মুসলিম পোর্ট

দক্ষিণ-পূর্ব আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক। যার পূর্বে ভারত মহাসাগর, উত্তরে তানজানিয়া ও উত্তর পশ্চিমে মালাউই ও জাম্বিয়া। ভৌগলিক বিশ্লেষণেই অঞ্চলগুলোর সমৃদ্ধ নিজস্ব বাস্তুসংস্থান ও উন্নত কৃষি প্রাসঙ্গিকতা সুস্পষ্ট। বলা হয়, যার উপর ভিত্তি করেই ৮ম শতকের শুরুর দিকে আরব-আফ্রিকান মিশ্র শ্রেনী ‘আরব সোয়াহিলি’ -গণ ১৪শ শতক পর্যন্ত অঞ্চলটিকে একটি উন্নত অর্থনীতি উপহার দিয়েছিলেন। যেটিকে ১৩শ থেকে ১৫শ শতককালীন সময়ে তানজানিয়াকে কেন্দ্র করে মুসলিমদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ‘কিলওয়া সালতানাত’ আরো বেগবান করে তুলে।

একই সাথে প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এই অঞ্চলটির দক্ষিণ-পূর্বেই অবস্থিত ১৬ কি.মি. চ্যানেলের মোজাম্বিক প্রণালী যার ঠিক ওপারেই রয়েছে এক সময়ে মুসলিমদের দ্বারা আফ্রিকার ঐতিহ্য, অর্থনীতি ও সংস্কৃতিতে মারাত্মক প্রভাব সৃষ্টিকারী দ্বীপ রাষ্ট্র মাদাগাস্কার।

ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে- কৃষি ও প্রাকৃতিক সম্পদ এর নেশায় ৭ম শতক এর প্রারম্ভিক সময় থেকেই আরব বণিকদের আনাগোনা বাড়তে থাকে অত্র অঞ্চলে। কখনো ভারত মহাসাগর ও মোজাম্বিক প্রণালীতে ভারতীয় উপমহাদেশের বণিকদের বাণিজ্যিক জাহাজেরও দেখা মিলতো, তবে ১৩শ শতকের পূর্বে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে উপমহাদেশের বণিকদের তেমন কোন বাণিজ্যিক ভিত্তি লক্ষ্য করা যায়না।

উমাইয়া খলিফা আমিরে মু’য়াবিয়া (র.) এর শাসনকালে উকবা বিন নাফির নেতৃত্বে আফ্রিকার উত্তর উপকূলে মুসলিমদের শক্তিশালী অবস্থানের ফলে নতুন এক দ্বার উন্মোচিত হয় মূলত আগত আরব ও পারস্য বণিকদের মাধ্যমেই। কেননা তারা বাণিজ্যের উদ্দ্যেশ্যে নৌ-পাল তুললেও পালে ছিল মানবতার মুক্তি প্রদানের ইখলাসি স্বু-বাতাস।

সেসময় মোজাম্বিককে আরবিতে সম্মোধন করা হতো ‘বিলাদ-আস-সুফালা’ নামে। ৯১৬ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদের বিখ্যাত লেখক আল মাস’উদ পরিভাষাটি তার লিখনিতে উল্লেখ করেন। তবে ‘আল ইদ্রিসি’ গোটা উত্তর আফ্রিকাকেই কয়েকটি ভাগে ভাগ করে উল্লেখ করেন। যেমন- বিলাদ আল বারবারা (বর্তমানে সোমালি উপকূল), বিলাদ আল জানস (বর্তমান কেনিয়া ও তানজানিয়া), এবং মোজাম্বিককে বলা হতো- বিলাদ আল সুফালা বা আল জানজি (The land of metal or gold)।

কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো- ১৫শ শতকের পূর্ব পর্যন্ত প্রায় ৮’ শত বছর ধরে মুসলিমদের আদালতপূর্ণ প্রভাবের বদৌলতে গড়ে উঠা অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে সুসমৃদ্ধ এই অঞ্চলটি ১৫শ শতক থেকে ১৯৭৫ (মোজাম্বিকের স্বাধীনতার বছর) সাল পর্যন্ত পর্তুগিজদের নিকৃষ্টতম ও ভয়াবহ উপনিবেশের শিকার হয়ে আজ বিশ্বের সবচেয়ে দরীদ্রপীড়িত রাষ্ট্রের একটিতে পরিণত হয়েছে। একই সাথে স্থানীয় মুসলিম গোত্র সমূহের মাধ্যামে একসময় উমাইয়া, আব্বাসীয় ও ওসমানী খেলাফতের ছত্রছায়ায় বেড়ে উঠা মোজাম্বিকসহ গোটা আফ্রিকা ভূখণ্ডই যেন আজ অনাহার, খড়া ও দুর্ভিক্ষের প্রতীক।

