মুসলিম পোর্ট

রাশিয়া-চেচনিয়া প্রথম যুদ্ধ (১৯৯৪-৯৬ সাল)

চেচেন মুসলমানদের ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায় হচ্ছে রাশিয়া- চেচনিয়া যুদ্ধ। রাশিয়া শেষ পর্যন্ত চেচেনদের সাথে পেরে না উঠে ১৯৯৪ সালে সরাসরি চেচনিয়া আক্রমণ করে। ১৯৯৪ সালের ২৬ নভেম্বরে রুশ ফেডারেল বাহিনী রাজধানী গ্রজনিতে প্রবেশ করে। আসলান মাসখাদাভ-এর নেতৃত্বে চেচেন মুসলমানরা প্রতিরোধ শুরু করে। চেচেনদের দমনে রাশিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়ালেৎসিন চেচনিয়ায় চল্লিশ হাজার সৈনিক প্রেরণ করেছিলেন। তারা আশা করেছিলেন যে, রুশ বাহিনী অতিদ্রুত বিদ্রোহীদের পরাস্ত করে রাজধানী গ্রজনির নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করতে সক্ষম হবে। কিন্তু পরাশক্তি রাশিয়া তীব্র প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। অবশেষে টানা দুইমাস ধরে তীব্র লড়াইয়ের পর রুশ বাহিনী গ্রজনির নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করতে সক্ষম হয়। এমতাবস্থায় চেচেন স্বাধীনতাকামী যোদ্ধারা গেরিলা যুদ্ধের আশ্রয় গ্রহণ করে।

১৯৯৫ সালের শুরুতে খাজিয়েভ-এর নেতৃত্বে রুশ সরকার গঠিত হয়। শীঘ্রই জাগায়েভ তার স্থলাভিষিক্ত হন। চেচেন প্রতিরোধ আন্দোলনকারীরা বিভিন্ন দিকে সাহায্যের আবেদন জানায়। তাদের এ আবেদনে একদিকে মুসলিম রাষ্ট্রগুলো চেচেন বাহিনীকে সমর্থন জানায় এবং আরব যোদ্ধারা তাদের সাথেই যোগ দেয়। অপরদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বাল্টিকের জনগণ এস্তোনিয়া, দাগেস্তান, জর্জিয়া, ইউক্রেন, বেলারুশ, হাঙ্গেরিসহ বিভিন্ন অঞ্চল চেচেন স্বাধীনতাকামীদের পক্ষে সমর্থন জানায়। দেশান্তরী চেচেনরাও ফিরে আসেন। দু’বছরের যুদ্ধে রাশিয়ার হাতে চেচেন যোদ্ধাসহ পঞ্চাশ হাজারের অধিক স্বাধীনতাকামী নিহত হয়। চেচেনরা একদিকে তীব্র প্রতিরোধ চালিয়ে যায় অন্যদিকে রুশ সৈন্যদের দ্বারা সংঘটিত গণহত্যার ব্যাপক প্রচার শুরু করে। এতে বিশ্বের বিভিন্ন কর্নারে রুশ বিরোধী মনোভাব প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। ফলে রুশ সৈন্যদের মনোবল ভেঙে পড়ে। অবশেষে চেচেন বাহিনীর গেরিলা আক্রমণের তীব্রতায় ১৯৯৬ সালের মার্চ মাসে রুশ সৈন্যরা পশ্চাদপসরণ করে এবং শান্তি আলোচনা শুরু করে। ১৯৯৬ সালের এপ্রিল মাসে রুশ বিমান হামলায় দুদায়েভ নিহত হন। ১৯৯৬ সালের আগস্টে রুশ সৈন্য প্রত্যাহার করা হয় এবং যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। ১৯৯৬ সালের ৩১ আগস্ট রাশিয়ার সাথে স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তিতে চেচেন নেতা আসলাম মাসখাদাভ শান্তিচুক্তি সম্পাদন করেন। প্রথম চেচেন যুদ্ধের শেষ দিকে চেচনিয়ার প্রায় দুই লক্ষ রুশ নাগরিক চেচনিয়া ত্যাগ করে। চেচনিয়ায় তীব্র রুশ বিরোধী মনোভাব এর কারণ বলে মনে করা হয়।

