এলাকা গুলাব সিংয়ের নিকট বিক্রি করে দেয়। গুলাব সিং ছিল নিকৃষ্ট অত্যচারী শাসক।

সেসময় কাশ্মির শিখ সাম্রাজ্যের গভর্নর হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন সাবেক গভর্নর গোলাম মহিউদ্দীনের পুত্র ইমাম উদ্দীন। ব্রিটিশরা এই কাশ্মীর অঞ্চল জম্মুর শাসক গুলাব সিংয়ের নিকট বিক্রির সিদ্ধান্ত নিলে কঠোর প্রতিবাদ করেন গভর্নর ইমাম উদ্দীন। প্রতিরোধ সত্ত্বেও ব্রিটিশরা কাশ্মীর এলাকা গুলাব সিংয়ের কাছেই বিক্রি করে। ফলশ্রুতিতে, জম্মু ও কাশ্মীর চলে আসে ডোগরা বংশের নিয়ন্ত্রণে। গুলাব সিং হয়ে ওঠেন জম্মু কাশ্মীরের একক অত্যচারী শাসক। ব্রিটিশরা তাকে স্বতন্ত্র ‘মহারাজা’ হিসেবেও স্বীকৃতি দেয়।

কাশ্মীরের শাসক হওয়ার বিনিময়ে গুলাব সিংয়কে ব্রিটিশদের কোষাগারে জমা দিতে হয়েছিল নগদ ৭৫ লাখ মুদ্রা। নগদ মূল্য ছাড়াও গুলাব সিংয়কে প্রতি বছর একটি ঘোড়া, বারোটি উন্নত জাতের ছাগল ও তিন জোড়া কাশ্মীরী শাল দিতে হতো। এসব গোলামীর পাশাপাশি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশদের পক্ষের অনেক সৈন্যও প্রেরণ করেছিল এই অত্যচারী শাসক। এসব আনুগত্যের ফলে ব্রিটিশদের প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন গুলাব সিং ও তার শাসকবংশ। এছাড়াও গুলাব সিং হয়ে ওঠেন পুরো কাশ্মীর ও আশেপাশের অঞ্চলের একচ্ছত্র অধিপতি। লাহোরকেন্দ্রিক কাশ্মীর তখন জম্মুকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে। সদ্য বিক্রিত জনপদের অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কোনো পর্যবেক্ষক রাখবারও প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনি।

অদ্য অঞ্চলে গুলাব সিং এক অত্যাচারী শাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। কাশ্মীরের জনগণ থেকে ইচ্ছামতো অতি উচ্চ হারে কর আরোপ করতে থাকেন; বিশেষ করে মুসলমানদের উপর অত্যাচার ও নির্যাতন শুরু হয় তার শাসনামল থেকেই। তিনি এই করারোপের উপায় হিসেবে বিভিন্ন জনস্বার্থ বিরোধী একচেটিয়া পদ্ধতি অনুসরণ করতে শুরু করেন। এর ফলে তার শাসনামলে কাশ্মীরের সাধারণ মুসলমান নাগরিকদের অত্যচারের পরিমাণ বৃদ্ধি হয়। ১৮৭৭ থেকে ১৮৭৯ সালে ঘটা এই দুর্ভিক্ষে স্থানীয় জনসংখ্যার পাঁচভাগের দু’ভাগ মারা গেলেও একজন হিন্দু পণ্ডিতও খাদ্যাভাবে মারা যাননি! এটাই প্রমাণিত হয় যে, কাশ্মীরের সাধারণ নাগরিকদের প্রতি কীরূপ বৈষম্যমূলক আচরণ করতেন হিন্দু পণ্ডিত শাসকেরা। শাসকদের এ অত্যাচারের ফলেই পরবর্তীতে ১৯৩১ সালে আজাদি (স্বাধীনতা) আন্দোলনের সূত্রপাত হয় কাশ্মীরে। দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ রূপ নেয় আন্দোলনে। ১৯৩১ সালে তৎকালীন মহারাজা হরি সিংয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ঈদের নামাযে খুৎবার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। মহারাজার সৈনিকেরা কুরআন শরীফের প্রতিও অবমাননামূলক আচরণ করে। এসবের ফলে সমগ্র রাজ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এর মাঝে এক সমাবেশে উত্তেজিত এক যুবক ‘আব্দুল কাদির’ মহারাজার বাসভবন ধবংসের হুঁশিয়ারি দেয়। তাকে আটক করা হয় এবং দ্রুত বিচার কাজ শুরু করা হয়। ১৯৩১ সালের ১২ জুলাই আব্দুল কাদিরের সমর্থনে কাশ্মীর জুড়ে মিছিল চলতে থাকে। এরূপ অবস্থায় উত্তেজিত জনতার রোষানল থেকে মুক্তির জন্য আব্দুল কাদিরের বিচার স্থানান্তর করা হয় কারা অভ্যন্তরে। শ্রীনগর কারাগারে পরদিন ১৩ জুলাই আব্দুল কাদিরের বিচার অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেও কাতারে কাতারে স্থানীয় মুসলমান সমবেত হয় সেই বিচার প্রত্যক্ষ করতে। বিচার চলাবস্থায় নামাযের ওয়াক্ত হয়ে যাওয়ায় এক যুবক আজান দেয়। সাথে সাথে মহারাজার গভর্নরের নির্দেশে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তাকে গুলি করার সাথে সাথে আরেকজন দাঁড়িয়ে যান আজান দিতে। তাকেও গুলি করে হত্যা করা হয়। তারপর দাঁড়িয়ে যান আরো একজন। এভাবে সেদিন আজান দেয়ার অপরাধে একে একে ২২ জন কাশ্মীরি মুসলমান মৃত্যুকে বরণ করেন। শোকে ক্ষোভে প্রথমে স্তব্ধ হয়ে পড়লেও পরে উত্তাল হয়ে ওঠে সমগ্র কাশ্মীর। ১৯৩১ সালেই প্রথমবারের মতো দীর্ঘদিনের অত্যাচার, নিপীড়ন ও সাম্প্রদায়িক বৈষম্যের বিরুদ্ধে স্থানীয় মুসলমান প্রজারা গণআন্দোলন করে। ১৯৩১ সালের এই গণআন্দোলনই পরবর্তীতে কাশ্মীরের স্বাধীনতা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটায়।

