ভূমিকা
রুশ ফেডারেশনের অন্তর্গত উত্তর ককেশাসের একটি মুসলিম স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল চেচনিয়া। এটি আজারবাইজান, জর্জিয়া এবং রাশিয়ার সীমান্তে অবস্থিত একটি প্রজাতন্ত্র। চেচনিয়া বা চেচেন রিপাবলিকের আয়তন ১৭ হাজার ৩০০ বর্গকিলোমিটার। রাশিয়ার আক্রমণ ও চেচেন স্বাধীনতাকামীদের লড়াইয়ের কারণে এখানকার জনসংখ্যা হ্রাস বৃদ্ধি ঘটে থাকে। তবে ২০১০ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী এখানকার জনসংখ্যা ১২ লক্ষ ৬৮ হাজার ৯৮৯ জন হলেও বর্তমানে জনসংখ্যা প্রায় ১৩ লক্ষ ৪৬ হাজার ৫০০ জন। দেশটির রাজধানী গ্রজনি।
১৯৯২ সালের পূর্বে চেচনিয়া ও ইঙ্গুশেটিয়ার সমন্বয়ে চেচনিয়া-ইঙ্গুশেটিয়া প্রজাতন্ত্র গঠিত ছিল। এ অঞ্চলটি পার্বত্য, তৈল, প্রাকৃতিক গ্যাস, চুনাপাথর, জিপসাম প্রভৃতি সম্পদে সমৃদ্ধ। বিশেষত এর দক্ষিণাঞ্চল পর্বত ও গহিন অরণ্যে আবৃত। এ অঞ্চলের জনগণের বিরোধ ও রক্তপাতের ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন এবং জাতিগত জটিলতা ব্যাপক। এখানে প্রায় ৬০টি স্বতন্ত্র জাতিগোষ্ঠীর লোকের বসবাস এবং ৫০টি ভাষা প্রচলিত। এ জাতিগোষ্ঠীগুলোর অধিকাংশই ক্ষুদ্র। তবে ককেশাস পর্বতমালা বহিঃশত্রুর হাত থেকে তাদের রক্ষা করেছে। শুধু তাই নয় এ পর্বতমালা তাদের বাইরের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতেও সাহায্য করেছে। তাই এদের অনেকেই তাদের ভাষা ও ঐতিহ্যবাহী রীতি সংরক্ষণে সক্ষম হয়েছে। ইসলাম গ্রহণের আগে চেচেনরা ধর্মীয় ও ঐতিহ্যগত কিছু আচার অনুষ্ঠানে বিশ্বাসী ছিল। এর মধ্যে ছিল একটি মৌসুমে কৃষিকাজ শুরুর দিনে বৃষ্টির অনুষ্ঠান। তবে এর লিখিত দলিল অত্যন্ত সীমিত। লোকমুখে প্রচলিত ছড়া ও গল্পের মাধ্যমে চেচেনরা তাদের ইতিহাস স্মরণে রেখেছে।
সাধারণত চেচনিয়ায় বসবাসরত জনগোষ্ঠীকে চেচেন নামে আখ্যায়িত করা হয়। কাস্পিয়ান সাগর হতে বলকান সাগর পর্যন্ত প্রায় তিনশো মাইল রেখা জুড়ে চেচেন মুসলমানদের বসবাস। সেসাথে রাশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলে অর্থাৎ দাগেস্তান, ইঙ্গুশেটিয়া এবং মস্কো অঞ্চলেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক চেচেন বসবাস করে। রাশিয়ার বাইরে কাজাখাস্তান, তুরস্ক, আজারবাইজান, মধ্যপ্রাচ্যের জর্ডান, ইরাক প্রভৃতি অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অভিবাসী চেচেনের বসবাস রয়েছে। জর্ডান ও ইরাকে বসবাসকারী চেচেনদের ১৮৫০ সালে ককেশিয়ান যুদ্ধে রুশ সামাজ্য কর্তৃক চেচনিয়া দখলের পর জর্ডান ও ইরাকে চলে যাওয়া চেচেনদের বংশধর মনে করা হয়। কাজাখাস্তানের চেচেনরা ১৯৪৪ সালে স্টালিনের শাসনামলে নির্বাসিত হয়েছিলেন। সাম্প্রতিককালে চেচেন যুদ্ধের পর হাজার হাজার চেচেন শরণার্থী ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও অন্যান্য স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। সুতরাং চেচেনরা এখন বিশ্বজুড়েই ছড়িয়ে পড়েছে। এ ছড়িয়ে পড়াটা সুখের নয়, নিজেদের বসতভিটে থেকে বিতাড়িত হয়ে শরণার্থী জীবন নিয়েই কোনোমতে বেঁচে থাকার তাগিদে ছড়িয়ে পড়েছে তারা। উল্লেখ্য, চেচেন জনগোষ্ঠী নিজেদের ভাইনাক (Vainakh) নামে অভিহিত করে চেচেন ভাষায় এ শব্দের অর্থ ‘আমাদের লোক’। অর্থাৎ তারা নিজেদেরকে একগোত্র ভাবতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করে। কিন্তু দুর্ভাগ্য তাদেরকে এ ঐক্যের অবস্থান থেকে বিচ্ছিন্ন করে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে দিয়েছে।
