মুসলিম পোর্ট

পর্তুগিজ ও ওলন্দাজদের পথ ধরে অফুরন্ত ধনসম্পদ, ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্যে আকৃষ্ট হয়ে ইংরেজরাও বাণিজ্যিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আসে। পর্তুগিজ ও ওলন্দাজরা ছিল পুনঃরপ্তানিকারক অর্থাৎ তারা এশীয় পণ্য সংগ্রহ করে সেগুলো আবার রপ্তানি করত। কিন্তু ইংরেজদের ছিল দেশীয় বাজার। তারা দেশি বাজারে নিজেরাই এশীয় পণ্য সরবরাহ করার জন্যে এশীয় বাণিজ্যে যোগদান করে ঐ সব ফড়িয়াদের উৎখাত করে। তারা সপ্তদশ শতাব্দির শুরুতে ভারতে আগমন করে এবং ১৭৮৬ সালে মালয় উপদ্বীপের পেনাঙ এ প্রথম বাণিজ্যিক ঘাঁটি স্থাপন করে। সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বী ওলন্দাজদের উপস্থিতি থাকলেও ওলন্দাজরা ছিল ঐ সময় ক্ষয়িষ্ণু শক্তি।

ইউরোপের প্রথম বণিকগোষ্ঠী পর্তুগিজরা ইতোপূর্বে ১৬৪১ সালে ঐ অঞ্চল থেকে ওলন্দাজদের দ্বারা বিতাড়িত হয়। ১৭৮৬ সাল থেকে ১৯৫৭ সালে মালয়ের স্বাধীনতা লাভ পর্যন্ত সমগ্র মালয় উপদ্বীপের বাণিজ্য, রাজনীতি, অর্থনীতিতে ইংরেজ তথা বৃটিশরা ব্যাপক দাপটের সাথে অবস্থান করে। এমনকি প্রশাসনিক ক্ষেত্রেও অন্যান্য বণিকগোষ্ঠীর চেয়েও তারা ব্যাপকভাবে সফল হয়।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ইংরেজ আগমনের প্রয়াস

প্রথমত, ১৫৮০ সালে ইংরেজ নাবিক ফ্রান্সিস ড্রেক সমুদ্রপথে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে উত্তমাশা অন্তরীপের পথে ইংল্যান্ডে ফিরে যান। ১৫৯১ সালে র‍্যালফ ফীচ ভারতবর্ষ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ভ্রমণ করে লন্ডন ফিরে যান। ইতোমধ্যে ইংরেজদের ভীতি প্রদর্শন এবং সে সঙ্গে প্রাচ্য আগমনের পথ পরিহার করার উদ্দেশ্যে স্পেন ‘আরমাদা’ নামক একটি বিশালাকৃতির যুদ্ধ জাহাজ প্রেরণ করে। কিন্তু ১৫৮৮ সালে ইংল্যান্ডের নৌ-বাহিনীর কাছে স্পেনের ‘আরমাদা’ পরাজিত হয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে। ‘আরমাদার’ বিরুদ্ধে জয়লাভের পর ইংল্যান্ডের আত্মশক্তি দারুণভাবে বৃদ্ধি পায় এবং প্রাচ্যে আগমনের ব্যাপারে ইংরেজদের মধ্যে বিপুল উৎসাহ ও আত্মপ্রত্যয় জন্মে।

দ্বিতীয়ত, ইতোমধ্যে উপর্যুক্ত ঘটনায় উৎসাহিত হয়ে বিশিষ্ট ইংরেজ নাবিক জেমস ল্যাংকাস্টারসহ বেশকিছু ইংরেজ নাবিক জলপথে পেনাও, জাভাসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে এসে উপস্থিত হয়। জেমস ১৫৯১ সালের এপ্রিল মাসে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন এবং ১৫৯২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পেনাও পৌছান। তিনি দুই বছর পেনাঙে অবস্থানের মাধ্যমে ব্যবসায়িক সম্ভাব্যতা যাচাই করে ১৫৯৪ সালের মে মাসে ইংল্যান্ডে ফিরে যান। ইতোমধ্যে ইংল্যান্ডের বণিকরা ব্যক্তিগতভাবে রানী এলিজাবেথের নিকট থেকে পর্তুগিজ বণিকদের ন্যায় বাণিজ্যিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে দেওয়ার অনুরোধপত্র নিয়ে ভারতবর্ষে মোগল সম্রাট আকবরের নিকট আগমন করে।

তৃতীয়ত, প্রথমদিকে ইংল্যান্ডের বণিকরা ব্যক্তিগতভাবে প্রাচ্য-বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করতে এসে তারা পর্তুগিজদের দ্বারা প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হয়। এরপর ইংরেজরা সম্মিলিতভাবে প্রাচ্যের বাণিজ্যে অংশগ্রহণের পরিকল্পনা নিয়ে রাণী এলিজাবেথের কাছে প্রাচ্য-বাণিজ্যে পরিচালনার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করে। রানী এলিজাবেথ ১৬০০ সালের ৩১ ডিসেম্বর The Governor and Company of Marchants of Trading in to East Indies নামক বণিক কোম্পানিকে প্রাচ্যের যাবতীয় দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনের রাজকীয় সনদ দান করেন। এ প্রতিষ্ঠিানটিই English East India Company নামে পরিচিত।

ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৬০১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রথমে জেমস ল্যাংকাস্টার-এর নেতৃত্বে পূর্ব-ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে মসলার ব্যবসা এবং কুঠি স্থাপনের চেষ্টা করে, কিন্তু এ অঞ্চলে শক্তিশালী ওলন্দাজ বণিকদের তীব্র প্রতিযোগিতা ও বাঁধার সম্মুখীন হয়ে মসলার দ্বীপপুঞ্জ হতে ইংরেজ বণিকরা বিতাড়িত হয়ে তারা ভারতবর্ষে বাণিজ্যকন্দ্র স্থাপনের চেষ্টা করে

১৭৫৭ সালের মধ্যে বাংলাসহ ভারতীয় উপমহাদেশের বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডে কোম্পানির অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করে এবং সেই ক্রমধারায় পলাশী-বক্সার-উত্তর যুগে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার দেওয়ানী লাভের ফলে সমগ্র বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চল ও ভারতীয় উপকূলে তারা একক প্রভাববলয় তৈরিতে সক্ষম হয়।

পঞ্চমত, অষ্টাদশ শতাব্দির শেষ দিকে অর্থাৎ ১৭৮৬ সালে কোম্পানির পুঁজির প্রাচুর্য অর্থনৈতিক সাফল্যের ধারাবাহিকতায় বাংলা-চীন বাণিজ্যের ক্রমবর্ধমান ব্যাপকতায় এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মসলা ব্যবসারের সম্ভাবনা দেখে শুধুমাত্র ভারতবর্ষে থাকা কোম্পানির পক্ষে সম্ভব ছিল না। বাংলা-চীন বাণিজ্যের নিরাপত্তার স্বার্থে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দিকে ইংরেজরা নজর দেয়। এছাড়া ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লব, আমেরিকার স্বাধীনতা অর্জন, ইউরোপীয় যান্ত্রিক পরিবর্তন, ভারতে কোম্পানি শাসন প্রতিষ্ঠা, ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বাণিজ্যিক বিপ্লব এবং সর্বোপরি চীনের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্কের জন্য মালয় অঞ্চলের বাণিজ্যিক বন্দর দখল করে উপনিবেশ স্থাপন ও বাণিজ্যিক কুঠি স্থাপনে প্রয়াসী হয়।

