মুসলমানদের কার্পেট শিল্প একটি সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের অংশ, যা কয়েক শতাব্দী ধরে বিকশিত হয়ে আসছে। প্রাচীন কাল থেকে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রসিদ্ধ এই শিল্প শুধু শৈল্পিক সৌন্দর্যেই সমৃদ্ধ নয়, বরং এটি প্রতিটি অঞ্চলের সংস্কৃতি ও ইতিহাসের প্রতিফলনও বহন করে। মসজিদ, বাড়িঘর এবং অন্যান্য স্থাপনায় সজ্জা ও প্রার্থনার জন্য এই কার্পেট ব্যবহৃত হয়। ইসলামী শিল্পের জটিল নকশা ও কারুকার্যের মাধ্যমে এগুলো তৈরি করা হয়।
☆ ইতিহাস
মধ্যপ্রাচ্যে সপ্তম শতাব্দীতে মুসলমানদের কার্পেট তৈরির সূচনা হয়। প্রাথমিক নকশা ছিল সরল, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে আরও জটিল ও সুন্দর হয়ে উঠে এই শিল্প। দশম ও একাদশ শতাব্দীতে মুসলিম কার্পেট তৈরি শিল্পের চরম উৎকর্ষে পৌঁছায়। পারস্য, তুর্কি ও মিশর ছিল তখনকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। উল, রেশম ও সোনার সুতো দিয়ে তৈরি জটিল জ্যামিতিক ও ফুলের নকশা ছিল এই কার্পেটের বৈশিষ্ট্য।
মুসলমানদের তৈরি এই কার্পেটগুলো ইউরোপেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং রাজা ও উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের কাছে সম্পদ ও স্থানের প্রতীক হিসেবে সংগ্রহ করা হত। আজও এই ঐতিহ্য টিকে আছে এবং বিশ্বজুড়ে অনেক দেশেই মুসলিম কার্পেট তৈরি করা হয়।
☆ নকশা
ইসলামী শিল্পের জটিল নকশা ও কারুকার্য মুসলিম কার্পেটের বৈশিষ্ট্য। জ্যামিতিক, ফুলের ও আরবি ক্যালিগ্রাফির সমন্বয়ে তৈরি হয় এই নকশা। প্রাণী ও মানুষের চিত্রও ব্যবহৃত হয়, তবে তা প্রায়শই স্টাইলাইজড বা বিমূর্ত। কার্পেটের উল্লেখযোগ্য কিছু নকশা হচ্ছে –
⇨ আরাবেসক: জ্যামিতিক নকশার জটিল মিশ্রণ, প্রায়শই ফুলের উপাদান দিয়ে সজ্জিত।
⇨ ইসলিমি: জ্যামিতিক নকশার ধরণ, তারার নকশা ও আন্তঃসেক্টেড বহুভুজ ব্যবহার করে।
⇨ ক্যালিগ্রাফিক: আরবি লিপির নকশা, কোরআনের আয়াত লেখার জন্য ব্যবহৃত।
⇨ জীবন্ত: প্রাণী ও মানুষের বাস্তবসম্মত চিত্রণ।
☆ অঞ্চলভেদে কার্পেটের বৈচিত্র
⇨ পারস্য কার্পেট
পারস্য বা ইরানের কার্পেট শিল্প গোটা বিশ্বে মাঝে বিখ্যাত। প্রাচীন যুগে পারস্য সাম্রাজ্যের কার্পেট শিল্পের উৎপত্তি। ১৫০১ থেকে ১৭৩৬ সাল পর্যন্ত সাফাভি শাসনামলে এই শিল্পের চরম উন্নতি ঘটে। পারস্য কার্পেটের নকশায় জ্যামিতিক, ফুল ও উদ্ভিদের চিত্র দেখা যায়।
⇨ তুর্কি কার্পেট
তুরস্কের কার্পেট শিল্পও বিখ্যাত। বিশেষ করে আনাতোলিয়ান কার্পেট। এই কার্পেটগুলোতে প্রধানত উজ্জ্বল রং এবং জ্যামিতিক নকশা ব্যবহৃত হয়। তুর্কি কার্পেটের ইতিহাস প্রায় হাজার বছরের পুরোনো, এবং এই শিল্পে মুসলিম তুর্কিদের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
⇨ আফগান কার্পেট
আফগানিস্তানের কার্পেট শিল্প তাদের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ। আফগান কার্পেটগুলো সাধারণত উল দিয়ে তৈরি এবং তাদের নকশা ও রঙের বৈচিত্র্য অনেক। আফগানিস্তানের বিভিন্ন জাতিগত গোষ্ঠী যেমন তাজিক, হাজারা এবং উজবেকদের মধ্যে এই কার্পেট শিল্পের বিভিন্ন ধরণ প্রচলিত।
⇨ মরক্কান কার্পেট
মরক্কান কার্পেট শিল্পের এক বিশেষ ধরণ হলো বারবার কার্পেট। এই কার্পেটগুলো সাধারণত হাত দ্বারা বোনা হয় এবং তাদের নির্দিষ্ট নকশা এবং প্যাটার্ন রয়েছে, যা প্রাচীন বারবার গোষ্ঠীর সংস্কৃতির অংশ।
⇨ ভারতীয় কার্পেট
ভারতীয় কার্পেট শিল্প মূলত মোঘল সাম্রাজ্যের সময় বিকশিত হয়। আকবরের শাসনামলে কার্পেট শিল্পে বড় উন্নতি ঘটে। ভারতীয় কার্পেটগুলিতে ফুলের নকশা, মেহরাব, এবং ইসলামিক নকশার প্রভাব লক্ষণীয়। বিশেষ করে কাশ্মীরী কার্পেট তার সূক্ষ্ম কাজের জন্য বিখ্যাত।
⇨ মধ্য এশিয়ার কার্পেট
উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, এবং কিরগিজস্তানের কার্পেট শিল্পের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তুর্কমেনিস্তানের কার্পেটের মধ্যে বুকারা কার্পেট বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই কার্পেটগুলোতে প্রায়শই লাল রং এবং জ্যামিতিক নকশার ব্যবহার দেখা যায়।
☆ তাৎপর্য
মুসলিমদের কার্পেট শিল্প শুধুমাত্র একটি শিল্পই নয়, এটি তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, ধর্মীয় প্রভাব এবং দৈনন্দিন জীবনের প্রতিচ্ছবি। এই শিল্পের মধ্য দিয়ে মুসলিম বিশ্বের সমৃদ্ধ ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং শৈল্পিক উৎকর্ষতা প্রতিফলিত হয়।
ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক দিক থেকেও মুসলিম কার্পেট গুরুত্বপূর্ণ। মসজিদে প্রার্থনার সময় মুসলমানরা এগুলো ব্যবহার করে। বাড়িতেও এগুলো সজ্জার জন্য ব্যবহৃত হয় এবং ঐতিহ্য ও পরিচয়ের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। মুসলিম কার্পেট শিল্প দক্ষতা ও সৃজনশীলতারও প্রতীক। কার্পেট তৈরির জটিল প্রক্রিয়া প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বিকশিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
সংকলক : হাসিবুল হোসেন শান্ত