প্রাগৈতিহাসিককাল হতে উত্তর ককেশাসের উঁচু অঞ্চলগুলোতে চেচেনরা বসবাস করে আসছে। মধ্যযুগে চেচনিয়ার নিচু জমিতে ‘খাজার’ এবং পরবর্তী সময়ে ‘এলানদের’ বসবাস ছিল। স্থানীয় সংস্কৃতিতে বাইজান্টাইন ও জর্জিয়ান সংস্কৃতির প্রভাব ছিল। জর্জিয়ার প্রভাবে দশ শতকে কিছু সংখ্যক চেচেন পূর্বাঞ্চলীয় সনাতন খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত হয়েছিল। যদিও উনিশ শতক পর্যন্ত চেচেনদের নিজ ‘পাগান’ ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা কম ছিল না। বর্তমানে চেচনিয়ায় খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ অব্দের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। এ নিদর্শনগুলোর মধ্যে ছিল পোড়ামাটির পাত্র, পাথরের তৈরি তৈজসপত্র, অলংকার ইত্যাদি। এ ধরনের পুরানো নিদর্শন থেকে তাদের প্রাচীন ইতিহাসের তথ্য-উপাত্ত বেরিয়ে এসেছে।
চেচেন জনগোষ্ঠীর ভাষা
চেচেন জনগোষ্ঠীর প্রধান ভাষা চেচেন। ভাষাটি নাখ অর্থাৎ উত্তর-পূর্ব ককেশিয়ান ভাষা পরিবারের অংশ। চেচেন ভাষা নিম্নভূমির মধ্যাঞ্চলে প্রচলিত ডায়ালিক্টের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ভাষার মধ্যে ইঙ্গুস অন্যতম। প্রতিবেশী ইঙ্গুশেটিয়ায় ইঙ্গুশ ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী আছে। সন্নিহিত জর্জিয়ার জনগণ বাতশি ভাষাভাষী। বিভিন্ন সময় চেচেনরা জর্জিয়ার আরবি এবং ল্যাটিন অক্ষর ব্যবহার করেছে। ১৯০৮ সালে রাশিয়ার সিরিলিক স্ক্রিস্ট সরকারিভাবে বর্ণমালা ছিল। চেচেন অঞ্চলে বসবাসকারী জনগণ সহজেই ইঙ্গুশ ভাষা রপ্ত করতে পারে। ১৮৮৯ সালে ৭৩.৪ শতাংশ জনগণ রুশ ভাষায় কথা বলত। যুদ্ধবিগ্রহ সংক্রান্ত অস্থিরতা, উপযুক্ত শিক্ষার অভাব, ভাষা শিক্ষায় অনীহা, যুদ্ধের কারণে দেশান্তরী হয়ে ভাসমান জনগোষ্ঠীতে পরিণত হওয়াসহ নানাবিধ কারণে রুশ ভাষাভাষী জনগণের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক কারণে তুর্কি ভাষার প্রতি চেচেনদের আগ্রহ আছে। ডায়াসপোরা চেচেনরা যে অঞ্চলে বাস করে সেই অঞ্চলের ভাষায় কথা বলেন।
চেচেন জনগোষ্ঠীর ধর্মবিশ্বাস
চেচনিয়ার জনগণ মূলত ইসলাম ধর্মাবলম্বী। অধিকাংশ চেচেন হানাফি মাজহাবে বিশ্বাসী সুন্নি মুসলমান। কেউ কেউ সুফি ঐতিহ্যে মুরিদ হওয়ায় বিশ্বাস করেন। উত্তর ককেশাস অঞ্চলে দুটি সুফি মতবাদ ব্যাপক প্রসার লাভ করেছিল। এর একটি হলো- নকশবন্দিয়া এবং অপরটি হলো- কাদেরিয়া। নকশাবন্দিয়া- দাগেস্তান ও পূর্বচেচনিয়ায় শক্তিশালী, অপরদিকে কাদেরিয়া মতবাদে বিশ্বাসীরা অবশিষ্ট চেচনিয়া এবং ইঙ্গুশেটিয়ায় বসবাস করে।