ষষ্ঠত, আঠারো শতকের শেষার্ধে ইংরেজ কোম্পানির বাণিজ্য বিস্তারের প্রশ্নটি গুরুত্বর আকার ধারণ করে। বিশেষ করে ১৭৩০ সালের পর ভারতীয় মালবার উপকূলে জাভা চিনি ও চীনা সিল্ক ব্যবসায় ওলন্দাজদের প্রচণ্ড উন্নতি হওয়ায় ভারতীয় বাণিজ্য কাঠামো বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। ১৭৩০ হতে ১৭৫০ সালের মধ্যে সুরাটে বাংলা ব্যবসায়ের নব্বই শতাংশ হ্রাস পায়। ভারত মহাসাগরের এরূপ বাণিজ্যিক বিপ্লব ঘটায় চীনা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ইংরেজ বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষার জন্য বঙ্গোপসারের পূর্বাঞ্চলে একটি বৃটিশ উপনিবেশ গঠনের প্রয়োজন সম্পর্কে কারো দ্বিমত ছিল না। এমতাবস্থায় বৃটিশ কর্মকর্তা ডালরিপ্লাল একটি স্থান কোম্পানিকে হস্তান্তর করার জন্য সুলু সুলতানের সাথে একটি চুক্তি সম্পাদন করেন। সুলু সাগরের বালাম বাঙ্গান দ্বীপটি উপযুক্ত স্থান বলে নির্বাচন করা হয়, কিন্তু মাদ্রাহ কাউন্সিল তা অনুমোদন না করায় ডালরিম্পাল ১৭৬৫ সালে ইংল্যান্ডে ফিরে যান। কোম্পানির ডাইরেক্টরগণ সুমাত্রায় একটি স্থান নির্বাচনের পরামর্শ দেয়, কিন্তু এ প্রচেষ্টাও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ১৭৭৩ সালে ক্যাপ্টেন জন হারবার্ট ডালরিম্পালের পরিকল্পনা অনুসারে বালাম বাঙ্গান এ উপনিবেশ স্থাপনের চেষ্টা করলে সুলুর জলদস্যুরা তা ব্যর্থ করে দেয়। এরপর ১৭৭৫ সালে জন হারবার্ট কনাইয়ের লাবুয়ানে একটি উপনিবেশ স্থাপন করেন, কিন্তু কোম্পানির ডাইরেক্টররা অনুমোদন না দেয়ায় তার চেষ্টা ব্যর্থ হয়।

সপ্তমত, ১৭৭১ সালেই ফ্রান্সিস লাইট জানতে পারেন যে, কেদাহ সুলতান তার নিরাপত্তার জন্য ইউরোপীয় সাহায্য কামনা করছেন। সুলতানের কথায় মাদ্রাজ কাউন্সিল রাজি না হলে ফ্রান্সিস তার কোম্পানিকে অবগত করেন যে, সুলতান তাদের সাহায্যের বিনিময়ে কেদাহ’র একটি বন্দর কোম্পানিকে হস্তান্তর করবে, কিন্তু এতে কোনো কাজ না হওয়ার ফলে ফ্রান্সিস ১৭৭২ সালে বৃটিশ গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংসকে প্রস্তাবটি গ্রহণ করার জন্য আবেদন করেন। এর ফলে আচেহ ও কেদাহতে একটি মিশন প্রেরণ করলেও তা ব্যর্থ হয়। তবে কেদাহ সুলতান মেলেউগারের বিরুদ্ধে সাহায্য দেয়ার শর্ত সাপেক্ষে বৃটিশদের প্রস্তাব গ্রহণ করেন। মাদ্রাজ কাউন্সিল কোনো প্রকার সামরিক দায়-দাযিত্ব গ্রহণ করতে রাজি না হওয়ায় ফ্রান্সিস লাইটের প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়।

অষ্টমত, গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংস বৃটিশদের বাণিজ্যিক নিরাপত্তা বিধানের জন্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে একটি শক্তিশালী নৌঘাঁটির প্রয়োজন অনুভব করেন। তাই বৃটেন ও আমেরিকার স্বাধীনতা রক্ষার জন্য ১৭৮৩ সালে ভার্সাই চুক্তি সম্পাদনের পর ১৭৮৪ সালে আচেহ ও রিয়াউতে তিনি দুটি মিশন প্রেরণ করেন। এমতাবস্থায় ফ্রান্সিস লাইট পিনাঙ্গ প্রস্তাবটি আবার উত্থাপন করেন। কলকাতার অস্থায়ী গভর্নর জেনারেল জন ম্যাকফারসন উক্ত প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন দান করেন। কোম্পানির ডাইরেক্টরগণ মত প্রকাশ করেন যে, পেনাঙ্গ তাদের নৌঘাঁটির শর্ত পূরণ করবে না তবে ঐ অঞ্চলে ওলন্দাজদের একচেটিয়া ব্যবসা ধ্বংস করতে এবং চীনা বাণিজ্য সম্প্রসারণ কাজে সহায়ক হবে। অবশেষে ১৭৮৬ সালের ১১ আগস্ট ফ্রান্সিস লাইট কলিকাতার অস্থায়ী গভর্নর ম্যাকফারসনের সাহায্যপুষ্ট হয়ে তিনটি জাহাজের সাহায্যে মালয় উপদ্বীপের কেদাহ রাজ্যর পেনাঙ্গ দ্বীপটির দখল করে নেন।

নবমত, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উর্বর ক্ষেত্রে অবস্থিত একটি প্রাচীন মালয় রাজ্য হচ্ছে কেদাহ। এটি ১৪৭৪ সালে মুসলিম রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ইতিহাসের আদিপর্ব থেকেই কেদা’র নদীগুলো ছিল বাণিজ্যিক জাহাজের আশ্রয় কেন্দ্র। উত্তর সুমাত্রা এবং মালয় উপদ্বীপের পশ্চিম উপকূলের বণিকরা এখানে যাতায়াত করত। কেদা’র প্রধান রপ্তানিদ্রব্য ছিল টিন। কেদার আর্থিক সমৃদ্ধি থাকলেও রাজনৈতিক নিরাপত্তা ছিল না।