অবশেষে, ১৮৮৫ সালে ব্রিটিশ সরকার এই এলাকার স্থানীয় প্রশাসনের উপর নজরদারি বৃদ্ধির জন্য কাশ্মিরে একজন ‘রেসিডেন্ট অব দ্য স্টেট’ নিয়োগ দেন। তাতেও স্থানীয় মুসলমানদের উপর অত্যাচার কমেনি; বরং দ্বিগুন পরিমাণে এই অত্যাচারের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছিল। স্থানীয় মুসলমানদের এতটাই কোণঠাসা করে রাখা হয়েছিল যে, ১৯৩০ সাল পর্যন্ত রাজ্যের সশস্ত্র বাহিনী কিংবা প্রশাসনিক কাজে হিন্দু রাজবংশীয় বাদে স্থানীয় মুসলমানদের চাকরির কোনো সুযোগ ছিল না।

কাশ্মীরের মুসলমানদের উপর অত্যাচার ও নিপীড়নের শুরু হয় শিখ সাম্রাজ্যের সময় থেকেই। শিখ সাম্রাজ্যের সময় সর্বপ্রথম ইসলাম ধর্ম বড় ধরনের বিপত্তিতে পড়ে। কেননা, পাঞ্জাব থেকে পরিচালিত এই শাসনামলে যাদের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হতো, তাদের প্রায় সবাই ছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। মাত্র দুজন মুসলমান গভর্নর দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়েছিলেন এখানে; তদেরও বেশীদিন স্থায়ী হতে দেয়নি। মুসলমানদের উপর কঠোর কর ব্যবস্থা তো ছিলোই, সেই সাথে এতটাই কঠোর নীতি ছিল শাসকদের যে, প্রায় দুই দশক ধরে কাশ্মীরের প্রধান মসজিদে সকল-ধরনের ইবাদত নিষিদ্ধ ছিল। তারপরের এক শতাব্দী ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত তার বংশধরগণ ব্রিটিশ রাজমুকুটের অনুগত গোলাম হিসেবে কাশ্মীর শাসন করেন। চলে আসছিল ডোগরা জমিদারদের কুশাসন। ডোগরা শাসকরা ব্যয়ের চেয়ে সঞ্চয়ের প্রতি বেশি মনোযোগী ছিল। ১৮৬৮ সালে উপত্যকায় রেভেনিউ আদায় হয়েছিল ১৮ লাখ ৩৬ হাজার ৩১৮ রুপি!