সোভিয়েত শাসনামলে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানসহ প্রকাশ্যে নামাজ আদায়ে নিষেধাজ্ঞা ছিল। তা সত্ত্বেও সোভিয়েত শক্তি চেচেনদের তাদের ধর্মবিশ্বাস থেকে সরাতে পারেনি। ১৯৮০ এর দশকে প্রকাশ্যে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালনে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা হয়েছে। এসময় উত্তর ককেশাসে ইসলামের দুটি ধারা আত্মপ্রকাশ করেছে। একটি সনাতনী বিশ্বাস অপরটি তরিকায়ে মুহাম্মাদীয়। এ মতবাদ প্রধানত দাগেস্তান এবং সাধারণভাবে চেচনিয়া ও উত্তর ককেশাসের অন্যান্য অঞ্চলে কিছুটা জনপ্রিয়তা অর্জন করে। বিশেষত সোভিয়েত অর্থনৈতিক অবস্থা ভেঙে যাবার পর চেচনিয়ার পাহাড়ি অঞ্চলের বসবাসরত দরিদ্র চেনেদের মধ্যে এ জনপ্রিয়তা লক্ষ করা যায়। বর্তমানে মুহাম্মদী মতাবলম্বীরা বিচ্ছিন্ন সম্প্রদায় হিসেবে বসবাস করছে। এ মতাবলম্বীরা ‘সালাফি’ নামে অভিহিত। তারা ইসলামের প্রাচীন মূল্যবোধ পুনঃপ্রতিষ্ঠায় আগ্রহী। অপরদিকে মস্কো সমর্থন পুষ্ট একনায়কবাদী শাসক রমজান কাদরি সনাতন ইসলাম নামে এক ইসলামের পৃষ্ঠপোষক। তিনি রাশিয়ার আইনকানুনের পরিবর্তে শরিয়াহ আইন প্রবর্তন করেছেন।
চেচনিয়ায় ইসলামের প্রচার ও প্রসার
আরবীয়রা বাণিজ্যপ্রবণ জাতি। সেই সূত্রে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে শুরু করে স্থল ও জলপথে দূররাজ্যেও বাণিজ্য ব্যাপদেশে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। ‘ইসলাম প্রচার ও বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড’ এ দুটিকেই গুরুত্ব দিয়ে তারা
ছড়িয়ে পড়েছে দূর দেশে। এভাবে চেচনিয়া অঞ্চলেও ইসলামের সুমহান বাণী সম্প্রসারিত হয়েছে। চেচনিয়ায় ইসলাম প্রতিষ্ঠার ইতিহাসকে কয়েকটি পর্যায়ে আলোচনা করা যেতে পারে। প্রথমত, ৬৪৩ সালে দাগেস্তান প্রজাতন্ত্রের ডারবেন্টে আরবদের আগমন ঘটে।
অচিরেই সমাজের বিভিন্ন স্তরে ইসলামের প্রচার ও প্রসার ঘটে এবং উন্নত সামাজিক আদর্শ হিসেবে ইসলামের উদারতা প্রসারিত হতে থাকে। আট শতকের মধ্যে ইসলাম ডারবেন্টের একটি প্রভাবশালী জীবনদর্শনে পরিণত হয়। ডারবেন্ট একটি শক্তিশালী দুর্গ, বিকাশমান ব্যবসায়কেন্দ্র এবং খিলাফতের সম্পদশালী শহরগুলোর একটি হিসেবে
দ্বিতীয়ত, এগারো শতকে ককেশাসের ইসলামীকরণের এক নতুন পর্যায় শুরু হয়। এগারো শতকের পূর্ববর্তী সময়ে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী শাসকগণ ‘ক্লান’-এর মাধ্যমে শাসন পরিচালনা করতেন এবং প্রজাদের উপর শাসকদের ধর্মের উপর কোনো প্রভাব ছিল না। ‘ক্লান’গুলো সামন্তপ্রভুদের সামন্তবাদী ব্যবস্থাপনায় এলে সামন্তপ্রভুদের ধর্ম করদ রাজ্যগুলোর প্রজাদের উপর শক্তিশালী প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। মোঙ্গলদের আক্রমণ, ‘খান’দের শাসন এবং গোত্রের প্রভাবের মাধ্যমে ককেশাসে ইসলাম শক্ত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়।
তৃতীয়ত, চৌদ্দ ও পনেরো শতকে তৈমুর লং-এর শাসনামলে ইসলামের ব্যাপক প্রসার ঘটে। তৈমুর লং তার শাসনের পূর্বে বিরাজমান ধর্মগুলোর পরিবর্তে ইসলাম প্রচারে সচেষ্ট হন। ইসলামের প্রচার-প্রসারে ধর্মবেত্তাগণ ব্যাপক সুযোগ সুবিধা লাভ করেন। ইসলাম চর্চার জন্য যেমন মসজিদ প্রতিষ্ঠা শুরু হয় তেমনি ইসলামি শিক্ষাকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ইসলামি শিক্ষাকেন্দ্রও প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। রাজধানী শহর কাজি কুমুখ ইসলামের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়।
