মুসলিম পোর্ট

ভারতের উত্তর প্রদেশের যমুনা নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠা আগ্রা শহরের আলোচনা যখন উঠবে স্বাভাবিকভাবেই চলে আসবে ভালোবাসার জন্যে এক অধিপতির অসাধারন নিদর্শনের কথা। বেগম ‘মুমতাজ মহলের’ বিদায় শোকে তার স্মৃতির প্রতি সম্মান স্বরুপ মুঘল সম্রাট শাহ জাহানের অমর সৃষ্টি আগ্রার ‘তাজ মহল’। আগ্রার তাজ মহলের অসামান্য সৌন্দর্য্যকে বিশ্লেষন করতে গেলেই উঠে আসে মুঘল সাম্রাজ্যের অসাধারন নির্মানশৈলীর ইতিহাস।তাজ মহলই শুধু নয় আগ্রা জামে মসজিদ , আকবরের সমাধি সৌধ, আগ্রা দুর্গসহ আগ্রার প্রতিটি স্থাপনা মুঘল সাম্রাজ্যের নির্মানশৈলীর মহত্ম বর্ণনা করে। এক সময়ের মুঘল সম্রাজ্যের রাজধানী আগ্রার জৌলুস ছিলো বিশ্ব সমাদৃত। ইউরোপ থেকে আসা পরিযায়ীরা অবাক হয়ে দেখেছেন শহর আগ্রার গরিমা । মুগ্ধ হয়েছেন মুঘল সম্রাজ্যের অসাধারন নির্মানশৈলী আগ্রা দুর্গের বিশালতায়, জামে মসজিদের আধ্যাত্মিকতায়, মেতেছেন শীশ মহলের মূর্ছনায়।

মুঘল সম্রাজ্যের ইতিহাসে আগ্রার অবস্থান অন্যতম এক স্থানে। মুঘল সাম্রাজ্যের বড় একটা সময় জুড়ে আগ্রা ব্যাবহৃত হয়েছে রাজধানী এবং ব্যাবসায়িক কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে। ফলে এখানে নির্মিত হয়েছে বিখ্যাত সব স্থাপনা, যার শান শৌকত আজও সৌন্দর্য্য প্রেমীদের মূল আকর্ষণের বস্তু।

ইতিহাসে আগ্রাঃ

আগ্রার প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে তেমন কোনোকিছু জানা না গেলেও এটুকু নিশ্চিত বলা যায় যে এর গোড়পত্তন হয়েছিলো ভারতে মুসলিম আগমনের বহু আগেই। গজনীর সুলতান মাহমুদের প্রশংসার্থে লিখিত কবি মাসুদ বিন সা’দ বিন সালমানের ‘কাসীদায়’ প্রথমবারের এই শহরের নাম দেখা যায় ।

 দিল্লী সালতানের সময়ে এই শহর রাজপুতানাদের শাসনে ছিলো । পরবর্তীতে সিকান্দার লোদী এই শহরকে পুন;নির্মান করেন ( ১৫০৫ খ্রি ) এবং নিজের রাজ্যসভা এখানে প্রতি:স্থাপন করেন এবং আগ্রা মুসলিম বিশ্বে খুব তারাতারিই একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে নেয় । আগ্রা থেকে দক্ষিণে গোয়ালিয়র এবং মালওয়া, পশ্চীমে রাজপুতানা, উত্তর-পশ্চীমে পাঞ্জাব , এবং পূর্বে গঙ্গার সমতল ভূমিতে রাজ্য পরিচালনার কাজ সহজ হওয়ায় এর রাজনৈতিক এবং ব্যবসায়িক কৌশলগত গুরুত্ব ছিল অনেক ।

