ইউরোপ মহাদেশের অন্তর্গত পূর্ব ভূমধ্যসাগরের বুকে ছোট্ট দ্বীপ সাইপ্রাস। সাইপ্রাসের সরকারি নাম “রিপাবলিক অফ সাইপ্রাস”। উত্তরে তুরস্ক, দক্ষিণ দিকে সিরিয়া, লেবানন, দক্ষিণ-পূর্বে ফিলিস্তিন এবং দখলদার ইসরাঈল কর্তৃক ফিলিস্তিনের দখলকৃত এলাকা এবং পূর্বে মিশর,পশ্চিমে গ্রিস,ও পূর্বে ইসরাইল অবস্থিত। ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপগুলোর মধ্যে তৃতীয় বৃহত্তম এটি।
ল্যাটিনিকরণ গ্রিক শব্দ কিউপ্রোস (Kupros) হতে সাইপ্রাস শব্দের উদ্ভব। সাইপ্রাস নামের উদ্ভব সম্পর্কে সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রবাদটি কপার প্রবাদ নামে পরিচিত। গ্রিক ও ল্যাটিন ভাষায় মেটাল বা ধাতু বুঝাতে কপার শব্দটি ব্যবহার করা হতো। বর্তমানে সাইপ্রাস নামক অঞ্চলটি কপার উৎপাদন সরবরাহের জন্য বিখ্যাত ছিল। বিশ্বে কপারের অন্যতম উৎস ছিল সাইপ্রাস। এখান থেকে বিভিন্ন দেশে প্রচুর মেটাল বা কপার সরবরাহ হতো। তাই এর নাম হয় সাইপ্রাস।
সাইপ্রাসের আয়তন ও অবস্থান :-
বর্তমানে গ্রিক সভ্যতার দেশটিতে উত্তর এবং দক্ষিণ দুটি প্রদেশে বিভক্ত হয়ে যাওয়ার কারণে তুর্কি অধ্যুষিত অঞ্চলকে নর্থ বা উত্তর বা তুর্কি সাইপ্রাস বলা হয়। আর গ্রিক অধ্যুষিত অঞ্চলকে দক্ষিণ বা ইউরোপ সাইপ্রাস বলা হয়। দেশটির অবস্থান সম্পর্কে ক্ষুদ্র তথ্যচিত্র:-
আয়তন : ৯ হাজার ২৫১ বর্গ কিলোমিটার। তুরস্কের মূল ভূখন্ড থেকে ৯০কি.মি.,গ্রিসের মূল ভূখন্ড থেকে ৯০০ কি.মি. দূরে অবস্থিত।
জনসংখ্যা : ১১ লাখ ৮৯ হাজার।
আদি বসতি : খ্রিস্টপূর্ব ১০ সহস্রাব্দ।
জাতিগত গোষ্ঠি : গ্রিক সাইপ্রিয়ট, তুর্কি সাইপ্রিয়ট ও আর্মেনিয়।
ব্রিটেন থেকে স্বাধীনতা লাভ : ১৯৬০ সাল
বিভক্তি : ১৯৭৫
ধর্ম : ৭০ শতাংশ খ্রিস্টান, ২০ শতাংশ মুসলিম, বাকিরা অন্যান্য ধর্মাবলম্বী।
রাষ্ট্রভাষা : গ্রিক ও তার্কিশ। তবে ইংরেজি ভাষাও ব্যাপক মাত্রায় পরিচিত।
রাষ্ট্রধর্ম : সাইপ্রিয়ট অর্থোডক্স চার্চ।
রাজধানী : নিকোসিয়া
মুদ্রা : দক্ষিণ সাইপ্রাসে ইউরো, উত্তর সাইপ্রাসে তুর্কি লিরা।
আয়ের উৎস : পর্যটন ও কৃষিকাজ।
সাইপ্রাসের ঐতিহাসিক গুরুত্বঃ-
• রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সাইপ্রাস হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য নিয়ন্ত্রণের অন্যতম প্রধান মাধ্যম।
• ভৌগোলিকভাবে এবং কৌশলগত দিক দিয়ে সাইপ্রাস হচ্ছে ভূমধ্যসাগরের প্রাণকেন্দ্র ।
• সামরিক দিক দিয়ে সাইপ্রাস হচ্ছে ভূমধ্যসাগরে ভাসমান এক প্রাকৃতিক রণতরী।
ভৌগোলিক এবং কৌশলগত দিক দিয়ে সাইপ্রাসের গুরুত্ব অপরিসীম। সাইপ্রাসের চারদিকে মুসলিম দেশসমূহ অবস্থিত হওয়ার কারণে এর গুরুত্ব এমনিতেই বৃদ্ধি পেয়ে যায়।
সাইপ্রাস দেশটি দুই বৃহৎ প্রতিবেশীর দ্বন্দ্বের জেরে বিভক্ত হয় স্বাধীনতা লাভের মাত্র ১৫ বছরের মাথায়। অনেক চেষ্টায়ও সেই ভাঙন আর জোরা লাগেনি। তুরস্ক ও গ্রিসের বিরোধের মধ্যে পড়ে সাইপ্রাস দ্বীপ এখন পৃথক দুটি রাষ্ট্র। দুই ভাগে বিভক্ত হওয়ার কারণে বিভক্ত জনগোষ্ঠীর উত্তর প্রদেশে ২৬৪,১৭২ বা ২৫.৩% লোক মুসলিম বা ইসলামের অনুসারী। এছাড়া দক্ষিণ প্রদেশে মুসলিম জনগোষ্ঠীর হার ১.৮% (২০১১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী)। দক্ষিণ প্রদেশের মুসলিমরা বহিরাগত বা অন্য দেশ থেকে আগত।
তুর্কি সাইপ্রিয় সমাজে মুসলিম সংখ্যা বেশি হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ; বিশ্বাসটির অনুগামীরা বেশিরভাগ সুন্নি সম্প্রদায়ের সাথে সম্মত, এর সাথে সাথে সুফিবাদের একটি প্রভাবশালী প্রবাহের সাথেও তাদের আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য এবং বিকাশ অন্তর্ভুক্ত আছে।
ইতিহাসে আরব বিজয়ের শুরুতেই ইসলাম সাইপ্রাসে এসেছিল। ঐতিহাসিকভাবে সাইপ্রাসের সাথে মুসলিমদের সম্পৃক্ততা ছিল ইসলামের তৃতীয় খলিফা উসমান (রা.)-এর সময়ে মুসলমানগণ সর্বপ্রথম সাইপ্রাসের মাটিতে পা রাখেন। এরপর উমাইয়াদের শাসন আমলে উমাইয়াগণ সাইপ্রাস মুসলিম খিলাফতের অন্তর্ভুক্ত করেন। যদিও স্থায়ী উপস্থিতি কেবল ১৫৭১ সালের উসমানীয়দের বিজয়ের পর দেখা গিয়েছিল। এর আগে, ভ্রমণপথ হিসাবে দ্বীপটিতে মুসলমানদের উপস্থিতি ছিল। উসমানীয় ভুট্টা পদ্ধতি দ্বারা নির্ধারিত কর হিসাবে রাষ্ট্রীয়ভাবে করের স্থিতির জন্য গ্রীক অর্থোডক্স জনসংখ্যার একটি ছোট অংশের সাথে দ্বীপের বেশিরভাগ ক্যাথলিক লাতিন জনগোষ্ঠীর লোক ইসলাম গ্রহণ করে, কিন্তু তা বাধ্যতামূলক ছিল না। এই কর ব্যবস্থার জন্য একটি সামান্য অর্থ প্রদানের প্রয়োজন ছিল এবং এর বিনিময়ে নাগরিকরা রাজ্য থেকে সুরক্ষা এবং অন্যান্য সুবিধাও পেত। ১৯৭৪ সালে সাইপ্রাসে তুর্কি আক্রমণের আগে তুর্কি সাইপ্রিয়রা (সাইপ্রাসের মুসলিম সম্প্রদায়) দ্বীপটির জনসংখ্যার ১৮% পুরো দ্বীপ জুড়ে বসবাস করত। বর্তমানে, আনুমানিক ২৬৪,১৭২ জন মুসলমানের বেশিরভাগই দ্বীপটির উত্তরে অবস্থান করছে। যারা প্রায় সবাই সুন্নি মুসলমান।
তুর্কি সাইপ্রাসে নকশবন্দী-হাক্কানী তরিকার নেতা নাজিম আল-কুবরুসী লারকানা থেকে এসেছিলেন এবং লেফকার বাসিন্দা ছিলেন। তুর্কি সাইপ্রিয় মুসলমানদের মধ্যে আরেকটি শাখা হ’ল আলেভিজম। দেশটিতে কিছু আহমদীয়া মুসলমান রয়েছেন।
সাইপ্রাসে ইসলামের আগমন :-
▪️প্রাথমিক অবস্থা :-
ইসলামের শুরু থেকেই মুসলিমদের কাছে সাইপ্রাসের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। কারণ অঞ্চলটির সাথে নবী সা. এর আপনজনদের গভীর সম্পর্ক ছিল। ইসলাম আসার আগে বাইজান্টাইনরা অঞ্চলটি শাসন করতো। তখন রাজধানী ছিল কনস্টান্টিনোপল বা ইস্তাম্বুল। এ অঞ্চলটি বিজয়ে হাদিসের অমীয় বাণী শুনে ছুটে এসেছিল অনেক সাহাবী ই। তারা ইস্তাম্বুলের দিকে আসতে শুরু করেন। উসমান রা. এর সময়ে সিরিয়ার গভর্ণর ছিলেন আবু সুফিয়ান ইবনে মুয়াবিয়া রা.। তিনি ২৮ হিজরি তথা ৬৫৯ খ্রি. “কুবরুচ” দ্বীপে সামরিক অভিযান পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নেন। সঙ্গে নেতৃত্ব দেন উবাদাহ ইবনে সামিত, মিকদাদ ইবনে আসওয়াদ, আবু আইয়ুব আনসারি ও আবু জর গিফারি ও অন্যান্য আরো সাহাবী।তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন নবী সা. এর খালা উম্মে হারাম বিনতে মালহাম। তিনি যেমন নবী সা. কে যত্ন, ভালোবাসতেন, নবী সা. ও তাকে অতি সম্মান করতেন। অভিযানে তিনি তার স্বামী উবাদাহ ইবনে সামিতের সাথে অংশগ্রহণ করেন। আক্রা থেকে ভূমধ্যসাগরের জলপথ চিড়ে নৌবাহিনীটি যখন সাইপ্রাস অবরোধ করল, শীত তখন শেষ দিকে। বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের অংশ সাইপ্রাস। স্বাভাবিকভাবেই সেখানকার সেনাবাহিনীর অপেক্ষায় ছিল নাগরিকরা। কোনো প্রকার সাহায্য না পেয়ে অবশেষে চুক্তি করল আরব বাহিনীর সঙ্গে। মুসলিম বাহিনী তাদের সার্বিক নিরাপত্তা দেবে। বিপরীতে বছরে ৭ হাজার ২০০ দিনার ট্যাক্স প্রদান করবে সাইপ্রাস। অবগত করবে বাইজেন্টাইন বাহিনীর পরবর্তী তৎপরতা। যদি কোনোভাবে বাইজেন্টাইন বাহিনী আক্রমণ করেও বসে, তাদের সহযোগিতা করবে না। ৬৪৯ সালে এভাবেই নৌবহরের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো ভূমধ্যসাগরের কোনো অংশ মুসলিম নিয়ন্ত্রণে এল। যাইহোক অভিযানের শেষে উম্মে হারাম তার সওয়ারীর পিঠ থেকে পড়ে গিয়ে আহত এবং পরে নিহত হন। তাকে সেই দ্বীপের লারকানা অঞ্চলে দাফন করা হয়। পরবর্তীতে তার কবরের পাশে একটি মসজিদ নির্মান করা হয় যার নাম খালা সুলতান মসজিদ। মসজিদটি গ্রিক সাইপ্রাসের মধ্যে অবস্থিত।
খলিফা উসমানকে রাজি করা সহজ ছিল না। আসলে নদী ও সমুদ্রের সঙ্গে আরবদের সম্পর্ক অতটা ভালো ছিল না। প্রয়োজনও পড়েনি কখনো। ইয়ামেন থেকে সিরিয়া পর্যন্ত দীর্ঘ স্থলপথ তখন বাণিজ্যিক যোগাযোগের জন্য যথেষ্ট। উটের কাফেলা ভারত মহাসাগরের বন্দর থেকে পণ্য নিয়ে শামের বন্দরে খালাস করত জলপথের ঝামেলা ব্যতিরেকেই। যাত্রাপথের সুবিধার জন্য গড়ে উঠেছিল গোত্রীয় মৈত্রী। এভাবে ব্যবসা করেই প্রভূত সম্পদ জমিয়েছিলেন মক্কার অভিজাতরা। খুব অল্প মানুষ আবিসিনিয়া কিংবা সিন্ধু অঞ্চলের সঙ্গে বাণিজ্যের সুবাদে সমুদ্র ভ্রমণের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। দৃশ্যের পরিবর্তন ঘটে ইসলামের আগমনে। নবি কেবল সমুদ্র অভিযানে উৎসাহই দেননি; ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন কয়েকটি অভিযান সম্পর্কে। ফলে মুসলিম শিবিরে নৌবহর নিয়ে বাড়তি আগ্রহ ছিল। বাইজেন্টাইন সম্রাটের নজরকাড়া নৌবহর। তাদের সঙ্গে টক্কর দিতে চাইলে ভূমধ্যসাগর অঞ্চলে নৌবহর ছাড়া সম্ভব না। বিষয়টা সবার আগে টের পান শামের গভর্নর মুয়াবিয়া। খলিফা উমরের আমলে তিনি কয়েক দফা চেষ্টা করেছেন নৌবাহিনী প্রতিষ্ঠার। সফল হননি। সম্প্রসারণশীল ছোট মুসলিম বাহিনীকে সমুদ্রে পাঠানোটা ঝুঁকিপূর্ণ মনে করতেন খলিফা উমর। যথেষ্ট কারণও ছিল ভাবার পেছনে। প্রথমত, আরবদের সমুদ্রকেন্দ্রিক অভিজ্ঞতার ঘাটতি। দ্বিতীয়ত, বাহরাইনের গভর্নর আল-আলা আল-হাদরামির সময়ে পারস্য উপসাগরে নৌ-অভিযানের প্রচেষ্টায় ব্যর্থতা। খলিফা উমরের পর দায়িত্ব গ্রহণ করেন উসমান। এ সময় পুনরায় নৌবাহিনী প্রতিষ্ঠার প্রসঙ্গ নিয়ে হাজির হন মুয়াবিয়া। প্রথম দিকে অস্বীকার করলেও শেষ পর্যন্ত সাইপ্রাস অভিযানের অনুমতি দেন খলিফা। ৬৪৯ সালের সফল অভিযান আরব সাম্রাজ্যের জন্য সমুদ্রপথকে নতুন মাত্রা হিসেবে যুক্ত করে। সিরিয়ার দায়িত্বে থাকা মুয়াবিয়া ভূমধ্যসাগরকেন্দ্রিক রাজনীতি বুঝতে দেরি করেননি। ফলে সাইপ্রাসের চুক্তি তাকে নতুনভাবে পরিকল্পনা চালাতে অনুপ্রাণিত করে। তার নজির দেখা যায় ৬৫৪ সালে। মুসলমানরা একদিক থেকে ভূমধ্যসাগারের পূর্ব ও দক্ষিণ পাশে ছড়িয়ে পড়ছে। ভূখণ্ডের অধিকাংশই আগে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের অধিভুক্ত ছিল। অল্প অল্প করে উত্তর আফ্রিকা ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলগুলোকে হাতছাড়া হতে দেখে টনক নড়ে সম্রাট হেরাক্লিয়াসের। হারানো অংশকে উদ্ধার করতে আলেকজান্দ্রিয়ার উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন ৫০০-৬০০ রণতরী। অভিযানের গুঞ্জন শুনেই নড়েচড়ে বসেন মুসলিম জাহানের খলিফা। বাইজেন্টাইন বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে একত্র হন দুই নৌ কমান্ডার। প্রথমজন মিসরের নৌবহরের প্রধান আবদুল্লাহ ইবনে সাদ, দ্বিতীয়জন শামের নৌবহরের প্রধান বিসর ইবনে আরতাহ। ক্রমেই অনিবার্য হয়ে উঠতে থাকে সংঘর্ষ। আলেকজান্দ্রিয়ার পশ্চিমে মারসি মাতরুহ শহরে মুখোমুখি হয় বাইজেন্টাইন ও আরব শিবির। মুসলিম বাহিনীর নেতৃত্বে তখন আমর ইবনে সুফিয়ান। বাইজেন্টাইন বাহিনী নৌযুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরেই পারদর্শী। বিপরীতে আরবরা স্থলপথে পারসিক ও বাইজেন্টাইন পরাশক্তিকে দাপটের সঙ্গে পরাজিত করতে পারলেও সমুদ্রযাত্রায় ছিল অনভ্যস্ত। সৈন্যের সংখ্যায়ও এগিয়ে ছিল বাইজেন্টাইন। ফলে বিজয় প্রায় অনুমান করেই রেখেছিল তারা। অথচ বিজয় ধরা দেয় আরবদের হাতে। অপ্রস্তুত বাইজেন্টাইন শিবির পরাজয় নিশ্চিত জেনে সিসিলিতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। সে সূত্র ধরেই সিসিলি অধিকার করে নেয় মুসলিম বাহিনী। তারপর সময়ের ব্যবধানে মুসলিম আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয় সাইপ্রাস, ক্রিট, কর্সিকা ও সার্দিনিয়ায়। মুসলিম ঐতিহাসিকরা একে লিপিবদ্ধ করেছেন ‘জাত আস-সাওয়ারি’ যুদ্ধ নামে।
