মুসলিম পোর্ট

কফির সূত্রপাত হয়েছিলো একটি পানীয় হিসাবে। ১৫ শতাব্দীতে ইয়েমেনে সুফিদের খানকাগুলোতে একধরনের পানীয় হিসেবে কফি পানের সূত্রপাত হয়েছে বলে জানা যায়। সর্বপ্রথম সেখানেই কফি বেরিগুলিকে প্রথমে রোস্ট করা হয়েছিলো অর্থাৎ আজকে যেভাবে এই পানীয়টি তৈরি করা হয় একইভাবে সর্বপ্রথম সুফি খানকাগুলোতে তৈরি করা হয়েছিলো।

কফি মূলত ইসলামিক বিশ্বে পানীয় হিসেবে পান করা হতো এবং এই পানীয়টি সরাসরি ধর্মীয় অনুশীলনের সাথে সম্পর্কিত ছিলো। উদাহরণস্বরূপ, মুসলিমরা পবিত্র রমজান মাসে অনেক বেশি কফি পান করতো যা তাদের দিনের বেলায় রোজা রাখার ক্ষেত্রে এবং রাতে জেগে থাকতে অনেক সাহায্য করে।

১০ম শতাব্দীর শুরুর দিকে মুসলিম বিশ্বে কফি ব্যারিয়ারগুলো ঔষধি হিসেবে পরিচিত ছিলো কিন্তু ১৫ শতাব্দীতে ইয়েমেনি সুফিদের মাধ্যমে কফি পান ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং সেখান থেকে মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোতে এবং পরবর্তীতে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে।

“কফি” শব্দটি ১৫৮২ সালে ডাচ শব্দ কফির মাধ্যমে ইংরেজি ভাষায় প্রবেশ করে, উসমানী খিলাফতের সময়ে তুর্কিরা কাহভে শব্দটি এই পানীয়কে বুঝানোর ক্ষেত্রে ব্যাবহার করতো। য়ারা মূলত আরবি কাহওয়াহ (قهوة) শব্দ থেকে কাহভে শব্দের ব্যবহার শুর করে।

উসমানী খিলাফতের সময়ে কফি ইয়েমেন থেকে ইস্তাম্বুলে আনা হয়েছিলো এবং সেই সময় কফি অনেক গুরুত্বপূর্ণ পানীয় হিসেবে পান করা হতো। উসমানীয় অঞ্চলগুলোতে খাবারের সাথে কফি গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হয়েছিলো এবং খাবারের ক্ষেত্রে একধরণের কমনীয়তা যোগ করেছিলো।

১৬ শতাব্দীতে উসমানীরা বিশ্বের সর্বপ্রথম কফিহাউস খুলেছিল যা আজ ইস্তাম্বুল নামে পরিচিত। লেভানটাইন আরব (পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় আরব) এবং তুর্কিরা কফিহাউস তৈরি করেছিলো যেগুলো ১৬ শতাব্দীর মুসলিম ঐতিহ্যবাহী কফিহাউসের পাণ্ডুলিপি আলোচনা ও সামাজিকীকরণের জন্যও ছিল।

ষোড়শ শতাব্দীতে ইস্তাম্বুলে কফিহাউসগুলো একটি সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছিলো। এমনকি উসমানীয় রাজদরবারগুলোতে সুলতান ও তার অতিথিদের কফি পরিবেশন করা ছিলো আপ্যায়নের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এছাড়াও কফির পাত্রগুলো সুন্দর এবং নিখুঁতভাবে তৈরি করার জন্য সুলতানদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধায়নে কফি মেকারদের অবস্থান প্রতিষ্ঠিত হয়।

কফি তুর্কি জীবনধারার সাথে আতিথেয়তা এবং বন্ধুত্বের আলোকবর্তিকা হিসাবে সংস্কৃতিতে একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। তাছাড়া বিশেষ অতিথিদেরকে বিশেষভাবে তৈরি কাপে কফি পরিবেশন করা হয়।

ইউরোপে কফিকে প্রথমে সন্দেহের চোখে দেখা হতো কারণ এটি মুসলিম দেশগুলোতে অনেক জনপ্রিয় একটি পানীয়। এমনকি পোপ ক্লিমেন্ট অষ্টম (১৫৩৬-১৬০৫) কফি পানকে নিষিদ্ধ করার জন্য প্রথমে তিনি পান করেছিলেন কিন্তু স্বাদ গ্রহণের পর তিনি এটি পান করার অনুমোদন দেন যার ফলে এটি ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে।

১৬৫০ সালে ইংল্যান্ডে প্রথম কফি হাউস খোলা হয় এবং ১৭০০ সালের মধ্যে লন্ডনে কফিহাউস অনেক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। উসমানীয় শাসনের প্রভাবে কফি হাউসগুলি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। মানুষের সামাজিকীকরণের পদ্ধতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে যেমনটি বর্তমান সময়ে সোশ্যাল মিডিয়ার উত্থানের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিপ্লব সৃষ্টি হয়েছে।

আরব এবং তুর্কি কফি প্রায় একই ধরনের। উভয় অঞ্চলে কালো কফি পরিবেশন করা হয়। তবে মধ্যে প্রধান পার্থক্য হল তুর্কি কফিতে সাধারণত এলাচ থাকে না।

আরব কফি মধ্যপ্রাচ্যসহ আরব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মধ্যে নিহিত মধ্যপ্রাচ্যে তৈরি করা কফির সবচেয়ে জনপ্রিয় রূপ। তাছাড়া এই কফি আরব রাষ্ট্রগুলোর একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য।

