মুসলিম পোর্ট

তেহরানে গত সপ্তাহে গুপ্ত হত্যায় শহীদ ইসমাইল হানিয়া নিহত হওয়ার পর হামাসের রাজনৈতিক শাখার নতুন প্রধান হিসেবে সদ্য নিয়োগ পেয়েছেন ইয়াহিয়াসিনওয়ার।এর মাধ্যমে মহান এই মুজাহিদকে জানার কৌতহলও বেড়েগিয়েছে জনমনে। কে এই ইয়াহিয়া সিনওয়ার? কেন-ই বা দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে ইজরায়েলি কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন সিনওয়ার?

প্রাথমিক জীবন:

ইয়াহিয়া ইবরাহিম হাসান সিনওয়ারের জন্ম ১৯৬২ সালে খান ইউনুসের একটি শরণার্থী শিবিরে এবং এটি তখন মিশরের অধীনে ছিল। তার পরিবার আস্কালান থেকে ১৯৪৮ সালে গাজা উপত্যকায় স্থানান্তরিত হয়। খান ইউনিস সেকেন্ডারি স্কুল থেকে মাধ্যমিকে স্নাতক হওয়ার পর তিনি গাজা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং সেখানে তিনি আরবি স্টাডিজে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।

কর্মজীবন:

আস সিনওয়ারকে প্রথম ১৯৮২ সালে নাশকতামূলক কার্যকলাপের জন্য গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং তিনি ফারা কারাগারে বেশ কয়েক মাস ছিলেন। সেখানে তিনি সালাহ শেহাদসহ অন্যান্য ফিলিস্তিনি কর্মীদের সাথে দেখা করেছিলেন এবং সেখান থেকেই নিজেকে কুদস মুক্তি আন্দোলনের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেন।

দখলদার ইজরায়েলি বাহিনী কর্তৃক ১৯৮৫ সালে তিঁনি আবার গ্রেপ্তার হন। মুক্তি পাওয়ার পর মহান এই মুজাহিদ রাহি মুশতাহার সাথে মুনাজ্জামাতুল জিহাদ ওয়াল-দাওয়া নিরাপত্তাসংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। এ সংস্থাটি ফিলিস্তিনি আন্দোলনে ইজরায়েলি গুপ্তচরদের শনাক্ত করার কাজ করত এবং এটি ১৯৮৭ সালে হামাসের পুলিশ বাহিনী হয়ে ওঠে।

১৯৮৮ সালে ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে দুই ইজরায়েলি সৈন্যকে অপহরণ ও হত্যা এবং চার ফিলিস্তিনি গুপ্তচর হত্যার পরিকল্পনার দায়ে গ্রেপ্তার করা হয় জায়নবাদি ইজরায়েল। পরে হত্যার জন্য দোষীও সাব্যস্ত করা হয়। ১৯৮৯ সালে তাকে চারটি মামলার জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে ২০০৮ সালে দখলদার ইজরায়েলের কারাগারে সাজা ভোগ করার সময় জীবন বাঁচাতে তার মস্তিষ্কে একটি টিউমার অপসারণের জন্য অপারেশন করা হয়েছিল। সিনওয়ার তাঁর সাজা হিসেবে ২২ বছর কাটান এবং ২০১১ সালে ইজরায়েলি সৈনিক গিলাদ শালিতের জন্য বন্দী বিনিময়ে ১,০২৬ জনের মধ্যে মুক্তি পাওয়া সবচেয়ে প্রবীণ ফিলিস্তিনি বন্দী তিঁনিই ছিলেন।

২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে সিনওয়ার গোপনে গাজা উপত্যকায় হামাসের নেতা নির্বাচিত হন এবং ইসমাইল হানিয়াহ’র কাছ থেকে তিঁনি দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মার্চ মাসে মহান এই মুজাহিদ গাজা ভূখণ্ডের হামাস নিয়ন্ত্রিত প্রশাসনিক কমিটি প্রতিষ্ঠা করেন। যার অর্থ হলো, তিনি রামাল্লায় ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সাথে কোনো প্রকারের ক্ষমতা ভাগাভাগির বিরোধিতা করেন এবং তিনি ইজরায়েলের সাথে যেকোনো পুনর্মিলন প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি আরও ইজরায়েল সৈন্য বন্দী করার জন্য হামাস যোদ্ধাদের আহ্বান জানান।

