আজ বিশ্ব পাই দিবস।
প্রতি বছর মার্চের ১৪ তারিখ তথা ৩.১৪ এই ফর্মের তারিখকে পাই দিবস হিসেবে পালন করা হয়। গণিত সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন এমন ব্যক্তি মাত্রই পাই এর গুরুত্ব অনুভব করেন। পাই গণিতের একটি মৌলিক পরিভাষা। পাই ব্যতীত আজকের পদার্থ বিজ্ঞানের, গণিতের, ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়গুলো সহ আরো অসংখ্য ক্ষেত্রের সহজ – জটিল অসংখ্য হিসাব করা সম্ভব হতো না। বিদ্যুৎ এবং চম্বুক সম্পর্কিত সূত্রগুলো প্রায়ই পাই এর উপর নির্ভরশীল। বৃত্তের সাথে সম্পর্কিত হিসাবগুলো এরকম আরো অসংখ্য ক্ষেত্রে পাই এর গুরুত্ব আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।
গণিতের এই গুরুত্বপূর্ণ পরিভাষার সর্বপ্রথম উদ্ভাবন করেন গিয়াসউদ্দিন জামশেদ। আমরা ইউরোপীয়ানদেরকে যদি জিজ্ঞাসা করি যে, পাই (π)-এর দশমিক সংখ্যার ধারণার আবিষ্কারক কে? তারা নিশ্চিত করেই এটা বলবে যে, এটা প্রাচীন গ্রিকদের আবিষ্কার। কিন্তু ইতিহাস বলে, ‘না, পাই (π)-এর দশমিক সংখ্যার আবিষ্কারক ও এর সর্বপ্রথম ধারণা দান করেন মুসলিমগণ। আর গিয়াসউদ্দিন জামশেদ-এর রচিত বই রিসালাতুল-মুহিতিয়া থেকে এর সম্পর্কে আপনাদের জানাতে চাই। গিয়াসউদ্দিন জামশেদ পাই (π)-এর মান হিসাবে এই (৩.১৪১৫৯২৬৫৩৫৮৯৭৯৩২) সংখ্যাগুলো উদ্ভাবন করেন। অর্থাৎ পাই (π)-যখন ইলেকট্রনিক ক্যালকুলেটর দিয়ে হিসাব করি আমরা এই সংখ্যার কোন ব্যতিক্রম পাই না।
আজকের পাই দিবসে আপনাদেরকে ইসলামী সভ্যতার এই মহান গণিতবিদ গিয়াসউদ্দিন জামশেদকে আপনাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে চাই।
গিয়াসউদ্দিন জামশেদ কে?
গিয়াসেদ্দিন জামশেদ হলেন একজন চিকিৎসক, গণিতবিদ এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানী যিনি ১৪ শতকের শেষার্ধে কাশানে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। যদিও তার জন্ম ও মৃত্যুর সঠিক তারিখ জানা যায় না, তবে তিনি উলু বে-এর আমন্ত্রণে সমরকন্দে যান, যেখানে তিনি কাশানে তার শিক্ষা জীবন শেষ করেন এবং সেখানেই তার গবেষণা চালিয়ে যান। কাদি জাদে রুমির সাথে একত্রে তিনি সমরকন্দে এমন এক মানমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন যা পূর্ব ও পশ্চিমের বৃহত্তম গবেষণা কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল।
গিয়াস উদ্দিন জামশেদ উলু বে-এর আমন্ত্রণে সামরকন্দে আসেন। তবে তার কাজের এত খ্যাতি থাকা সত্ত্বেও, তার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়। গিয়াস উদ্দিন জামশেদ ইতিহাসে মূলত দশমিক পদ্ধতির আবিষ্কার হিসেবে সমাদৃত। তিনি মূলত গণিত এবং জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে কাজ করেছিলেন এবং প্রথম গণিতে দশমিক পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন। তিনি ইলহানের জিসিতে ব্যবহৃত টেবিলের সংস্কার করে খাগানি জিসি লিখেন, যার মধ্যে মেরাগা মানমন্দিরে করা তার পর্যবেক্ষণসমূহ স্থান পেয়েছে। সুলেম এল-সেমা নামক তার রচনায় তিনি মহাকাশীয় বস্তুর দূরত্বের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছেন। খাগনি জিসির এই কাজটি বিগত কয়েক শতাব্দী ধরে পূর্ব ও পাশ্চাত্য উভয় ধারার বৈজ্ঞানিক গবেষণায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ১৮৪১ সালে প্রথম এবং পরবর্তীতে ১৮৫৩ সালে খাগানি জিসি ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়েছিল এবং এই কাজ সম্পর্কে শেষ নিবন্ধটি ১৯১৭ সালে Müşteşrik ED দ্বারা প্রকাশিত হয়েছিল।
গিয়াস উদ্দিন জামশেদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল দশমিক ভগ্নাংশের যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ নিয়ে গবেষণা করেন এবং তিনি উদাহরণ সহ দেখিয়েছেন কিভাবে দশমিক ভগ্নাংশের যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগের কাজ করতে হয়। তাই গবেষণা বলা চলে গণিতের চাবিকাঠি হিসেবে কাজ করে।