চতুর্থত, ত্রয়োদশ ও চর্তুদশ শতাব্দীতে মোঙ্গল এবং তাদের তুর্কি করদরাজ্যগুলো বর্তমান চেচেনিয়া অঞ্চলে দুটি ব্যাপক আক্রমণ পরিচালনা করে। এতে ব্যাপক ধ্বংস ও প্রাণহানি ঘটে। চেচেনদের পূর্ব পুরুষগণ একাধিকবার মোঙ্গল হামলা সফলভাবে প্রতিরোধ করার জন্য কৃতিত্বের অধিকারী। মোঙ্গলদের হামলা চেচনিয়ার ইতিহাস ও এর জনগণের জীবনে সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর একটি। যে কোনো মূল্যে মোঙ্গলদের প্রতিরোধ করে স্বকীয়তা বজায় রাখার দৃঢ় ইচ্ছার জন্য চেচনিয়ার সাধারণ মানুষকে সীমাহীন দুর্ভোগের সম্মুখীন হতে হয়েছে। বীরত্বপূর্ণ এ প্রতিরোধের অনেক কাহিনী আজও প্রচলিত আছে।
এ অঞ্চলে খ্রিষ্টধর্ম জর্জিয়ার সাথে সম্পর্কের উপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল ছিল। মোঙ্গল আক্রমণের ফলে খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীদের অভয়াশ্রম এবং পাদ্রিদের পতনের পর খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত চেচেনরা মানসিক শান্তি লাভের আশায় পাগান ধর্মে পুনঃপ্রত্যাবর্তন করে। এ সময় বিপুলসংখ্যক ঐতিহাসিক দলিল ধ্বংস করা হয়। আক্রমণের কয়েক বছরের মধ্যেই জর্জুকেতিয়া বিলুপ্ত হয়ে যায়। তবে প্রতিরোধ সৃষ্টিকারী জনগণ রয়ে যান। তদুপরি মোঙ্গলরা সানঝা নদীর উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হন। চেচেন জনগোষ্ঠী তাদের কৃষিকাজের জন্য এ নদীর পানির উপর নির্ভরশীল ছিল। ফলে বিদ্যমান সামান্ততান্ত্রিক অবস্থা ভেঙে পড়ে।
যুদ্ধের ফলে ভাইনাকদের রাজ্য, তাদের জীবনধারা, ধর্ম এবং ইতিহাসের দলিলের বড় অংশ ধ্বংস হয়ে যায়। জনগোষ্ঠী প্রতিরোধের বিভিন্ন উপায় উদ্ভাবন করেন এবং তাদের জীবনধারা পরিবর্তিত হয়। গোত্রগুলো যুদ্ধকালীন সংগঠনে পরিণত হয়। পার্বত্য অঞ্চল এবং বনাঞ্চলে যুদ্ধের গেরিলা কৌশল পরিপূর্ণতা অর্জন করে। এ সময়ই সামরিক প্রতিরোধ টাওয়ার নির্মিত হয় যা এখন ভাইনাক জনগণের প্রতীকে পরিণত হয়েছে। যুদ্ধে পুরুষ মহিলা ও শিশুদের অংশগ্রহণ, সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা অবসান, ধনী ও দরিদ্রদের সহায়তায় এগিয়ে আসা প্রভৃতি ভাইনাকদের মধ্যে সমতা ও ভ্রাতৃত্বের মনোভাব গড়ে তোলে। এ মনোভাবই মোঙ্গল আক্রমণ পরবর্তী শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
উচ্চভূমি রক্ষায় সফলতার পর ভাইনাকরা মোঙ্গল নিয়ন্ত্রিত নিচু অঞ্চলগুলোতে হামলা চালায়। তারা নিচু ভূমির অনেকখানি পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হলেও দ্বিতীয় মোঙ্গল আক্রমণের সময় তা হাতছাড়া হয়। ভাইনাকরা সানঝা নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে তাদের দখল বজায় রাখতে সক্ষম হন। পনেরো শতকের শুরুতে দ্বিতীয় মোঙ্গল আক্রমণ শেষ হবার পর ভাইনাকরা সমতল ভূমিতে ফিরতে শুরু করে। আঠারো শতকে তাদের এ প্রত্যাবর্তন সম্পন্ন হয়।
পঞ্চমত, ১৫৯৪ সালে রুশ সেনাবাহিনী অটোমান, তাতার এবং দাগেস্তানিদের সম্মিলিত বাহিনীর কাছে উত্তর দাগেস্তানের মুলুক নদীর যুদ্ধে পরাজিত হয়। এর প্রভাব চেচনিয়াতেও পড়ে। ফলে মুসলমানদের প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়তে থাকে। এমনকি চেচনিয়ার সমাজ-সংস্কৃতিও মুসলিম প্রভাবাধীন হয়ে পড়ে।