১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগের আগে যখন জম্মু-কাশ্মীর ডোগরা রাজাদের অধীন, তখন তার আয়তন ছিল ২ লাখ ২২ হাজার ৩৩৬ বর্গ কিলোমিটার। এই বিশাল ভূখণ্ড এখন তিন রাষ্ট্রের মধ্যে বিভাজিত হয়ে আছে। ভারতের নিয়ন্ত্রণে আছে প্রায় এক লাখ বর্গ কিলোমিটার, যা মোট ভূমির ৪৫ শতাংশ। পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে আছে ৭৮ হাজার বর্গ কিলোমিটার বা ৩৬ শতাংশ। আর চীনের অধীনে আছে ৩৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার বা ১৬ শতাংশ। পরবর্তীতে পাকিস্তান চীনের মধ্যে সীমান্ত সংক্রান্ত সমঝোতায় চীন পাকিস্তানের মধ্য থেকে আরও পেয়েছে পাঁচ হাজার ৮০০শ’ বর্গ কিলোমিটার। এতে চীনের নিয়ন্ত্রিত এলাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২০ শতাংশ। পাকিস্তান-ভারত ও চীন-ভারত যুদ্ধের মধ্যদিয়ে কাশ্মীর এই তিন রাষ্ট্রের মধ্যে বিভাজিত হয়েছে। ১৯৪৮ ও ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধে। এর মধ্যে ১৯৪৮ সালের যুদ্ধে পাকিস্তান কাশ্মীরের একাংশ দখলে নেয়, যা আজাদ কাশ্মীর নামে পরিচিত। বাকি অংশ ভারতের নিয়ন্ত্রণে থাকে। ১৯৪৭ সালে, ব্রিটিশরা যখন বিদায় নেয় এবং ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশে বিভক্ত হয় তখন তারা ৫৬২ টি প্রিন্সলি স্টেটকে হয় ভারত নয় পাকিস্তানে যোগ দিতে বলে। ভারতের স্টেট গুলো ভারতে এবং পাকিস্তানের গুলো পাকিস্তানে যোগ দেয়। কিন্তু ৩ টি স্টেট স্বাধীন থাকতে চেয়েছিল। হায়দ্রাবাদ, জুনগর এবং জম্মু ও কাশ্মীর। এদের মধ্যে হায়দ্রাবাদ এবং জুনগর ছিল হিন্দু সংখ্যা গরিষ্ঠ কিন্তু তাদের রাজা ছিল মুসলিম। জনগণ বিক্ষোভ করে ভারতে যোগদান করার জন্য, ফলে ভারতীয় সেনাবাহিনী এ্যাকশনে যায় এবং দখল করে নেয়। পরবর্তীতে গণ-ভোটের মাধ্যমে বৈধতা হাসিল করে নেয়।