প্রেসিডেন্ট জাওহার দুদায়েভ

চেচনিয়ার ইতিহাসে জাওহার দুদায়েভ একটি নাম, একটি ইতিহাস। চেচনিয়ার স্বাধীনতার স্বপ্নের সাথেই এ নামটি মিশে আছে। তিনি চেচনিয়ার স্বাধীনতার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁর নেতৃত্বেই চেচনিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করে। তাইতো চেচেন জাতির স্বপ্নেও জাগ্রত থাকে এ নামটি। ১৯৪৪ সালের ১৫ এপ্রিল জোখার দুদায়েভ পিয়ার ভোমায়াস্কা অঞ্চলের ইয়ালখের গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল আহমদ মুসা এবং মাতার নাম আলেপতিনা কেদোরভনা দুদায়েভ। দুদায়েভের পিতা জাতিতে চেচেন এবং মা ছিলেন রুশ। মোট সাত ভাইবোনের মধ্যে দুদায়েভ ছিলেন সবার ছোট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়ে তার পিতা এবং বড়ভাই স্টালিন বাহিনীর হাতে শহিদ হন। দুদায়েভ রাডিকাফকাজে ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং এ দু বছর লেখাপড়া করে সামরিক বাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৬২ সালে রাশিয়ার তাম্বর শহরের বৈমানিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে তার সামরিক শিক্ষা শুরু হয়। চেচেনরা জাতিগতভাবে রুশদের কাছে বৈষম্যের শিকার হলেও দুদায়েভ স্বীয় প্রতিভা ও যোগ্যতা বলে সমস্ত বাধা অতিক্রম করে রাশিয়ার মস্কোর সেরা সামরিক প্রতিষ্ঠান ইউরি গ্যাগারিন এয়ারফোর্স একাডেমিতে শিক্ষালাভের সুযোগ পান।

১৯৭৬-৭৯ সাল পর্যন্ত দুদায়েভ রাশিয়ার এয়ারফোর্স রেজিমেন্ট এর চিফ অব স্টাফ, ১৯৭৯-৯০ সাল পর্যন্ত কামান্ডার অব ডিভিশন এর পদ অলংকৃত করেন এবং ১৯৯০ সালেই স্বেচ্ছায় সামরিক বাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। অবসরের পর দুদায়েভ নিজেকে মেলে ধরেন জনকল্যাণে। ১৯৯০-৯১ সেশনের জন্য তিনি চেচেন জাতির মহাসম্মেলনের নির্বাহী কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময়ের মধ্যেই তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে তিনি চেচনিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। জাতীয় চেতনা এবং অতীত ঐতিহ্যের পূর্ণ ধারকবাহক ছিলেন দুদায়েভ। তাইতো তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার পরেই চেচেনদের মধ্যকার স্বাধীনতার অগ্নিমশাল প্রজ্বলিত করে তোলেন। চেচেনরা সে বছরেই দুদায়েভের নেতৃত্বে চেচনিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এ ঘোষণাকে রাশিয়া কোনোভাবেই মেনে নেয়নি। নানা কায়দা কৌশলে তারা চেচনিয়াকে নিজেদের বাহুডোরে রাখার প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে অবশেষে ১৯৯৪ সালের ১১ ডিসেম্বর রুশ প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিন তিন ডিভিশন সৈন্য দিয়ে চেচনিয়া আক্রমণের নির্দেশ দেন।