ষষ্ঠত, পনেরো শতকের শেষভাগে এবং ষোলো শতকের শুরুতে ককেশাসের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য অটোমান এবং সাফাভি সাম্রাজ্যের মধ্যে বিরোধ শুরু হয়। ককেশিয়ার জনগণ উভয়পক্ষের উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে একটিকে অপরটির বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার প্রচেষ্টা নেয়। শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব এবং সাম্রাজ্য দুটির মধ্যে আঞ্চলিক বিরোধ এ উভয় কারণেই এ বিরোধ সৃষ্টি হয়। এ বিরোধের ফলশ্রুতিতে পারসিয়ানরা আজারবাইজানিদের শিয়া মতবাদে দীক্ষিত করতে সক্ষম হয়। শুরুতে রাশিয়ার সাথে মিত্রতা অটোমান এবং সাফাভি সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার অস্ত্র হিসেবে বিবেচিত হতো এবং চেচেন রাজনীতিতে রাশিয়ামুখী একটি ধারা তৈরি হয়। এসময় অটোমানমুখী ও পারসিয়ামুখী ধারার কার্যকর ছিল। এ তিনমুখী ধারার অনুসারীরা নিজে যার অনুসারী তাকে সবচেয়ে কম ক্ষতিকর মনে করতো। বস্তুতপক্ষে শুরু থেকেই অটোমান সাম্রাজ্যের প্রতি চেচেনদের দুর্বলতা ছিল। অটোমানরা তাদের পদানত করতে পারে এ আশঙ্কাও তাদের ছিল।
সপ্তমত, দাস্তেগান ইতোমধ্যে ইসলামের বিকশিত অঞ্চলে পরিণত হয়। ষোলো শতকের মধ্যভাগে সুন্নি ধারার মুসলমানরা দাগেস্তানে প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। অন্যদিকে পশ্চিম ককেশাসেও সুন্নিধারার হানাফি মতাবলম্বীরা শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে। এ সময় ইসলাম প্রচার ও প্রসারের একটি অবারিত সুযোগ তৈরি হয়। কিন্তু রাশিয়ার আক্রমণের মুখে ইসলাম ও খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে বিরাজমান শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ভেঙে পড়ে।
অষ্টমত, ককেশাস অঞ্চলের উপর তিনটি সাম্রাজ্য-অটোমান, রুশ ও পারসিয়ানদেরও নজর ছিল। ষোলো শতকে রুশরা দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হলে চেচেনও রুশদের মধ্যে সংঘর্ষের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। উনিশ শতকের শুরুতে ককেশিয়া অঞ্চলে তাদের নতুন ভূখণ্ডে যাতায়াতের পথ সুরক্ষিত রাখার উদ্দেশ্যে রাশিয়া উত্তর ককেশাস বিজয়ে মনোনিবেশ করে। অধিকাংশ রুশ অভিযানের নেতৃত্ব দেন জেনারেল ইয়ারমলো। তিনি চেনেদের অপছন্দ করতেন এবং তাদের উদ্ধত ও বিপজ্জনক জনগোষ্ঠী হিসেবে বর্ণনা করেছেন। চেচেনদের হামলায় ক্রুদ্ধ হয়ে ইয়েরমলো নিষ্ঠুর পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করেন। রুশরা চেচেনদের পাহাড়ি অঞ্চলে বিতাড়নের কৌশল অবলম্বন করে। এতে চেচেনরা নিম্নভূমিতে অবস্থিত তাদের খাদ্যভাণ্ডার হারিয়ে হয় আত্মসমর্পণ করবে অথবা উপবাসে মৃত্যুবরণ করবে মনে করেই চেচেনদের নিম্নভূমি হতে পাহাড়ি অঞ্চলে বিতাড়নের কৌশল নেওয়া হয়। তবে চেচেনরা এর কোনোটাতেই সম্মত ছিলেন না। তারা ১৭৮৫ সালে নিম্নভূমিতে প্রত্যাবর্তনের জন্য শেখ মনসুরের নেতৃত্বে যুদ্ধ শুরু করে। ১৭৯১ সালে শেখ মনসুর বন্দি হন এবং ১৭৯৪ সালে নির্বাসিত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। তবে চেচেনদের এ প্রতিরোধ এ অঞ্চলে রাশিয়ানদের অগ্রগতি সাময়িকভাবে স্তব্ধ করে দেয়। এতে চেচনীয় মুসলমানদের সক্ষমতারই প্রমাণ মেলে। উনিশ শতকের শেষভাগে রাশিয়া ককেশাস বিজয়ে সচেষ্ট হলে রাশিয়ার প্রতি বিমুখ হয়ে অটোমানদের সহানুভূতি অর্জনের লক্ষ্যে চেচেনরা ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়। তবে এ সময় অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের সূচনা হয়েছে। তারা ইসলামে নব দীক্ষিতদের রক্ষায় এগিয়ে আসতে সমর্থ ছিল না, এমনকি অটোমানরা তাদের নিজেদের সাম্রাজ্য রক্ষায় সন্দিহান হয়ে পড়েছিল।