উমাইয়া শাসনকে মনে করা হয় মুসলিম আধিপত্যের বিস্তারের যুগ। তার প্রমাণ দেখা যায় নৌবাহিনীর উত্থানে। সে সময় প্রাচ্যের সঙ্গে সম্পর্ক, যোগাযোগ ও অভিযান পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে কাজ করেছে আল-উবুল্লা, বাহরাইন, বসরা, দিব্বা, দেবল, জুলফার, মাকরান, রিশার ও সোহারের মতো বন্দর। একইভাবে পশ্চিম দিকে আধিপত্য বিস্তারের নিমিত্তে সরব ছিল আক্রা, আইলা, আসকালান, বৈরুত, সাইপ্রাস, জাফা, সুর ও তিউনিসের মতো বন্দরগুলো। গড়ে উঠেছে জাহাজ নির্মাণ কেন্দ্র, পরিচালনা দপ্তর এবং নৌযুদ্ধের প্রয়োজনে সামরিক দুর্গ। প্রায় শূন্য থেকে গড়ে ওঠা নৌবাহিনী ক্রমেই ভূমধ্যসাগরে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছে। স্থলে প্রতাপশালী আরবরা জলেও পরিণত হয়েছে পরাশক্তিতে। রাজধানী সিরিয়া থেকে উমাইয়া শাসনের সমাপ্তি ঘটে ৭৫০ সালে। কিন্তু নৌবাহিনীতে তাদের যে অবদান তার ফলাফল আস্বাদন করেছে পরবর্তী মুসলিম পরাশক্তিগুলো। ভূমধ্যসাগরের পূর্বতীরে আব্বাসীয় শাসন, আফ্রিকায় আগলাবি শাসন, আন্দালুসিয়ায় উমাইয়া শাসন এবং তুরস্কে উসমানি শাসনে বিস্তৃত করেছে সেই ঐতিহ্য।
উসমানী খেলাফতের সাইপ্রাস বিজয় থেকে গত এক শতাব্দীর একমাত্র উদ্ধারকৃত ভূমি; সাইপ্রাস
▪️অতীত থেকে বর্তমান
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৩শ শতাব্দীর শেষ দিকে ক্যাথলিক জেনসি (Catholic Genoese)-রা সাইপ্রাসে আগমন করে। ইউরোপ সেসময় নৌশক্তিতে শক্তি অর্জন করতে শুরু করেছিল মাত্র। ইউরোপীয়ানরা বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছিল। সেই প্রেক্ষিতেই তাদের আগমন সাইপ্রাসে। তাদের পরপরই ভেনেটিয়ান্সরা সাইপ্রাসে আসে। ভেনেটিয়ান্সরা নৌশক্তিতে ব্যাপক উন্নতি সাধন করে তৎকালীন সময়ে। ১৪শ থেকে ১৬শ শতাব্দীতে তারা নৌবাহিনী গঠন করে এবং নৌশক্তিতে পারদর্শিতা অর্জন করে নেয় খুব অল্প সময়ের মধ্যে। এবার তারা পুরো ভূমধ্যসাগরকে তাদের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার প্রচেষ্টা চালায়। সাইপ্রাসে ওরা ধীরে ধীরে শক্ত ভিত গড়ে তোলে। সাইপ্রাসকে কেন্দ্র করেই ভূমধ্যসাগর নিয়ন্ত্রণ করতে সবধরণের প্রচেষ্টা পরিচালনা করে। ক্যাথলিকরা সাইপ্রাসের চালকের আসনে থাকায় সেখানে অবস্থিত অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের উপর চরম জুলুম নির্যাতন পরিচালনা করতে থাকে। অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের উপর ক্যাথলিকদের এ নির্যাতন ৩০০ বছরের অধিক সময় ধরে অব্যাহত ছিল।
তৎকালীন সময়ে বিশ্বের চালকের আসনে অবস্থান করছিল উসমানী সালতানাত। সমগ্র বিশ্বের কাছে মানবতার ত্রাণকর্তা হিসেবে একটি ভাবমূর্তি ছিল উসমানীয়দের। তারা যেখানেই পদার্পণ করেছে সেখানেই ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল। ইসলামের উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানুষের প্রতি ইনসাফ করা, সমাজ এবং বিশ্বে মজলুমের পাশে দাঁড়ানো, জুলুমকে সমূলে মূলোৎপাটন করা। আনাতোলিয়ার ঠিক পাশেই। এরকম একটি অঞ্চলে মজলুম মানুষের উপর অকথ্য নির্যাতনে উসমানীগণ । অস্বস্তি অনুভব করেন। আর অন্যান্য অঞ্চলের মতো সাইপ্রাসের জনগণও উসমানীদের নিয়ন্ত্রণে শান্তিতে থাকার জন্য উদগ্রীব ছিল। উসমানীগণ সাইপ্রাসকে জালিমের করতল থেকে মুক্ত করার জন্য অভিযান পরিচালনা করতে চান। কিন্তু সাইপ্রাস রোমানদের সাথে সম্পৃক্ত থাকার কারণে সে অঞ্চলে হঠাৎ করে হামলা করার অর্থ হচ্ছে পুরো রোমান বিশ্বকে যুদ্ধের জন্য ডেকে আনা। সাইপ্রাসের ভেনেটিয়ান্সরা ভূমধ্যসাগরে উসমানীদের জন্য মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দস্যুতা, হজযাত্রী এবং বণিকদের পথ রুদ্ধ করে লুণ্ঠন করার কারণে এবার আর দেরি না করেই উসমানীরা আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। ১৫৭০ সালে লালা মুস্তফা পাশার নেতৃত্বে সাইপ্রাস অভিযান পরিচালনা করা হয়। তিনি সাইপ্রাসে দূত প্রেরণ করে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানান। কিন্তু ভেনিস ও সাইপ্রাসে নিযুক্ত তাদের শাসক সুলতানের বার্তা অবজ্ঞাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ সাইপ্রাসের নিরাপত্তাব্যবস্থা ও অফুরন্ত খাদ্যভাণ্ডার তাদের অহংকারী করে তুলেছিল।
নিকোসিয়া শহরকে সাইপ্রাসের রাজধানী নির্ধারণ করে নিকোলাস ডান্ডোলোকে এবং বন্দরনগরী ফার্মাগুস্তায় মার্ক এন্তোনিও ব্রাগাদিনকে শাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তারা ভেনিসকে সাইপ্রাস রক্ষার অভয় দেয়। একই সঙ্গে ইউরোপের খ্রিস্টান শাসকদের ‘দ্য হলি লিগ’ ছিল তাদের ভরসার আরেকটি জায়গা। সুলতান দ্বিতীয় সেলিম সাইপ্রাস অভিযানের সব আয়োজন সম্পন্ন করেন। লালা মোস্তফা পাশাকে তিনি এই অভিযানের দায়িত্ব দেন। অন্যদিকে মুসলিম অভিযানের সংবাদে ইহুদি, গ্রিক ও খ্রিস্টানদের একাংশ তুর্কিদের পক্ষে সংগঠিত হয়।
১৫৭০-এর সেপ্টেম্বরে লালা মোস্তফা পাশা নিকোসিয়ায় আত্মসমর্পণের বার্তা পাঠান। কিন্তু উত্তরে তারা আবারও ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে। ফলে তুর্কি বাহিনীর সামনে যুদ্ধ ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকল না। সুলতানের বাহিনী সাইপ্রাসের মাটিতে গোলাবারুদ নিক্ষেপ শুরু করে। দুর্গের ভেতর থেকে আত্মরক্ষার চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত নিকোসিয়ার পতন হয়। ৯ সেপ্টেম্বর একপ্রকার বিনা বাধায় ক্যারেন শহর জয় করে মুসলিম বাহিনী।
১৫ সেপ্টেম্বর বন্দরনগরী ফার্মাগুস্তায় পৌঁছে যায় লালা মোস্তফার বাহিনী। তারা ব্রাগাদিনকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানায়। কিন্তু সে তা প্রত্যাখ্যান করলে লালা মোস্তফা দুর্গ অবরোধ করেন। পাঁচটি গেট, ১৫টি বুরুজ এবং দুর্গের চারপাশের গভীর পরিখা—সব মিলিয়ে নিরাপত্তাব্যবস্থা বেশ মজবুত ছিল। তারপর মুসলিম অভিযান শুরু হওয়ার পর নিরাপত্তাব্যবস্থা আরো জোরদার করা হয়।
লালা মোস্তফা চাইছিলেন অবরোধের অবকাশে আহত সৈন্যরা বিশ্রাম পাক এবং নতুন সৈন্য আসুক। আর ব্রাগাদিন অপেক্ষা করছিল ‘দ্য হলি লিগ’-এর সম্মিলিত বাহিনীর জাহাজের। কিন্তু তুর্কি বাহিনীর জয়যাত্রা ও বিক্রমের কারণে বেশির ভাগ ইউরোপীয় শাসক যুদ্ধে যোগদানে সম্মত হচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত কয়েকটি জাহাজ ও ১৭০০ সৈন্যের বহর নিয়ে ক্রিট থেকে যাত্রা করেন জেনারেল মার্ক কুরিনি। কিন্তু তিনি সম্মুখ আক্রমণে না গিয়ে তিনটি জাহাজ দিয়ে তুর্কিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন আর অন্য জাহাজগুলো বিক্ষিপ্তভাবে তুর্কি জাহাজগুলোর ওপর আকস্মিক আক্রমণ শুরু করে। তিন সপ্তাহ পর তারা ফিরে যায়।
দীর্ঘ অপেক্ষার পর এপ্রিলে নতুন তুর্কি সৈন্যরা সাইপ্রাসে এলে লালা মোস্তফা সর্বাত্মক আক্রমণ শুরু করেন। তবে চূড়ান্ত হামলার পূর্বে ব্রাগাদিনকে আবারও আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু ব্রাগাদিন তা প্রত্যাখ্যান করে। জুনের শেষ সপ্তাহে দুর্গের দেয়ালের একাংশ ধসে পড়ে। আবার দুর্গে তীব্র খাদ্যসংকট তৈরি হয়। ফলে জনসাধারণের পক্ষ থেকে আত্মসমর্পণের চাপ আসতে থাকে। ১৫৭১ সালের ১ আগস্ট ব্রাগাদিন আত্মসমর্পণে সম্মত হয়। ৫ আগস্ট সে শহর ও দুর্গের চাবি লালা মোস্তফার হাতে তুলে দেয়। এ সময় প্রকাশ পায়, ব্রাগাদিন বন্দি হজযাত্রীদের হত্যা করেছে। তখন জিম্মি হত্যার দায়ে ব্রাগাদিন শাস্তির মুখোমুখি হয়।
প্রায় ৪০ হাজার শহীদের রক্তের বিনিময়ে সমগ্র সাইপ্রাসকে জালিমের হাত থেকে মুক্ত করতে সক্ষম হন উসমানীগণ। সেই সাথে উক্ত অঞ্চলের মানুষের অধিকার নিশ্চিত ও শান্তি-শৃংখলাও প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। এরপর থেকে ৩০৮ বছর দ্বীপের মধ্যে বসবাসকারী অর্থোডক্স খ্রিস্টান, মুসলিম এবং ক্যাথলিকসহ অন্যান্যরা শান্তিতে বসবাস করছিল। প্রায় ৩০০ বছর সাইপ্রাস ছিল উসমানীয়দের গুরুত্বপূর্ণ নৌ-ঘাঁটি। এটাকে ব্যবহার করে পুরো ইজিয়ান সাগর এবং ভূমধ্যসাগরে একক কর্তৃত্ব বিস্তার করতে সক্ষম হয় উসমানীয়রা। শতাব্দী অতিবাহিত হওয়ার পর উসমানী সাম্রাজ্য তখন বহির্শক্তির আক্রমণে নাজেহাল। ইউরোপের একের পর এক অংশ উসমানীদের হাতছাড়া হচ্ছিল। এরই মধ্যে ইহুদীরা তাদের প্রতিশ্রুত ভূমি তথা Promised Land প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরিকল্পনা মাফিক অগ্রসর হতে থাকে। প্রতিশ্রুত ভূমি রক্ষার জন্য সবচেয়ে বড় বাধা ছিল উসমানীয়রা। তাই তাদেরকে ধ্বংস করার জন্য বিভিন্ন ধরনের বাহানায় ইউরোপের সাথে একের পর এক যুদ্ধ সংগঠিত করতে থাকে।