এ সময় দুদায়েভ চেচেন জাতির আকাঙ্ক্ষার প্রতীক ও চোখের মণি হয়ে ওঠেন। দুদায়েভ সর্বশক্তি দিয়ে রুশদের আক্রমণ প্রতিহত করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। এমতাবস্থায় ১৯৯৫ সালে দুদায়েভের জ্যেষ্ঠপুত্র রুশদের আক্রমণে শহিদ হন এবং ১৯৯৬ সালের শুরুর দিকে তাঁর জামাতা সালমান রাদুয়েভও শহিদ হন। চেচেনবাহিনী বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেও দুদায়েভ ছিলেন স্বাধীনতার জন্য প্রীণ উৎসর্গকারী স্বাধীনতাকামী পুরুষ। তাইতো তিনি পাহাড়ি অঞ্চলে আশ্রয় নিয়ে গেরিলা যুদ্ধের নীতি অবলম্বন করে চেচনিয়ার স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার প্রয়াসে এগিয়ে যান। এমতাবস্থায় রুশ প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিন স্যাটেলাইট টেলিফোনে আলাপের মাধ্যমে বিষয়টি মীমাংসার আয়োজন করেন। দুদায়েভ শেষ পর্যন্ত সে প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে রাজধানী গ্রজনি থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে জেখেসু অঞ্চলের একটি নিভৃত এলাকা থেকে স্যাটেলাইটে রুশ প্রেসিডেন্টের সাথে সংলাপ শুরু করেন। কিন্তু রুশ প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিন বিশ্বাসঘাতকতা করে কাপুরুষোচিতভাবে তাঁর অবস্থানকে নির্ণয় শেষে তাঁকে উদ্দেশ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। সে হামলায় ১৯৯৬ সালের ২৪ এপ্রিল চেচনিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলনের অকুতোভয় নেতা জোখার দুদায়েভ শহিদ হন। রুশরা তাকে হত্যা করতে পারলেও চেচেনদের স্বাধীনতার স্বপ্নকে হত্যা করতে পারেনি, তাকেও মুছে ফেলতে পারেনি জনগণের হৃদয় থেকে। স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতীক দুদায়েভ অত্যন্ত সংস্কৃতিমনা ছিলেন। তিনি ফুল, কারাতে ও সংগীত ভালোবাসতেন। কুরআন তিলাওয়াত ও কবিতা আবৃত্তি তাঁর প্রিয় শখ ছিল। তিনি পুশকিন ও লের মগুভের কবিতার ভক্ত ছিলেন।

প্রথম চেচেন যুদ্ধ পরবর্তী চেচনিয়া

রুশ প্রতিরোধ আন্দোলনের নেতা হিসেবে আসলান মাসখাদাভ অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তিনি ১৯৯৭ সালের নির্বাচনে চেচনিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এসময় তিনি চেচনিয়ার অর্থনৈতিক বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে তিনি একটি ধর্মনিরপেক্ষ এবং পশ্চিমা ধাঁচের চেচনিয়া গড়ার পক্ষপাতী ছিলেন। এ নীতিমালাটি চেচেনদের কাছে পছন্দ হয়নি। অন্যদিকে প্রথম চেচেন যুদ্ধের সময় সৌদি আরবের পুষ্ট মুসলিম যোদ্ধারা ব্যাপক সংখ্যায় চেচনিয়ায় এবেশ করেন। যুদ্ধের পর এসব সৈনিকের অধিকাংশই চেচনিয়ায় থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ইসলামি আদর্শের চেতনা লালনকারী এসব সৈনিক নিজেদেরকে একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। ফলে চেচনিয়া ইসলামি চেতনা সংবলিত একটি আদর্শিক রাষ্ট্রের কাঙ্ক্ষিত ঘাঁটিতে পরিণত হয়।

শরিয়াভিত্তিক আদর্শিক চেতনায় উজ্জীবিত আরবীয় সৈনিকদের সাথে স্থানীয় সুফিবাদী চেতনাধারীদের মধ্যে কিছুটা মতপার্থক্য সূচিত হয়। এ বিষয়টি এক পর্যায়ে অত্যন্ত চরম আকার ধারণ করে। সুফিবাদী চেতনা লালনকারীরা আরবীয় শরিয়াপন্থি যোদ্ধাদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। তারই জের ধরে ১৯৯৬-১৯৯৯ সালের মধ্যে বেশ কিছু মসজিদেও হামলার ঘটনা ঘটে। ধর্মনিরপেক্ষ চেচনিয়ার জনগণের সামনে তারা নিজেদের মতবাদকে একটি বিকল্প মতাদর্শ হিসেবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়। স্থানীয়ভাবে তাদেরকে ওহাবি আখ্যা দিয়ে কোণঠাসা করার প্রয়াস চালানো হলেও তাদের প্রভাবেই চেচেন প্রেসিডেন্ট আসলান মাসখাদাভ ১৯৯৮ সালে চেচনিয়ায় ইসলামি শরিয়া আইন প্রচলনে বাধ্য হয়েছিলেন।