নবমত, ১৮০৩ সালে প্রতিবেশী দাগেস্তানকে সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে রাশিয়া আবার চেচেনিয়া অভিযান শুরু করে এবং দীর্ঘমেয়াদি ককেশাস যুদ্ধ শুরু হয়। রুশ শাসনের বিরুদ্ধে চেচেন প্রতিরোধ দাগেস্তানি নেতা গাজি মোহাম্মদ, গামজাদ বেগ এবং ইমাম শামিল-এর নেতৃত্বে গড়ে ওঠে। কয়েক দশক যুদ্ধের পর ১৮৫৯ সালে চেচেনরা পরাভূত হয়। তাদের অনেক মানুষ নিহত হয়। বিপুল সংখ্যক চেচেন দেশত্যাগে বাধ্য হয়। চেচেনগণ নিপুণ সামরিক কৌশলের অধিকারী এবং অত্যন্ত স্বাধীনচেতা ছিলেন। রুশ সেনাপতিগণ চেচেনদের বিরুদ্ধে তীব্র বিদ্বেষ পোষণ করতেন। সেনাপতি এরমালাউ বলেছিলেন, একজন চেচেন জীবিত থাকলেও তিনি বিশ্রাম নেবেন না।
দীর্ঘস্থায়ী এ নিষ্ঠুর যুদ্ধের ফলে উনিশ শতকের শেষভাগ পর্যন্ত হাজার হাজার চেচেন দেশত্যাগ করে। ১৮৪৭ সালে উত্তর ককেশাসে ১.৫ মিলিয়ন চেচেনের বসবাস ছিল। ১৮৬১ সালে এ সংখ্যা কমে এক লক্ষ চল্লিশ হাজারে উপনীত হয়। ১৮৬৭ সালের মধ্যে দেশান্তর ও বহিষ্কারের পর এক লক্ষ ষোলো হাজার চেচেন অবশিষ্ট ছিল, ফলে কুড়ি বছরে চেচেন জনসংখ্যা হ্রাস পায় ৯২.৩ শতাংশ।
দশমত, ১৮৬০-এর দশকে রাশিয়া বলপূর্বক নির্বাসন ও এথনিক নিধন শুরু করে। অনুমান করা হয় যে, ১৮৬৫ সালে প্রায় ৮০ শতাংশ ইঙ্গুশ ইন্সুশিটিয়া ত্যাগ করে মধ্যপ্রাচ্য গমন করে। নিম্নভূমিতে বসবাসকারী চেচেনদেরও বিপুল সংখ্যায় উচ্ছেদ করা হয়। এদের মধ্যে অনেকেই ফিরে এলেও চেচেনের নিম্নভূমির ঐতিহাসিক চেচেন জনবসতি ফিরে আসতে দীর্ঘসময় প্রয়োজন হয়। ১৯৪৪ সালে ককেশাসের অপরাপর কয়েকটি জনগোষ্ঠীসহ সকল চেচেনকে সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্টালিনের নির্দেশে কাজাখ ও কিরগিস্তানে নির্বাসনে পাঠানো হয়। তাদের প্রজাতন্ত্র বিলুপ্ত করা হয়। অন্ততপক্ষে এক-চতুর্থাংশ, সম্ভবত অর্ধেক চেচেন জনগোষ্ঠী এ প্রক্রিয়ায় মৃত্যুবরণ করে এবং তাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহাসিক দলিলপত্র ধ্বংস হয়।
পরিশেষে বলা যায়, ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের পর উত্তর ককেশাসের পাহাড়ি অধিবাসীরা পার্বত্য উত্তর ককেশাস গণপ্রজাতন্ত্র গঠন করে। ১৯২১ সালে রুশ অধিপত্য মেনে নিতে তারা বাধ্য হয়। জোসেফ স্টালিন ব্যক্তিগতভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরে ব্যাপক স্বায়ত্তশাসন প্রদানের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। ঐ বছরই ধয়ত্তশাসিত পার্বত্য সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র গঠিত হয়। ১৯২৪ সালে এটি খেতে ৬টি প্রজাত্যায় শাঠন করা হয়। ১৯৩৪ সালের চেচেন-ইঙ্গুশ সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র গঠিত হয়।
চেচনিয়ায় কমিউনিস্ট শাসনে মুসলমানদের অবস্থা
