মুসলিম পোর্ট

প্রতিটি শহরের ইতিহাসের নিজস্ব সুবাস থাকে। সভ্যতার শহর শাহী বাংলা ও সুবে বাংলার দান ঢাকা তথা আজকের পুরান ঢাকাও তার ব্যতিক্রম নয়। মসলিন যুগের স্মৃতি, সিন্দুকবন্দি ইতিহাসের মতোই একসময় এখানে বাতাসে ভাসতো সুগন্ধির ঘ্রাণ—উদ, আতর, গোলাপ জল কিংবা চন্দনের মিষ্টি সুবাস।

বাংলার সুগন্ধি সংস্কৃতি শুরু হয় অনেক আগে, আরব ও পারস্যের ব্যবসায়ীদের হাত ধরে। ইসলাম প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে এসব অঞ্চলের বণিক ও সুফি সাধকেরা বাংলা অঞ্চলে আতর ও সুগন্ধির ব্যবহার নিয়ে আসেন। খ্রিস্টীয় ১৩-১৪ শতকে দিল্লি সালতানাতের শাসনামলে বাংলার অভিজাতদের মধ্যে আতরের ব্যবহার শুরু হয়।

কিন্তু বাংলায় আতরের স্বর্ণযুগ শুরু হয় মূলত মুঘল আমলে (১৫৭৬-১৭৫৭)। মুঘল সম্রাটরা আতরকে শুধু বিলাসিতার বস্তু হিসেবেই নয়, বরং ধর্মীয় ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবেও গ্রহণ করেন। মুঘল শাসকরা আতরকে শুধু বিলাসিতার অংশ হিসেবেই দেখেননি, বরং এটি ছিল অভিজাত সংস্কৃতির প্রতীক। ঢাকার অভিজাতদের মধ্যে আতর ব্যবহারের প্রবণতা তৈরি হয়, যা নবাবি আমলে এসে আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

সেই সময় পুরান ঢাকা ও সোনারগাঁওয়ের বাজারগুলোতে দেখা মিলত বাহারি আতরের—উদ, চন্দন, গোলাপ, কস্তুরি, কেওড়া, কাশ্মীরি জাফরান ইত্যাদির মিশ্রণে তৈরি অনন্য সুগন্ধি। ইসলামপুর, চকবাজার ও বকশীবাজারের অলিগলিতে আতর ব্যবসা জমজমাট হয়ে ওঠে। আতরের ছোট কাঁচের বোতল বা দস্তার কেটলি যেন এক টুকরো রাজকীয়তার স্মারক ছিল।

একসময় পুরান ঢাকার আতরের চাহিদা এতটাই বেশি ছিল যে ব্যবসায়ীরা আরব, পারস্য ও তুরস্ক থেকে উৎকৃষ্ট মানের আতর আনাতেন। কিন্তু ধীরে ধীরে এই ঐতিহ্য ম্লান হতে থাকে। আতরের জায়গা দখল করে নেয় পাশ্চাত্যের সুগন্ধি, পারফিউম, বডি স্প্রে। এক সময় যেসব দোকানে শত শত আতরের বোতল সাজানো থাকত, সেগুলোর জায়গা এখন নিয়েছে আধুনিক পারফিউম ব্র্যান্ড।

এখন সময় গড়িয়েছে। আতরের সুঘ্রাণও ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে উঠেছে যেন! এই অঞ্চলটির একজন প্রবীণ আতর ব্যবসায়ী আক্ষেপ করে বলেন—

“আগে বিয়ের কনে, বর বা ঈদের নতুন পোশাকের সাথে আতর ছিল অবিচ্ছেদ্য। এখন তরুণরা পারফিউমের দিকে ঝুঁকেছে। এই আতরের কেটলিগুলো একসময় আমাদের ঐতিহ্যের প্রতীক ছিল, এখন যেন শুধুই স্মৃতি।”

চকবাজারের এক পুরনো বিক্রেতার কথায় পাওয়া যায় আরও করুণ সুর—
“আগে আমাদের দোকানে ১০০ রকমের আতর থাকত, এখন কেবল নির্দিষ্ট কিছু ক্রেতাই আসে। রাজকীয় আতরের সেই গন্ধ আর নেই।”

তবে এখনো কিছু মানুষ আতরের ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। নামাজের আগে আতর ব্যবহারের ধর্মীয় রীতি আজও অনেকের মধ্যে টিকে আছে। কিছু উদ্যোক্তা ই-কমার্স ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আতরকে নতুনভাবে জনপ্রিয় করার চেষ্টা করছেন।

কিন্তু পুরান ঢাকার আতরের সেই স্বর্ণযুগ কি আবার ফিরে আসবে? হয়তো না, হয়তো হ্যাঁ। তবে যতদিন না ঢাকার বাতাসে আবার রাজকীয় আতরের সুবাস ভেসে ওঠে, ততদিন হয়তো কেবলই স্মৃতির ঘ্রাণ বয়ে বেড়াবে পুরান ঢাকার অলিগলি।

সংকলনঃ মারুফা জাহান মুমু