আসলান মাসখাদাভ যুদ্ধবিধ্বস্ত চেচনিয়াকে গড়ে তোলার প্রয়াসে নানাবিধ কর্মসূচি গ্রহণ করলেও তা সফল হয়নি। অবশেষে মাসখাদাভ রুশ অর্থ সাহায্যের মাধ্যমে বিধ্বস্ত চেচনিয়া ও এর অর্থনীতি পুনর্গঠনে প্রয়াসী হয়েছিলেন।

ফলে রাশিয়ার প্রতি তাকে নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতে হয়েছে। রাশিয়া পরিপূর্ণভাবে সাহায্যের আশ্বাস দিলেও প্রতিশ্রুত সাহায্যের অনেকটাই শেষ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে মাসখাদাভের পরিষদবর্গের ব্যাপক দুর্নীতির কারণে প্রাপ্ত সহায়তাকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো সম্ভব হয়নি অর্থনৈতিক সংকটের এমন পর্যায়ে গেরিলাদের অনেকেই কর্মসংস্থানের অভাবে অপহরণ, খুন, হত্যার মতো অপরাধে জড়িত হন। ফলে সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় বিরোধীদের বিভিন্নমুখী চাপে মাসখাদাভ তার ক্ষমতা সংহত করতে ব্যর্থ হন। এ সাথে রাশিয়ার প্রতি নমনীয়তা, অর্থনৈতিক দৈন্য কাটানোর ব্যর্থতা এবং রাষ্ট্রীয়যন্ত্রকে শাস্তি শৃঙ্খলাবদ্ধ রাখতে ব্যর্থ হওয়ায় তার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে ওঠে এমতাবস্থায় ১৯৯৮-১৯৯৯ সালে তাকে হত্যার জন্য দু’বার প্রচেষ্টা চালানো হলেও সৌভাগ্যবশত তা ব্যর্থ হয়। রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা এ হত্যার প্রচেষ্টার সাথে জড়িত ছিল বলে অনেকের ধারণা। এ প্রেক্ষাপটে রাশিয়ার বিরুদ্ধে সশস্ত্র হামলার ঘটনা বৃদ্ধি পায়। এমতাবস্থায় বিরোধীদের বিভিন্নমুখী চাপে মাসখাদাভ তার ক্ষমতা সংহত করতে ব্যর্থ হন।

দ্বিতীয় চেচেন যুদ্ধ

নেতৃত্বে দাজেস্তানে স্বাধীনচেতা যুদ্ধ বাহিনী গঠন করেন। বিষয়টি রাশিয়ার কাছের মোটেও ভালো লাগেনি। চেচেন বিদ্রোহীদের তৎপরতা বৃদ্ধির আশঙ্কায় রাশিয়ার নতুন প্রধানমন্ত্রী ভ্লাদিমির পুতিনের নির্দেশে ১৯৯৯ সালের ১ অক্টোবর রুশ সৈন্যরা তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করতে চেচনিয়ায় প্রবেশ করে। পর্যবেক্ষকদের মতে, চেচেনদের চোরাগোপ্তা হামলা বন্ধ করে রুশ আধিপত্য বজায় রাখতে চেচনিয়ায় রুশ সৈন্য প্রবেশ অবশ্যম্ভাবী ছিল। তবে এটাও কথা সত্য যে, চেচেন স্বাধীনতাকামীরা রাশিয়ার বিরুদ্ধে চোরাগোপ্তা হামলা না করলেও আধিপত্য নিরঙ্কুশ রাখতে রুশ সৈন্যরা চেচনিয়ায় প্রবেশ করতো বলে পর্যবেক্ষকগণ মনে করেন। পাল্টাপাল্টি আক্রমণের এক পর্যায়ে যুদ্ধের মোড় রুশ সৈনিকদের পক্ষে চলে যায়। এবং ২০০০ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে রুশ সৈন্যরা চেচনিয়ার উপর কর্তৃত্ব স্থাপন করে। ২০০২ সালে রুশ পৃষ্ঠপোষকতায় আহমেদ কাদিরভ একটি সরকার গঠন করেন। ২০০৩ সালে শাসনতন্ত্রের উপর একটি গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু এ গণভোটে জনগণের মতামতের কোনো প্রতিফলন ঘটেনি। কথিত আছে, এ গণভোট এতটাই দুর্নীতি হয়েছে যে, রুশ সৈন্য এবং মৃত চেচেনরাও গণভোটে ভোট প্রদান করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। এ ধরনের ভোট চুরি ঠেকাতে চেচেন স্বাধীনতাকামীরা প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করলেও রাশিয়ার তেলেসমাতি পরিকল্পনায় তেমন কোনো লাভ হয়নি।