অপরদিকে, জম্মু এবং কাশ্মীরের জনসংখ্যা ছিল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কিন্তু রাজা ছিল হরি সিং। হরি সিং শুরুতে স্বাধীন থাকতে চেয়েছিলেন এবং একই সাথে নেহেরু ও জিন্নাহ সাথে এই বিষয় নিয়ে তর্ক-বিতর্কও করছিলেন। হরি সিং কাশ্মীরকে এশিয়ার সুইজারল্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। কাশ্মীরকে পাকিস্তানের অংশ করতে জিন্নাহ ছিল বেশ আত্মবিশ্বাসী। তিনি কাশ্মীরকে তার পকেটে রাখা ‘ব্লাঙ্ক চেক’ বলে আখ্যায়িত করেন। রাজা হরি সিং এর উপর নেহেরুর আস্থা ছিল কম। নেহেরু, জেলে বন্দি শেখ আবদুল্লার (কাশ্মীর স্বাধীনিতাকামী নেতা) মুক্তি চাচ্ছিল। স্বাধীন হবার ১৩ দিন পূর্বে রাজা হরি সিং পাকিস্তানের সাথে ‘স্ট্যান্ড স্টিল’ চুক্তি স্বাক্ষর করে। কিন্তু ভারত এই চুক্তিতে একমত হয়নি। দুটি নতুন দেশ জন্ম হবার ফলে বিভিন্ন অঞ্চলে মুসলিম-শিখ-হিন্দুদের মধ্যে দাঙ্গার সৃষ্টি হয়। কাশ্মীরেও একই পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে মুসলিম উপজাতিরা পাকিস্তানে পলায়ন করতে থাকে। এই ঘটনায় পাকিস্তান ক্ষুব্ধ হয়ে পাহাড়ি নন স্টেট বাহিনীকে কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রেরণ করেন, ২২ শে অক্টোবর। কারণ চুক্তির কারণে সেনাবাহিনী সরাসরি আক্রমন করতে পারে নাই। বাহিনীর আক্রমনে কাশ্মীরের অধিকাংশ অঞ্চল রাজার নিয়ন্ত্রণেরও বাইরে চলে যায়। তারই প্রতিক্রিয়ায় মহারাজা হরি সিং ভারতের সাহায্য প্রার্থনা করেন। শেখ আবদুল্লাহ (কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামী নেতা) পরাশর্মক্রমে ভারতের সাথে চুক্তি করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু ভারত সরকার তাদের সাথে যুক্ত হবার শর্ত জুড়ে দেয় এবং রাজা হরি সিং তা মেনে নেয়। এরই ধারাবাহিকতায় স্বাক্ষরিত হয় ‘ইন্সট্রুমেন্ট অব এসেশন’ (Instrument of Accession) চুক্তি। পাকিস্তান এই চুক্তিকে মেনে নেয় নি, তারা দাবি করে চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে হরি সিংকে বাধ্য করা হয়েছে চুক্তি করতে। চুক্তির পর দিন ভারত তার নিয়মিত সৈন্য বাহিনী প্রেরণ করে এবং নন স্টেট বাহিনীকে হটিয়ে কাশ্মীরের দখল নেয়। একই সময় পাকিস্তানও তাদের সেনাবাহিনী প্রেরণ করে। ফলে স্বাধীন হবার প্রথম বছরেরই যুদ্ধ বেঁধে যায় দুটি নতুন দেশের মধ্যে। চুক্তি অনুসারে হরি সিং কাশ্মীরে পূর্ণ স্বায়ত্তত্বশাসন চেয়ে নেন এবং শেখ আবদুল্লাহকে অন্তর্বর্তী কালীন সরকারের প্রধান ঘোষণা করেন। এই যুদ্ধের ফলে কাশ্মীর দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এক অংশ চলে যায় ভারতের নিয়ন্ত্রণে। যার নাম হয় জম্মু এবং কাশ্মীর এবং পাকিস্তানের অংশের নাম হয় আজাদ কাশ্মীর।

১৯৪৭ সালের প্রথমদিকে হরি সিং কাশ্মীরের পুন্চ অঞ্চলে খাজনা বৃদ্ধি করেন এবং এর ফলে ঐ অঞ্চলের জনসাধারণের মধ‍্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এছাড়াও ‘নিখিল জম্মু ও কাশ্মির মুসলিম কনফারেন্স’ নামে মুসলমানদের যে দল ছিল, দলটি এসময় জম্মু প্রদেশের পুন্চ ও মিরপুর অঞ্চলে বিপুল জনপ্রিয় ছিল এবং এই দলটি পাকিস্তানের সঙ্গে যোগ দেয়ার জন্য জনসাধারণকে আহ্বান জানায়।

ইতোমধ্যে খাজনা আদায়কে কেন্দ্র করে অক্টোবরে পুন্চে বিদ্রোহ দেখা দেয় এবং রাজা হরি সিং–এর হিন্দু ও শিখ সৈন‍্যরা কঠোর হাতে বিদ্রোহ দমনের চেষ্টা করে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে বহুসংখ্যক মুসলমান সৈন‍্য বিদ্রোহে যোগ দেয়। পুন্চ অঞ্চলের প্রায় পুরোটাই হরি সিংয়ের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ১৯৪৭ সালের ৩ অক্টোবর পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে পুন্চ, মুজাফফরাবাদ ও মিরপুরে মুসলমান গোত্রপ্রধানরা মিলিত হয়ে ‘আজাদ জম্মু ও কাশ্মির সরকার’ গঠন করেন। খাজা গুলাম নবী গিলকার এই সরকারের রাষ্ট্রপতি এবং সর্দার মুহাম্মদ ইব্রাহিম খান প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। কিন্তু গিলকার কয়েকদিনের মধ্যে শ্রীনগরে গ্রেপ্তার হন এবং পাকিস্তানের সঙ্গে বিরোধের কারণে এই সরকারটি বিলুপ্ত হয়ে যায়। ২৪ অক্টোবর পাল্লান্দ্রিতে আরেকটি ‘আজাদ জম্মু ও কাশ্মির’ সরকার গঠিত হয় এবং সর্দার ইব্রাহিম খান এই সরকারের রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন। এই দিনটিকে বর্তমানে ‘আজাদ কাশ্মির দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়।