শ্যামদেশ বা থাইল্যান্ড ১৩০০ সাল থেকে শ্যামের রাজারা কেদার প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালায়। কেদাহ সুলতান থাইশক্তির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ইংরেজদের সাহায্য পাওয়ার আশায় পিনাঙ-এ বৃটিশ ঘাঁটি স্থাপন করতে অনুমতি দেন। উনিশ শতকের প্রথম দিকে চাকারি বংশের শাসনাধীন থাকা অবস্থায় শ্যামদেশ ছিল শক্তিশালী রাষ্ট্র। সীমান্তবর্তী মালয় রাজ্যগুলোকে শ্যামদেশ তার আশ্রিতরাজ্য মনে করত। শ্যাম শাসক মনে করতেন মালয় রাজ্যগুলোর বৈদিশিক নীতি, শাসনের রদবদল সবকিছু ব্যাংককের নির্দেশে পরিচালিত হওয়া উচিত। তাই শ্যামদেশকে না জানিয়ে কেদাহ সুলতান পেনাঙকে বৃটিশদের হাতে ছেড়ে দেওয়া ভালো চোখে দেখেনি। তাছাড়া কেদাহ সুলতান আহমদ তাজুদ্দিনকে শ্যামদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। এভাবে উনিশ শতকের প্রথমদিকে যখন কেদার উপর শ্যামদেশের চাপ বৃদ্ধি পেতে থাকে তখন কেদাহ সুলতান বৃটিশদের কাছে সামরিক সাহায্য কামানা করেন। কিন্তু পাঁচ বছর ধরে কেদাহ বৃটিশদের কাছ থেকে কোনোরূপ সাহায্য পাননি। ফলে কেদাহ সুলতান পিনাং হতে ইংরেজদের বিতাড়নের জন্য বিদ্রোহ করেন। বৃটিশরা এ বিদ্রোহ দমন করে এবং ১৭৯১ সালে উভয় পক্ষের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তির শর্তানুযায়ী বার্ষিক ৬,০০০ স্পেনীয় ডলারের বিনিময়ে কেদাহ সুলতান বৃটিশদের কাছে পেনাঙ দ্বীপ অর্পণ করেন। ১৮০০ সালে পেনাঙ-এর গভর্নর জেনারেলরূপে স্যার জর্জ লিথ কেদাহ সুলতানের সাথে আরো একটি চুক্তি সম্পাদন করেন। এ চুক্তি অনুসারে সুলতানের বার্ষিক অনুদান বাড়িয়ে ১০,০০০ ডলার করা হয় এবং কেদার একটি ভূখণ্ড কোম্পানিকে দান করা হয়। ফ্রান্সিস লাইট ১৭৯৪ সালে মারা যান এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি পেনাঙ এর সুপারিন্টেনডেন্ট ছিলেন। লাইটের পরে পেনাঙ এর শাসনকর্তা হয়ে আসেন মেজর ম্যাকডোনাল্ড (১৭৯৫-৯৯ খ্রি.), জর্জ লিথ (১৭৯৯-১৮০৩ খ্রি.), আর.টি. ফারকুহার (১৮০৪-০৫ খ্রি.) প্রমুখ। ১৮০৫ সালে পেনাঙকে প্রেসিডেন্সিরূপে গণ্য করা হয় এবং কলকাতা, মাদ্রাজ ও বোম্বের মতো পেনাঙও ছিল সমপর্যারভুক্ত প্রেসিডেন্সি।

দশমত, অষ্টাদশ শতাব্দির শেষলগ্নে বৃটিশদের জন্য পূর্ব-ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে আধিপত্য বিস্তারের একটা দারুণ পরিবেশ তৈরি হয়। ১৭৮৯ সালে ফ্রান্সে ফরাসি বিপ্লব সংঘটিত হয়। এ বিপ্লবের পর ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে যুদ্ধ আরম্ভ হয়। ফ্রান্স হল্যান্ড দখল করে নেয়। ফলে ঐ সময় পূর্ব-ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে গুরুত্বপূর্ণ ওলন্দাজ সামরিক ঘাঁটিগুলো ফরাসিদের দখলমুক্ত রাখার জন্য বৃটিশরা সচেষ্ট হয়। সে কারণে ১৭৯৫ সালে মালাক্কা, অ্যামবয়ানা, বান্দা এবং সুমাত্রার পশ্চিম উপকূলের গুরুত্বপূর্ণ স্থান বৃটিশরা দখল করে নেয়। ফরাসি প্রভাব থেকে জাভাকে মুক্ত রাখার জন্য ১৮১১ সালে জাভাও দখল করা হয়। পেনাত-এর গভর্নরের সহকারী সচিব টমাস র‍্যাফেলস ১৮১১ সালে জাভা দ্বীপ দখল করেন, কিন্তু ১৮১৬ সালের অগাস্ট মাসে জাভা ওলন্দাজদের ফিরিয়ে দিলে র‍্যাফেলস এ অঞ্চলে ব্রিটিশ প্রভাববলয় সৃষ্টির জন্য উপযুক্ত স্থান অনুসন্ধান করেন। পিনাংকে কোম্পানির চতুর্থ প্রেসিডেন্সীর মর্যাদা দেয়া হলেও স্থানটি দ্বীপপুঞ্জ থেকে দূরে পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত হওয়ায় এর বাণিজ্যিক গুরুত্ব হ্রাস পায়। এ সময় বেহুলীন ও মালাক্কার শাসনকর্তা স্ট্যামফোর্ট র‍্যাফেলস-এর প্রস্তাবক্রমে তুমাসিক বা সিঙ্গাপুরে উপনিবেশ স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। র‍্যাফেলস ১৮১৯ সালের ২৮ জানুয়ারি তুমাসিকে অবতরণ করেন এবং ৩০ জানুয়ারি মালয় প্রধান তেমাঙ্গ গঙ ও জোহর রাজ্যের সুলতান হোসেনের সাথে এক চুক্তি বলে তুমাসিক দখল করে সিঙ্গাপুর নগরী প্রতিষ্ঠা করেন।

একাদশতম, ইউরোপের আর্থ-সামাজিক বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বৃটিশের ভাগ্যে সুবাতাস আনায়ন করে। ১৮২৪ সালে লন্ডন কনভেনশন অনুযায়ী সমগ্র মালয় জগৎকে দুই ভাগে ভাগ করে বৃটিশ ও ওলন্দাজরা। এ চুক্তিটি মালয় ব্যবচ্ছেদ নামে পরিচিত। লন্ডন কনভেনশন অনুসারে ইংরেজরা বেন্ডুলীন ডাচদের ছেড়ে দেয়। পক্ষান্তরে ডাচরা মালাক্কা, পিনাং, সিঙ্গপুর, প্রভৃতি অঞ্চলে বৃটিশ আধিপত্য মেনে নেয়। সেই পরিপ্রেক্ষিতে পেনাঙ, মালাক্কা ও সিঙ্গাপুর নিয়ে বৃটিশ উপনিবেশ গঠিত হয়। এ অঞ্চলগুলো নিয়ে বৃটিশরা গঠন করে স্টেট সেটেলমেন্টস বা প্রণালী উপনিবেশ। এটাকে বৃটিশ মালাক্কা প্রণালী উপনিবেশ বলা হয়। এ উপনিবেশ মালয় উপদ্বীপে বৃটিশ প্রাধান্যের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। চুক্তি সম্পাদনের পর পরই সিঙ্গাপুরের দ্রুত বিকাশ ঘটে। সিঙ্গাপুরকে প্রণালী উপনিবেশের রাজধানী করা হয়। তিনটি অঞ্চলের শাসন সংক্রান্ত বিষয়ে কলকাতা প্রেসিডেন্সী থেকে নির্দেশ আসলেও সিঙ্গপুরের গভর্নরের হাতে ছিল কেন্দ্রীয় দায়িত্ব। প্রণালী উপনিবেশের শাসন উপদ্বীপের উত্তরাঞ্চলের সীমান্তবর্তী শ্যামদেশের সাথে সুদৃঢ় মিত্রতার নীতি গ্রহণ করে।