দ্বিতীয় চেচেন যুদ্ধ ও সাম্প্রতিক চেচনিয়া

পরপর দুটি যুদ্ধের ফলে চেচনিয়ার লক্ষ লক্ষ জনগণ দারিদ্র্যে বিপুল জনগোষ্ঠীর দেশান্তর ঘটেছে এবং রাষ্ট্রটির অবকাঠামো ধ্বংস হয়েছে। কাদিরভ দাবি করেন যুদ্ধের পর উত্তর চেচনিয়া ও গ্রজনি পুনর্নির্মাণে তিনি সক্ষম হয়েছেন। নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকদের মতে, কাদিরভ এবং তার গোত্রভুক্তদের অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হলেও মূল চেচনিয়ার দুর্দশার লাঘব হয়নি। অধিকন্তু ২০০১ সালের সেপ্টেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে হামলার পর চেচেনদের প্রতি পশ্চিমা হাশিয়া উঠেপড়ে লাগে। রুশদের এ অভিযোগ পশ্চিমামহল ব্যাপকভাবেই গ্রহণ করে। মনোভাবে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। চেচেন বিদ্রোহীদেরকে জঙ্গি মুসলমান চিহ্নিত করতে চেচনিয়ার মুসলমানদের আন্দোলনকে জঙ্গিবাদের উত্থান হিসেবে উল্লেখ করে যে প্রচারণা চালানো হচ্ছে এটা নিছক ইসলাম ফোবিয়ার কারণেই। শাসকগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে মুসলমানদের কাঙ্ক্ষিত কোনো সফলতাই দেখানো হয়নি। বরং দীর্ঘকাল ধরে নরক্ষমতা দখলের জন্য চেচেন জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করা হয়েছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতেও এ অনুভূতি ব্যবহৃত হয়েছে। এ বিষয়টি উপেক্ষা করে প্রায় প্রথম চেচেন যুদ্ধের পরের অনিশ্চিত এবং অস্থিতিশীল পরিবেশে ক্রমাগত অধিকতর বলপ্রয়োগ এ অঞ্চলে ইসলামি চরমপন্থিদের উত্থানে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। প্রথম চেচেন যুদ্ধের ফলে চেচনিয়ার শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। এ অব্যবস্থার জন্য জনগণ শাসকগোষ্ঠী ও নেতাদেরকেই দায়ী করে। যেহেতু শরিয়া আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখে এবং কঠোর হাতে দুর্নীতি প্রতিরোধ করে, তাই চেচেনরা সামাজিক অনাচার দূরীকরণের একটি পথ বিবেচনায় শরিয়া আইনের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে। প্রথম চেচেন প্রেসিডেন্ট দুদায়েভ ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। পরবর্তীকালে ১৯৯৪ সালে রুশ আগ্রাসন মোকাবিলা করার জন্য চেচেন জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার উদ্দেশ্যে তিনি ইসলামি অনুভূতি ব্যবহার করেন। চেচেন সৈন্যদের মধ্যে লড়াকু মনোভাব এবং শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাবার মানসিকতা তৈরির জন্যও ইসলামি অনুভূতি অত্যন্ত কার্যকর ছিল। মস্কোর সাহায্য লাভে ব্যর্থ হওয়ায় মাস্কাডাউয়ের পতন ঘটে, দেশে বিশৃঙ্খলা ও অর্থনৈতিক দুর্যোগ নেমে আসে। স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে একটি কার্যকর বিকল্প হিসেবে ১৯৯৭ সালে নির্বাচনি প্রচারণাকালে ইয়ানডারবিয়েভ একটি ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ডাক দেন। ইয়ানডারবিয়েভ নিজে ইসলামি আদর্শের অনুসারী ছিলেন কি না তা নিয়ে প্রশ্ন আছে, তবে তিনি ইসলামের প্রতি চেচেন জনগণের দুর্বলতার বিষয়ে সচেতন ছিলেন এবং সুবিধা আদায়ের জন্য ধরনের প্রচারণা চালিয়েছেন। 