**উপনিবেশপূর্ব মোজাম্বিক-এর অবস্থান।

১৬’শ শতক পূর্ব মোজাম্বিক সহ গোটা উত্তর আফ্রিকা অঞ্চলের তেমন কোনো গচ্ছিত ইতিহাস পাওয়া সম্ভব না হলেও প্রায় ৫০০ শত বছরের নিকৃষ্টতম পর্তুগিজ শাসন ও শোষণ এর পরও টিকে থাকা প্রাচীন মসজিদসহ বেশ কিছু মুসলিম স্থাপত্যের দিকে নজর দিলে এব্যাপারটি খুব সহজেই বোধগম্য যে, এই অঞ্চলটিতে ন্যায়ের উত্তরসূরী কারা। এমন কি! ১৫৬৪ সালে পর্তুগিজ শাসন সম্পূর্ণরূপে স্থাপিত হওয়ার পরও ১৮শ শতক পর্যন্ত দেশটির উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলে ‘সোয়াহিলি’ সালতানাদের সাথে সম্পৃক্ততা সুস্পষ্ট। যাদের কল্যাণেই একসময় মোজাম্বিকানরা সারা দুনিয়ায় স্বর্ণ, মোনিকাঞ্চন পাথর সহ কৃষি উৎপাদন ও সরবরাহে শ্রেষ্ঠ অবস্থান দখল করে ছিল। একই সাথে ইসলামি সংস্কৃতির প্রভাবও কোনো অংশে কম ছিল না।

বিশেষ করে, ৮ম শতক থেকে ১১শ শতক পর্যন্ত দেশটির শানগা, মানদা, চিবিউন বা টানা অঞ্চলে অর্থনৈতিক শক্তিশালী অবস্থান সৃষ্টি হয় মুসলিমদের কল্যাণেই। আজকের মোজাম্বিক এর বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংগঠন গুলো নিজেদেরকে উক্ত নামসমূহের মাধ্যমে উপস্থাপন করাটাও যার বৃহত্তর প্রমাণ বহন করে। যেমন; ‘শানগা’- বর্তমান দরিদ্রপিড়িত মোজাম্বিক এর সফল অর্থনৈতিক সংগঠন গুলোর একটি, ‘চিবিউন ও টানা’ জাতিসংঘের স্বীকৃত প্রাচীন স্থাপত্য অঞ্চল, যেগুলোর পরতে পরতে আব্বাসীয় ধারার স্থাপত্যের ছোঁয়া বিদ্যমান।

বিশেষ করে, ৮ম শতক থেকে ১১শ শতক পর্যন্ত দেশটির শানগা, মানদা, চিবিউন বা টানা অঞ্চলে অর্থনৈতিক শক্তিশালী অবস্থান সৃষ্টি হয় মুসলিমদের কল্যাণেই।

আবার, ‘কিলওয়া সালতানাদ’ এর কথা উল্লেখ না করলেই নয়। তানজানিয়াকে রাজধানী করে গড়ে উঠা এই সালতানাতটি সমগ্র উত্তর আফ্রিকায় স্বর্ণসময় পার করেছে ১৩শ শতক থেকে পর্তুগিজ আগমন পর্যন্ত (১৫০০ শতক)। এমনকি, সালতানাতটি ১৮শ শতকে ভয়াবহ গণহত্যার শিকার হওয়ার আগ পর্যন্ত টিকে ছিল।

পর্তুগিজদের লেখা এক ইতিহাস গ্রন্থে (Eduardo do Couto Lupi, 1895-1910) তারাই উল্লেখ করে- “মুসা এবং হাসান নামের দুই মুসলিম তাদের আরো কিছু সঙ্গী নিয়ে কিলওয়া সালতানাত (পার্শ্ববর্তী তানজানিয়া অঞ্চল) থেকে মোজাম্বিকে আসে ১১শ শতকের দিকে”।