দ্বাদশতম, বৃটিশ কর্তৃক স্টেট সেটেলমেন্টস গঠন করার পর মালয়ের অন্য রাজ্যগুলোর অর্থাৎ কেদাহ, পেরাক ও সেলাংগোর ইত্যাদির ওপর শ্যামদেশ নানা রকম চাপ সৃষ্টি করে। এ সমস্যা সমাধানের জন্য বৃটিশ সরকার দূতরূপে ক্যাপ্টেন হেনরি বার্নেকে ব্যাংকক পাঠান। হেনরি বার্নে ১৮২৫ সালের শেষের দিকে ব্যাংকক পৌঁছান এবং ১৮২৬ সালের জুন মাস পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করেন। তার প্রতি বৃটিশ গভর্নর নির্দেশ দেন যে, ইংরেজ কোম্পানি এবং শ্যামদেশের মধ্যে মৈত্রী স্থাপন করতে হবে। এছাড়া বাণিজ্যিক চুক্তি, কেদার সুলতানের ক্ষমতা প্রত্যার্পণ, পেরাক ও সেলাংগোরের স্বাধীনতা ইত্যাদি ব্যাপারকে আলোচনায় গৌণ স্থান দিতে হবে। অবশ্য এক্ষেত্রে ভিন্ন মত পোষণ করেন পেনাঙের গভর্নর রবার্ট ফুলারটোন। তিনি বলিষ্ঠ স্বাধীন নীতির প্রবক্তা ছিলেন। শ্যামদেশের প্রতি তিনি কঠোর মনোভাব অবলম্বনের পক্ষপাতি ছিলেন। বার্নের প্রতি তার নির্দেশ ছিল যে, মালয় রাজ্যগুলোর স্বার্থসম্বলিত সমস্যা আলোচনায় প্রধান গুরুত্ব পাবে; শ্যামদেশের কর্তৃত্বের প্রয়াস ও দাবির বিরুদ্ধে শক্ত মনোভাব গ্রহণ করতে হবে; মালয় রাজ্যগুলোর অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে শ্যামদেশের হস্তক্ষেপ প্রবণতাকে বাধা দিতে হবে। যা হোক, ১৮২৫ সালের অ্যান্ডারসন চুক্তি এবং ১৮২৬ সালের ইঙ্গ-শ্যাম চুক্তি বা ব্যাংকক চুক্তি বা বার্নে চুক্তি অনুযায়ী মালয় উপদ্বীপের উত্তরাঞ্চলের চারটি রাজ্য যথা- পেনাঙ, সেলাঙ্গোর, কেলানতান, ক্রেঙ্গানু- এর প্রতিরক্ষার দায়িত্ব পায় বৃটিশরা। উক্ত রাজ্যেগুলোতে চুক্তির পূর্বে শ্যামদেশের বিশেষ প্রভাব ছিল। শ্যামদেশ ৪টি মালয় রাজ্যকে করদরাজ্যের মতো মনে করত। উনিশ শতকের মধ্যভাগে মালয়ের পশ্চিম উপকূলে শুধুমাত্র পারলিস ও কেদাহ হতে শ্যামদেশের প্রভাব ছিল। তবে এ দুটি রাজ্যে নিজস্ব মালাই শাসক ছিল। তারা শ্যামদেশের প্রতি নামেমাত্র প্রথাগত আনুগত্য দেখিয়েছে। পেরাক ও সেলাংগোর ছিল স্বাধীন। কেলানতান ছিল নামমাত্র মালাই শাসকের অধীন। তবে ত্রেংগানু শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বাস্তবক্ষেত্রে ত্রেংগানু ছিল স্বাধীন। তবে বলা যায়, ১৮৬৩ সাল নাগাদ পূর্বতীরের মালয় রাজ্যগুলোতে শ্যামদেশের আগ্রাসী ভূমিকার অবসান হয়েছে বলা যায়।

সর্বোপরি, মালয় উপদ্বীপে মোট নয়টি রাজ্য ছিল। যথা- কেদাহ, পারলিস, পেরাক, কেলানতান, ক্রেংগানু, নেগ্রিসেমবিলান, পাহাং, জোহর, সেলাংগোর। জোহর ব্যতিত মালয় উপদ্বীপের অন্য ৮টি রাজ্যেই বৃটিশরা প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। ১৮১৯ সালে সিঙ্গাপুর প্রতিষ্ঠার সময় থেকে ইংরেজদের সাথে জোহর রাজ্যটির ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। তারপরও রাজ্যটি মালয় ফেডারেশনে যোগদান করেনি এবং ১৯১৪ সালের পূর্বে কোন বৃটিশ উপদেষ্টা গ্রহণ করেনি। ১৮৯৫ সালে জোহর রাজ্যের জন্য জনৈক বৃটিশ আইনজ্ঞ একটি সংবিধান রচনা করেন। ১৯১৪ সালে কিছু সংশোধনীসহ উক্ত সংবিধানটি গৃহীত হয়, এভাবে মালয় রাজ্যে বৃটিশ উপনিবেশিকতাবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়। মালয় উপদ্বীপের ৯টি রাজ্যে বৃটিশ কোম্পানির সম্প্রসারণ নীতি প্রসারিত হয়। তবে দ্বীপাঞ্চল ছাড়াও সারাওয়াক ব্রুনাই এবং সাবাহ অঞ্চল ইংরেজ প্রভাব বলয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়।

মালয়ে ব্রিটিশ রেসিডেন্ট পদ্ধতি

ভারতে নিজেদের ভিত্তিমূল সুদৃঢ় করার পরে বৃটিশরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দিকে নজর দেয়। মালয় ভূখণ্ডের কেদাহ রাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর পেনাঙ। ১৭৮৬ সালে ফ্রান্সিস লাইট কলকাতার অস্থায়ী গভর্নর ম্যাকফারসনের সহযোগিতায় মালয় উপদ্বীপের কেদাহ রাজ্যের পেনাঙ দখলের মাধ্যমে মালয় উপদ্বীপে বৃটিশ প্রভাব বিস্তার শুরু করে। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তারা মালয়ের ৯টি রাজ্যের মধ্যে আটটিতে প্রভাব বিস্তার করে এবং পরবর্তীতে অন্য একটি রাজ্য জোহরেও প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়।

ভারতীয় উপনিবেশের অভিজ্ঞতার আলোকে বৃটিশরা মালয় জগতে অত্যন্ত সতর্কতার সাথেই কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। তারা ১৭৮৬ সাল থেকে ১৮৬৭ সাল পর্যন্ত মালাক্কা, সিঙ্গাপুর ও পেনাও অঞ্চলগুলোকে চীন-বাংলা বাণিজ্যের নিরাপত্তাকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করে। এ সময়কালে কোলকাতা প্রেসিডেন্সীর নির্দেশ মতোই এখানকার উপনিবেশিক শাসন কাঠামো পরিচালিত হতো। ১৮৬৭ সাল থেকে এ অবস্থার পরিবর্তন হয়। বিশেষ করে ১৮৬৮ সালে মালয় উপদ্বীপের উপনিবেশসমূহের নিয়ন্ত্রণ ভারতীয় অফিস থেকে লন্ডনের কলোনিয়াল অফিসে হস্তান্তর হয়। অর্থাৎ ১৮৫৭ সালের আগ পর্যন্ত উপনিবেশগুলোতে ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শাসনকার্য পরিচালনা করত। কিন্তু ১৮৫৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে ‘সিপাহী বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত সর্বভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম বা মহাবিদ্রোহ সংঘটিত হওয়ার পর ‘ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির’ কাছ থেকে শাসনক্ষমতা চলে যায় সরাসরি লন্ডনে রানী এলিজাবেথের হাতে। সেই প্রক্রিয়ায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় রেসিডেন্ট প্রথাও ‘প্রতিষ্ঠিত হয়।