২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মিশরে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনার একটি নতুন দফা শুরু হয় এবং সিনওয়ার গাজা ভখণ্ডে হামাসের প্রশাসনিক কমিটি ভেঙে দিতে সম্মত হন।  অতি সম্প্রতি তিনি গাজায় ২০১৭ সালে নতুন ইজরায়েলি প্রযুক্তি দ্বারা বন্ধ করার আগে মুহাম্মাদ দেইফ যে টানেলগুলি ব্যবহার করে লুকিয়ে ইজরায়েলের যোদ্ধাদের অনুপ্রবেশ করাতে চেয়েছিলেন, সেগুলো বাতিল করে দেন।

২০২১ সালের মার্চে গোপনে অনুষ্ঠিত একটি নির্বাচনে তিনি হামাসের গাজা শাখার প্রধান হিসাবে দ্বিতীয় বার চার বছরের মেয়াদে নির্বাচিত হন। সিনওয়ার গাজায় সর্বোচ্চ পদমর্যাদার হামাস কর্মকর্তা এবং গাজার দে ফাক্তো শাসক। এর সাথে বলা হয়, তিঁনি হানিয়ার পর হামাসের দ্বিতীয় শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব।

২০২১ সালের ১৫ মে একটি ইসরায়েলি বিমান হামলা হামাস নেতার বাড়িতে আঘাত করে বলে জানা যায়। তবে সেখানে কোন মৃত্যু বা আহত হওয়ার তাৎক্ষণিক বিবরণ পাওয়া যায়নি। ইজরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মধ্যে দক্ষিণ গাজার খান ইউনুস অঞ্চলে এই হামলা চালানো হয়। যাহোক, তার পরের সপ্তাহেই তিনি প্রকাশ্যে হাজির হন। সিনওয়ারের সবচেয়ে সুস্পষ্ট ও সাহসী অবস্থানের একটি দৃষ্টান্ত ফুটে উঠে ২০২১ সালের ২৭ মে, যখন তিনি একটি প্রেস কনফারেন্সে উল্লেখ করেছিলেন, প্রেস কনফারেন্সের পর পায়ে হেঁটে বাড়িতে যাবেন!

এমনকি দখলদার ইজরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে তাচ্ছিল্য করে ইয়াহিয়া সিনওয়ার নিজেকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সিনওয়ার তারপর কয়েক ঘন্টা গাজার রাস্তায় ঘুরেন এবং জনসাধারণের সাথে সেলফি তুলে সময় কাটিয়েছিলেন।

বর্তমান দায়িত্ব:

শহীদ ইসমাইল হানিয়া হত্যাকাণ্ডের পর মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে উত্তেজনা যখন তুঙ্গে, ঠিক তখন হানিয়ার উত্তরসূরি হিসেবে গতকাল মঙ্গলবার সিনওয়ারের নাম ঘোষণা করা হয়। নিজের মাটিতে হানিয়াকে হত্যার ঘটনায় ইতিমধ্যে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণের অঙ্গীকার করেছে ইরান।

গত ৩১ জুলাই হানিয়ার ওপর ওই হামলার ঘটনায় ইসরায়েল এখনো তার সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার বা অস্বীকার কোনোটি করেনি। অজ্ঞাত স্থান থেকে সিনওয়ার তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে কতটুকু যোগাযোগ বজায় রাখতে সক্ষম হবেন, ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের দৈনন্দিন রাজনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে যেতে ও গাজায় যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠায় মধ্যস্থতার কাজ তদারক করতে পারবেন সমগ্র উম্মাহ সেটি দেখার অপেক্ষায়। ১৯৮৭ সালে শেখ আহমেদ ইয়াসিন হামাস প্রতিষ্ঠা করার পরপরই যাঁরা সংগঠনটির নেতৃত্বে আসেন, ইয়াহিয়া সিনওয়ার তাঁদের একজন। পরের বছরই ইসরায়েলি বাহিনী তাঁকে গ্রেপ্তার করে ও চার দফা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে।

– সাদ সিদ্দিকী