১৮৭৭-৭৮ সালের দিকে রাশিয়ার সাথে যুদ্ধে উসমানীয়রা পরাজিত হলে বার্লিন চুক্তির মাধ্যমে উসমানীয়রা এই সাইপ্রাসকে ব্রিটেনের হাতে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। তখন কথা ছিল রাশিয়ার হাত থেকে উসমানীয়রা মুক্ত হলেই ব্রিটেন সাইপ্রাসকে উসমানীয়দের কাছে ফেরত দিবে। কিন্তু তারপর ভেতরে ঘটে যায় নানা ঘটনা এবং উসমানীয়রা কোনভাবেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে পারেনি। উসমানীয়দের দুর্বলতার সুযোগে বৃটিশরা দ্বীপের জনসংখ্যা কাঠামো পরিবর্তনের চেষ্টা চালায়। তারা পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করা রোমানদের সে অঞ্চল থেকে সাইপ্রাসে স্থানান্তর করতে থাকে, যেভাবে তারা ইহুদীদেরকে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নিয়ে এসে ফিলিস্তিনের মাটিতে একত্রিত করেছিল। রোমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় দ্বীপের জনসংখ্যার ভারসাম্য নষ্ট হয় এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও ধর্মীয় বিভেদ পুনরায় উঁসকে দেয়ার কারণে রোমানরা দ্বীপে অবস্থিত তার্কিশ বংশোদ্ভূত এবং সেখানে অবস্থানরত মুসলিমদের উপর নির্যাতন চালাতে থাকে। বিভিন্ন ধরনের সংঘাত সৃষ্টি করে মুসলিমদের উপর গণহত্যা চালাতে থাকে। সাইপ্রাসের শাসনভার বৃটিশদের হাতে দেয়ার পর, ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উসমানীয়রা পরাজিত হয় এবং ব্রিটেন সাইপ্রাসকে পুরোপুরি দখল করে নেয় এবং তারা সাইপ্রাসকে যুক্তরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। নতুন তুর্কি রাষ্ট্র গঠনের ১৯২৩ সালে লুজান চুক্তির মাধ্যমে তুরস্ক সাইপ্রাসের ব্রিটেনের এই দখলদারিত্ব আনুষ্ঠানিকভাবে মেনে নেয়। তবে শর্ত থাকে সেখানে থাকা মুসলমানদের তথা তুর্কীদের উপরে কোন প্রকার জুলুম নির্যাতন করা যাবে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেন যখন বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হাত গুটিয়ে নেয় তখন এই সাইপ্রাস থেকেও চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয় তারা। এরপর ১৯২৫ সালে উসমানী খিলাফতের পতনের পর সাইপ্রাসকে একটি Crown Colony তে পরিণত করা হয়। সে সময় সাইপ্রাসের নেতৃত্ব এবং রাষ্ট্র কাঠামো নিয়ে আলোচনা চলে ব্রিটিশ – গ্রিস এবং তুরস্কের মধ্যে। বহুবার বৈঠকের পর বৈঠক আলোচনা হয়। এরকম ভাবে অনেক বৈঠক এবং আলোচনার পর অবশেষে ১৯৫৯-৬০ সালে এসে সাইপ্রাসে বসবাসকারী গ্রীক এবং তুর্কি অর্থাৎ মুসলমান এবং খ্রিস্টানদের মধ্যে সমঝোতা করে “রিপাবলিক অফ সাইপ্রাস” রাষ্ট্র গঠন করা হয়। তখন সাইপ্রাসের মোট জনসংখ্যার মোটামুটি ৭০% ছিল খ্রিস্টান এবং ৩০% ছিল মুসলমান তুর্কি। প্রজাতন্ত্র গঠনের পর থেকেই বিভিন্ন ধরনের আন্তঃসংঘাতের অজুহাতে মুসলিমদের হত্যা করা হতে থাকে। বারবার কোনো না কোনোভাবেই এক ধরনের সংঘাতের সৃষ্টি করা হতো এবং দিনশেষে মুসলিমদের হত্যা করা হতো। এসবের অজুহাতে ১৯৬৩ সালে সাইপ্রাসের সরকার কর্তৃক মুসলিমদের উপর গণহত্যা পরিচালিত হয়। কিন্তু তুরস্কের সরকার শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। সর্বোচ্চ ভাষণ এবং বিবৃতির মাধ্যমে নিজেদের দায়িত্ব পালন করেছে। ক্ষমতায় ছিলেন CHP এর প্রধান ইসমত ইনোনু। তিনি কয়েকটি টহল বিমান পাঠিয়েই অর্পিত দায়িত্ব সম্পন্ন হয়েছে বলে মনে। করেছেন। টহল বিমানের হুমকি দিয়ে হত্যাযজ্ঞ কিছুটা বন্ধ করা গেলেও সুদূরপ্রসারী কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি তার পক্ষ থেকে।
ফলস্বরূপ মুসলিমদের উপর হত্যা, নির্যাতন সংগঠিত হতে থাকে। ইসমত ইনোনুর পর এবার ক্ষমতায় আসেন ইসলামপ্রিয় সেক্যুলার নেতা সুলেয়মান দেমিরেল। পূর্বেই উল্লেখ করেছি, তিনি তুরস্কের জনগণের নিকট ইসলামের মহান সেবক হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। তিনি টহলের জন্য হলেও অন্ততপক্ষে একটি বিমান পর্যন্তও পাঠাননি। কিন্তু সংসদ এবং জনগণের সামনে সাইপ্রাসের মুসলিমদের পক্ষে জোরালো বক্তব্য প্রদান করে জনগণের সমর্থন আদায় করে নিয়েছিলেন। মুখে ব্যাপক কথা বললেও কাজের বেলায় অশ্বডিম্ব হিসেবে দেখা গিয়েছে সুলেয়মান দেমিরেলকে। ১৯৬৭ সালে আবারও মুসলিমদের উপর গণহত্যা চালানো হয়। সুলেয়মান দেমিরেল পূর্বের মতোই বক্তব্য প্রদান করছিলেন পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে। জনগণও তার বক্তব্যে বিভোর হয়ে যেত। তিনি কিছু ত্রাণ সামগ্রী পাঠাতেন। তুরস্কের মানুষ এটাতেই সন্তুষ্ট ছিল। এবার তিনি জোরালোভাবে বলেন, “আমরা সেনাবাহিনী পাঠাচ্ছি মুসলিমদের উদ্ধারের জন্য”। তুরস্কের মানুষ একথা শোনা মাত্রই তাকে আবারও ইসলামের ত্রাণকর্তা উপাধি দিতে থাকে। সাইপ্রাসের মুসলিমরা অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে অপেক্ষায় থাকে। সেনাবাহিনী জাহাজ প্রস্তুত করে অভিযান শুরু করতে যাবে, ঠিক এসময়েই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জনসনের চিঠি এসে হাজির সুলেয়মান দেমিরেলের টেবিলে । তিনি সাথে সাথেই আর্মিকে নির্দেশ দেন, “আপনারা ফিরে আসুন” । এভাবে দুবার জনগণকে দেখানোর উদ্দেশ্যে আর্মি পাঠানোর ঘোষণা দিয়ে আর্মিকে মাঝপথ থেকে ফিরিয়ে আনেন সুলেয়মান দেমিরেল শুধুমাত্র তার প্রভু আমেরিকার নির্দেশে।
বিজয়াভিযান ১৯৬০ সালে সাইপ্রাসকে প্রজাতন্ত্র ঘোষণার পর থেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন মাকারস। তার আমলেই দুবার গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে মুসলিমদের উপর। নির্যাতন তো অব্যাহত ছিলই। ১৫ জুলাই, ১৯৭৪ সালে সাইপ্রাসের ক্ষমতাসীন মাকারসের বিরুদ্ধে ক্যু করে Eska এর নেতা স্যাম্পসন। ক্ষমতা হাতে নেয়ার পর থেকেই সে পুরো সাইপ্রাসকে গ্রীসের সাথে অন্তর্ভুক্তকরণের ঘোষণা দেয়। সে লক্ষ্যে মুসলিম জনসংখ্যা কমানোর উদ্দেশ্যে আবারও গণহত্যা শুরু করে ।
তবে এবার তুরস্কের ক্ষমতায় বামপন্থী সেক্যুলার CHP ও ইসলামী আন্দোলন মিল্লি গরুশের রাজনৈতিক দল মিল্লি সালামেত পার্টি (MSP) এবং ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান। ক্ষমতায় আসার পূর্ব থেকেই প্রফেসর এরবাকানের লক্ষ্য করছিলেন সাইপ্রাস তখনও অশান্ত এক নগরী। বলা যায়, অনেকাংশে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছিল এ নগরী। ১৯৭৪ সালে CHP এর সাথে কোয়ালিশন করে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই পরিস্থিতি পরিবর্তন হতে শুরু করে। এসময় বিরোধীদলে অবস্থানরত তথাকথিত ইসলামপ্রিয় সেক্যুলার নেতা সুলেয়মান দেমিরেল সরকারের তুমুল সমালোচনা করছিলেন। সেই সাথে বামপন্থীদের সাথে নাজমুদ্দিন এরবাকানের কোয়ালিশনকে নিজের মনগড়া ব্যাখ্যায় বিশ্লেষিত করছিলেন। তথাকথিত এই ইসলামের সেবকের এতো সমালোচনায় কান দেয়ার এবং তার সব কথার জবাব দেয়ার সময় ছিল না প্রফেসর এরবাকানের । যেখানে সাইপ্রাসের অবস্থা খুবই নাজুক।
Eska-এর নেতা স্যাম্পসন মুসলিমদের উপর ব্যাপকহারে গণহত্যা শুরু করার পূর্বেই তার ঘাড় মটকে দেয়ার ব্যবস্থা করেন ড.নাজমুদ্দিন এরবাকান । স্যাম্পসন ক্যু করে ক্ষমতায় আসে ১৫ জুলাই। আর তুরস্কের সেনাবাহিনী সাইপ্রাস আক্রমণ করে ২০ জুলাই আক্রমণের পরপরই ২৩ জুলাই তাকে ক্ষমতা থেকে নামতে বাধ্য করা হয় এবং সাইপ্রাসের উত্তর অংশকে স্বাধীন ঘোষণা করা হয় । সাইপ্রাসের বীর মুজাহিদ এবং তুরস্কের জানবায় যোদ্ধাদের সর্বোচ্চ নাজরানার বিনিময়েই আজকের সাইপ্রাস এতো শান্তিপূর্ণ ।
১৫ জুলাই, স্যাম্পসন ক্ষমতা গ্রহণের পর সাইপ্রাসের সংকটময় অবস্থার সমাধানের জন্য তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী বুলেন্ত এজেবিদ ইংল্যান্ড সফরের সিদ্ধান্ত নেন। ইংল্যান্ডে গিয়ে বুলেন্ত এজেবিদ যে সব দাবি উত্থাপন করবেন আর প্রতিউত্তরে ইংল্যান্ড কি বলবে সেটার কোনো নিশ্চয়তা নেই। যাওয়ার পূর্বে এজেবিদ তুরস্কের একটি শহর আফিয়োনে অবস্থান করছিলেন। সেখানে জরুরী ভিত্তিতে জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের এ বৈঠক ডাকা হয় এবং প্রফেসর এরবাকানের দৃঢ় ভূমিকায় পরিষদ এই সিদ্ধান্ত নেয় যে, “অবশ্যই হামলা করা জরুরী”। কিন্তু এরপরই CHP এর গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ বলে যে, “এটা একটি দুঃসাহসী কাজ হবে। সাবধান! এমন কোনো কাজ করবেন না। সাইপ্রাসে হামলা করা মানে সারা দুনিয়ার রোমানদের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া”। তাই মন্ত্রিপরিষদ এবং জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের কোথাও কোনো সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হননি প্রফেসর এরবাকান।
MSP এবং প্রফেসর এরবাকান শুরু থেকেই এজেবিদের ইংল্যান্ড সফরের বিরুদ্ধে ছিলেন। কারণ মুসলিমদের সকল সমস্যার ক্ষেত্রে ইংল্যান্ড মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে সময়ক্ষেপণ করাতো এবং প্রচণ্ড গড়িমসি করতো। আর এজেবিদ চাচ্ছিল ইংল্যান্ডের সাথে মিলিত অভিযান কারণ এতে করে সে পাশ্চাত্যের রোষানল থেকে বেঁচে যাবে। ইংল্যান্ডের সাথে যৌথ অভিযান পরোক্ষভাবে গ্রীসের পক্ষে যাবে এটা সহজেই অনুধাবন করা যাচ্ছিল। ইতিহাসে যারাই আমেরিকা বা পাশ্চাত্যকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে তাদের সাথে যৌথ অভিযান পরিচালনা করেছে তারা সর্বদা নিজেদেরই ক্ষতি সাধন করেছে এবং তাদের এই পদক্ষেপের নির্মম শিকার হতে হয়েছে মুসলিমদের। ইতিহাস থেকে শিক্ষা খুব কম মানুষই নেয়। উসমানীগণ কার্লোউইটজ চুক্তির পর থেকে ভূমি হারানো শুরু করে। দীর্ঘ ৩০০ বছর পর সাইপ্রাস শান্তি মিশনের মাধ্যমে তুরস্ক এই প্রথম বড় কোনো কৌশলগত বিজয় অর্জন করলো। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছিল যে- উসমানী খিলাফত ইংল্যান্ডের সাথে চুক্তি করেছিল সাইপ্রাস নিয়ে। সে হিসেবে তুরস্ক সাইপ্রাসের একমাত্র জামিনদার রাষ্ট্র ছিল । আর জামিনদার রাষ্ট্র হিসেবে অভিযান পরিচালনা করার একমাত্র অধিকার ছিল তুরস্কের। ইংল্যান্ডকে নিয়ে একত্রে অভিযানের কোনো মানে হয় না। তারপরও এজেবিদ ইংল্যান্ড যাবে।
যাই হোক, ১৬ জুলাই এজেবিদ ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করার পর রাষ্ট্রের ক্ষমতা প্রফেসর নাজমুদ্দিন এরবাকানের হাতে হস্তগত হয়। এজেবিদ যাত্রা করার পরপরই তৎক্ষণাৎ বিমানবন্দরেই তিনি সকল বাহিনীর প্রধানের সাথে সাক্ষাত করেন। তিনি তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, “স্যাম্পসন দ্বীপে ক্যু করেছে ঠিকই কিন্তু তাকে সবাই গ্রহণ করেনি। মাকারসের অনুগত সৈন্যবাহিনীর সাথে বিভিন্ন জায়গায় স্যাম্পসনের সংঘাত চলছে। তাই এই বিশৃংখলা থেকে আমাদের লাভবান হওয়ার সুযোগ আছে” ।
তিন বাহিনীর প্রধান একত্রে বলে ওঠেন, “আমাদের নিশ্চিত একটি আদেশের প্রয়োজন। কারণ এর পূর্বে আমরা দুবার অভিযান পরিচালনার জন্য বের হয়েছিলাম ঠিকই কিন্তু আমেরিকার চিঠির কারণে তৎকালীন সরকার আমাদের ফিরে আসতে বাধ্য করে। পূর্বে দুবার ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছি। আজ আপনি আমাদেরকে প্রস্তুতি নিয়ে অভিযান পরিচালনার কথা বলছেন। এখন অভিযান পরিচালনার পর যদি আমাদের সেনাবাহিনীকে ফিরে আসতে বলা হয় তাহলে কিন্তু আমাদের এই সেনাবাহিনী ভবিষ্যতে কোনো সময়ই সত্যিকারের কোনো অভিযান পরিচালনার ব্যাপারে বিশ্বাস করতে পারবে না। এ বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে এরপর আপনি সিদ্ধান্ত প্রদান করুন” ।
জবাবে এরবাকান বলেন, “আমি আপনাদেরকে সরকারিভাবে নির্দেশ প্রদান করলাম। কত দ্রুত সময়ের মধ্যে আপনারা সাইপ্রাসের কিরেনিয়া অভিমুখে যাত্রা করতে পারবেন?”