আরবি কফিকে উদারতার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কফি বর্তমানে জাতীয় ঐতিহ্যে পরিণত হওয়া সৌহার্দ্যপূর্ণ আতিথেয়তার একটি অবিচ্ছেদ্য দিক উপস্থাপন করে। এছাড়াও কফিকে আরব অঞ্চলে একতার প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয় যা সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সমিতিগুলিকে সংরক্ষণ করে সমাজকে পুনর্গঠনে করেছে।

আরবি কফি স্বাদের দিকে এত জনপ্রিয় হওয়ার মূল কারণ হলো এর প্রস্ততকরণ প্রক্রিয়া। জানা যায় আরব বেদুইনরা মাটি খনন করে একটি ফায়ারপ্লেসের উপর তাদের কফি তৈরি করতো এবং সময়ের সাথে সাথে এটি কুয়ার দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছিলো।

মিশরে ইসলামী সুফিদের ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে দৃঢ় করতে কফি অনেক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হতো। এছাড়াও সুফি খানকাগুলোতে তারা তাদের ইবাদাতের সময় কফি পান কর‍তেন। ১৭ শতকের শেষের দিকে কায়রোতে ৬৪৩ টি বায়ত কাহওয়া (কফি হাউস) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। এমনকি সেগুলো সাংস্কৃতিক কেন্দ্র এবং একটি জনসভার স্থানে পরিণত হয়েছিলো।

আপনি যদি মিশর বা সিরিয়ায় কোন একটি কফিশপে গিয়ে কফি (قهوة) অর্ডার করেন তবে আপনাকে অবশ্যই বলতে হবে আপনি কতটুকু পরিমাণ চিনি নিবেন কারণ কফিটি মিষ্টি পানি দিয়ে তৈরি করা হয়। আপনি সামান্য মিষ্টি (আরিহা), মাঝারি মিষ্টি (মাজবুট) বা খুব মিষ্টি (জিয়াদা) অর্ডার করতে পারেন। এছাড়াও মিষ্টি ছাড়া একধরণের সাদা কফিও পাওয়া যা শুধুমাত্র শোক অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন  দুঃখজনক অনুষ্ঠানে পান করা হয়।

কাহওয়ে হল দুধের সাথে কফির একটি সোনালি সংস্করণ যা এলাচ এবং দারুচিনি দিয়ে মসলাযুক্ত কাহওয়ে মিষ্টির সাথে খেজুরের অসাধারণ কম্বিনেশন।

সুদানে গুহওয়াহ নামে একটি বিশেষ কফি তৈরি করা হয় এবং জেবেনা নামক ঐতিহ্যবাহী লাল মাটির ক্যারাফেতে পরিবেশন করা হয়। গুহওয়া সাধারণত, এলাচ, কালো মরিচ, আদা এবং মশলা দিয়ে প্রস্তুত করা হয়। এমনকি অনেক দেশের অনুষ্ঠানগুলোতে (বিশেষ করে ইউরোপে) মদ্যপানের পূর্বে একটি বিশেষ “কফি অনুষ্ঠান” পর্ব থাকে।

ওমানি গাহওয়া কফিতে স্বাদের ক্ষেত্রে বিচিত্রিতা আনতে মশলার সাথে জাফরান, গোলাপ জল এবং এলাচ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আবার কিছু মানুষ এতে লবঙ্গ এবং দারুচিনি যোগ করে।

কাতারে আরবি কফি পরিবেশন করা আতিথেয়তার একটি  গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক। এটি ‘ফিনজান’ নামক একটি ছোট কাপে ‘ডালা’ নামে পরিচিত একটি ঐতিহ্যবাহী কফির পাত্র থেকে পরিবেশন করা হয় কিন্তু কাপটি সম্পূর্ণ ভরাট করা হয় না। কারণ কাপটি উপরে সম্পূর্ণ ভরে গেলে এটি একপ্রকারের অপমান বলে মনে করা হয়।

মরক্কোতে নৌস-নৌস কফি একটি জনপ্রিয় পানীয়। নাম থেকে বোঝা যায়, ‘নৌস নাউস’ অর্থ অর্ধেক। এই কফিতে অর্ধেক দুধ-অর্ধেক কফি থাকে। অর্ধ-এসপ্রেসো, অর্ধ-ফোমযুক্ত দুধের কম্বো সাধারণত একটি গ্লাসে পরিবেশন করা হয় এবং যা সত্যিই অনেক মজাদার পানীয়।

লেবানিজ হোয়াইট কফি ঐতিহ্যবাহী লেবানিজ রন্ধনপ্রণালী থেকে এসেছে। ‘আহওয়েহ বায়দা’ বা লেবানিজ হোয়াইট কফি সাধারণত খাবারের পরে দেওয়া হয়। বাস্তবিক অর্থে এই হোয়াইট কফি আসলে কফি নয় বরং এটি গরম পানি, কমলার রস এবং মিষ্টি হিসাবে চিনি বা মধুর একটি মিশ্রণ প্রক্রিয়া।

মাজাগ্রানকে সাধারণত ‘আইসড কফি’ বলা হয়। মাজাগ্রান হলো কোল্ড কফি যা মূলত আলজেরিয়া থেকে এসেছে। এই আইসড কফিটি লেবু দিয়ে তৈরি করা হয়।

– আব্দুল্লাহ আল মুঈন