এদিকে জম্মু ও কাশ্মির জুড়ে ব‍্যাপক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা–হাঙ্গামা শুরু হয়। ১৯৪৭ সালের অক্টোবর ও নভেম্বরে জম্মু প্রদেশে উগ্রপন্থী হিন্দু ও শিখরা ‘রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ’র (আরএসএস) পরিচালনায় এবং জম্মু ও কাশ্মিরের সরকার ও রাজকীয় সৈন‍্যবাহিনীর প্রত‍্যক্ষ সহায়তায় প্রায় ৫০,০০০ থেকে ১,০০,০০০ মুসলিমকে হত্যা করে। এই গণহত‍্যার মূল উদ্দেশ্য ছিল জম্মু প্রদেশের জনসংখ‍্যায় মুসলিমদের অনুপাত হ্রাস করা।

১৯৪৮ সালে কাশ্মীর সমস্যা নিয়ে বৈশ্বিক সমাধানের জন্য ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশ জাতিসংঘের সাহায্য প্রার্থনা করে। সমস্যা সমাধানের জন্য জাতিসংঘ ভারত ও পাকিস্তান সংকট সমাধান বিষয়ক কমিশন গঠন করে। সমাধান হিসেবে নিরাপত্তা পরিষদের রিজুলেশন-৪৭ প্রস্তাব করা হয় যেখানে ভারত এবং পাকিস্তানকে তাদের নিজ নিজ সৈন্য সরানোর নির্দেশ দেওয়া হয় এবং সর্বশেষ গণ ভোটের আয়োজন করতে বলা হয়। কিন্তু দিন শেষে ভারত এবং পাকিস্তান কোন পক্ষই তাদের সৈন্য হটিয়ে নেয় নি। কার্যত জাতিসংঘের সমাধান ব্যর্থ হয়ে যায়।

১৯৪৯ সালের জুলাই মাসে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান শেখ আব্দুল্লাহ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৭০ এর বিধানের বিষয়ে আলোচনা করেন। তখনও ঐ অনুচ্ছেদটির খসড়া করা হচ্ছিল। ১৯৫০ সালে ভারতের সংবিধানে অনুচ্ছেদ ৩৭০ অনুযায়ী বিশেষ মর্যাদা পায় জম্মু ও কাশ্মীর।

১৯৫০ সালে ভারতের সংবিধানে অনুচ্ছেদ ৩৭০ অনুযায়ী বিশেষ মর্যাদা পায় জম্মু ও কাশ্মীর। ১৯৫২ সালে কাশ্মীরের সাথে দিল্লি চুক্তি সম্পন্ন হয়; যেখানে রাজ্যের সাথে কেন্দ্রের সম্পর্কের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পায়। ১৯৫৬ সালে জম্মু ও কাশ্মীর আলাদা সংবিধান পায় এবং নিজেদের ভারতের অভ্যন্তরীন অংশ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে। পরবর্তীতে ১৯৬২ সালে ভারত চীন যুদ্ধের ফলে চীন আকসাই চীন অঞ্চল দখল করে নেয়। আবার, পাকিস্তানের বন্ধুত্বের প্রতীক হিসেবে (The Trans Karakorum Tract) কাশ্মীরের বিশাল একটি অংশ, সাশগ্রাম ভ্যালি চীনকে উপহার দেয়। ফলে মূল কাশ্মীর ভূখণ্ড তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। ১৯৭২ সালের সিমলা চুক্তি অনুযায়ী ভারত এবং পাকিস্তান কাশ্মীর সমস্যাকে নিজেদের মধ্যে সমাধান করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং একই সাথে ‘লাইন অব কন্ট্রোল’ অবতারনা করা হয়। ১৯৭৫ সালে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং শেখ আব্দুল্লাহ কাশ্মীর চুক্তি স্বাক্ষর করেন, যেখানে আবারো অনুচ্ছেদ ৩৭০ এর গুরুত্বের ওপর জোর দেয়া হয়। ১৯৯০ সালে জঙ্গিবাদের উত্থানের ফলে কাশ্মীরি পন্ডিতরা (হিন্দু ব্রাহ্মণ) কাশ্মীরে তাদের বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হন। ১৯৯৫ সালে আবার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরসিমহা রাও নিশ্চিত করেন যে অনুচ্ছেদ ৩৭০ রদ করা হবে না। ২০১৫ সালে রাজ্যে পিপল’স ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সাথে সরকার গঠন করে বিজেপি; যা কাশ্মীরের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা। ২০১৮ সালে পিডিপি’র সাথে বিজেপি জোটভঙ্গ করার পর রাজ্যে কেন্দ্রীয় শাসন ঘোষণা করা হয়। ২০১৯ সালে কাশ্মীর উপত্যকাকে সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ অনুচ্ছেদ ৩৭০ ও ৩৫এ রদ করার প্রস্তাব তোলেন সংসদে।