ইব্রাহিম লোদীর পরে সম্রাট বাবরও তার রাজধানী আগ্রায় স্থাপন করেন এবং সেখানে  বিখ্যাত চার বাগ প্রাসাদ সহ বহু স্থাপনা গড়ে তোলেন। তার পরবর্তী হুমায়ুন এবং শের শাহও আগ্রাকে তাদের রাজধানী নির্ধারন করেছিলেন । নিজের রাজ্যসভা লাহোরে স্থাপন করলেও মসনদে আকবর এই আগ্রাতেই বসেন। লাহোরের পাশাপাশি জীবনের বড় একটি অংশ তিনি আগ্রাতেই কাটান। আকবরের পরে সম্রাট জাহাঙ্গীরও গদিতে আসিন হন এই আগ্রাতেই । তিনি কাশ্মীর এবং লাহোরের পাশাপাশি এই শহরেই জীবনের বড় একটি  সময় অতিবাহিত করেন। সম্রাট শাহ জাহানও আগ্রাতেই সালতানাতের গদিতে আসিন হোন তবে তিনি এখানে স্থায়ীভাবে অবস্থান করেননি ।  তিনি দিল্লিতে শাহজানাবাদ নামে নতুন শহর স্থাপন করেন তবে শেষ বয়সে তিনি আবার এই আগ্রাতেই ফিরে আসেন। শাহজাহানের পরবর্তীতে আওরঙ্গজেব নিজের শাসন পুরোপুরি দিল্লি কেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠা করেন ।এরপর থেকেই মুঘল সম্রাজ্যে আগ্রার গুরুত্ব কমতে থাকে।

সেই সময়ে ভারত সফরে আসা ইউরোপিয়ানদের অধিকাংশই অকপটে স্বীকার করেছেন প্যারিস, লন্ডন এবং কন্সট্যান্টিনোপলের পর আগ্রার মতো বড় শহর তারা দেখেনি। সে সময়ে আগ্রা হয়ে উঠেছিলো ভারতবর্ষে বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু।

বিখ্যাত স্থাপনাঃ

 আগ্রা দুর্গঃ

আগ্ৰা দুর্গ বা আগ্ৰার লালকেল্লা, ভারতীয় উপমহাদেশে মোঘল স্থাপত্যের এক অনবদ্য নিদৰ্শন। দুৰ্গটি ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের আগ্রায় যমুনা নদীর তীরে অবস্থিত। ষোড়শ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর প্ৰথমাৰ্ধের মধ্যবৰ্তী সময়ে মুহাম্মদ কাসেম খান মীর-ই বাহারের তত্ত্বাবধানে মোঘল সম্রাট আকবরের শাসনামলে এই দুর্গ নির্মিত হয়। পরবর্তীতে সম্রাট জাহাঙ্গীর এবং শাহজাহানের শাসনামলে  দুৰ্গের বহু নতুন স্থাপনা নিৰ্মিত হয়েছিল।

রাঙা বেলেপাথরের তৈরি আগ্রা দুৰ্গের প্রাঙ্গণের আয়তন ২.৫ কি.মি.। দুৰ্গটির অভ্যন্তরে বহু প্ৰাসাদ, মিনার এবং মসজিদ রয়েছে। দুৰ্গ-অভ্যন্তরে উল্লেখযোগ্য স্থাপনা সমূহ – খাস মহল, শীশ মহল, মুহাম্মান বুৰ্জ (এটি অষ্টভূজাকৃতির মিনার), দেওয়ান-ই-খাস (১৬৩৭), দেওয়ান-ই-আম, মোতি মসজিদ (নিৰ্মাণকাল ১৬৪৬-৫৩) এবং নাগিনা মসজিদ (১৬৫৮-১৭০৭)। এই স্থাপনাসমূহে ‘তিমুরিদ পারসিক’ শিল্পকলা এবং ‘ভারতীয় শিল্পকলা’র এক আশ্চৰ্য মিশ্ৰণ পরিলক্ষিত হয়। কেল্লাটি ১৯৮২ সালে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসাবে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের অন্তৰ্ভুক্ত হয়।

