মুসলিম পোর্ট

ডিসেম্বর ৬, ১৯৯২ইং

আজকের এই দিনে ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন স্থাপত্য ৫০০ বছরের অধিক সময়ের স্মৃতিবিজরিত মুঘল সালতানাতের স্মৃতিচিহ্ন বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলেছিলো কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা।

ভারতের উত্তর প্রদেশের ফৈজাবাদ জেলার অযোধ্যা শহর মুঘলরা বিজয় করলে সম্রাট বাবর এখানে একটি মসজিদ নির্মাণের নির্দেশ দেন। সম্রাটের নির্দেশে তার সেনাপতি মীর বাকি ১৫২৮-২৯ সালে এই মসজিদ নির্মাণ করেন। সম্রাটের নাম অনুসারে এই মসজিদের নামকরণ করা হয়, বাবরি মসজিদ। ষোড়শ শতকে মোঘল সম্রাট বাবরের সময় তৈরি করা বাবরি মসজিদ ছিলো উপমহাদেশে ইসলামী সভ্যতার অন্যতম প্রাচীন স্থাপত্য ও স্মৃতিচিহ্ন। যা বর্ণবাদী হিন্দু ও ব্রাহ্মণ্যবাদীদের শোষণ থেকে উপমহাদেশের শোষিত মানুষকে মুক্তি ও মোঘলদের বিজয়ের চিহ্ন বহন করে।

মির্জা জহিরউদ্দিন মুহাম্মদ বাবর ছিলেন মানব সভ্যতার ইতিহাসে একজন বিখ্যাত সম্রাট এবং মুঘল সালতানাতের প্রতিষ্ঠাতা।  তিনি পানিপথের প্রথম যুদ্ধে দিল্লীর লোদি রাজবংশের শেষ সুলতান ইব্রাহিম লোদিকে পরাজিত করে দিল্লি জয় করে মুঘল সালতানাত প্রতিষ্ঠা করেন। তার নির্মিত বাবরি মসজিদ মুঘল সালতানাতের স্মৃতিচিহ্ন বহন করে। যেভাবে উসমানী সুলতান মুহাম্মদ ফাতিহ ইস্তাম্বুল বিজয় করে আয়াসোফিয়া মসজিদ নির্মাণ করেন, যা তার বিজয়ের স্বাক্ষী বহন করে।

১৯ শতকে কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থাপত্য ধ্বংস করার ব্যাপারে আলোচনা শুরু করে। এর যুক্তি হিসেবে ভারতকে একটি হিন্দু রাষ্ট্র বলে অবহিত করেন এবং বলেন, এখানে মুসলমানদের কোন ইতিহাস, স্থাপত্য থাকতে পারে না। এর অংশ হিসেবে ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বপ্রাচীন ও মুঘল সালতানাতের স্মৃতিচিহ্ন বহনকারী বাবরী মসজিদ ভেঙে সেখানে একটি মন্দির প্রতিষ্ঠার কথা বলেন। এসময় তারা হিন্দু ধর্মের প্রবক্তা রামের জন্মস্থান হিসেবে বাবরি মসজিদকে উল্লেখ করেন এবং তা ভেঙে সেখানে রাম মন্দির প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে হিন্দুদের মাঝে জনমত গড়তে শুরু করেন। ১৯৪৯ সালে মসজিদের মূল গম্বুজের মধ্যে নিয়ে আসা হল রাম লালার মূর্তি। ১৯৫০ সালে রামলালার মূর্তিগুলোর পুজার অধিকারের আবেদন জানিয়ে ফৈজাবাদ জেলা আদালতে আবেদন করলেন গোপাল শিমলা বিশারদ। একই সময়ে বাবরি মসজিদে মূর্তি রেখে দেয়ার এবং পূজা চালিয়ে যাওয়ার জন্য মামলা করেন পরমহংস রামচন্দ্র দাস। এভাবেই হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা শুরু হয়। এরপর এই স্থানের অধিকার চেয়ে মামলা করেন নির্মোহী আখড়া। এসময় বাবরি মসজিদের মালিকানায় থাকা সুন্নি সেন্ট্রাল ওয়াকফ বোর্ডও মামলা দায়ের করে। ফেব্রুয়ারি ১, ১৯৮৬ সালে স্থানীয় আদালত সরকারকে নির্দেশ দেয়, হিন্দু তীর্থযাত্রীদের বাবরি মসজিদে প্রবেশাধিকার দিতে। সে সময়ে রাজীব গান্ধী ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। এরপর কট্টর হিন্দুত্ববাদী বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বিজেপি ও এর সহযোগী সংস্থার সদস্যদের দিয়ে দাঙ্গা, সভা-সমাবেশ ও তাদের অনুসারীদের উস্কে ডিসেম্বর ৬, ১৯৯২ সালে ঐতিহাসিক স্থাপত্য মুঘল সালতানাতের স্মৃতিচিহ্ন বহনকারী বাবরী মসজিদ ভেঙে ফেলে। এসময় প্রতিবাদ জানানো মুসলমানদের উপর চড়াও হয় কট্টর হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসীরা। তাদের হামলায় ২০০০ এরও অধিক মুসলমান নিহত হয়।