উত্তরে তারা বললেন, “আমাদের একদল সেনাবাহিনী ইসকেন্দেরিয়াতে অবস্থান করছে। কমান্ডোর একটি গ্রুপ সব রকমের অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে দ্বীপে পৌঁছাতে খুব তাড়াতাড়ি হলে ২০ জুলাই, সোমবার সকাল পর্যন্ত সময় লাগতে পারে”।
এজেবিদ ১৮ জুলাই তুরস্কে ফিরে আসার পূর্বেই যুদ্ধ জাহাজগুলো প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল। এরপরের দিন বন্দর থেকে ছেড়ে যাবে এরকম প্রস্তুতিতে উপনীত হয়েছিল। প্রফেসর এরবাকান চাচ্ছিলেন পূর্বে যেভাবে সেনাবাহিনীকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল, এবার যেন কোনোভাবেই এরকম না হয়। তাই তিন বাহিনী প্রধানকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী এজেবিদকে রাজি করানোর ব্যাপারে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কেননা, সে তখন প্রধানমন্ত্রী। এজেবিদ যদি ফিরে আসার নির্দেশ দেয় তাহলে সব প্রচেষ্টার উপর পানি ঢেলে দেয়া হবে । প্রফেসর এরবাকান বুলেন্ত এজেবিদকে বলেন, “জাহাজ যাত্রা করতে প্রস্তুত, সকল প্রকার প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। সেনাবাহিনী যুদ্ধের জন্য মুখিয়ে আছে। এ অবস্থায় কোনোভাবেই ফিরে আসা সম্ভব নয়। যুদ্ধে আমাদের অবতীর্ণ হতেই হবে। সেই সাথে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা এবং সদস্যগণ বলছেন, পূর্বের মতো যদি এবারও আমাদেরকে ফিরিয়ে আনা হয় তাহলে আমরা আর কখনোই সাইপ্রাসের জন্য কোনো অভিযানে বের হবো না”।
উদ্দেশ্য করে বলেন, “আমরা যদি যুদ্ধ শুরু করি, তাহলে এ যুদ্ধ কি অবস্থা বেগতিক দেখে শেষ পর্যন্ত এজেবিদ তিন বাহিনীর প্রধানকে চালিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য আমাদের আছে?”
প্রশ্নের জবাবে নৌবাহিনী প্রধান দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, “আমি কৃষ্ণ সাগরের সন্তান। একটি নৌকা হলেও তা দিয়ে আমি সাইপ্রাস যেতে পারবো”। তার এ কথায় সেনাবাহিনী প্রধান সেমিহ সানজারসহ অন্যান্য প্রধানদের চেহারার মধ্যে আত্মবিশ্বাসের বিদ্যুৎ খেলে যায়। তারা সকলেই জোর গলায় বলে ওঠেন, “অবশ্যই আমাদের এ অভিযান পরিচালনা করা প্রয়োজন” ।
উপরোক্ত অবস্থায় অধিকাংশ রাজনীতিবিদ এবং সংশয়বাদীরা খুবই আতংকিত হয়ে পড়েছিল। তারা পাশ্চাত্যের ভয়ে এতটাই কাবু ছিল যে, শেষ পর্যন্ত তারা একথা বলতে বাধ্য হয় যে, “আমেরিকার লিখিত অনুমতি ব্যতীত হামলা করা উচিত হবে কিনা?” কতটা হীনমন্য এবং গোলামী মন-মানসিকতার অধিকারী ছিল তারা। সাইপ্রাসের জামিনদার রাষ্ট্র হচ্ছে তার্কি। সেখানেও নাকি অনুমতির প্রয়োজন। অনেকটা বাংলাদেশ সরকারকে এরকম বলা যে, “ভারত সরকারের অনুমতি না নিয়ে সেনাবাহিনীর সেন্ট মার্টিনে অভিযান পরিচালনা করা উচিত হবে কিনা?” অবশ্য এরকম দাসত্ববাদী মন-মানসিকতা সম্পন্ন মানুষ প্রায়ই দেখা যায়।
পাশ্চাত্যও হাত গুটিয়ে বসে ছিল না। ১৮ তারিখই আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের সহকারী জোসেফ সিসকো এথেন্সে গিয়ে উপস্থিত হন। ওইদিনই তিনি তার্কি আসেন। ফেরার সময় প্রধানমন্ত্রী এজেবিদের সাথে সাক্ষাত করেন এবং যুদ্ধে অগ্রসর হতে নিষেধ করেন। কিন্তু মিল্লি সালামেত পার্টি এবং প্রফেসর নাজমুদ্দিন এরবাকানের দৃঢ় অবস্থানের কারণে এজেবিদ পিছু হটতে পারেননি।
১৯ জুলাই অভিযানের পূর্বে মেরসিনের ন্যাভাল বেইসে গিয়ে হাজির প্রফেসর এরবাকান। তিনি সেনাপ্রধানদের নির্দেশ দেন, “আপনাদের বিমান যারা পাইলট, তাদের মধ্য থেকে জানবায ১০০ জন পাইলটকে আমার কাছে নিয়ে আসুন” ।
তিন বাহিনী প্রধান অল্প সময়ের মধ্যেই ১০০ জন জানবায় পাইলট নিয়ে কনফারেন্স রুমে হাজির। প্রফেসর এরবাকান এবার পাইলটদের উদ্দেশ্যে জ্বালাময়ী এক তেজোদীপ্ত ভাষণ প্রদান করেন। তিনি বলেন, “আপনারা সবাই মুসলিম। আপনারা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতির গর্বিত সদস্য। আপনারা ন্যায় এবং অন্যায়ের পার্থক্যকারী জাতির অংশীদার। ন্যায়ের ঝাণ্ডা উড্ডীনের জন্য এই জাতি কখনোই কারও সামনে মাথা নোয়ানো তো দূরে থাক, কাউকে পরোয়া পর্যন্ত করেনি। মনে রাখবেন শহীদের মর্যাদা পৃথিবী ও আসমানের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মর্যাদা। আগামী কয়েক ঘন্টায় আপনাদের সাহসিকতার উপর নির্ভর করছে সাইপ্রাসের মজলুম মুসলিমদের ভাগ্য, আমাদের তার্কিশ ভাইদের ভাগ্য। আপনারা কি মজলুম ভাইদের উদ্ধারের জন্য প্রস্তুত?” সকল পাইলট হাত উচিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলে ওঠলো, “আমরা প্রস্তুত” ।
প্রফেসর এরবাকান আবারও বলেন, “আপনাদের অভিযানের সময় ভূমধ্যসাগরে অবস্থিত আমেরিকান রণতরী থেকে হুমকি আসতে পারে। আপনাদের মধ্যে কারা সেই হুমকিকে প্রত্যাখ্যান করে, নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে, নিজের মজলুম ভাইদের জন্য জালিম আমেরিকার রণতরীতে হামলা করার দুঃসাহস দেখাতে পারবেন? মনে রাখবেন আমরা আমেরিকার সাথে সঙ্ঘাতে যাচ্ছি। যারা দুঃসাহসী কেবল তারাই হাত তুলুন। কেউ না চাইলে আমরা অন্য কাউকে তার জায়গায় রিপ্লেস করবো। আমরা কোনো বুযদিলকে নিয়ে যুদ্ধে যেতে চাই না” ।
কনফারেন্স রুমে উপস্থিত ১০০ জন পাইলটের সকলেই হাত তুলল । কনফারেন্স রুমের ভেতর অন্যরকম এক আধ্যাত্মিক পরিবেশ বিরাজ করছিল। কারও চেহারায় দৃঢ় প্রত্যয়, কারও চোখে আত্মবিশ্বাসের দ্যুতি বিচ্ছুরিত হচ্ছে, কারও শরীরের মধ্যে দুঃসাহসের বিজলি খেলে যাচ্ছে।
প্রফেসর এরবাকান তাদের সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আঙ্কারা চলে আসলেন। সাইপ্রাস অপারেশনের সাংকেতিক নাম দেয়া হয় Operation Atilla. তার্কি সরকারের পক্ষ থেকে প্রফেসর এরবাকান অপারেশনের নাম দেন “Cyprus Peace Operation’ বা “সাইপ্রাস শান্তি মিশন” ।
২০ জুলাই, ১৯৭৪ । ইঞ্জিনের শব্দে স্থলের অঙ্কুরকণাও যেন প্রকম্পিত। পরক্ষণেই সাইপ্রাসের নীল আকাশের বুক চিরে শতশত বিমানের আগমন। সেই সাথে ঈগলের ন্যায় ক্ষিপ্র গতিতে নেমে আসছে হাজার হাজার জানবায তার্কিশ প্যারাট্রপার। ভোরের আলো দেখার পূর্বেই তার্কিশ আর্মি সাইপ্রাস অভিমুখে যাত্রা করে। সেনা, নৌ এবং বিমান বাহিনীর সমন্বয়ে অভিযান পরিচালিত হয়। তুরস্ক সরকারের পক্ষ থেকে স্টেটমেন্ট দেয়া হয়, “We are not actually fighting for war, we go to the island to bring peace to the Greeks and the Turks. After we tried all the diplomatic and political ways, we were forced to do this.”
এবার এজেবিদকে ফোন করেন হেনরি কিসিঞ্জার। তিনি বলেন, “যুদ্ধ বিরতি করুন। যেখানেই আছেন সেখানেই থামুন। আর একটুও সামনে অগ্রসর হবেন না”। এজেবিদ মন্ত্রিসভার বৈঠক ডাক দিলেন। CHP এর মন্ত্রিদের অধিকাংশই ভয়ে কাবু। তাদের মতে, “স্বয়ং হেনরি কিসিঞ্জার ফোন করেছেন। এবার যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা দিতেই হবে।”
প্রফেসর এরবাকান মন্ত্রিসভার বৈঠকে উঠে দাঁড়ালেন। সকলকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, “দখলদার ইসরাঈল আজ পর্যন্ত জাতিসংঘের কোনো প্রস্তাবকে কি মেনে নিয়েছে? জাতিসংঘ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলেই যে আমাদেরকে সেই একই সিদ্ধান্ত নিতে হবে এমন কোনো কথা নেই। দেশ ও জাতির অস্তিত্বের প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করার কোনো যৌক্তিকতা নেই” । বুলেন্ত এজেবিদ, প্রফেসর এরবাকানের সাথে একমত পোষণ করেন। তিনি প্রফেসর এরবাকান এবং মিল্লি সালামেত পার্টির (MSP) উদ্দেশ্যে বলেন, “আপনাদেরকে ধন্যবাদ। আপনারা আমাদেরকে একটি ভুল সিদ্ধান্ত থেকে উদ্ধার করেছেন” তারপরও অধিকাংশ মন্ত্রী নাখোশ। সেদিনই তার্কিশ সেনাবাহিনীর একটি অংশ দ্বীপের উত্তর পার্শ্বে পৌঁছে যায় এবং সেখানে অবস্থানরত গ্রীক সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে পুরো কোস্ট নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়।
এরমধ্যে আবারও মন্ত্রিসভার বৈঠক বসে। বৈঠকে এবার CHP এর মন্ত্রিদের একাংশ চুপ ছিলেন। অপর একটা অংশ মিল্লি সালামেতের উদ্দেশ্যে বাঁকা কণ্ঠে খোচা দিয়ে বলছিল, “আমাদের রাডার কাজ করছে না, ক্ষেপণাস্ত্রগুলোও ভালোভাবে কাজ করছে না। আমাদের এখন হবে?” অর্থাৎ তারা ইঙ্গিতে বলছিল, “তুরস্কের না আছে ভালো রাডার, না আছে ভালো কোনো ক্ষেপণাস্ত্র । আর তারা নাকি যাবে যুদ্ধে করতে?” জবাবে প্রফেসর এরবাকান বলেন, “আপনারা যে তথ্য উপাত্ত দিচ্ছেন তা আমরা বিশ্বাস করি না। আপনাদের তথ্যের ভিত্তিতে যুদ্ধবিরতির দিকে আমরা যেতে পারি না। সেনাবাহিনীর কী অবস্থা সেটা আমরা সেনাবাহিনীর মুখ থেকেই শুনবো। এরপর বিবেচনা করা যাবে।”
ঠিক সেসময়েই মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থিত হন পরিকল্পনা সংস্থার প্রধান নেজদেত উরু পাশা এবং অভিযান পরিচালনাকারী এক জেনারেল। তারা মন্ত্রিসভার সামনে অভিযানের অগ্রগতি সম্পর্কে ব্রিফিং করলেন। ব্রিফিং শেষ হলে প্রফেসর এরবাকান তাদের প্রশ্ন করলেন, “আমাদের রাডার নাকি নষ্ট? এটা কি সঠিক?” উত্তরে নেজদেত উরু পাশা বললেন, “না তো! কে বলেছে?” “আমাদের ক্ষেপণাস্ত্রগুলো নাকি উৎক্ষেপণযোগ্য নয়, একথা কি সঠিক?”- প্রশ্ন করলেন এরবাকান। উত্তরে তিনি বললেন, “সাইপ্রাস অভিযানের মতো আরও ৫ টি অভিযান পরিচালনা করার মতো ক্ষেপণাস্ত্র মজুদ আছে আমাদের”। এবার মন্ত্রিসভার আর কেউ কোনো কথা বলতে পারলেন না। প্রফেসর এরবাকান উপ-প্রধানমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও বলা যায় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছিলেন। বৈঠকের শেষ পর্যায়ে সেনা কর্মকর্তাদেরকে প্রফেসর এরবাকান প্রশ্ন করলেন, “আপনারা বর্তমানে যেখানে অবস্থান করছেন, সেই অবস্থানে কি আমরা আমাদের অবস্থান রক্ষা করতে পারবো? G 5 (প্রদর্শিত ম্যাপে উল্লিখিত সীমারেখা) লাইন কি আপনারা দখল করতে পারবেন?”