তথ্যটির সত্যতা থাকলেও হতে পারে তাদের আগমনের মাধ্যমেই মোজাম্বিকের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক রূপ ভীষণভাবে পরিবর্তন হতে থাকে। তবে নিঃসন্দেহে তাদের আগমনই মোজাম্বিকে প্রথম মুসলিম আগমন নয়।

বলাবাহুল্য, মাদাগাস্কারে স্থানীয় মুসলিম গোত্রসমূহ-ই মূল ভিত্তি হয়ে ন্যায়ভিত্তিক শাসন প্রতিষ্ঠা করলেও মোজাম্বিক প্রণালীর এপারের অঞ্চলগুলোর প্রেক্ষাপট কিছুটা ভিন্ন ছিল। যেমন- বিশেষ করে কিলওয়া, সোওয়াহিলি অথবা শানগা, মানদা ইত্যাদি ছোট ছোট সালতানাতের অধীনেই উত্তর আফ্রিকায় ইসলামের সুবাতাস বয়েছিল।

তবে ১১শ শতক পরবর্তী সময়ে উত্তর আফ্রিকা বিশেষ করে মোজাম্বিকের অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্নই মুসলিমদের হাতে ছিল সেটি ১২শ শতক থেকে ভারত মহাসাগর ও মোজাম্বিক প্রণালীতে আরব, আনাতলিয়া, পারস্য ও ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম বণিকদের অধিকতর আনাগোনাই প্রমান করে।

ঐতিহাসিক সত্য- ১৫শ শতকের মধ্যভাগে পর্তুগিজ ও ফরাসি আগমন উত্তর আফ্রিকায় বাড়তে থাকলে সোয়াহিলিগন অ্যাংগোজ উপদ্বীপ ও মোজাম্বিক এর মাঝামাঝি অঞ্চলকে কেন্দ্র করে এক শক্তিশালী ব্যাবসায়ী ও অর্থনৈতিক ভিত্তি নির্মাণ করতে থাকেন নতুন করে। এমনকি, অঞ্চলটিতে সোয়াহিলিগনের কল্যাণেই কিলওয়া সালতানাত থেকে শেখ ও সুলতান নিয়োগ করা হতে থাকে। ফলশ্রুতিতে ১৬শ শতকে মোজাম্বিক এর দক্ষিণ ও উত্তর অঞ্চলে পর্তুগিজ ব্যাবসার কেন্দ্র শক্তিশালী হওয়ার পাশাপাশি পর্তুগীজদের দ্বারা মারাত্মক গণহত্যা সংঘটিত হওয়ার পরও এ্যাংগোজ উপদ্বীপ ও মোজাম্বিক এর মধ্যবর্তী বিশাল একটি অংশ তখনও মুসলিমদের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। পরবর্তী ২ শত বছরও (১৮শ শতক পর্যন্ত) যার শক্তিশালী অবস্থান টিকে ছিল।

বলা হয়- ১৫শ শতকের শেষ ভাগে মোজাম্বিকে পর্তুগিজ শাসন সম্পূর্ণরূপে স্থাপিত হলেও অ্যাংগোজ উপদ্বীপ ও মোজাম্বিক এর মধ্যবর্তী অঞ্চলটি তখনও ইসলামী খেলাফতের সাথে সংযোগ স্থাপন করে সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয়ভাবেও সমৃদ্ধতা অর্জন করে চলেছিল।

লক্ষ্যণীয় বিষয় যে, প্রাকৃতিক সম্পদ বা কৃষি নির্ভরশীলতা ছাড়াও মুসলিমরা সংশ্লিষ্ট অঞ্চলকে এক বহুমুখী ব্যাবসায়ীক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। যেমন- মোজাম্বিকের কোয়ারিম্বা উপদ্বীপে ‘মেলিউয়েন’ পরিচিত সিল্ক ও কটনের উন্নত পরিধেয় মুসলিমরাই উপহার দিয়েছিল। বিশ্বব্যাপী ছিল যার সুখ্যাতি।