আগ্রা জামে মসজিদঃ

আগ্রা জামে মসজিদ, লাল ইট দিয়ে নির্মিত তিনটি বিশাল আকারের গম্বুজ বিশিষ্ট জামে মসজিদ আগ্রায় মোঘল সাম্রাজ্যের আরেকটি গুরুত্বপুর্ন স্থাপনা। সপ্তদশ শতকে সম্রাট শাহ জাহানের জ্যেষ্ঠ কন্যা জাহান আরা বেগম এই মসজিদ নির্মান করেন। সম্রাট শাহ জাহানের সময়ে মসজিদ ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় মসজিদগুলোর একটি ছিলো আগ্রা জামে ।   

সম্রাট আকবরের মাজারঃ

আকবরের সমাধিসৌধ মুঘল স্থাপত্যের আরেকটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। আসাধারন নির্মানশৈলীর এই সৌধটি ভারতের উত্তর প্রদেশের আগ্রার শহরতলী সিকান্দ্রাতে ৪৮ হেক্টর (১১৯ একর) জমির নির্মিত। ১৬০৫ সালে সমাধিসৌধটির নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং ১৬১৩ সালে নির্মাণ সম্পন্ন হয়।

তাজমহলঃ

আগ্রার যমুনা নদীর তীরে নির্মিত তাজমহলকে মনে করা হয় মুঘল স্থাপত্যশৈলীর অন্যতম আকর্ষণীয় নিদর্শন হিসেবে, যার নির্মাণশৈলীতে সম্মিলন ঘটানো হয়েছে পারস্য, তুরস্ক, ভারতীয় এবং ইসলামী স্থাপত্যশিল্পের। মুঘল সম্রাট শাহজাহান আপন স্ত্রী আরজুমান্দ বানু বেগমের (মুমতাজ মহল নামে পরিচিত) স্মৃতির স্মরণে এই অপূর্ব সৌধটি নির্মাণ করেন ।

 ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দে নির্মান কাজ শুরু হয়ে ১৬৫৩ সালে কাজ শেষ হওয়া তাজমহল বিশ্বের অপূর্ব সুন্দর স্মৃতিসৌধ ও মনোমুগ্ধকর নিদর্শন। ভালোবাসার জন্যে নির্মিত অবিশ্বাস্য স্মরণীয় স্থাপনা এই তাজ।

 ইসলামিক স্থাপত্যের অপূর্ব নিদর্শন যা শান্তি ও সৌন্দর্যের প্রতীক। তাজমহল তৈরি হয়েছে বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী নকশার উপর, বিশেষ করে পারস্য ও মুঘল স্থাপত্য অনুসারে।

সম্রাট শাহ জাহানের সময়ে মুঘল স্থাপনা পরিমার্জনের এক নতুন স্তরে পৌঁছায়।যেখানে পূর্ববর্তী মুঘল স্থাপনাসমূহ তৈরি হয়েছিল লাল বেলে পাথরে, শাহজাহান চালু করেছিলেন সাদা দামি মার্বেল পাথরের প্রচলন ।

তাজমহল তৈরি করা হয়েছে বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার নকশার উপর, বিশেষ করে পারস্য ও মুঘল স্থাপত্য অনুসারে। নির্দিষ্ট কিছু নকশাতে তিমুর ও মুঘল স্থাপনাকে হুবহু অনুসরণ করা হয়েছে। যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য,  তিমুরের গুর-ই-আমির, সমরখন্দে মুঘল সাম্রাজ্যের পূর্বসূরি, হুমায়ূনের মাজার, ইমাদ-উদ-দৌলার মাজার, এবং দিল্লীতে শাহজাহানের নিজের তৈরি দিল্লী জামে মসজিদ।

ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রসারিত মুঘল সাম্রাজ্য এক অসাধারন স্থাপত্যশৈলীর প্রবর্তন করে। ইসলামি, পারস্য ও ভারতীয় স্থাপত্যের এক অসাধারন সংমিশ্রণে নির্মিত এসব স্থাপনা এখনো বিশ্ববাসীকে চমকপ্রদ করে থাকে। অধিকাংশ স্থাপনাই এখন বিশ্ব হেরিটেজের অন্তর্ভূক্ত। 

লেখক- মু. জুবায়ের আলম