ইতোপূর্বে উপনিবেশের ক্ষমতা বাংলা-ভারতের সংগে যুক্ত ছিল। ১৮৬৭ সালের পূর্বে কোম্পানীর কাছে মালয় রাজ্যগুলোতে প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ করাকে বিপদসঙ্কুল মনে করত। তাই ইংরেজরা বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত থাকলেও প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে ততোটা সক্রিয় ছিল না। তারা প্রতিনিয়ত প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ অনুসন্ধান করছিল। ইতোমধ্যে এ সময়কালে মালয় উপদ্বীপের রাজ্যগুলোতে সনাতনী প্রশাসনিক ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা, উত্তরাধিকার দ্বন্দ্ব, উপদ্বীপের বাণিজ্যে বিভিন্ন জলদস্যুগোষ্ঠীর হানাহানি, টিন ও খনিজ শিল্পে চীনা জনগোষ্ঠীর আধিপত্য, শ্রমিক রাজনীতি, সিঙ্গাপুরে বৃটিশ বাণিজ্যের অগ্রগতি, সুয়েজখাল উন্মুক্ত হলে প্রাচ্যে ইউরোপীয় বাণিজ্যের প্রসার প্রভৃতি ঘটনার প্রেক্ষিতে মালয় উপদ্বীপের রাজ্যগুলোতে বৃটিশ হস্তক্ষেপের সুযোগ সৃষ্টি হয়।

উনবিংশ শতাব্দির শেষের দিকে পাশ্চত্য জগতে টিনের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। টিন শিল্পকে কেন্দ্র করে মালয়ী ও চীনা শ্রমিকদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে। এছাড়া মালয় উপদ্বীপের নানা রাজ্যে, বিশেষ করে পেরাকে উত্তরাধিকার দ্বন্দ্ব জটিল আকার ধারণ করে। সেলাংগোরে চীনা ও মালাই গোষ্ঠীর মধ্যে গৃহযুদ্ধের উপক্রম হয়। এ অবস্থার প্রতিকারের জন্য সিঙ্গাপুরের চেম্বারস অব কমার্স এবং বহু উদ্যোগী বণিক লিখিতভাবে বৃটিশ হস্তক্ষেপের আবেদন জানায়। মালয় উপদ্বীপের এরূপ অশান্ত পরিবেশের অজুহাতে বৃটিশরা উপদ্বীপের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের সুযোগ পায়।

উনবিংশ শতাব্দীর সত্তর-এর দশকে ইউরোপে ধনতন্ত্রের বিকাশ ঘটে। এ সময় পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদে রূপ নেয়। এ সময় সারাবিশ্বে ব্যাপকভাবে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য স্থাপনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়। ইংল্যান্ডে কৃষি ও শিল্প বিপ্লব সংঘটিত হলে শিল্প-কারখানার জন্যে কাঁচামাল সংগ্রহ, শিল্পপণ্যের বাজার সম্প্রসারণ এবং অধিক পুঁজি বিনিয়োগের তাগিদে বৃটিশ কোম্পানী ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য সম্প্রাসারণে অধিক আগ্রহী হয়ে ওঠে। তারা নতুন ঔপনিবেশিক নীতির কৌশল হিসেবে মালয় উপদ্বীপের রাজ্যসমূহের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপে উৎসাহিত হয়ে ওঠে।

বিভিন্ন রাজ্যে রেসিডেন্ট প্রথা চালু

১৮৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী মালয় উপদ্বীপের ক্রাউন কলোনীগুলোকে সরাসরি বৃটিশদের নিয়ন্ত্রণে আনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এজন্য এ্যান্ড্রু ক্লার্ককে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। তিনি ছিলেন একজন সৈনিক এবং কর্মতৎপর ব্যক্তি। তিনি এ বিষয়ে ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। পেরাক: এ্যান্ড্রু ক্লার্ক-এর ইতিবাচক পদক্ষেপের জন্য পেরাক ছিল উপযুক্ত স্থান। কারণ এখানে রাজ-পরিবারের উত্তরাধিকার দ্বন্দ্ব ও চীনা উপদলীয় কোন্দল মারাত্মক আকার ধারণ করে। রাজ পরিবারের সুলতান, রাজা মুদা, রাজা বিন্দাহারা ইত্যাদি পর্যায়ক্রমিক একটি নির্দিষ্ট পদবিন্যাস ছিল মালয় রাজ্যের উত্তরাধিকার নির্ধারণের পদ্ধতি। সুলতানের মৃত্যুর পর রাজা মুদা তার স্থলাভিষিক্ত হন এবং মুদার স্থান দখল করেন রাজা বিন্দাহারা। এ উত্তরাধিকার নীতি সকল যুবরাজের দ্বারা সমর্থিত হতে হতো।

১৮৭১ সালে পেরাকের সুলতান আলীর মৃত্যুর পর এ নিয়ম ভেঙ্গে যায়। নিয়ম অনুযায়ী আব্দুল্লাহর রাজা মুদা হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু ইসমাইল সুলতান নির্বাচিত হন এবং পেরাকের একাংশের প্রধানগণ তাকে সমর্থন দেয়। আব্দুল্লাহও নিজেকে সুলতান বলে ঘোষণা দেন এবং নিম্ন পেরাকের প্রধানরা তাকে সমর্থন দেয়। পেরাকের এ রকম রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলায় এন্ড্রু ক্লার্ক তার প্রতিনিধিকে পিনাঙ এ প্রেরণ করেন এবং লারুডের প্রতিদ্বন্দ্বী সমাজপতিদের সমন্বয়ে জানুয়ারি মাসে পেরাক নদীর মোহনার প্যাঙ্কর দ্বীপে পেরাকের প্রধানকর্তা ব্যক্তিদের একটি সভা আহ্বান করেন। এ সভায় বিখ্যাত প্যাংকর চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্যদিয়ে আব্দুল্লাহকে পেরাকের বৈধ শাসকরূপে ঘোষণা করা হয় এবং চুক্তির শর্তানুযায়ী পেরাকের সুলতান তার দরবারে একজন বৃটিশ রেসিডেন্ট রাখতে সম্মত হয়। আর এর মাধ্যমেই মালয় উপদ্বীপে প্রতিনিধির মাধ্যমে পরোক্ষভাবে বৃটিশ শাসনব্যবস্থা চালু হয় যা রেসিডেন্ট সিস্টেম নামে পরিচিত।

প্যাংকর চুক্তির দুটি ধারায় রেসিডেন্ট পদ্ধতির মূলনীতি প্রতিষ্ঠিত হয়। ৬নং ধারায় বলা হয়, ধর্ম ও প্রথা ছাড়া বাস্তব শাসনব্যবস্থার প্রতিটি বিষয়ে সুলতান ইংরেজ কর্মকর্তার উপদেশ অনুসারে চলবেন। ১০নং ধারায় বলা হয়, রাজস্ব এবং সাধারণ প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করবে রেসিডেন্ট। অর্থাৎ বৃটিশ উপদেষ্টা ধর্ম ও আদত আইন ছাড়া বাঁকি বিষয়ে যথা শাসনতান্ত্রিক, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে পরামর্শ দান করার অধিকার পায়। রেসিডেন্ট ব্যবস্থা বাস্তবায়নের জন্যে বৃটিশরা প্রথমত আঞ্চলিক সুলতানের কাছ থেকে একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে সেখানে রেসিডেন্ট নিয়োগ করে। এরপর ১৮৭৪ থেকে ১৮৯৫ সালের মধ্যে মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে পেরাক, সেলাংগার, নেগ্রিসেসবিলান এবং পাহাঙেও রেসিডেন্ট ব্যবস্থা চালু হয়।

