মুসলিম পোর্ট

লোটন মসজিদ।
প্রতিষ্ঠাকাল: ১৪৭৫। 

মসজিদ সংলগ্ন বারান্দার উপর চৌ-চালা ছাদ সংযুক্ত হওয়ার একটি বিশেষ দৃষ্টান্ত হলো লোটন মসজিদ। ইটের তৈরি এক গম্বুজবিশিষ্ট গৌড়ীয় মুসলিম স্থাপত্যের মধ্যে লোটন মসজিদই উল্লেখযোগ্য। ১৪৭৫ সালে সুলতান ইউসুফ শাহ (১৪৭৪-৮১) কর্তৃক নির্মিত এই মসজিদটি ৩৪ ফুট দৈর্ঘ্যের একটি বর্গাকার কক্ষ, সামনে পূর্বদিকে ১১ ফুট বিস্তৃত একটি বারান্দা ও কোনাগুলোতে ছয়টি অষ্টভুজী বুরুজ নিয়ে গঠিত। সুতরাং এর বহির্দেয়ালের দৈর্ঘ্য ৭২ ফুট এবং প্রস্থ ৫১ ফুট। মসজিদে প্রবেশের জন্য পূর্ব, উত্তর ও দক্ষিণ দিকে তিনটি করে খিলান দরজা বর্তমান। মসজিদের পশ্চিম দেয়ালের অভ্যন্তরভাগে তিনটি মিহরাব রয়েছে। 

এই মসজিদে নামাজগৃহের উপরিভাগে নির্মিত হয়েছে একটি বিশাল গম্বুজ। সম্মুখভাগের বারান্দার উপরে রয়েছে তিনটি গম্বুজ। চমৎকার বিষয়টি হলো- এই গম্বুজ তিনটির মধ্যে মধ্যস্থলের গম্বুজটি বাংলার চৌ-চালা খড়োঘরের নির্মাণ পদ্ধতিতে নির্মিত। এই চৌ-চালা ছাদের পরিমাপ উত্তর-দক্ষিণে ১১.৫০ ফুট এবং পূর্ব-পশ্চিমে ১০.৫০ ফুট। এই নির্মাণ পদ্ধতি অবশ্যই বাংলার আবহমানকালের গৃহ নির্মাণ- কৌশলেরই প্রতিফলন। অযত্নরক্ষিত বিধায় এর প্রকৃত অবয়ব এবং গঠন সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা পাওয়া সম্ভব না হলেও অনুমান করা যায় যে, এই মসজিদের চালাছাদটিতে ষাটগম্বুজ মসজিদের সাতটি চৌ-চালা ছাদের ন্যায় চারটি চালা ক্রমান্বয়ে সংক্ষিপ্ত আকারে উপরদিকে উত্থিত হয়ে একটি টুইয়ে মিলিত হয়েছে। এখানেও দুটি ট্রাপিজিয়াম সদৃশ এবং দুটি ত্রিভুজাকৃতির চালার ব্যবহার লক্ষণীয়। তবে এই চালাছাদের সঙ্গে ষাটগম্বুজ মসজিদের পার্থক্য হলো, এই মসজিদের চালাছাদের নিম্নাংশ ধনুকাকৃতির যা ষাটগম্বুজ মসজিদে নেই। এই মসজিদের চৌ-চালা ছাদের অভ্যন্তরে উৎক্ষেপন বিন্দুতে এবং নিম্নাংশে পাটাভাগের অভ্যন্তরে বরফি নকশা ও ছোটো ছোটো খিলান নকশার সাথে সারিবদ্ধ পুষ্প নকশা বিদ্যমান। তাছাড়া চৌ-চালার নিম্নভাগে চালার সঙ্গে সাদৃশ্য রেখে সারিবদ্ধ বর্গাকার গঠন সন্নিবেশের মাধ্যমে এর নিম্নাংশ আয়তাকার পাটাভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। নিচ থেকে দেখলে এগুলোকে অলংকরণ বলে মনে হয়। 

বাগেরহাটের ষাটগুম্বুজ মসজিদে ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের গৌড়ের ছোট সোনামসজিদে চৌচালা আচ্ছাদন ব্যবহৃত হয়েছে। তবে এ দুই মসজিদে ব্যবহৃত চৌচালার মধ্যে কিছুটা বৈসাদৃশ্যও আছে। লোটন মসজিদের বাইরের দিকের চার কোনায় এবং বারান্দার দু’পাশে খাঁজকাটা বুরুজ রয়েছে। অর্থাৎ এ মসজিদের বাইরের দিকে সংযুক্ত ছয়টি বুরুজই খাঁজকাটা। 

এ মসজিদের সর্বত্র বিভিন্ন রঙের ষড়ভূজাকৃতির রঙিন টালির ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। যেমন- গাঢ় নীল, হলুদ, সবুজ এবং সাদা। বাংলার অন্য কোনো ইমারতে এত বৈচিত্র্যপূর্ণ রঙিন বা মিনা করা টালি ব্যবহৃত হয়নি। রাজশাহীর বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরে এ মসজিদের কয়েকটি রঙিন টালি সংরক্ষিত আছে। এ মসজিদের পোড়ামাটির নকশাগুলোও রঙিন আস্তরণযুক্ত। এ ধরনের রঙিন টালি চাঁপাইনবাবগঞ্জের গৌড়ের ছোট সোনামসজিদে ও বাগেরহাটের খানজাহানের সমাধিতে ব্যবহৃত হয়েছে। পাবনা জেলার নবগ্রাম মসজিদের সঙ্গে এ মসজিদের সাদৃশ্য রয়েছে। অলঙ্করণের দিকে দিয়ে মালদা জেলার গৌড়ের গুমটি দরওয়াজার সঙ্গে এর সাদৃশ্য রয়েছে। এ মসজিদে মাত্রারিক্ত অলঙ্করণ ব্যবহৃত হওয়ায় স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য ক্ষুণ হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।