চেচেন যুদ্ধের নিষ্ঠুরতা, বিরামহীনতা এবং সর্বগ্রাসী ধ্বংসযজ্ঞ চেচেন জনগণকে প্রভাবিত করেছিল। গ্রজনিতে বোমাবর্ষণে ২৪,০০০ বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছিল। রুশ সেনা ক্যাম্পে চেচেনদের বন্দি করে নির্যাতন এবং এমনকি হত্যা করা নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছিল। এ ধরনের পরিস্থিতিতে জিহাদের ডাক রুশবিরোধী যুদ্ধে চেচেন জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। জিহাদে অংশ নেওয়া বিদেশিরা শুধু যে বস্তুগত সহায়তা প্রদান করেছিল তাই নয়, তারা চেচেন জনগণকে একটি বিশাল মানসিক শক্তিও যুগিয়েছিলেন। প্রথম চেচেন যুদ্ধের পূর্বে ও যুদ্ধের সময় ঘটনাবলির উপর অপ্রতুল রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ জিহাদিদের সংঘবদ্ধ হতে উৎসাহিত করে। ইসলামি আদর্শের প্রসার জিহাদিদের কাম্য ছিল। তাদের কার্যকলাপের ফলে ১৯৯৯ সালে দাগেস্তান যুদ্ধ শুরু হয়। ফলে পুরো ককেশাসে অস্থিতিশীলতা তৈরি হয় এবং যুদ্ধের আশঙ্কা দেখা দেয়। ধর্মীয় উন্মাদনা এ অঞ্চলে বসবাসরত রুশদের দেশত্যাগ বাধ্য করতে পারে, ফলে রুশ অর্থনীতি বিপর্যস্ত হবে এবং নিজেদের জনগণকে রক্ষা করতে ব্যর্থতার জন্য রুশ মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হবে- এ আশঙ্কায় রাশিয়া চেচনিয়ার একটি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যাপক হামলা ও প্রচারাভিযান শুরু করে। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন যে, চেচেন জনগণের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান না করে তাদের জঙ্গি আখ্যায়িত করা বা দমননীতি প্রয়োগ করে চেচেন সমস্যার সমাধান হবে না। 

পরিশেষে বলা যায় যে, রুশপন্থি লৌহমানব কাদিরভের কঠোর নিয়ন্ত্রণে চেচনিয়া আপাতত শান্ত। তার শাসনামলে সুফিবাদের পুনর্জাগরণ ঘটেছে। গ্রজনিতে ইউরোপের সবচেয়ে বড় মসজিদের নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু কট্টর মনোভাবাপন্ন জনগণ কাদিরভ ও তার সুফি অনুসারীদের রাশিয়ার ক্রীড়নক বলে অভিযোগ করেন। তবে কাদিরভের সাথে রাশিয়ার বিরোধের লক্ষণ পরিস্ফুট হয়েছে। কাদিরভ ব্যাপক স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে অবস্থান দেখাচ্ছেন। এমতাবস্থায় মুসলিম নেতাদের প্রতি কাদিরভের নমনীয় মনোভাব এবং আবখাজ- এর স্বাধীনতার প্রতি তার সমর্থন রাশিয়ার মোটেই। পছন্দনীয় নয়। পক্ষান্তরে রাশিয়ান ফেডারেশনের অভ্যন্তরীণ পুনর্গঠনে রাশিয়ার সাম্প্রতিক নীতি স্বাধীনতাকামীদের কাছেও অপছন্দনীয়। ফলে চেচনিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাসের গতি কখন কোন দিকে মোড় নেবে তা সহজে অনুমান করা অত্যন্ত কঠিনই হবে।

– মুসলিম পোর্ট