একই সাথে, সামুদ্রিক ব্যাবসায়ী-যান (অত্র অঞ্চলে পরিচিত ছিল আরবি শব্দ داو বা Dhows নামে) উৎপাদনে মোজাম্বিক এর ছিল একক অবস্থান। রোভিউমা ভ্যালি, জামবাজি, লিমপোপো ইত্যাদি মুসলিম অঞ্চলসহ সমগ্র আফ্রিকা ও বিশ্ববাজারেও উপস্থাপিত হতো মোজাম্বিক এসকল পণ্যের দরূন। এবং এইসকল ব্যাবসায়ী কাজেও সোয়াহিলি ভাষা প্রাধান্য পেত, যেমন- ফিওমো/fumo (প্রধান), মুয়েন/mwene (সহকারী প্রধান), মিউজোজ/ Mujoge (সোয়াহিলি ব্যাবসায়ী) ইত্যাদি।

তবে মোজাম্বিকের মূল ব্যাবসায়ীক পন্য সমূহের মধ্যে সর্বাগ্রে ছিল স্বর্ণ, ধাতু, আইভোরি বা হাতির দাঁত ইত্যাদি।

* পর্তুগিজ আগমন পরবর্তী অবস্থা।

মোজাম্বিকে পাশ্চাত্যের নিকৃষ্টতম কলোনী স্থাপনের আলোচনার পূর্বে সংলিষ্ট কিছু বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন- ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে রাসূল (স.) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মদিনা রাষ্ট্রের গোড়াপত্তনের মধ্য দিয়েই ইসলামী সভ্যতার সূচনাকাল। পরবর্তীতে খেলাফতে রাশেদা, উমাইয়া, আব্বাসীয় ও সর্বশেষ ওসমানী খেলাফত এর পতনের মাধ্যমে ১৩শত বছরের ধারাবাহিক ইসলামী সভ্যতার স্থবির হয়ে যায়। এই সুদীর্ঘ সময়কাল গোটা মানবতা মুসলিমদের ন্যায়ভিত্তিক শাসননীতির আদলে থেকে শান্তিপূর্ণ জীবন পরিচালনা করেছে। আফ্রিকাও এর ছোঁয়া থেকে বাদ যায়নি।

কিন্তু ১৪শ শতক পরবর্তী ধীরে ধীরে মুসলিমরা তাদের স্বকীয় অবস্থান দুর্বল করে ফেলতে শুরু করে। ক্ষমতার পালাবদল হতে থাকে পাশ্চাত্যের দিকে।

পাশ্চাত্যের উত্থানের পর্যায়সমূহকে যদি লক্ষ্য করা হয়-

*জ্ঞানার্জন

*ভিত্তি তৈরী

*ক্ষমতায়ন

যার সর্বশেষ এ্যাজেন্ডা ‘ক্ষমতায়ন’ সম্ভব করে তোলে ভয়াবহ গণহত্যা ও অঞ্চলে অঞ্চলে উপনিবেশ স্থাপনের মাধ্যমে। মুসলিমদের স্থবিরতার সময় ঘনিয়ে আসে ব্রিটিশ, ফরাসি, ইতালিয়ান, স্পেনিশ ও পর্তুগিজদের নিকৃষ্টতম কলোনী স্থাপন ও শোষণ এর সময়কালে।

প্রকৃতপক্ষে, বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলেও ইউরোপ তখন থেকেই প্রভুত্বকামী হয়ে উঠতে শুরু করে। ইউরোপের এই মানসিকতার নমুনা অতীত থেকে আজকের বাস্তবতায়ও জ্বলন্ত। তাদের আর্টিলারি থেকে নাট্যমঞ্চ এবং বোমা থেকে গীতিকাব্য অবধি সবকিছুতেই রয়েছে এই মানসিকতার ছাপ। আধুনিক পশ্চিমা ঔপনিবেশিকতার মধ্যে সেটা অনেক বেশি খোলাসা হয়েছে। ইউরোপীয় কথিত আধুনিকতার সূচনাবিন্দুতে বিশ্বের প্রতি তাদের মনোভাব কেমন ছিল, সেটা দেখার জন্য টরডিসিলাস চুক্তির সিদ্ধান্তের দিকে তাকাতে পারি-

বিশ্বের ওপর স্পেন ও পর্তুগালের অধিকার প্রশ্নে পোপ ষষ্ঠ আলেকজান্ডার (১৪৩১-১৫০৩) এ সিদ্ধান্ত প্রদান করেন ১৪৯৪ সালের ৭ জুন। তিনি ইউরোপের বাইরের গোটা দুনিয়াকে বণ্টন করে দেন স্পেন ও পর্তুগালের মধ্যে। ইউরোপবহির্ভূত দুনিয়াকে তিনি দুই ভাগ করেন। পশ্চিম ভাগ দেন স্পেনকে, পূর্বভাগ পর্তুগালকে। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশ দখল করে শাসন করবে স্পেন। পর্তুগাল দখল ও শাসন করবে আফ্রিকা।