তবে তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো তিনি তৎকালীন সময়ে ইসলামী সভ্যতায় গাণিতিক জ্ঞানের সমস্ত জ্ঞান গবেষণাকে গুছিয়ে উপস্থাপন করেন। তাঁর এই কাজের একটি অংশে হিসেবে তিনি তাত্ত্বিকভাবে দশমিক ভগ্নাংশ পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন। তিনি এখানে যে তথ্য দিয়েছেন তা পরবর্তীতে ১৬ শতকের বিখ্যাত উসমানীয় গণিতবিদ এবং জ্যোতির্বিদদের একজন, তাকিউদ্দীন (আরবি: تقي الدين محمد بن معروف الشامي السعدي, তাকি আল-দীন আবু বকর মুহাম্মদ ইবনে কাদি মা’রুফ আল-আশমাদ আল-শাদ) অনুসরণ করেছিলেন। তিনি শুধুমাত্র দশমিকের যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগের প্রক্রিয়া বের করাতেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না বরং নব উদ্ভাবিত এই জ্ঞানকে তিনি ত্রিকোণমিতি এবং জ্যোতির্বিদ্যায় প্রয়োগ করে বিকাশ ঘটান।
তিনি তার গ্রন্থ রিসালাতুল-মুহিতিয়াতে সর্বপ্রথম সাইন (sine)-এর হিসাব নিয়ে বিশদ আলোচনা করেন। যদিও আমরা পাশ্চাত্যের ইউরোপীয় মদদপুষ্টদের জিজ্ঞাসা করি, তোমরা যে বল মুসলিমরা গ্রিক ও মিশরীয়দের থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞান নিয়েছে; মিশরীয়দের মাঝে সাইন (sine)-এর ধারণা কোথায়? কোথায় তাদের মাঝে ত্রিকোণমিতির ধারণা? মিশরীয়দের মাঝে এসবকিছুর বিন্দুমাত্রও ধারণা পাওয়া যায় না। যদি পাওয়া যেত তাহলে উনবিংশ কিংবা বিংশ শতাব্দীতে প্রযুক্তির যে বিকাশ তা আরো হাজার বছর পূর্বে হওয়া দরকার ছিল।
কিন্তু দেখুন গিয়াসউদ্দিন জামশেদ কীভাবে সাইনের (sine)-এর ধারণাকে বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি শুধু সাইন এক ডিগ্রি এর ধারণাই দেননি একই সাথে sine 1 degree =০.০১৭৪৫২৪০৪৪৩৭২৩৮৩৭১ গণনা করতে সক্ষম হয়েছিলেন অর্থাৎ দশমিকের পরে ১৮ ঘর পর্যন্ত তিনি সাইন (sine) এক ডিগ্রিতে গণনা করতে পেরেছেন। এই হিসাব যখন আজকে ইলেকট্রনিক ক্যালকুলেটরে করি তখন একই ফল আমরা পেয়ে থাকি। এভাবে গিয়াসউদ্দিন জামশেদ ত্রিকোণমিতির পরিমাপকে টেবিল তথা এরকম সূক্ষ্ম পদ্ধতিতে উদ্ভাবন করেছেন।
কীভাবে তিনি এটা করেছেন? কীভাবে কোন ক্যালকুলেটর ছাড়াই এত জটিল হিসাব-নিকাশগুলো করেছেন, এই চিন্তা যখন করি তখন আমাদেরকে সত্যি-ই অবাক হতে হয়।
গিয়াস উদ্দিন জামশেদের sine 1° পদ্ধতিগতভাবে নির্ধারণের জন্য উল্লেখিত সমাধান পরবর্তীতে ১৬ শতকে ফরাসি গণিতবিদ ফ্রাঁসোয়া ভিয়েট তার গবেষণা কর্মে প্রচুর পরিমাণে ব্যবহার করেন।
এছাড়াও গিয়াসেদ্দিন জামশেদকে গণিতের ইতিহাসে দশমিক পদ্ধতির আবিষ্কারক হিসাবে বিবেচনা করা হয়। তিনি উচ্চক্রম সংখ্যাসূচক সমীকরণের আনুমানিক সমাধানের পদ্ধতির জন্যও বিখ্যাত।
গিয়াস উদ্দিন জামশেদ এমন একজন গণিতবিদ যিনি কিনা সঠিকভাবে sine 1 ডিগ্রির মান দশমিকের পরে ১৮ ঘর পর্যন্ত আবার অন্যদিকে পাই এর মান দশমিকের পরে ১২ ঘর পর্যন্ত নির্ণয় করেছেন কোন প্রকারের ক্যালকুলেটরের ব্যবহার ছাড়া। এছাড়াও দশমিক ভগ্নাংশের হিসাব নিকাশ পদ্ধতির মতো গণিতের মৌলিক বিকাশ সাধন করেছেন। গণিতে তাঁর অবদান এমন যে তাঁকে এবং তাঁর অবদানকে অস্বীকার করলে গণিত বলতে আমাদের সামনে খুব বেশিকিছু থাকে না।
এছাড়াও জ্যোতির্বিদ্যা এবং গণিতের উপর গিয়াস উদ্দিন জামশেদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে যা এখনো আমাদের আঁড়ালেই রয়ে গিয়েছে। তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল রিসালেত-উল মুহিতিয়ে এবং মিফতাহ-উল হিতাপ। এর মধ্যে কিছু কাজ ইস্তাম্বুলে, আয়া সোফিয়া এবং নুর ওসমানিয়ে লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত রয়েছে। তার মৃত্যুর হয় আনুমানিক ১৪২৪ সালে। কিছু সূত্র অনুসারে, তাঁকে তাঁর প্রতিষ্ঠিত সেই বিখ্যাত মানমন্দিরের কাছে সমাহিত করা হয়েছিল।
লিখেছেন- সায়েম মুহাইমিন