সেনা কর্মকর্তাগণ জবাব দেন, “আমরা সেখানে যে সেনাদল পাঠিয়েছি, তাদেরকে বাগানের মতো এই জায়গায় জড়ো করে রাখা সম্ভব নয়। সেনাবাহিনী এখানে জড়ো হয়ে থাকলে বোমা বৃষ্টি হলে আমাদের অনেক ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। আমরা এখন একটি যুদ্ধাবস্থায় আছি। আর সেনাবাহিনীর পক্ষে এমন জায়গায় অবস্থান করা সম্ভব নয়। আমাদেরকে দ্রুতই সামনের দিকে মুভ করতে হবে যেহেতু আমাদের লক্ষ্য G-5 লাইন”। তাদেরকে ধন্যবাদ জানিয়ে সেদিন দ্বিতীবারের মতো যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে বাধা প্রদান করে প্রফেসর এরবাকান। এরপর এজেবিদ সিসকোর সাথে দেখা করে বলেন, “লক্ষ্যে পৌঁছার পূর্ব পর্যন্ত আমাদের অভিযান চলবে” ।
২১ জুলাই, ১৯৭৪। যুদ্ধ পুরোদমে শুরু হয়। তার্কিশ বিমান বাহিনী গ্রীস সেনাবাহিনীর কনভয়ের উপর হামলা করে। সাইপ্রাস সমুদ্রসীমায় তার্কিশ এবং গ্রীসের নৌবাহিনী সরাসরি যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। তার্কিশ সেনাবাহিনী দ্বীপের উত্তর অংশের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় অল্প সময়ের মধ্যেই। প্যারাট্রপাররা নিকোশিয়ায় অবতরণ করে। নিকোশিয়া বৰ্তমান নর্দান সাইপ্রাসের রাজধানী। তার্কিশ সেনাবাহিনী সাইপ্রাসের উত্তর পার্শ্বে পৌঁছার পর জনগণ তাদের উষ্ণ সংবর্ধনা জানায়। তার্কিশ সেনাবাহিনী একের পর এক এলাকা মুক্ত করে চলছে গ্রীক বাহিনীর হাত থেকে। তার্কিশ সেনাবাহিনী আকাশ পথ ও বিমান পথে সকল ধরনের বিমান ও জাহাজ চলাচল নিষিদ্ধ করে। অল্পক্ষণের যুদ্ধেই গ্রীস বাহিনী পিছু হটতে শুরু করে।
রাতে পুনরায় যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব আসে সরকারের কাছে। মন্ত্রিসভার বৈঠকে CHP এর মন্ত্রিরা বলে ওঠলো-“ দেখুন আমাদের এই অপরিণামদর্শী পদক্ষেপের কারণে আমরা পুরো দুনিয়াকে আমাদের প্রতিপক্ষে পরিণত করতে যাচ্ছি” ।
উত্তরে এরবাকান বলেন, “আমরা দুনিয়ার অবস্থা নয়, আমরা আমাদের সেনাবাহিনীর অবস্থা দেখব। আমাদের সেনাবাহিনী এখনও শক্তিশালী অবস্থায় আছে। যখন তারা নিজেদেরকে প্রতিরক্ষা করতে পারবে না এরকম অবস্থায় আসবে, কেবল তখনই আমরা যুদ্ধবিরতির কথা চিন্তা করতে পারি”।
“আমরা সেনাবাহিনীর সাথে কথা বলেছি। তারা বলেছে যে তারা এ অবস্থায় উপনীত হয়েছে অর্থাৎ আমাদের সেনাবাহিনী এখন নিজেদের প্রতিরক্ষা করতে পারবে না”। মন্ত্রীদের একাংশ একথা বলে । প্রফেসর এরবাকান উত্তরে বলেন, “অবস্থা যদি তাই হয় যে আমাদের সেনাবাহিনী সুবিধাজনক অবস্থানে পৌঁছাতে পারবে না, তাহলে আমাকে একটু সময় দেন। আমি সেনাবাহিনী প্রধানের সাথে দেখা করে আসি।”
মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষ করেই প্রফেসর এরবাকান সেনাবাহিনীর প্রধান সেমিহ সানজার পাশা এর সাথে দেখা করতে যান। মরহুম সেমিহ সানজার পাশা তখন কার্যালয়ে বসে যুদ্ধ পর্যবেক্ষণ করছিলেন। তার কাছে প্রফেসর এরবাকান যুদ্ধের সর্বশেষ অবস্থা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমরা নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই G-5 লাইনে পৌঁছে যেতে পারবো। আগামীকাল বিকাল ৫ টার পূর্বে যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করবো না। কারণ আগামীকাল বিকাল ৫ টার মধ্যেই সেনাবাহিনীর দিক থেকে G-5 লাইন হস্তগত করতে পারবো। আর আমাদের অভিযানের প্রথম ধাপ ছিল এটাই। এরপর আমরা দ্বিতীয় ধাপের অভিযান পরিচালনা করবো”।
মরহুম সেমিহ সানজার পাশাকে লক্ষ্য করে এরবাকান বলেন, “দেখুন, আপনাদের বিশেষজ্ঞ এবং জেনারেলগণ এসেছিলেন। তারা বলেন যে, শেষ পর্যন্ত আমরা এখানে টিকে থাকতে পারবো না। G-5 লাইন পর্যন্ত আমাদেরকে যেভাবেই হোক যেতে হবে। দেখুন মিল্লি সালামেত পার্টি হিসেবে আমরা যে কোনো সময় যুদ্ধ বিরতির সিদ্ধান্ত নিতে পারবো। সে শক্তি আমাদের আছে। কিন্তু এই অভিযানের ন্যায় এবার দ্বিতীয়বার অভিযান শুরু করার ব্যাপারে নির্দেশনা দেয়া আমার একার পক্ষে আর সম্ভব হবে না। পার্লামেন্টের অবস্থা তো বুঝতেই পারছেন। তাই আমি আপনার কাছে সৈনিক হিসেবে একটি প্রতিশ্রুতি চাচ্ছি। যাই করুন না কেন, দ্বিতীয় দফার অভিযান যে করেই হোক অব্যাহত রাখবেন। যদিও এখানে ধরে রাখা আপনাদের পক্ষে সম্ভব নয়”। তখন সানজার পাশা বললেন- “আপনাকে সৈনিকের প্রতিশ্রুতি দিলাম” ।
সানজার পাশা যে মানচিত্র এঁকেছিলেন প্রফেসর এরবাকান সেটি সাথে করে নিয়ে আসেন মন্ত্রিসভার বৈঠকে। তিনি মন্ত্রীদের উদ্দেশ্য করে বলেন, “আমাদের সেনাপ্রধান G-5 লাইন পর্যন্ত যাত্রা করতে চেয়েছেন এবং সে পর্যন্ত যাওয়াকেই নিরাপদ ভাবছেন।” রাতে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। আবারও ফোন করেন এজেবিদকে। তিনি প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেন যুদ্ধ বিরতি ঘোষণার জন্য। এরপর জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল। Waldheim দ্বিতীয়বার কল করেন যুদ্ধবিরতির জন্য। প্রফেসর এরবাকান মিল্লি সালামেত পার্টির পক্ষ হয়ে সর্বাত্মক চেষ্টা করছিলেন যুদ্ধবিরতি যেন পরের দিন বিকাল ৫ টা পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হয়। কারণ তিনি সেনাপ্রধানকে কথা দিয়ে এসেছিলেন যে, মিল্লি সালামেত পার্টির পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে যুদ্ধবিরতি দীর্ঘায়িত করার জন্য।
কিন্তু ২২ তারিখ জাতিসংঘের পক্ষ থেকে আবারও বুলেন্ত এজেবিদকে কল করা হয়। প্রফেসর এরবাকান প্রধানমন্ত্রী বুলেন্ত এজেবিদকে এতো করে বুঝানোর পরেও পাশ্চাত্যের ভয়ে নতজানু হয়ে বিকাল ৫ টার পরিবর্তে সকাল ১১ টায় যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিয়ে দেন যা আমাদের জন্য এবং সেনাবাহিনীর জন্য বিরাট একটা ধাক্কা ছিল। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর বাধ্য হয়ে সেনাবাহিনীকে নিজেদের অগ্রযাত্রা রুখতে হয়। যুদ্ধ পরবর্তী পর্যালোচনায় দেখা যায়, এতো আগে যুদ্ধবিরতির ঘোষণার ফলে তুরস্কের হাত থেকে সাইপ্রাসের সবচেয়ে বড় শহর নিকোশিয়ার (তার্কিশ লেফকশা) একটি অংশ হাতছাড়া হয়ে যায়।
প্রফেসর নাজমুদ্দিন এরবাকান এবং মিল্লি গরুশের উদ্দেশ্য ছিল সমগ্র সাইপ্রাসকে তুরস্কের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা। অনেকেই তার এ পদক্ষেপকে সাম্রাজ্যবাদী একটি পদক্ষেপ হিসেবে দেখতে থাকেন। বিশেষ করে, তার্কির অভ্যন্তরের কিছু লোক। তাদের মতে তুরস্কের উচিৎ নিজের দেশ নিয়ে চিন্তা করা। প্রফেসর এরবাকানের সাইপ্রাস শান্তি মিশনের পিছনে যে কারণটি ছিল তা হলো, ঐতিহাসিকভাবে এবং ১৮৭৮ সালের চুক্তি অনুসারে তুরস্ক হচ্ছে সাইপ্রাসের একমাত্র জামিনদার রাষ্ট্র। তুরস্কের এই মালিকানা বা জামিনদারিত্ব সমগ্র সাইপ্রাসের উপর বর্তায়। যার ফলে সমগ্র সাইপ্রাসের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা তুরস্কের অবশ্য কর্তব্য।
সেই সাথে রোমের নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলেও মুসলিমরা বসবাস করছে। তুরস্ক দ্বীপের এক অংশ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে অপর অংশ যদি গ্রীসের হাতে ছেড়ে দেয় তাহলে সেই অংশে বসবাসকারী মুসলিমদের উপর জুলুম- নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যাবে। সেখানকার গ্রামগুলোতে পূর্বের মতো আবারও হত্যাযজ্ঞ চালানো হতে পারে। তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল, সমগ্র সাইপ্রাস তুরস্কের নিয়ন্ত্রণে থাকলে ভূমধ্যসাগরের সংগঠিত যেকোনো বিষয়ে পাশ্চাত্যের সাথে দর কষাকষির সময় তুরস্ক শক্তিশালী অবস্থানে থাকতো। কারণ সাইপ্রাসের অর্ধেক আর পুরোটা দখলের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। পাশ্চাত্য কোনোকালেই তুরস্ক এবং মুসলিম দেশসমূহের ব্যাপারে কখনোই ইনসাফ দেখাতে পারেনি, আসলে ওদের ইনসাফ করার মন-মানসিকতা পর্যন্তও নেই। আর মুসলিম হিসেবে বর্তমান জুডো-খ্রিস্টান সভ্যতার কাছ থেকে মুসলিমদের প্রতি ইনসাফ আশা করা বোকামির নামান্তর।
২৩ জুলাই, ১৯৭৪।। ক্যু করে ক্ষমতায় আরোহণকারী নিক স্যাম্পসন পদত্যাগ করে। ৭০০ জন গ্রীক সৈন্যকে তার্কিশ আর্মি গ্রেফতার করে তুরস্কের দক্ষিণপার্শ্বে অবস্থিত মেরসিনে নিয়ে আসে। তার্কি এবং গ্রীসের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি হতে থাকে। দুদেশের প্রধানমন্ত্রীর পাল্টাপাল্টি কথা চলতে থাকে । অতঃপর ২৫ জুলাই জেনেভা কনভেনশনে উপস্থিত হন দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী।
তখন বুলেন্ত এজেবিদ পড়েছিল গ্যাড়াকলে। পাশ্চাত্যের সাথে আপোষ না করায় নিজের দলের মন্ত্রি এবং এমপিদের রোষানলে পড়ছিল। অপরদিকে কোয়ালিশন করে ক্ষমতায় আসার কারণে প্রফেসর নাজমুদ্দিন এরবাকানের কথা মানতে বাধ্য হচ্ছিল। ক্ষমতার হারানোর ভয় ছিল মারাত্মক। তার উপর সংসদে মিল্লি সালামেত পার্টির এমপিদের আগুন গরম বক্তব্যের সামনে তার দলের কেউই মুখ খুলতে পারছিল না। তার উপর সাইপ্রাস ইস্যু নিয়ে মিল্লি সালামেতের ৪৮ জন এমপির জোরালো প্রতিবাদে তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল। প্রফেসর নাজমুদ্দিন এরবাকান এবং মিল্লি সালামেত পার্টির চাপে বুলেন্ত এজেবিদ বাধ্য হয়ে পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন।
তুরস্কের অনড় অবস্থানের কারণে ১ আগস্ট, যুক্তরাষ্ট্র তার্কিতে তার সব ধরনের এইড কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। জেনেভার দ্বিতীয় সম্মেলনের পূর্বে গ্রীস সরকার তার্কিশ সেনাবাহিনীকে সাইপ্রাসের সীমানা প্রত্যাহার করে নিতে বললে তুরস্ক তা প্রত্যাখ্যান করে। এতে করে সম্পর্ক আরও টানাপোড়েনের মধ্যে পড়ে।
৫ আগস্ট, ১৯৭৪ গ্রীক সৈন্যরা মধ্যরাতে সাইপ্রাসের Grine সমুদ্রবন্দরে তার্কিশ সৈন্যদের উপর হামলা এবং মারাত্মক ক্ষতি সাধন করে। দুই দেশের মধ্যে আলোচনা চলতে থাকে। এরই মধ্যে ১৩ জুলাই, গ্রীক সৈন্যরা Meriç নদীর পাশে সুড়ঙ্গ তৈরি করা শুরু করে এবং মাইন পুঁতে দেয়।
প্রফেসর এরবাকানের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন সেনাপ্রধান সানজার পাশা যে তিনি দ্বিতীয় অভিযান পরিচালনা করবেন। মিল্লি সালামেত পার্টির লক্ষ্য তখনও সফল হয়নি। প্রফেসর এরবাকান সাইপ্রাসের কৌশলগত ভৌগোলিক অবস্থানকে এ অভিযানের ভিত্তি হিসেবে ধরেছিলেন। তাই যেকোনো ভাবেই দ্বিতীয় অভিযান পরিচালনা করা প্রধান শর্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ২২ জুলাই থেকে ১২ আগস্ট পর্যন্ত কূটনৈতিক টানাপোড়েন, সংসদে বামপন্থী এমপি এবং বিরোধীদলীয় নেতা সুলেয়মান দেমিরেলের চাপ এসব বিষয় দ্বিতীয় অভিযানের বিষয়ে সকলকে সন্দিহান করে তুলছিল।