এরই ধারাবাহিকতায়, ১৪শ শতক থেকেই আফ্রিকায় পর্তুগিজদের গুঞ্জন অপ্রত্যাশিতভাবেই প্রাসঙ্গিক হতে শুরু করে। ব্যাবসায়ের উদ্দেশ্যে তাদের আগমন থাকলেও ধীরে ধীরে স্থানীয় গোত্র সমূহের ধর্মান্তরিতকরণ, প্রলোভন ইত্যাদির মাধ্যমে মুসলিমদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সমৃদ্ধ সংস্কৃতি, অর্থনীতিকে দূষণ করতে শুরু করে।

পর্তুগিজদের লিখনি অনুযায়ী- “১৫ শ শতকের শুরুর দিকে “ভাস্কো দা গামা” মোজাম্বিকে হাজির হয়ে দেখেন, সমগ্র মোজাম্বিক কিলওয়া সালতানাতের অধীনে অঞ্চল ভিত্তিক শেখদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে”।

পর্তুগালের বিখ্যাত লেখক দোয়ারতে বারবোজা-ও তার লিখনিতে উল্লেখ করেন – “এ্যাংগোজ, সোফালা, কিউওয়ামা বা মোজাম্বিকসহ এর সকল অঞ্চলই কিলওয়া সালতানাতের অধীনে ছিল”।

একই সাথে মধ্য মোজাম্বিকের কিলিমানি, ইনহেম্বেন, উত্তর মোজাম্বিক এর বাজারুতো অঞ্চল সহ আশেপাশের সকল অঞ্চলই সোয়াহিলি মুসলিমদের নিয়ন্ত্রণে ছিল।

পরবর্তীতে ১৫শ শতকের ৬০ এর দশকে ব্যাবসায়ীকভাবেই অত্র অঞ্চলে পর্তুগিজদের প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং ১৬শ শতকের শুরুতেই মোজাম্বিকের অস্তিত্বে বিষফোড়া হিসেবে উত্থান হয় পর্তুগিজ শাসন এর। সেসময় থেকে ৪০০ শত বছরের অধিক সময়-কাল পরেও আজকের মোজাম্বিক এর অবস্থা দেখে শোষণ এর মাত্রা সহজেই অনুমেয়।

তবে এক্ষেত্রে ১৮৮৫ সালে বার্লিন কনফারেন্স এর পূর্ব পর্যন্ত মোজাম্বিক এর সম্পূর্ণ অঞ্চলে পর্তুগাল শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়নি।

১৫শ শতকে সোয়াহিলি-গণের নতুন করে প্রতিষ্ঠিত এ্যাংগোজ উপদ্বীপ ও মোজাম্বিক এর মধ্যবর্তী কিলওয়া সালতানাত টিকে ছিল ১৮শ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত।

বার্লিন কনফারেন্স এর পরই পর্তুগিজরা ওই অঞ্চলেও তাদের প্রকৃত রূপ প্রদর্শন শুরু করে। ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ প্রতিষ্ঠা করে কতৃত্ব দখল নিয়ে নেয়।

ঐতিহাসিকদের মতে- “১৭ শ শতকে মধ্য মোজাম্বিকে স্থানীয়দের প্রতি পর্তুগিজদের বর্বরতার দৃশ্য এমন ছিল যে, ছোট ছোট শিশু যাদেরকে তখনও কোনো কাজ করানো সম্ভব হতোনা, পর্তুগিজরা তাদের তরবারি বা চাকুর ধার পরীক্ষা করার জন্য শিশুদের গলা কেটে পরীক্ষা করতো”। এরূপ হাজারো নৃশংসতার চাদরে আবৃত মোজাম্বিকসহ গোটা দুনিয়ার ঔপনিবেশিক অঞ্চল সমূহ।

পর্তুগিজদের আগমনের পর গণহত্যার পাশাপাশি মোজাম্বিকসহ গোটা আফ্রিকার সবচেয়ে ভয়াবহ অধ্যায়ের আরেকটি হলো তাদেরকে সমগ্র ইউরোপে দাস হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া তথা দাস প্রথা।