সেলাংগোরঃ

পেরাকের পর এন্ড্রু ক্লার্ক সেলাংগোরের দিকে দৃষ্টি দেন। কারণ ঐ সময় কুয়ালালামপুরে একটি মালাক্কা জাহাজ লুণ্ঠন হলে আটজন বৃটিশ নাগরিকের মৃত্যু হয়। এর ফলে এন্ড্রু ক্লার্ক নৌ-মহড়ার আয়োজন করেন এবং চীনা নৌবহরের এডমিরাল স্যাডওয়েলকে যোগদানের জন্য নির্দেশ দেন। বৃটিশদের ভয়ে আতংকিত হয়ে সেলাংগোর সুলতান জলদস্যুদের বিচার করতে রাজি হন এবং একজন রেসিডেন্ট গ্রহণ করেন। সুলতানের সাথে চুক্তি সম্পাদিত না হলেও পেরাকের রেসিডেন্ট সুইটেন হ্যামের সাথে ডেভিসনকে সেলাংগোরে রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ করা হয়।

নেগ্রিসেম্বিলানঃ

নেগ্রিসেম্বিলানেও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এবং শ্রমিক ও বণিকদের মধ্যে নানামুখি অসন্তোষের পরিবেশ খুঁজে পায় বৃটিশরা। এমতাবস্থায় লিঙ্গী নদীর তীরবর্তী টিন খনিজ অঞ্চলে খনি শ্রমিকদের ওপর নানাভাবে কর আদায় করার অভিযোগ ওঠে। ফলে খনি শ্রমিকরাও অসন্তোষ প্রকাশ করে। এ ধরনের সমস্যাকে সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে ১৮৭৪ সালের এপ্রিল মাসে এন্ড্রু ক্লার্ক সুঙ্গী উজাঙ ও লিঙ্গী প্রধানদেরকে নিয়ে একটি চুক্তি সম্পাদন করেন। উক্ত চুক্তির মাধ্যমে উভয়ের সমঝোতার পাশাপাশি পরবর্তী শৃঙ্খলা বিধানের জন্য ট্যাথামকে সহকারী রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ করা হয়।

পাহাঙঃ

পাহাঙ রাজ্যটি দীর্ঘদিন যাবৎ সুশৃংখলভাবে শাসিত হলেও সময়ের বিবর্তনে সেখানেও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। বণিক, চীনা নাগরিক ও স্থানীয়দের প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সময় অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এমতাবস্থায় বৃটিশ নাগরিক ওয়েন্ডের পরামর্শে ১৮৮৭ সালে পাহাঙ সুলতান রাজ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য একটি চুক্তি করে একজন বৃটিশ কাউন্সিলর এজেন্ট গ্রহণ করেন। সম্ভবত এটাই ছিল সুলতানের ভুলের প্রথম ধাপ। পরের বছর অর্থাৎ ১৮৮৮ সালে জনৈক চীনা কর্তৃক একজন বৃটিশ নাগরিক নিহত হলে সিঙ্গাপুর হতে সুলতানের ওপর নানাবিধ চাপ আসে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও রাজ্যে শান্তি-শৃংখলা প্রতিষ্ঠার নিমিত্তে সুলতানকে একজন রেসিডেন্ট গ্রহণে বাধ্য করা হয়। পাহাঙ-এর মতো মিনাঙকাবুর রাজ্যগুলোর ওপরও চাপ সৃষ্টি করা হয় এবং ১৮৯৫ সালে নয়টি রাজ্যই নেগ্রিসেমবিলান-এর সাথে সংযুক্ত হয়ে বৃটিশ আশ্রিত রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং প্যাংকর চুক্তির শর্ত অনুসরণ করে চলে।

রেসিডেন্ট প্রথার বাস্তবায়ন সমস্যা

প্যাংকর চুক্তি অনুসারে রেসিডেন্টকে সুলতানের উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগের কথা বলা হলেও রেসিডেন্টের উপদেশ সুলতানের কাছে কতটুকু গ্রহণযোগ্য হবে তা বলা হয়নি। ফলে পেরাকে প্রথম অবস্থায়ই রেসিডেন্ট ব্যবস্থা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। প্যাংকর চুক্তিতে রেসিডেন্টের উপদেশদানের অধিকার ছিল খুবই সীমাবদ্ধ। মালয়ের ধর্ম ও প্রথাসিদ্ধ বিধিনিষেধের বিষয়ে তার পরামর্শ দেয়ার অধিকার ছিল না। অথচ মালয় রাজ্যগুলোতে রাজস্বনীতি ও সাধারণ শাসনব্যবস্থা ছিল প্রথাসিদ্ধ নিয়ম-কানুন দ্বারা পরিচালিত। সেখানে প্রথামতো রাজস্ব ছিল সুলতান ও তার অনুচরদের ব্যক্তিগত আয়, কিন্তু পেরাকের প্রথম রেসিডেন্ট আই ডব্লিউ বার্চ ছিলেন একজন দৃঢ় ও দ্রুতগামিতায় বিশ্বাসী ব্যক্তি। রেসিডেন্ট নিযুক্ত হওয়ার পর তিনি দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ভ্রমণ করেন এবং বাস্তব অবস্থা জানার চেষ্টা করেন। তিনি একজন খাঁটি বুর্জোয়া ছিলেন। যার ফলে সামন্ত ব্যবস্থা ছিল তার কাছে অত্যন্ত অসহনীয়, অত্যাচারমূলক এবং পশ্চাৎপদ। দেশের প্রথা হিসেবে দেশের রাজস্ব রাজপরিবারে ও অভিজাত শ্রেণির নিজস্ব সম্পদ বলে বিবেচিত হত। বার্চ এ ব্যবস্থাটি রহিত করেন। তিনি মনে করেন, রাজস্ব জনগণের সম্পদ এবং তা ব্যয় হবে রাষ্ট্রের কল্যাণে, কিন্তু পেরাকের সুলতান আব্দুল্লাহ বার্চের এ কর্মকাণ্ড মেনে নিতে পারেননি। এর ফলে বার্চ সুলতান ও অভিজাতদের শত্রুতে পরিণত হন।

ইতোমধ্যে গভর্নর এন্ড্রু ক্লার্ক গভর্নর জেনারেলের পরিষদের সদস্য হয়ে ভারতে চলে যান এবং তার স্থলভিষিক্ত হন উইলিয়াম জেরভয়েস। জেরভয়েসও ছিলেন একজন রাজকীয় প্রকৌশলী। তিনি বার্চের রেসিডেন্ট ব্যবস্থায় প্রতিদিন অবনতি লক্ষ করেন। এ কারণে তিনি রেসিডেন্ট ব্যবস্থা তুলে দিয়ে সরাসরি রানীর কমিশন শাসন প্রবর্তনের চিন্তা করেছিলেন। ঠিক এমন সময় ১৮৭৫ সালের ২ ডিসেম্বর পেরাক সমাজপতিরা বার্চকে হত্যা করে। ফলে রেসিডেন্ট ব্যবস্থাটি প্রথমবারের মতো ব্যর্থ হয়।