এরই মধ্যে তার্কিশ সেনাবাহিনীর উপর হামলা এবং সুড়ঙ্গ নির্মাণের ব্যাপারে অবগত হওয়ার পর প্রফেসর এরবাকানের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৪ আগস্ট, ১৯৭৪ সালে সাইপ্রাসে তার্কিশ সেনাবাহিনী দ্বিতীয়বারের মতো অভিযান পরিচালনা করে। দ্বিতীয় দফার এই অভিযানে যেন কোনো প্রকার বিরতি না দেয়া হয় তার নির্দেশ প্রদান করেন সেনাপ্রধানকে । তিনি সেনাপ্রধানকে বলেন, “আমাদের সেনাবাহিনীকে কমপক্ষে লারকানা পর্যন্ত দখল করতেই হবে যেকোনো মূল্যে।”
১৫ আগস্ট তার্কিশ আর্মি একের পর এক শহর পুনর্দখল করে চলছিল। সেই সাথে প্রধান একটি মেরিন ঘাঁটি যাকে বসফরাস নামে ডাকা হতো সেটিও দখল করে নেয় । এরপর তিন্তু এয়ারপোর্ট দখল করে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হতে থাকে সেনাবাহিনী। পরদিন যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেয়া হয়। এবং যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।
প্রফেসর এরবাকান পূর্বেই সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছিল লারকানা যেকোনো মূল্যেই দখল করতে হবে। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর মুহতারাম খালাদের মধ্যে উম্মে হারাম (রা.)-এর কবর লারকানা শহরেই অবস্থিত। যার কারণে এ শহর পুনর্দখলের জন্য প্রফেসর এরবাকান সেনাবাহিনীকে সর্বোচ্চ চাপ দেন।
সেনাবাহিনী ঠিকই লারকানার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। কিন্তু লারকানার উদ্দেশ্যে যাত্রাকারী সৈন্যবাহিনীর কমান্ডারের কাছে গোপনে নির্দেশ দেয়া হয় যে-“আপনারা যাবেন না, ফিরে আসুন” । যার ফলে আরও অনেক অঞ্চল সেনাবাহিনীর হাতছাড়া হয়ে যায়।
এরপর সেনাবাহিনীর সেই কমান্ডার তার্কিতে ফিরে এসে যুদ্ধের ব্রিফিং করার সময় বলেন, “জনাব এরবাকান, আপনি যদি আমাদের ফিরিয়ে না আনতেন তাহলে অনেক বেশি ভালো হতো। আপনার দেয়া নির্দেশের কারণে আমরা আর অগ্রসর না হয়ে ফিরে আসি যার ফলে অনেক অঞ্চল আমাদের হাতছাড়া হয়ে যায়” ।
কমান্ডারের কথা শুনে প্রধানমন্ত্রী এজেবিদ এবং উপ-প্রধানমন্ত্রী নাজমুদ্দিন এরবাকান দুজনেই অবাক। বুলেন্ত এজেবিদও এই বিষয়ে জানতো না ৷ আর প্রফেসর এরবাকান যেখানে নিজে লারকানা দখলের জন্য এতো প্রচেষ্টা করে দ্বিতীয় দফার অভিযান পরিচালনা করেছেন সেই তিনি কেনই বা ফিরে আসার নির্দেশনা দিবেন? প্রতিউত্তরে প্রফেসর এরবাকান সেই কমান্ডারকে বলেন, “আমরা দুজনেই এখানে আছি । আমরা ফিরে আসার কোনো নির্দেশনাই দেইনি। ফিরে আসার ব্যাপারে যে কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল তা আমরা এইমাত্র জানতে পারলাম” ।
সেনা কমান্ডারও হতবাক। তাহলে কে দিল এই নির্দেশনা। তুরস্কের অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ বলে থাকেন যে, তুরস্কের ভেতরে ডীপ স্টেট বিদ্যমান। তারাই বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে। যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার নির্দেশনা তার একটি নমুনা মাত্র। তাদের মতে, তুরস্কের জাতীয়তাবাদী দল MHP কে প্রতিষ্ঠা করেছে এই ডীপ স্টেট। কেননা, তাদের মতো উগ্র জাতীয়তাবাদী দল থাকলে তুরস্কের রাজনীতিতে কখনো ঐক্য দেখা দিবে না। কুর্দিশ-তার্কিশ এই বিভেদকে সর্বদা জাগ্রত রাখার জন্যই তার্কির এই জাতীয়তাবাদী দল MHP কে আলপারসলান তুর্কেশের মাধ্যমে তৈরি করানো হয়েছে। এই আলপারসলান তুর্কেশ হচ্ছেন সেই ব্যক্তি যিনি কিনা ১৯৬০ সালের ক্যু এর মুখপাত্রের ভূমিকা পালন করছিলেন।
যাই হোক, তুরস্ক সাইপ্রাসের তার হিস্যা পেল এবং সেখানে একটি ফেডারেল সরকার গঠন করার জন্য কাজ শুরু করে। এরই মধ্যে আবারও জেনেভা কনফারেন্স শুরু হয়। মিল্লি সালামেত পার্টি জেনেভা কনভেনশন থেকে কানাকড়িও প্রত্যাশা করেনি। কারণ জেনেভা কনভেনশন তুরস্কের জাতীয় স্বার্থের দিক থেকে কোনো মূল্যায়নেরই দাবি রাখেনি। কনভেনশনে রোমানদেরকে G-5 লাইন থেকেই ৫ কি.মি পেছনে যাওয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। আর এতে যদি তারা রাজি হতো তাহলে এটা তুরস্কের স্বার্থের সম্পূর্ণ বিপরীত একটি কাজ হতো। প্রশ্ন ওঠতে পারে কেন?
কারণ রোমানদের বিশ্বাসঘাতকতা এবং চুক্তি ভঙ্গের ইতিহাস নতুন নয়। মুসলিমদের সাথে তারা কখনোই কোনো চুক্তির মর্যাদা রক্ষা করেনি। সাইপ্রাসের ক্ষেত্রেও তাদের সাথে ১৮৭৮ সালের চুক্তির কোনো মর্যাদা তারা রাখেনি। এরকম আরও হাজারো ইতিহাস আছে। তাদেরকে ৫ কি.মি পিছনে যেতে বলা হচ্ছে। কিন্তু কিছুদিন পর ওরা যে আবার হাম- লার প্রস্তুতি নিবে না তার নিশ্চয়তা কে দিবে? গ্রীস সুযোগ পেলে অন্যান্য ইউরোপীয়ান রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর সাহায্য নিয়ে আবারও হামলা করবে যা তার্কির জন্য মারাত্মক বিপজ্জনক।
কারণ সেনাবাহিনীর বর্ণনা মতে, সাইপ্রাস সেনা অভিযানের খরচ ছিল তৎকালীন সময়ের হিসাবে প্রায় ৯ বিলিয়ন লিরা বা ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তাও দুই অভিযানের স্থায়িত্বকাল ছিল সব মিলিয়ে মাত্র সাতদিন। সেই সাথে অভিযান পরিচালনার সময় প্রতি ৪ জনে ১ জন হতাহত হতে পারে সেই হিসেবটাও মাথায় রাখতে হবে।
অবশেষে, আল্লাহর অশেষ রহমতে ৫০০ জন তরতাজা সৈনিকের রক্তের বিনিময়ে সাইপ্রাসের মুসলিমদের স্বাধীনতা অর্জিত হয়। এরকম একটি সেনা কমান্ডারও হতবাক। তাহলে কে দিল এই নির্দেশনা। তুরস্কের অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ বলে থাকেন যে, তুরস্কের ভেতরে ডীপ স্টেট বিদ্যমান। তারাই বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে। যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার নির্দেশনা তার একটি নমুনা মাত্র। তাদের মতে, তুরস্কের জাতীয়তাবাদী দল MHP কে প্রতিষ্ঠা করেছে এই ডীপ স্টেট। কেননা, তাদের মতো উগ্র জাতীয়তাবাদী দল থাকলে তুরস্কের রাজনীতিতে কখনো ঐক্য দেখা দিবে না। কুর্দিশ-তার্কিশ এই বিভেদকে সর্বদা জাগ্রত রাখার জন্যই তার্কির এই জাতীয়তাবাদী দল MHP কে আলপারসলান। তুর্কেশের মাধ্যমে তৈরি করানো হয়েছে। এই আলপারসলান তুর্কেশ হচ্ছেন সেই ব্যক্তি যিনি কিনা ১৯৬০ সালের ক্যু এর মুখপাত্রের ভূমিকা পালন করছিলেন।
বিজয় পরবর্তী কথাঃ-
সাইপ্রাসকে ফেডারেল রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা তার্কির জন্যও বিপজ্জনক এবং এটি ছিল পুরো সাইপ্রাস অভিযানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের বিরুদ্ধে। তাই মিল্লি সালামেত পার্টি এই সিদ্ধান্তের কঠোর বিরোধিতা করে। সাইপ্রাসের এই অঞ্চলকে ফেডারেল রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করলে রোমানদেরই সুবিধা হবে সবচেয়ে বেশি। অল্পকিছুদিন পর দ্বীপে বিশৃংখলা সৃষ্টি করে গ্রীস খুব সহজেই একে নিজেদের করায়ত্বে নিয়ে যেতে পারবে। এতে করে দেখা যাবে, সেখানে মেম্বার অথবা চেয়ারম্যান থাকবে তার্কিশ কিন্তু প্রশাসনিক ক্ষমতা থাকবে গ্রীকদের হাতে। ইতিহাসের সুস্পষ্ট প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও রোমানদেরকে ভালোভাবে না জেনেই এরকম একটি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। তাই মিল্লি সালামেত পার্টি শক্তভাবে এর বিরোধিতা করে। জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদে তুমুল বিতর্ক চলে এ নিয়ে। সেনাবাহিনী মিল্লি সালামেত পার্টি এবং প্রফেসর এরবাকানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। এক্ষেত্রে সেনাপ্রধান সানজার পাশার অসামান্য ভূমিকা ছিল। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়, “প্রাদেশিক ব্যবস্থা আমাদের কোনো কাজে আসবে না। আর সেটি করলে সাইপ্রাসের বিন্দুমাত্র নিয়ন্ত্রণও আমাদের হাতে থাকবে না।”
মিল্লি সালামেত পার্টি সাইপ্রাসের দুই অংশকে দুটি স্বাধীন দেশ হিসেবে ভূমিকে সমানভাগে ভাগ করার ব্যাপারে চিন্তা করছিল। প্রফেসর এরবাকান বলেন, “সাইপ্রাসকে ভাগ করে দুটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র ঘোষণা করা হোক। শান্তি মিশন শুরু করার সময় আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল এটি। পরবর্তীতে মিল্লি সালামের পার্টি প্রকাশ্যে ঘোষণা করে, “সাইনাসের সমান দুই ভাগে ভাগ করে দুটি স্বাধীন দেশ হবে।”
৭৪ সালের পর থেকে কেন আজ পর্যন্ত দ্বীপটিতে করছে? উত্তর একটিই- ভূমিকে সমানভাবে ভাগ করার কারণে। সময়ে শুধু এ বিষয়ে কথা বলাটাকেই বীরত্ব হিসেবে বিবেচনা করা হে কাজ করার ব্যাপারে কেউ আগ্রহী ছিল না। আজও ব্যতিক্রম কিছু নেই। মুসলিম রাষ্ট্রের প্রধানগণকে বর্তমানেও মুসলিম বিশ্বের নির্বাচিতদের নিয়ে বড় বড় কথা বলতে দেখা যায়। কিন্তু কাজের বেলায় তাদের 1 পাওয়া যায় না। রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায় না। রাষ্ট্রীয়ভাবে সর্বোচ্চ যে উদ্যোগ নেয়া হয় তা হচ্ছে ত্রাণ সামগ্রী পা যেটা তুরস্কের ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মেয়াদকালীন প্রধ সুলেয়মান দেমিরেলও করতো সাইপ্রাসের জন্য যে কিনা স্বঘোষিত ম্যানে ছিল। যদিও ২০০০ সালের পূর্ব পর্যন্ত মানুষ তাকে ইসলামের সেবক হিসেবেই জানতো। এমনকি তার পূর্বে CHP এর প্রধানমন্ত্রী ইসমত ইনোনু তো ত্রাণের পাশাপাশি টহল বিমান পর্যন্তও পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সেটা ওই টহলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বর্তমানের মতো পূর্বেও অধিকাংশ মানুষ মনে করতো যে ত্রাণ পাঠালেই মুসলিম রাষ্ট্রের কর্তব্য শেষ। রা তো সেখানকার মানুষদের উপর চলমান জুলুমের অবসান ঘটাবে না। আর ত্রাণ বা এসব পাঠানো তো মূল কাজের ১০০ ভাগের মাত্র ১ ভাগ। জুলুমের সমূলে মূলোৎপাটন না করা পর্যন্ত একটি মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানের শ্বাস ফেলারও সুযোগ থাকার কথা নয়। সুলেয়মান দেমিরেল ইতিহাসের তৃতীয় সর্বোচ্চ ৫৩% ভোটে নির্বাচিত হয়েছিল। ঠিকই। কিন্তু উম্মাহর জন্য তার কোনো ভূমিকা ছিল না। অথচ তৎকালীন তুরস্কের ইসলামের ত্রাণকর্তা খ্যাত এই সুলেয়মান দেমিরেল যাকে সবুজ কমিউনিস্ট আখ্যা দিয়েছিল সেই প্রফেসর এরবাকান মাত্র ১১.৮% ভোট এবং ৪৮ জন এমপি নিয়ে সাইপ্রাস বিজয়ের এক দুঃসাহসী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।