২০১৯ সাল পরবর্তী বর্তমান পর্যন্ত ৫/৬ বছরের ইতিহাসকে আরেকটু ভালো করে পর্যালোচনা করলে হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসনটা আরো ভালোভাবে ফুটে উঠবে তবে সপ্তাহখানেক আগের তথা ২০২৪ সালের কাশ্মীর নির্বাচন এনালাইসিস করলে বিষয়টা আরো সুস্পষ্ট হবে বলে আশা রাখছি…

মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে কাশ্মীর নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেছিলেন নরেন্দ্র মোদি। সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ খারিজের পর তিনি চেয়েছিলেন জম্মু-কাশ্মীরকে প্রথমবারের মতো কোনো হিন্দু মুখ্যমন্ত্রী উপহার দিতে। স্বপ্ন সাকার করতে চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি তিনি।

জম্মুজুড়ে প্রচার চলেছে কোনো ডোগরার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার কথা। উপত্যকার জনতা তা ব্যর্থ করে দিল। এই অতৃপ্তি নিশ্চিতভাবেই তাঁকে বহুদিন হতাশাচ্ছন্ন রাখবে। জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভার ভোট হলো ১০ বছর পর গত সপ্তাহখানেক আগে। এ সময়ে ঝিলম দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। পিডিপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে বিজেপি চার বছর রাজত্ব করেছে। তারপর জোট ভেঙে রাজ্যটাকেই ভেঙে দিলেন মোদি। লাদাখকে আলাদা করে দুটি পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গড়ার পাশাপাশি কেড়ে নিলেন জম্মু-কাশ্মীরের সংবিধান প্রদত্ত বিশেষ ক্ষমতা। খারিজ করলেন সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ।

সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ না দিলে আরও কত দিন সেখানে কেন্দ্রের শাসন চলত, কেউ জানে না। যেমন এখনো জানা নেই, প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা কবে পাবে। কবে প্রতিষ্ঠা পাবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের পূর্ণ হুকুম।

ভাবী মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ জানিয়েছেন, রাজ্যের মর্যাদা ফেরতের দাবিই হবে নতুন মন্ত্রিসভার প্রথম প্রস্তাব। যদিও তা যে শর্তসাপেক্ষ, সে ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন বিজেপি নেতা রাম মাধব, যাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ভোট পরিচালনার। তিনি বলেছেন, রাজ্যের মর্যাদা ফেরতের আগে কেন্দ্রকে নিশ্চিত হতে হবে, সেই সব ভয়ংকর দিন ভূস্বর্গে আর ফেরত আসবে না। কে জানে, ভোট হলেও এটা দিল্লি-শ্রীনগরের নতুন রাজনৈতিক ঠোকাঠুকি পর্ব হতে চলেছে কি না।

ন্যাশনাল কনফারেন্স (এনসি) ও কংগ্রেসের জোট জম্মু-কাশ্মীরে সরকার গড়ুক, নিশ্চিতভাবেই মোদি তা চাননি। চাননি বলেই বিধানসভার বহর বাড়ানো হয়েছে। কেন্দ্রগুলোর সীমানা নতুনভাবে এঁকে হিন্দুপ্রধান জম্মুতে বাড়ানো হয়েছে ৬টি আসন, মুসলমানপ্রধান কাশ্মীরে ১টি। ওখানেই তিনি থেমে থাকেননি। আইন করে উপরাজ্যপালকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে বিধানসভায় পাঁচজনকে মনোনীত করার, যাঁদের ভোটাধিকারও থাকবে।