পেরাকে বার্চের হত্যাকাণ্ডের পর রেসিডেন্ট ব্যবস্থা বহাল থাকবে কি-না এ নিয়ে গভর্নর জেরুয়েস এবং উপনিবেশ সেক্রেটারী কারনাভ্যানের মধ্যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। বিতর্কের পর সব দিক বিবেচনা করে পেরাকে রেসিডেন্ট ব্যবস্থা পুনরায় চালু করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কেননা পেরাক রেসিডেন্ট ব্যবস্থায় সমস্যা দেখা দিলেও মালয়ের অপর রাজ্য সেলাঙগোরে রেসিডেন্ট ব্যবস্থা ভালোভাবে চলতে থাকে। সেলাংগোরের গভর্নর ডেভিড ঘন স্বীয় বুদ্ধিমত্তার সাথে রাজ্যের সুষ্ঠু হিসাব-নিকাশ ব্যবস্থার মাধ্যমে খাজাঞ্চিখানার পুনর্গঠন করেন। রাজ্যে শৃংখলা বিধানের জন্যে পুলিশ সংস্থাও তৈরি করেন। সেইসাথে কুয়ালালামপুরে খনিজ অঞ্চলে শ্রমিকদের মধ্যে শান্তি রক্ষা করেন।

রেসিডেন্টের বুদ্ধিমত্তা ও প্রয়োগ পদ্ধতির ব্যাপারে গুরুত্ব আরোপ করে ১৮৭৭ সালে হিউলোকেজকে পেরাকের রেসিডেন্ট নিয়োগ করা হয়। তিনি ১৮৭৭-৮৯ সাল পর্যন্ত উক্ত পদে বহাল ছিলেন। তিনি একজন উদ্ভিদবিদ্যা বিশারদ হয়েও একজন পেশাদার প্রশাসকের ন্যায় অগ্রগামী ও সফল রেসিডেন্ট হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি মালয় ভাষায় কথা বলতে পারতেন এবং মালয় রীতিনীতি, আচার- আচরণের সাথে পরিচিত ছিলেন। তিনি সর্বপ্রথম মালয় অভিজাতদের জন্য রাজস্বের একটি অংশ নির্দিষ্ট করে দেন এবং তাদের মধ্যে যোগ্য ব্যক্তিকে কর আদায়কারী কর্মচারী নিয়োগ করেন। অভিজাতরা তাদের আদায়কৃত রাজস্ব হতে নিজেদের বেতন গ্রহণ করতেন এবং বাঁকি অংশ খাজাঞ্চিখানায় প্রেরণ করতেন। সমাজে বাধ্যতামূলক শ্রমখাজনার পরিবর্তে ভূমিখাজনা প্রবর্তন করেন। সমাজ-প্রধানের সশস্ত্র লাঠিয়াল বাহিনীর পরিবর্তে নিয়মিত শিক্ষিত পুলিশ বাহিনী গঠন করেন। এসব পরিবর্তন রেসিডেন্টের পরামর্শে সুলতান ও অভিজাতদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হয়।

স্টেট কাউন্সিল গঠন

রেসিডেন্ট ব্যবস্থাটি বাস্তবায়নের জন্যে স্টেট কাউন্সিল বা রাজ্য পরিষদ গঠন করা হয়। পেরাকে এটি প্রথম প্রবর্তন করা হয়। এর সদস্য ছিলেন মালয় সমাজপতিদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ, চীনা প্রতিনিধি এবং রেসিডেন্ট। রাষ্ট্রের সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মালয় ভাষায় আলোচনা করা হত। পরিষদটি মূলত আইনসভা হলেও বার্ষিক বাজেট অনুমোদনসহ সব গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগ, প্রশাসনিক পদক্ষেপ অনুমোদন, মালয় প্রধানদের বেতন ও সুবিধাদি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা ছিল এর আওতাভুক্ত। পেরাকের সাফল্যের পর সর্বত্রই স্টেট কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করা হয়।

মালয়ের বৃটিশ রেসিডেন্টগুলো পৃথক পৃথকভাবে শাসিত হওয়ায় আইন-কানুন, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও শাসন ক্ষেত্রে নানা অসুবিধার সৃষ্টি হয়। এ প্রেক্ষিতে সুইটেনহ্যাম স্পষ্ট ভাষায় মত প্রকাশ করেন যে, বিভিন্ন রেসিডেন্সির মধ্যে সমন্বয় সাধন করা ছাড়া রেসিডেন্ট ব্যবস্থার উন্নয়নের বিকল্প কোনো পথ নেই। তাই তিনি এ সকল সমস্যা সমাধানের জন্য ১৮৯৩ সালে স্ট্রেটস সেটেলমেন্টের গভর্নর সিসিল ক্লিমেন্টি স্মিথের কাছে বৃটিশ রেসিডেন্টগুলোর সমন্বয়ে একটি যুক্তরাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা পেশ করেন। খসড়া পরিকল্পনাটি লন্ডনে ‘সেক্রেটারি অব স্টেট ফর কলোনিজ’ এর কাছে পাঠানো হয়।

এদিকে সিসিল ক্লিমেন্টি স্মিথের পর স্টেটস সেটেলমেন্টসের গভর্নর হয়ে আসেন চার্লস মিচেল। সুইটেনহ্যাম এর প্রস্তাবের আলোকে বাস্তবভিত্তিক একটি প্রতিবেদন তৈরির জন্য লন্ডন সরকারের পক্ষ থেকে তাকে নির্দেশ দেয়া হয়। দীর্ঘ দুই বছরের গবেষণার পরে মিচেল ১৮৯৫ সালে প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। তাতে উল্লেখ করা হয় যে, মালয় রাজ্যগুলোর শাসকদের সম্মতি থাকলে যুক্তরাষ্ট্র গঠনের খসড়া পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, চারটি রেসিডেন্সিতে বিচার বিষয়ে, কর ব্যবস্থাপনায় এবং ভূমি ব্যবস্থায় এক রেসিডেন্সি থেকে অন্যটি এতো ভিন্নতর যে, কোনো একক কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক ক্ষমতা ব্যতীত তাদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা সম্ভব নয়। তিনি আরো বলেন যে, একজন গভর্নরকে চারজন রেসিডেন্সির সাথে কাজ করতে হয়, প্রত্যেক রাজ্যে ভিন্ন ভিন্ন নীতি-পদ্ধতি চালু থাকায় সব কাজে সমন্বয় করা কষ্টকর হয়ে পড়ে। সে কারণে প্রস্তাবিত ফেডারেশনে তিনি একজন রেসিডেন্ট জেনারেল নিয়োগ করার সুপারিশ করেন। রেসিডেন্ট জেনারেল হবেন প্রধান নির্বাহী পরিচালক। তিনি রেসিডেন্টের মাধ্যমে রাজ্যের প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড দেখাশুনা করবেন। স্টেট কাউন্সিলের হাতে আইন প্রণয়ন ক্ষমতা থাকলেও সুলতান, সমাজপতি ও রেসিডেন্টের সমন্বয়ে পরামর্শের ভিত্তিতে আইন প্রণয়ন করা হবে। প্রতিটি রাজ্য অর্থনৈতিকভাবে স্বায়ত্তশাসিত থাকবে এবং বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা নিয়োগের জন্য একটি ফেডারেল কর্মকমিশন গঠিত হবে।

লন্ডনের কলোনিয়াল অফিস মিচেলের মতামতকে সমর্থন করে। মালয়ের চারটি রাজ্যের শাসকবর্গও সানন্দে এ প্রস্তাব মেনে নেয়। ফলে ১৮৯৬ সালে ১ জুলাই মালয়ের চারটি রাজ্য পেরাক, সেলাঙ্গোর, পাহাঙ এবং নেগ্রিসেমবিলান নিয়ে গঠন করা হয় ‘দ্য ফেডারেটেড মালয় স্টেটস’ বা মালয় রাষ্ট্রসমূহের ফেডারেশন, কিন্তু প্রস্তাবে সুলতানের ক্ষমতা হ্রাস করার কোনো কথা না থাকলেও বাস্তবে প্রশাসনের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ চলে যায় রেসিডেন্ট জেনারেলের হাতে। সুলতান প্রকান্তরে ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ে। তার হাতে শুধুমাত্র ধর্ম ও প্রথাসিদ্ধ আইনের ক্ষমতা ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। এদিকে রাজ্যের প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত মুসলমানরাও ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে পড়ে।