সাইপ্রাস বিজয়ের পূর্বে সেসময়ে সাইপ্রাসের ব্যাপারে কথা বলাকে অতিরিক্ত সাহসিকতা হিসেবে বিবেচনা করা হতো। পাশ্চাত্যের ভরে সুলেয়মান দেমিরেল এবং তার দল AP এর নেতাকর্মীরা বলতো, “চুপ করো না কেন? এসব কাজ কখনো করতে পারবে না” ।
৬৯ থেকে ৭৪ সাল পর্যন্ত যখনই সাইপ্রাস বিষয়ে নাজমুদ্দিন এরবাকান কথা বলতেন তখন তাদের পক্ষ থেকে জবাব দেয়া হতো, “সাইপ্রাসের বিষয়ে বুদ্ধিমত্তা এবং ট্যাকটিসের (কৌশল) সাথে ডিল করতে হবে। পর- রাষ্ট্রনীতি এতো সোজা নয়। কদিন হলো যে রাজনীতিতে এসেছ? সবকিছু হুটহাট করে হয় না। ক্ষমতায় গিয়ে আগে ভিত শক্ত করে নিতে হয়। এরপর কোনো পদক্ষেপ নেয়ার কথা চিন্তা করা যাবে।” আসলে কারণ তা নয়। কারণ হচ্ছে, পাশ্চাত্যের আজ্ঞাবাহীরা সাইপ্রাসের ব্যাপারে কথা বলা পছন্দ করতো না।
তাদের কথাবার্তার ধরণ ছিল এরকম যে, সাইপ্রাসের মুসলিমদের উপর গণহত্যা হচ্ছে তো আমাদের কী হয়েছে? আমরা তো এর বিরুদ্ধে জোরালো কণ্ঠে প্রতিবাদ জানাচ্ছি। জাতিসংঘে নিন্দা জানাচ্ছি। বিবৃতি দিচ্ছি, ত্রাণ পাঠাচ্ছি। অনেক মানুষকে তার্কিতে আশ্রয় দিচ্ছি যারা সমুদ্রপথে তার্কিতে এসেছে রিফিউজি হিসেবে। এর বেশি আমরা করতে পারবো না । এখানে আমেরিকা আছে, ইউরোপ আছে আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে এখানে ইংল্যান্ড আছে। পররাষ্ট্রনীতিতে অনেক মারপ্যাচ আছে। হুট করে কিছু করা যায় না” ।
তার্কির সীমানার ৪০০ কি.মি দূরে মুসলিমদের উপর গণহত্যা চলছে! জুলুম-নির্যাতন সহ্যের মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে, মহিলাদের উপর নির্যাতন করা হচ্ছে, শিশুদের হত্যা করা হচ্ছে। আর সুলেয়মান দেমিরেল ৫৩% ভোটে জয়ী হয়ে কিনা বলেন, “এখানে আন্তর্জাতিক রাজনীতির মারপ্যাচ আছে । ত্রাণ পাঠাচ্ছি আর জোরালো প্রতিবাদ জানাচ্ছি, হুমকি দিচ্ছি যে, সাইপ্রাসে মুসলিমদের আর একফোটা রক্ত ঝরলে তুরস্কের পক্ষ থেকে সেটা হবে সর্বশেষ সতর্কবার্তা। এরপর আর সহ্য করা হবে না।” অথচ এতো বছরের ক্ষমতায় ইসমত ইনোনুর মতো অন্ততপক্ষে একবারের জন্যও টহল বিমান পর্যন্ত পাঠাননি তিনি। যদি পাঠাতো তাহলে বুঝা যেত কিছু একটা আগ্রহ আছে। বড় বড় ডায়লগ তো রাস্তার পাগলও দেয় ।
অথচ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তির উচিত হচ্ছে পদক্ষেপ নেয়া, মানুষকে জুলুম থেকে রক্ষা করা। আসলে ওরা ৫৩% ভোট পেলেই কি আর ১০০% ভোট পেলেই কি? ওদের লক্ষ্য হচ্ছে ক্ষমতা। ক্ষমতাকেই ওরা পূজা করে। ক্ষমতার জন্য এতো সুন্দর সুন্দর বুলি বিশ্ববাসীর সামনে আওড়ায়। আর এই ক্ষমতার জন্যই লক্ষ লক্ষ মানুষকে মৃত্যুর মুখে পতিত হতে দেখেও কোনো টু শব্দ পর্যন্ত করে না। আর তারাই বিশাল বিশাল মসজিদ নির্মাণ করে ইসলামের সেবক হিসেবে একটা ইমেজ তৈরি করে জনগণের মাঝে । জনগণ ওদের এসব চালবাজি বুঝতো না। কারণ সে সময়ের টিভি এবং পত্রিকায় যা বলা হতো, দেখানো হতো মানুষ তাই বিশ্বাস করতো।
প্রফেসর এরবাকান ওদের মতলব ভালো করে বুঝেছিলেন। গণতান্ত্রিক এই ব্যবস্থায় তিনি ক্ষমতায় যেতে পারবেন না পূর্ণাঙ্গভাবে সেটা তিনি জানতেন। তাইতো বামপন্থীদের সাথে জোট করে মাত্র ১১.৮% ভোট। নিয়ে ক্ষমতায় গিয়ে, হাজারো অপবাদ মাথায় নিয়ে মাত্র একদিনের জন্য প্রধানমন্ত্রী হয়েই সাইপ্রাস অভিযান পরিচালনা করে সেখানকার মজলুম মুসলিমদের মুক্ত করেছিলেন। যখন সাইপ্রাস হামলা করা হয়েছিল তখন বলা হয়েছিল, “সমগ্র দুনিয়া তার্কির বিপক্ষে চলে যাবে”। এখানে প্রশ্ন হলো, “এই যে সমগ্র দুনিয়া বা পাশ্চাত্য, তারা কবে তার্কির পক্ষে ছিল?”
সমগ্র দুনিয়া বিপক্ষে যাওয়ার পর কী হয়েছিল? ১০ বছর পর সকলে এটা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল যে, সেখানে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন ছাড়া কোনো পথ খোলা নেই। অবশেষে ১৯৮৩ সালে নর্দান সাইপ্রাসকে স্বাধীন ঘোষণা করা হয়।
প্রফেসর নাজমুদ্দিন এরবাকান স্বয়ং নিজে নর্দান সাইপ্রাসের পতাকা অঙ্কন করেন। দখলদার ইসরাঈলের পতাকা যেভাবে অঙ্কন করা হয়েছে তিনি তাদের জবাবে নর্দান সাইপ্রাসের পতাকা অঙ্কন করেন।
দখলদার ইসরাঈলের পতাকার উপরে এবং নীচে নীল যে দুটি রেখা টানা আছে এবং মাঝে ওদের ছয় তারকার চিহ্ন অঙ্কন করা। সেটির অর্থ হচ্ছে,নীল নদ হতে ফোরাত পর্যন্ত সমস্ত ভূমি দখলদার ইসরাঈলের। তারা এখানে তাদের বৃহৎ ইসরাঈল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবে। ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান সাইপ্রাসের পতাকাতে উপরে ও নীচে দুটি লাল রেখা টেনে মাঝে ইসলামী সভ্যতার প্রতীক চাঁদ-তারকা অঙ্কন করে এটি জানান দেন যে, নীল এবং ফোরাতের মধ্যবর্তী এলাকা মুসলিমদের এবং তা থাকবেই। আর সাইপ্রাস বিজয় হচ্ছে তার নিশ্চয়তা।
সাইপ্রাস নিয়ে দখলদার ইসরাঈলের মাথা ব্যথার কারণ প্রফেসর এরবাকান বলতেন, “মুসলিমদের কাছে ফিলিস্তিনের যে পরিমাণ গুরুত্ব রয়েছে, সাইপ্রাসের গুরুত্ব তার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। কারণ ভৌগোলিকভাবে সাইপ্রাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর বর্তমান যুদ্ধনীতিতে স্ট্র্যাটেজিক এলাকা নিজেদের হাতে থাকা মানে পারমাণবিক বোমা নিজেদের হাতে থাকার শামিল” ।
আসলেও তাই। সাইপ্রাস হতে ফিলিস্তিনের দূরত্ব খুবই কম। স্বল্প বা মাঝারি পাল্লার মিসাইল দ্বারা ফিলিস্তিনে আঘাত হানা ওদের জন্য কোনো ব্যাপারই না যদি সাইপ্রাস ওদের হাতে চলে যায়।
ভৌগোলিকভাবেই সাইপ্রাসের গুরুত্ব বর্ণনাতীত। আজকের মতো পূর্বেও পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সাইপ্রাসকে ইউরোপের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য জোরদার প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। প্রশ্ন উঠবে, কেন?
শতাব্দীর পর শতাব্দী সাইপ্রাস দ্বীপটি কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপ হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে। মুসলিম বিশ্বের সাথের এর সম্পৃক্ততা ঐতিহাসিক। সাইপ্রাস মুসলিম বিশ্বের একদম প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত হওয়ার কারণে এর কৌশলগত গুরুত্ব কল্পনারও অতীত। ভাবুন- একটি দ্বীপের ২০০ কি.মি এর মধ্যে কতটি বড় বড় মুসলিম দেশ? তুরস্ক, মিশর, সিরিয়া, ইরাক, লেবাবন এবং মুসলিমদের প্রাণের স্পন্দন আল-আকসার ফিলিস্তিনের ভূমি ।
পূর্বে সাইপ্রাস ছিল ভূমধ্যসাগরকে নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি ভাসমান নৌ-ঘাঁটি। অর্থাৎ সাইপ্রাস যে নিয়ন্ত্রণ করবে ভূমধ্যসাগরের প্রতিটি জাহাজের গতিবিধি তার পর্যবেক্ষণে থাকবে। সে সময়ে ইউরোপীয়ানরা সাইপ্রাস হাতে রাখতে চেয়েছিল মুসলিম সেনাবাহিনী যেন ভূমধ্যসাগরের নিয়ন্ত্রণ নিতে না পারে এবং ব্যবসার ক্ষেত্রে একচ্ছত্র আধিপত্য যেন ইউরোপীয়ানদের হাতেই থাকে ।
আর বর্তমানে সাইপ্রাস হচ্ছে দখলদার ইসরাঈলের মাথা ব্যাথার কারণ। কেননা, ভৌগোলিকভাবে সাইপ্রাসের পূর্বের অংশটি বর্তমানে স্বাধীন হলেও তা তুরস্কের নিয়ন্ত্রণে, সে অঞ্চলটি দখলদার ইসরাঈলের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ একটি এলাকা। ইসরাঈল থেকে এর দূরত্ব ৩০০ কি.মি এর চেয়েও কম । সেখানে যদি কোনো মুসলিম দেশ নৌঘাঁটি স্থাপন করে এবং সেই সাথে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে তাহলে মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রও ইসরাঈলে আঘাত হানতে সক্ষম। এ বিষয়টি দখলদার ইসরাঈলের ঘুম হারাম করে দিয়েছে ১৯৭৪ সালের পর থেকে। তাই তারা উঠে পড়ে লেগেছে সাইপ্রাসের তার্কি নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলটিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত করতে। ইসরাঈলের চারপাশে সবই মুসলিম দেশ। বের হওয়ার একটিই রাস্তা ভূমধ্যসাগর। সেখানেও গলার কাঁটা হিসেবে বিঁধে আছে সাইপ্রাসের পূর্ব অঞ্চল যেটি বর্তমানে তুরস্কের অধীনে। বর্তমানে তুরস্কের সাথে দখলদার ইসরাঈল সুসম্পর্ক বজায় রেখে তুরস্ক সরকারকে চাপ দিচ্ছে সাইপ্রাসকে যেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের অধিভুক্ত করে দেয়। দুর্ভাগ্যবশত তুরস্ক সরকারও সাইপ্রাসের এই অঞ্চলটিতে কোনো উন্নয়নমূলক কাজ করছে না কোনো এক অজ্ঞাত কারণে। সাইপ্রাসের দুই অংশের তুলনা করলে দেখা যায়, ইউরোপের সাইপ্রাসের তুলনায় তুরস্কের সাইপ্রাসের জীবন মান অনুন্নত। কথাটা শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই রূঢ় সত্য যে, বিগত ২০ বছরে উন্নয়নের কোনো ছোঁয়া না থাকায় স্বাভাবিকভাবেই মানুষ কিছুটা হলেও তুরস্ক সরকারের প্রতি বিরক্ত। মানুষ উন্নয়ন চায়, মানুষের উন্নয়নের জন্য সরকারের কাজ করা উচিৎ। কিন্তু তুরস্ক সরকার কোনো এক অজ্ঞাত কারণে এই অঞ্চলের উন্নয়ন ব্যাহত রেখেছে। সরকার বিশাল বিশাল মসজিদ নির্মাণ করছে ঠিকই কিন্তু সেই অঞ্চলের মানুষের জীবন-যাত্রার মান উন্নয়নের জন্য কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। তুর্কি সাইপ্রাসের মানুষ এখন পর্যন্ত যে জিনিসটিকে প্রাধান্য দিচ্ছে তা হচ্ছে ইসলামী ভাবধারা । মানে মুসলিম হিসেবে একটি মুসলিম দেশের সাথে সম্পৃক্ত থাকা। এ চিন্তাধারা সাইপ্রাসের জনগণের মধ্যে কতদিন থাকে সেটিই হচ্ছে প্রশ্নের বিষয়। সরকারের অবহেলায় আল্লাহ না করুক যদি ওরা গ্রীসের অধিকৃত অঞ্চলের সাথে যুক্ত হয় তখন এই সাইপ্রাসই মুসলিমদের গলার কাটা হিসেবে আবির্ভূত হবে।