ককেশাসে কমিউনিস্ট শাসনের শুরুতে অন্যান্য ককেশিয়ানদের মতো চেচেনরাও আশাবাদী হয়ে উঠেছিল। কমিউনিস্টরা চেচেনদের প্রচলিত সমাজব্যবস্থা ও সংস্কৃতি সমঅধিকারের উপর অত্যন্ত গুরুত্ব প্রদান করতো। তাই সাম্রাজ্যবাদ অবসানে কমিউনিস্টদের প্রতিশ্রুতি কমিউনিজমের প্রতি তাদের দুর্বল করে তোলে। তদুপরি অধিকাংশ চেচেন দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করতো। অনেক সুফি নেতা ধর্মের প্রতি কমিউনিজমের অত্যন্ত বিরূপ মনোভাব সত্ত্বেও কমিউনিস্টদের সাথে যোগ দেন। কমিউনিস্টদের প্রতিশ্রুতি কমিউনিজমের প্রতি তাদের আরো দুর্বল করে তোলে। তারা মনে করেন যে, সমমর্যাদা যা প্রতিষ্ঠায় কমিউনিস্টরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এজন্য ইসলামের সাম্যনীতির শিক্ষার প্রচার প্রসার বেশি জরুরি। তবে শীঘ্রই চেচেনদের মোহভঙ্গ ঘটে। বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর মধ্যে স্বার্থের সংঘাত শুরু হয়। তদুপরি একই গ্রুপের ভিতর রাজনৈতিক বিভাজন একটা জটিল অবস্থার সৃষ্টি করে।
এক বছরের মধ্যে পাঁচটি প্রভাবশালী স্বতন্ত্র গ্রুপ গড়ে ওঠে; ১. তেরেক কোজা, ২. বুর্জোয়া চেচেন, ৩. কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন মুসলমানদের কাদরি গ্রুপ, ৪. শহরে রুশ বলশেভিক, ৫. দাগেস্তানের ইসলাম পন্থিদের অনুসারী নকশাবন্দি এবং দীর্ঘস্থায়ী একটি গৃহযুদ্ধের সূচনা হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে হাসান ইসরাইলদের নেতৃত্বে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ফিনল্যান্ডের যুদ্ধ স্বাধীনতার জন্য চেচেনদের উজ্জীবিত করে তোলে। ১৯৪০ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু হয়। দক্ষিণ-মধ্য চেচেন ও ইন্সুশিটিয়ার একটা বড় অংশ বিদ্রোহীদের দখলে যায়। ১৯৪১ সালের জুন মাসে জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে। জার্মানদের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বিদ্রোহের নেতৃত্ব জার্মানদের হাতে তুলে দিতে ইসরাইল সম্মত ছিল না; বরং ইসরাইল চেচেনদের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দিয়ে জার্মানদের উপর চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। এতে জার্মান-চেচেন মৈত্রী গড়ে ওঠার সম্ভাবনা নস্যাৎ হয়ে যায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে জার্মানদের সাথে চেচেনদের যোগাযোগ থাকলেও চেচেন এবং নাৎসিদের মধ্যে আদর্শগত পার্থক্য ছিল প্রবল। তারা একে অপরকে বিশ্বাস করতেন না। কোজাকদের সাথে সম্পর্ক স্থাপনে জার্মান প্রচেষ্টাও চেচেনদের জন্য স্বস্তিদায়ক ছিল না। বিদ্রোহী নেতা ইসরাইল হিটলারকে ভীষণভাবে অপছন্দ করতেন। এতৎসত্ত্বেও স্টালিনের সরকার চেচেনদের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ উত্থাপন করে। ১৯৪৪ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে জনগণকে স্থানীয় পার্টি ভবনে সমবেত করে জানিয়ে দেওয়া হয় যে, জার্মানদের সাথে কলাবোরেশনের শাস্তি হিসেবে তাদের নির্বাসনে পাঠানো হবে। নির্বাসিতদের ৪০-৫০ শতাংশ ছিল শিশু। নির্বাসনে প্রেরণকালে বিপুল সংখ্যক চেচেনকে তুচ্ছ কারণে হত্যা করা হয়। পরবর্তী গ্রীষ্মকালের মধ্যে চেচনিয়া-ইঙ্গুশিটিয়া রাষ্ট্র বিলুপ্ত করা হয়। বহু স্থানের নাম রুশ নান দ্বারা প্রতিস্থাপিত করা হয়। চেচেনের ইতিহাস সম্পর্কিত সকল পুস্তক পুড়িয়ে ফেলা হয়। মসজিদ ও কবরস্থান ধ্বংস করা হয়। চেচেনদের কবরের মৃতের পরিচয় নির্দেশক পাথর দিয়ে ফুটপাত, ভবনের ভিত্তি এবং এমনকি শূকরের খোয়াড় তৈরি করা হয়।
ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন ও ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণের অপরাধে কয়েক লক্ষ মুসলমানকে হত্যা করা হয়। শুধু সরকারি হিসেবেই ১৯৪৪-১৯৪৮ সালে একলক্ষ চুয়াল্লিশ হাজার সাতাশ জন মুসলমানকে হত্যা করা হয়। অনেক ঐতিহাসিকের মতে প্রকৃত সংখ্যা এ সংখ্যার তুলনায় অনেক বেশি। কাউন্সিল অব ইউরোপ এ হত্যাকাণ্ডকে গণহত্যা বলে সংজ্ঞায়িত করেছে।
১৯৮৫ সালে মিখাইল গর্বাচেভ সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষমতায় আসেন। ১৯৮৯ সালে প্রথম বারের মতো একজন চেচেন চেচেনো-ইঙ্গুশেটিয়ার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। ১৯৯০ সালের এপ্রিল মাসে সুপ্রিম সোভিয়েত অঙ্গরাজ্যগুলোকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার অধিকারসহ স্বায়ত্তশাসন প্রদান করে। তবে সার্বভৌমত্বের দাবিতে তীব্র আন্দোলনের মুখে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন। ১৯৯০ সালে সোভিয়েত বিমান বাহিনীর একজন প্রাক্তন বৈমানিক দুদায়েভ রাশিয়ান ফেডারেশন থেকে চেচনিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। নিজ সমস্যায় জর্জরিত রাশিয়ান ফেডারেশন প্রায় তিন বছর চেচনিয়ার প্রায় স্বাধীন অবস্থা অব্যাহত থাকতে দেয়।
১৯৯১ সালে জোখার দুদায়েভ স্টালিনের শাসনামলে ধ্বংস করা কবরস্থানের হারিয়ে যাওয়া পাথরগুলো সংগ্রহ করে রাজধানীতে একটি দেয়াল নির্মাণ করেন। অতীতের হৃদয় বিদায়ক ঘটনাবলির জন্য শোক প্রকাশ এবং মৃত পূর্বপুরুষদের নামে সবচাইতে ভালো চেচেন রিপাবলিক নির্মাণের জন্য কঠোর পরিশ্রম করার অঙ্গীকারের প্রতীক হিসেবে এ দেয়ালটি নির্মিত হয়। এ দেয়ালটিতে উৎকীর্ণ ছিল- ‘আমরা ভাঙব না, আমরা কাঁদব না, আমরা কোনো দিনই ভুলব না’। তবে জনগণের তীব্র প্রতিবাদ সত্ত্বেও কাদরিয়েভ সরকার এটি সরিয়ে ফেলেছে।
১৯৯১-১৯৯৪ সালে চেচেন নৃগোষ্ঠীভুক্ত নয় এমন বিপুল সংখ্যক নাগরিক চেচনিয়া ত্যাগ করে। পর্যবেক্ষকদের মতে ভেঙে পড়া সোভিয়েত ইউনিয়নের সকল অংশ থেকে রুশদের সরে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এ সময়ে রাশিয়ার সাথে চেচনিয়ার বিরোধ বৃদ্ধি পায় এবং অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দেয়। বিশেষজ্ঞদের মতে রাশিয়ার অর্থনৈতিক অবরোধ এবং দুদায়েভের দুর্বল অর্থনৈতিক নীতি উভয়ই এজন্য দায়ী। এজন্য দুদায়েভের তীব্র সমালোচনা হলেও তার বিরোধীরা চেচনিয়ার স্বাধীনতার বিরোধিতা করেনি। তারা শুধু দুদায়েভের সমালোচনা করেছেন।
রাশিয়ার ফেডারেল সরকার চেচেনের স্বাধীনতা মেনে নিতে অস্বীকার করেন। চেচেন ভূখণ্ডে নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য চেচেনের বিরোধী দলকে অর্থ সাহায্য প্রদান করা হয়। তবে বিরোধী দলও স্বাধীনতার পক্ষে থাকায় এ প্রচেষ্টা সফল হয়নি। সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দুদায়েভ সরকারকে উৎখাতের চেষ্টাও ব্যর্থ হয়।
চলবে…