২০১৯ সালে জম্মু-কাশ্মীর পুনর্গঠন আইনে বলা হয়েছিল,

উপরাজ্যপাল যদি মনে করেন বিধানসভায় পর্যাপ্ত নারী নির্বাচিত হননি, তাহলে তিনি দুজন নারীকে মনোনয়ন করতে পারবেন। ২০২৩ সালে সেই আইনও সংশোধন করা হয়। উপরাজ্যপালকে অধিকার দেওয়া হয় আরও তিনজনকে মনোনীত করার, যাঁদের মধ্যে দুজন হবেন উদ্বাস্তু কাশ্মীরি পণ্ডিত (একজন নারী), অন্যজন পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের উদ্বাস্তু। এর ফলে বিধানসভার বহর বেড়ে হয় ৯৫।

ভোটের ফলাফল বেরোনোর আগেই বিজেপি সেই পাঁচজনের নাম ভাসিয়ে সগর্ব ঘোষণা করে, পাঁচজনই দলের পদাধিকারী। এর বিরুদ্ধে এনসি, পিডিপি, কংগ্রেস, সিপিএম সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার হুমকি শুনিয়ে রেখেছে। তাদের কথায়, মন্ত্রিসভার সঙ্গে আলোচনা না করে একতরফা মনোনয়নের অধিকার অনির্বাচিত উপরাজ্যপালের থাকতে পারে না। আশঙ্কা, এই মনোনয়ন মুখ্যমন্ত্রী ও উপরাজ্যপালের সংঘাতের দ্বিতীয় হেতু হতে পারে। দিল্লিতে যা আকসার তথা হরহামেশাই হচ্ছে। ক্ষমতা দখলে এত কিছুর পরও নরেন্দ্র মোদির স্বপ্ন অধরা থেকে গেল উপত্যকাবাসী বিজেপির দিক থেকে মুখ ফেরানোয়!

কাশ্মীর উপত্যকায় ৪৭ আসনের মধ্যে এনসি জিতেছে ৩৫টি। জোট শরিক কংগ্রেস ৯ আসন। সিপিএম তার একমাত্র আসনটি এবারও হাতছাড়া করেনি। কুলগামে এ নিয়ে টানা পাঁচবার জিতলেন ইউসুফ তারিগামি।

উপত্যকা ও জম্মুর সংযোগকারী পুঞ্চ, রাজৌরি জেলায় ১৬ আসনে লড়ে এনসি ৭টি দখল করলেও তাদের চূড়ান্ত হতাশ করেছে কংগ্রেস। জম্মু অঞ্চলে ৩০টি আসনে প্রার্থী দিয়ে কংগ্রেস জিততে পেরেছে মাত্র ১টি আসনে। অথচ ২০১৪ সালের প্রবল মোদি-হাওয়াতেও জম্মু এলাকায় কংগ্রেস ৫টি আসন জিতেছিল।

বলতেই হবে, হরিয়ানায় কংগ্রেস যেমন নিশ্চিত জয়ের মুখ থেকে হার ছিনিয়ে ফিরেছে, জম্মুতেও তেমনই তারা নিজেদের মুখ পুড়িয়েছে। অথচ ৩৭০–পরবর্তী জম্মুতে অসন্তোষের আগুন দাউ দাউ না হলেও ধিকিধিকি জ্বলছিল। বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহারের ফলে স্থানীয় হিন্দু-শিখ ব্যবসায়ীরা কোণঠাসা হচ্ছিল। বহিরাগত গুজরাটি, পাঞ্জাবি শিল্পপতিদের কাছে হারাচ্ছিল জমির অধিকার। সংকুচিত হচ্ছিল সরকারি ও বেসরকারি চাকরির বাজার। বেড়ে যাচ্ছিল অসম প্রতিযোগিতা।

একদিকে হিন্দুত্ববাদ প্রতিষ্ঠা ও সন্ত্রাসবাদ দমনের অভীপ্সা, অন্যদিকে অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানের প্রতিযোগিতায় ক্রমে কোণঠাসা হওয়া—এই দুই সংঘাতে জম্মুর হিন্দুসমাজ যে দোলাচলের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, তাতে ঘা মারার ক্ষেত্রে কংগ্রেস চূড়ান্ত ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।

জম্মু, সাম্বা, কাঠুয়া, উধমপুর জেলাগুলোয় রাহুল একবারের জন্যও প্রচারে যাননি। উপযুক্ত প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও দল করে গেল একের পর এক ভুল। সেই সুযোগ হাতছাড়া করেনি বিজেপি। তাদের ২৯টি আসনের প্রতিটিই জম্মুর। উপত্যকায় তারা খাতা খুলতে ব্যর্থ।