ইতিহাসের জঘন্যতম এই ধ্বংসযজ্ঞের প্রতিবাদ করে সমগ্র বিশ্বের সচেতন মানুষ। ভারতের মুসলমান সহ বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আরবদেশ সমূহ ও যুক্তরাজ্যে মানুষ ভয়াবহ ক্ষোভ প্রকাশ করে এবং সম্ভব সকল ধরণের প্রতিবাদ করে। এছাড়া যুক্তরাজ্যেও ভয়াবহ প্রতিবাদ করা হয়। এরপর থেকেই মুসলমান হিন্দু দাঙ্গা চরমে পৌছে যায়। যা ভারতের প্রতি আজও বাংলাদেশের মানুষের ঘৃণার অন্যতম কারণ।

১৬ ডিসেম্বর, ১৯৯২ সালে কেন্দ্রীয় সরকার মসজিদ ধ্বংসের বিষয়টি তদন্ত করার জ্ন্য অবসরপ্রাপ্ত উচ্চ আদালত বিচারক মনমোহন সিং লিবারহানের নেতৃত্বে লিবারহান কমিশন গঠন করে। ১৬ বছরে ৩৯৯ বার বৈঠকের পর ২০০৯ সালের ৩০ জুন উক্ত কমিশন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে ১,০২৯ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদন অনুসারে ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বরের ঘটনা “অপ্ররোচিত কিংবা অপরিকল্পিত” ছিল না। তারপরেও পরবর্তীতে সি বি আই এর করা মামলার ৩২ জনকেই মুক্তি দেওয়া হয়। বিশেষ সিবিআই আদালতের বিচারক রায় পড়ার শুরুতেই জানিয়ে দেন, মসজিদ ভেঙে ফেলার এই ঘটনা “পূর্ব পরিকল্পিত ছিল না।” বরং বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলার দিন বিজেপি নেতারা উন্মত্ত জনতাকে ঠেকানোর চেষ্টা করেছিলেন বলেও আদালত মন্তব্য করেছে। কিন্তু মানুষের চাপ তারা ঠেকাতে পারেনি। যা ছিলো সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন।

মসজিদের মালিকানা মামলার শুরুতে নিন্ম আদালত ২:১ হারে হিন্দু ও মুসলমানদের ভাগ করে এ স্থানের মালিকানা হস্তান্তর করার কথা বলে। এ রায়ের বিরুদ্ধে উভয়ই উচ্চ আদালতে রিট করে এবং উচ্চ আদালত বাবরি মসজিদের সম্পূর্ণ জায়গাকে রাম মন্দিরের জন্য বরাদ্দ দেন। আর মুসলমানদের জন্য আযোদ্যায় ভিতরেই অন্য কোন স্থানে মসজিদ নির্মাণের জন্য ৫ একর জমি বরাদ্দ দেন। পরবর্তীতে ৫ আগস্ট, ২০২০ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী রাম মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর প্রতিষ্ঠা করেন। এভাবেই শতাব্দীর জঘন্যতম এই ধ্বংসযজ্ঞ বাস্তবায়ন করেন। 

ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে ইসলামী সভ্যতার ইতিহাস মুছে দিতে কট্টর হিন্দুত্ববাদী বিজেপি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ সহ একাধিক দল বিভিন্ন স্থাপনা ভাঙা, মসজদ ধ্বংস ও রাস্তা সহ বিভিন্ন যায়গার নাম পরবর্তন সহ বহুমুখী কর্মসূচি পালন করে আসছে। বর্তমানে তারা ভারতের রাষ্ট্র ক্ষমতায়, সে ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করে তারা শুধু ইসলামী সভ্যতার স্থাপনা নয় একইসাথে ভারতে বসবাসকারী মুসলমানদের উপর চালাচ্ছে ধর্মীয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও কর্মসংস্থান সহ সকল ক্ষেত্রেই ভয়াবহ শোষণ। চরম দারিদ্র্যতার ফলে ভারতে বসবাসকারী মুসলমানগন আজ ভয়াবহ দুর্বিষহ জীবন-যাপন করছে।

আজ ঐতিহাসিক এই স্থাপনা বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ৩১ বছর পূর্ণ হলো।

লেখক- মু. শফিকুল ইসলাম