সেই সাথে একথাও সত্য যে, সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো এই দ্বীপকে ইসরাঈলের নিরাপত্তার জন্য ব্যবহার করতে চায়। সাইপ্রাসকে নিয়ে ইহুদীদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি- Turkish Republic of Northern Cyprus কে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে সেখান থেকে মুসলিম অধিবাসীদের সম্পূর্ণরূপে বের করে দিয়ে সাইপ্রাসকে চিরতরে মুসলিম দেশসমূহ হতে পৃথক করে ফেলা। সাইপ্রাসের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর সেখানে আমেরিকার ঘাঁটি স্থাপন করে সেই ঘাঁটি থেকে ইসরাঈলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। উল্লেখ্য, আমেরিকার ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা সর্বনিম্ন ২,০০০ কি.মি। অর্থাৎ সেখানে ঘাঁটি স্থাপন মানে হচ্ছে, আমেরিকাকে পুরো মুসলিম বিশ্বের মোড়ল বানানো। যদিও বর্তমানে কোনো পার্থক্য নেই। তারপরও পার্থক্য থেকে যায়। কারণ, আমেরিকার ঘাঁটিগুলো হচ্ছে মুসলিম দেশগুলোতে। তুরস্কে প্রায় ৮০ টির মতো আমেরিকান সেনাবাহিনীর ঘাঁটি আছে, কাতারে আছে, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব এসব দেশে তো আছেই। ঘাঁটি যতই থাকুক না কেন? সরকার যতই আমেরিকা বা পাশ্চাত্যের নিয়ন্ত্রণে থাকুক না কেন জনগণ তো মুসলিম। যদি কখনো সব দেশের মুসলিমরা একত্রিত হয়ে যায়, তখন সেসব মুসলিম দেশে আমেরিকার অবস্থান তেমন সুবিধাজনক হবে না। ওরা সেই ভয়েই আছে। সেজন্য সেইফ জোন হচ্ছে সাইপ্রাস । সাইপ্রাসকে পুরোপুরি দখল নিলে এবং সেখান থেকে মুসলিমদের তাড়িয়ে দিলে কোনো মুসলিম দেশের তখন আর কিছু করার থাকবে না। অন্যদিকে ইসরাঈল যতই শক্তিশালী হোক না কেন, প্রায় ১৫০ কোটি মুসলমানের একদম প্রাণকেন্দ্রে অবস্থান করার কারণে সর্বদা একটা ভয়ে থাকে। ওরা যখন ওদের চতুর্দিকে তাকায় তখন এক ভীতিকর অবস্থা দেখতে পায়। ওদের ভবিষ্যত আশঙ্কা হচ্ছে, “একদিন সকল মুসলিমরা একত্রিত হয়ে তাদেরকে ভূমধ্যসাগরে নিক্ষেপ করবে”। এ ভয়েই তারা অস্থির । সেকারণেই ইসরাঈলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ওরা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বারোপ করে। বর্তমানে ওরা মুসলিম বিশ্বের শাসকদেরকে হাতের মুঠোয় নিয়ে কিছুটা স্বস্তিতে আছে। কিন্তু তাদের লক্ষ্য হচ্ছে সাইপ্রাস। সাইপ্রাসকে পাশ্চাত্যের হাতে হস্তান্তর করতে পারলেই তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। একারণেই দখলদার ইসরাঈল সাইপ্রাসকে এতো গুরুত্ব দিয়ে থাকে।
প্রফেসর নাজমুদ্দিন এরবাকান ৩০-৪০ বছর ধরে তুরস্কের জনগণ ও মুসলিম উম্মাহর সামনে বারবার সাইপ্রাস ইস্যুকে কেন তুলে ধরছেন? মূল কারণ এটাই। তুরস্কের অধিকৃত সাইপ্রাস পূর্ব দিকে সরু হয়ে বিস্তৃত হয়েছে এবং কারপাজ উপদ্বীপের মাধ্যমে তুরস্ক পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছে। মানচিত্রের দিকে তাকালে এটা সহজেই বোধগম্য যে, তুরস্কের সবচেয়ে নিকটস্থ দ্বীপ হচ্ছে সাইপ্রাসের কারপাজ নামক এই উপদ্বীপটি । আল্লাহ না করুন এই দ্বীপটি যদি শত্রুদের হস্তগত হয় অর্থাৎ সেই সাথে পুরো সাইপ্রাস হস্তগত হয়, তাহলে আমেরিকার সেখানে বিমানঘাঁটি, সামরিক ঘাঁটি এবং নৌঘাঁটি করতে বেশি সময় লাগবে না। আর সেখানে ঘাঁটি প্রতিষ্ঠিত হলে সেখান থেকে আমেরিকার জন্য তুরস্ক, সিরিয়া, ইরাক, ফিলিস্তিনের যেকোনো অঞ্চলে যে কোনো স্থানে আক্রমণ হবে খুব দ্রুত এবং সহজে। সাইপ্রাসের এই অঞ্চল থেকে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের কোনো প্রয়োজন নেই। ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা ৪,০০০ কি.মি. বা ৫,০০০ কি.মি হওয়ার দরকার হবে না। মাত্র ২০০ কি.মি পাল্লা সম্পন্ন মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে পুরো তুরস্ক, সিরিয়া এবং ফিলিস্তিনে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো সম্ভব আমেরিকার পক্ষে। পূর্বেই বলেছি, সাইপ্রাস ভূমধ্যসাগরে ভাসমান এক প্রাকৃতিক রণতরীর ন্যায়। সাইপ্রাস যার হাতে থাকবে, সে ভূমধ্যসাগরসহ পুরো অঞ্চলের উপর কর্তৃত্ব বজায় রাখতে পারবে। তাই এটি তুরস্কের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের সাথে সম্পর্কিত। শুধু তুরস্ক বললে ভুল হবে। সিরিয়া, ফিলিস্তিন এবং মিশরও এর সাথে সম্পৃক্ত। মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি-শৃংখলা রক্ষার জন্য, পুরো মুসলিম বিশ্বের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য এবং তুরস্কের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সাইপ্রাসের অপরিসীম।
এসব বিষয়কে মাথায় রেখেই প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান ১৯৭৪ সালে সাইপ্রাস শান্তি অভিযান পরিচালনা করে সাইপ্রাসের বর্তমান তার্কি নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলকে স্বাধীন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি সেখানকার মুসলিমদের উপর গণহত্যা বন্ধের সাথে তুরস্ক ও পুরো মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিলেন।
শেষ পর্যন্ত ১৯৮৩ সালে সেখানকার তুর্কিরা Turkish Republic of Northern Syprus রাষ্ট্র গঠন করে। সেখানে নির্বাচন হয় সরকার গঠন হয় তুরস্ক সেখানে অর্থনৈতিক সহায়তা দেয় এবং দিয়ে যাচ্ছে এখনো। বহু তুর্কি সেনা সদস্যও রয়েছে সেখানে। পরবর্তীতে বহুবার সেখানে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে একটা ফেডারেল রাষ্ট্র গঠন করতে প্রস্তাব দেয় তুরস্ক, পুরো সাইপ্রাস নিয়ে। ২০০৪ সালে জাতিসংঘের তখন কাছ সেক্রেটারি জেনারেল কফি আনান এ প্রস্তাবের সমর্থনে বিস্তারিত একটা পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন যা “আনান প্ল্যান” নামে পরিচিত। তুরস্ক সেই প্রস্তাব মানলেও গ্রিক সাইপ্রাস এ প্রস্তাব মানতে অস্বীকৃতি জানায়। বিবাদ যখন চলছে ঠিক সেই সময়ে এই অমীমাংসিত দ্বীপের এক অংশকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অংশ করে নেওয়া হয় অর্থাৎ ২০০৪ সালে গ্রিক-সাইপ্রাস
কে ইউরোপীয় ইউনিয়ন তার সদস্য করে নেয়। আর তুরস্ক অংশটি পড়ে থাকে এর বাইরে। যদিও ইউরোপীয় ইউনিয়নের গঠনতন্ত্র যা “ওপেন হাইজেন ক্রাইটেরিয়া” নামে পরিচিত। এই গঠনতন্ত্র অনুযায়ী অমীমাংসিত কোন অঞ্চলকে বা ভূখণ্ডকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব না কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিজের সেই আইন লঙ্ঘন করেই গ্রিক-সাইপ্রাসকে সদস্য করে নেয়। আর সাইপ্রাস দ্বীপের সমস্যার সমাধান আরো কঠিন থেকে কঠিনতর হয়। তারপরও ওই দ্বীপে বড় ধরনের সংঘাত এড়াতে সেখানে যেকোনো ধরনের অস্ত্র বিক্রি করার উপরে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। গ্রিক-সাইপ্রাস এবং তুর্কি সাইপ্রাস কাউকে কেউ অস্ত্র দিতে পারবে না এরকম একটা আন্তর্জাতিক সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু গ্রিক সেখানে অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রাখে এবং তারা চায় তুর্কি সাইপ্রাসের অন্তর্ভুক্ত করে নিতে। আর তুরস্ক চায় তুর্কি সাইপ্রাসের ক্ষমতা তুর্কিদের হাতে রেখে ফেডারেশন গঠন করতে; যেখানে সাইপ্রাসের উভয় পক্ষে সমান অধিকার থাকবে। কিন্তু এই প্রস্তাব মেনে নেয়নি গ্রিক-সাইপ্রাস। সে কারণে কোন সমাধানে আসতে পারছে না। তারপরও তুরস্ক, ব্রিটেন, জাতিসংঘ সহ আরো অনেক দেশ এবং সংস্থা এই সাইপ্রাস সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে কিন্তু কোন সমাধান এখনও হয়নি। পশ্চিমারা গ্রিক সাইপ্রাসের পক্ষেই বেশি গুরুত্ব দেয় এবং তাদের মতে তুরস্ক সেখানে অবৈধ দখলদার। আর তুরস্কের কথা হচ্ছে সাইপ্রাসে বসবাসর তুর্কি মুসলমানদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করা পর্যন্ত তুরস্ক ওই এলাকা ছাড়বেনা। তাই এখনো দুই ভাগে বিভক্ত অবস্থায় আছে সাইপ্রাস। মাঝখানে জাতিসংঘের একটা তিন লাইন আছে সেখানে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী আছে তুরস্কের জন্য ৪০ হাজার সেনা আছে তুর্কি-সাইপ্রাসে। ব্রিটেনের সেখানে সামরিক ঘাঁটি আছে তা ব্রিটেনকে লিখিতভাবে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ ওই সামরিক ঘাটি যে ভূমিতে অবস্থিত সেটুকু এখনও ব্রিটেনের না। ব্রিটেনের দুইটি সামরিক ঘাঁটি আছে সেখানে। এই পরিস্থিতির মধ্যে গত কয়েকদিন আগে আমেরিকা গ্রিক-সাইপ্রাসের উপর থেকে সেই অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেয় অর্থাৎ আমেরিকা ঘোষণা দেয় যে গ্রিক-সাইপ্রাসের কাছে তারা অস্ত্র বিক্রি করবে। তুরস্ক এর বিরোধিতা করছে এবং বলছে যে এই অস্ত্র বিক্রি করলে গ্রীক সাইপ্রাসে সংঘাত আরও বাড়বে এবং আমেরিকা এই সাইপ্রাস ইস্যুতে যে নিউট্রাল বা দুই পক্ষের মাঝখানে সমান দূরত্ব বজায় রাখার যে নীতি ছিল সেই নীতি থেকে তারা সরে আসলো। এই সিদ্ধান্তের কারণে সাইপ্রাসের সংঘাত আরো মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। যদি আমেরিকা তার এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে না আসে, তাহলে তুরস্ক তার সেখানে সামরিক উপস্থিতি আরও বাড়াবে। ইতিমধ্যে তুর্কি সাইপ্রাসের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেখানে থাকা জাতিসংঘের শান্তি মিশনকে তাদের সৈন্য নিয়ে চলে যেতে বলেছেন। তুরস্ক তুর্কি সাইপ্রাসের সব চাহিদা পূরণ করছে। যেমন সেখানে তুরস্ক থেকে ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইন টেনে খাবার পানি সরবরাহ করছে। তুরস্কে এখন তার বন্ধুরাষ্ট্র গুলোকে আহ্বান জানিয়েছে তারা যেন শীঘ্রই এই তুর্কি সাইপ্রাসকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। রাশিয়া, আজারবাইজান, পাকিস্তান, কাতারসহ আরও কিছুতে স্বীকৃতি দিতে পারে বলেও তুরস্কের গণমাধ্যমে বিভিন্ন সময় খবর প্রচার করা হয়। এখন ধারণা করা হচ্ছে যে তুরস্ক এই তুর্কি সাইপ্রাসে আরো দ্রুতগতিতে অস্ত্র এবং সেনা মতায়ন করবে। এখন তুরস্ক সেখানে সামরিক ঘাঁটি গড়ারও পরিকল্পনা করছে। তুর্কি সাইপ্রাসের একটা জায়গা তুরস্ককে সামরিক ঘাঁটি তৈরি করার জন্য লিজ দেওয়া হয়েছে। সেখানে বিমান ঘাঁটি নৌকাঘাঁটি এবং একটা ড্রোন ঘাটিও নির্মাণ করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তুরস্কের কিলার ড্রোন সেখানে পাঠানো হয়েছে। তুরস্কের রাষ্ট্রপতি বলেছেন, তুর্কি সাইপ্রাসকে চারিদিক থেকে রক্ষা করার জন্য তুর্কি ড্রোনগুলা সর্বদা কাজ করে যাচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও এই অঞ্চলের নিরাপত্তায় তুরস্ক সবকিছু করবে। তুরস্কের বিমানবাহী রণতরী যেটা এখন ড্রোনবাহী রণতরীতে রূপান্তরিত হচ্ছে সেটাও আগামী বছর সার্ভিসে আসলে হয়তোবা এই দ্বীপেরই আশেপাশে মোতায়ন করা হবে। সুতরাং আগামী বছর অর্থাৎ লুজান চুক্তির ১০০ বছরে সেখানে বড় ধরনের একটা সংঘাত হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।