এই ব্যর্থতার প্রধান কারণ যদি হয় মোদি সরকারের ২০১৯ সালের ৫ আগস্টের যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত, দ্বিতীয় কারণ তাহলে ভোটে জিততে তাদের হীন চাতুরী। ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদ উপত্যকার মানুষ শুধু যে মন থেকে মেনে নেয়নি, তা–ই নয়, বিজেপির ছল, বল, কৌশলকেও এই ভোটে তারা সমবেতভাবে পরাজিত করেছে।

তা করতে গিয়ে উপত্যকাবাসী চোখ বন্ধ করে বেছে নিয়েছে পরিচিত ঘরের দল এনসিকে। আবদুল্লাহ পরিবারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ-অসন্তোষ থাকা সত্ত্বেও এই ভোটে তারা নির্দ্বিধায় তাদেরই কোল পেতে দিয়েছে বহিরাগত আগ্রাসী বিজেপির উগ্র হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদ রুখতে।

তারা বুঝেছে, ৩৭০ অনুচ্ছেদ লোপ পেলেও ‘কাশ্মীরিয়ৎ’-এর অহংবোধ কেউ যদি রক্ষা করতে পারে, তাহলে এনসিই পারবে।

বিজেপি যতই আসন প্রাপ্তির বড়াই করুক, ২৯ আসন জেতার কৃতিত্ব (২০১৪ সালে পেয়েছিল ২৫টি) যতই বিজ্ঞাপিত হোক, এই ফল ৩৭০–এর বিরুদ্ধে উপত্যকাবাসীর গণভোট বলেই পরিচিতি পাচ্ছে।

একই রকমভাবে এই ফল বোঝাল, উপত্যকাবাসী নীতির ক্ষেত্রে বিজেপির দ্বিচারিতারও বিরুদ্ধে। তাদের সব আয়োজনই তাই বৃথা।

বিজেপির অঙ্ক ছিল জম্মুর সিংহভাগ আসন জিতে উপত্যকার মুসলমান ভোটে বিভাজন ঘটানো। সে জন্য প্রথম ভরসা ছিল দলছুটদের নিয়ে তৈরি আপনি পার্টি ও আজাদ পার্টি।

পিডিপির শীর্ষ নেতা আলতাফ বুখারি ও কংগ্রেসের গুলাম নবী আজাদ লোকসভা ভোটে সেই লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় বিজেপি কাছে টানে বিচ্ছিন্নতাবাদী জেলবন্দী সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার রশিদকে। এই চার শক্তিকে নানাভাবে মদদ দিয়েও বিজেপি নিজেদের চূড়ান্ত ব্যর্থ প্রতিপন্ন করল। তাদের কারিকুরি বুঝতে উপত্যকার মানুষের দেরি হয়নি। এরা বিজেপির ‘বি-টিম’ বলে এনসির প্রচার বিনা বাক্যে তারা গ্রহণ করেছে। বিজেপি এখন সাফাই গাইছে এই বলে যে বিচ্ছিন্নতাবাদী বা সন্ত্রাসবাদীদের গণতান্ত্রিক পথে ফেরত আনার সুযোগ করে দেওয়াটা কম কথা নয়।

সহমরণে যাওয়া আর্তনাদ চাপা দিতে প্রবলভাবে সতীর জয়গান করা হতো। হরিয়ানার জয় উদ্‌যাপনে বিপুল ঢক্কানিনাদ কাশ্মীরে বিজেপির ব্যর্থতা চাপা দেওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। দেশে তো বটেই, আন্তর্জাতিক স্তরেও নরেন্দ্র মোদির কাশ্মীর নীতি নতুন প্রশ্ন তুলবে। প্রধানমন্ত্রী নিজেকেও দাঁড় করাচ্ছেন অন্য এক পরীক্ষার মুখে। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কত দ্রুত জম্মু-কাশ্মীরকে তিনি রাজ্যের পরিচিতি ফিরিয়ে দেন, তা দেখতে উন্মুখ থাকবে সবাই। ওমর আবদুল্লাহর দশা অরবিন্দ কেজরিওয়ালের মতো হয় কি না, আপাতত সেটাই মূল আকর্ষণ।

-আলী মোর্শেদ সানী