উল্লেখিত, পাচারকৃত এই হতভাগা দাসদের বেশির ভাগই ছিল মুসলমান।

মার্কিন কোস্টগার্ড আলেকজান্ডার মারে পামার ওরফে অ্যালেক্স হেলির (১৯২১-১৯৯২) আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘রুটস : দ্য সাগা অব অ্যান অ্যামেরিকান ফ্যামিলি’ (১৯৭৬) এ বিষয়ে দুনিয়ার নজর খুলে দেয়। বইটিতে রয়েছে আফ্রিকা থেকে মানুষ ধরে আনার কিছু ঘটনার প্রামাণ্য বর্ণনা।

দীর্ঘদিন ধরে গবেষণার পর তিনি জানতে পারেন আমেরিকায় তার প্রথম পূর্বপুরুষের নাম কুন্তা কিন্তে। গাম্বিয়া থেকে কুন্তা কিন্তেকে ধরে নিয়ে আসে ইউরোপীয়রা। স্বজনেরা তাকে খুঁজে পায়নি কখনো। বিভিন্ন পণ্যের সাথে পশুর খাঁচায় ভরে ১৪০ জন শিকার করা মানুষকে জাহাজে করে নিয়ে আসা হয়। রাস্তায় নির্মমতায় মারা যায় ৪২ জন ভাগ্যহত। বেঁচে থাকেন ৯৮ জন। আমেরিকার আ্যনাপোলিসের বাজারে তাদেরকে বিক্রি করা হয়। কুন্তাকে কিনে নেন জনৈক জন ওয়ালার। নামপরিচয়হীন ঝরাপাতার মতো ঝরে গেছে কুন্তা-কিন্তেদের জীবন। আ্যালেক্স হেলির গবেষণা থেকে জানা যায়- সংখ্যাহীন, সন্ধানহীন এমন কুন্তা কিন্তেরা ছিলেন মুসলমান।

পর্তুগীজদের বর্বরতা ছিল ভয়াবহ। ১৪৯৭ সালে সূচিত ভাস্কো ডা গামার (১৪৬০-১৫২৪) অভিযান ছিল পর্তুগীজদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অভিযাত্রা। এর মাধ্যমে আজকের পর্তুগাল নিজের আধিপত্য দাঁড় করাতে সক্ষম হয়। ভারতগামী যাত্রায় ভাস্কোর বাহিনী প্রথমে উপনীত হয় মোজাম্বিক ও তানজানিয়ায়। বাণিজ্যের নামে গিয়েও কামানের গোলায় উপকূলীয় শহর বিধ্বস্ত করে তারা শহরে প্রবেশ করে। যারা নতিস্বীকার করেনি, তাদের সবাইকেই হত্যা করা হয়। উল্লেখিত, স্থানীয় শেখদের অনেকেই গণহত্যা থেকে বাঁচতে বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হন। কেননা, আফ্রিকার নিজস্ব সামরিক সামর্থ্য গণহত্যা ঠেকাতে যথেষ্ট ছিলনা। একই সাথে কেন্দ্রীয় খেলাফতও ততো দিনে দূর্বল হতে শুরু করেছিল।

এভাবেই সমগ্র আফ্রিকার সাথে সাথে মোজাম্বিকও ধনকুব থেকে ধীরে ধীরে সর্বস্ব হারাতে শুরু করে। ১৫৬৪ থেকে শুরু করে ১৯৭৫, এই সুবিশাল পর্তুগিজ কলোনিয়াল সময়কালটির পর আজকের মোজাম্বিকের অবস্থা অবলোকন করলে দেখা যায়- একসময় এর ন্যায়ভিত্তিক অর্থনীতির আদলে গড়ে উঠা উন্নত অর্থনীতি, ইসলামি সংস্কৃতি বা ধর্মীয় চেতনা কোনোটির-ই অস্তিত্ব আর বাকি নেই।

তবুও, আজকের মাপুতা শহরের (মোজাম্বিক) মসজিদসহ মোজাম্বিকের মুসলিম স্থাপত্য সমূহ প্রমাণ করে, একসময় মানবতার মুক্তির কাজে প্রতিশ্রুতি বদ্ধ মুজাহিদগণ পদচিহ্ন রেখে গিয়েছেন আরব সোয়াহিলি ও কিলওয়া সালতানাতের এই গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলটিতে।

লেখক ও সংকলক- মুশফিকুর রহমান