ক্রাউন কলোনীর গভর্নর ক্লিমেন্টি স্মিথ ও মিচেলের পরিকল্পনায় চারটি রাজ্যের রেসিডেন্ট এর জন্য একজন ‘রেসিডেন্ট জেনারেল’ পদ সৃষ্টি করা হয়। ১৮৯৬ সালে প্রথম রেসিডেন্ট জেনারেল নিযুক্ত হন ফ্রাঙ্ক সুইটেনহ্যাম। রেসিডেন্ট জেনারেল এবং বিভাগীয় প্রধানদের সদর দপ্তর কুয়ালামপুরে স্থাপন করা হয়। অর্থাৎ কুয়ালালামপুরে ছিল মালয় যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী। ফ্রাঙ্ক সুইটেনহ্যাম সর্বপ্রথম একটি কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক বিন্যাস সাধন করেন। তিনি একজন আইন উপদেষ্টা, একজন চীনা বিষয়ক সেক্রেটারী, অর্থ কমিশনার, বিচার কমিশনার, পুলিশ কমিশনার ও একটি গণপূর্ত পরিচালকের পদ সৃষ্টি করেন।

পেরাকের কুয়ালা কাঙসারে ১৮৯৭ সালে ফেডারেশনের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। মালয়ের রাজ্যগুলোতে নামেমাত্র পরোক্ষ বৃটিশ শাসন থাকলেও ক্রমান্বয়ে রাজ্যগুলোতে বৃটিশদের প্রত্যক্ষ শাসন চালু হয়। ফেডারেটেড রাজ্যগুলোর সদর দপ্তর কুয়ালালামপুরে প্রতিষ্ঠিত হলে গঠন করা হয় ‘ফেডারেটেড কাউন্সিল’। ফেডারেটেড কাউন্সিলে প্রণালী উপনিবেশের গভর্নরের সভাপতিত্বে গৃহীত আইন রাজ্যগুলোতে প্রেরণ করা হত। সামগ্রিক শাসনব্যবস্থা শুধু কেন্দ্রীকরণ নয়। রাজ্য চারটির শাসনব্যবস্থা সিঙ্গাপুরের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। প্রণালী উপনিবেশের গভর্নরের সদর দপ্তর ছিল সিঙ্গাপুর।

দি ফেডারেটেড মালয় স্টেটস শাসকদের দ্বিতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ১৯০৩ সালে কুয়ালালামপুরে। এ সভায় পেরাকের সুলতান দুঃখ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, মালয়ীদের হাতে কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না। তিনি অতিকেন্দ্রীকতার বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেন এবং ফেডারেশন কাঠামোর সংস্কার দাবি করেন। এ ব্যবস্থা মালয় রাজ্যগুলোর শাসক পরিবারে অসন্তোষের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। উপদ্বীপে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, টিন শিল্পের বিকাশ, শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার অজুহাতে বৃটিশদের গৃহীত পদক্ষেপে জনগণ আশান্বিত হয়ে ওঠে। সেইসাথে রেলপথ নির্মাণ, সকল রাজ্যে একই ধরনের ভূমি আইন ও খনি আইন প্রবর্তন, সরকারি উদ্যোগে পেরাকে জমি জরিপ করাসহ রাজ্যগুলোতে কৃষি, বনসম্পদ ও চিকিৎসা বিজ্ঞান বিষয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় উৎসাহিতকরণের প্রক্রিয়ায় জনগণ ইতিবাচক হিসেবে দেখে, কিন্তু বাস্তবে তার ফলাফল সুখকর ছিল না। মালয়ী জনগণ এক্ষেত্রে অনেকাংশে বঞ্চনার শিকার হতে থাকে। বিশেষ করে রাজকর্মকর্তা ও কর্মচারীর মূল ভূমিকায় চীনা ও মালয়ী অমুসলিমরা প্রাধান্য পেতে থাকে। রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রেও বৃটিশ কর্তৃপক্ষ অনেকাংশে সফল হয়। ১৮৯৫ থেকে ১৯০৫ সালের মধ্যে চারটি রাজ্যের মোট রাজস্ব ৮ মিলিয়ন ডলার থেকে ২৪ মিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। ডাক ও তার বিভাগেরও উন্নয়ন সাধিত হয় এবং প্রতিবছরে টেলিগ্রাফের তার ২,০০০ মাইল বৃদ্ধি পায় এবং ১০ মিলিয়ন চিঠিপত্র চারটি রাজ্যে বিলি করা হয়। সড়ক, রেলপথ এবং হাসপাতালের সংখ্যাও বৃদ্ধি করা হয়। সেইসাথে বিংশ শতাব্দির দু’দশকে মালয় রাজ্যকে বিশ্ববাণিজ্যের প্রথম সারির বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। তবে এক্ষেত্রেও বৈষম্য লক্ষ করা গেছে। চীনা ও মালয়ী অমুসলিমদের বাণিজ্যিক সুবিধাসহ বৃটিশ পৃষ্ঠপোষকতায় তাদেরকে উদ্যোগতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস চালানো হয়।

বৃটিশরা মালয় ফেডারেশনকে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান দেখাতে সক্ষম হলেও রাজনৈতিকভাবে তারা সমালোচিত হয়। কারণ মালয় ফেডারেশন গঠিত হলেও প্রকৃত যুক্তরাষ্ট্র তখনও গঠিত হয়নি। যদিও চারটি রাজ্যের শাসক, বিভাগীয় প্রধান এবং স্টেট কাউন্সিল বা রাজ্য পরিষদের সদস্যরা সম্মেলনে মিলিত হয়ে আলাপ-আলোচনা করেছেন, কিন্তু তাদের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা ছিল না। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রও রাজ্যগুলোর মধ্যে ক্ষমতা বিভাজনের সুনির্দিষ্ট সীমারেখা চিহ্নিত করা হয়নি। তাছাড়া এককভাবে রেসিডেন্ট জেনারেলের হাতে সর্বময় কর্তৃত্ব ন্যস্ত করা হয়। শাসনতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক কারণে মালয় যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনায় নানা ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিল। বিশেষ করে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে মালয়ীদের চেয়ে চীনাদের অংশগ্রহণকে বৃটিশরা বেশি প্রাধান্য দিতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। ফলে মালয়ী বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের মনে অসন্তোষ দেখা যায়।

রাজ্যে অসন্তোষ দূর করার নিমিত্তে ১৯০৯ সালে ফেডারেশন পুনর্গঠন করে একটি ফেডারেল কাউন্সিল বা যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিষদ গঠন করা হয়। চারটি রাজ্যের সুলতানের সম্মতি নিয়েই সিঙ্গাপুরের জন অ্যান্ডারসনের উদ্যোগে এ যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিষদ গঠিত হয়। এ পরিষদের সভাপতি হন হাই কমিশনার অর্থাৎ স্টেটস সেটেলমেন্টের গভর্নর। অন্যান্য সদস্যের মধ্যে ছিলেন চার রাজ্যের সুলতান, চার রেসিডেন্ট, রেসিডেন্ট জেনারেল এবং হাই কমিশনার মনোনীত ও বৃটিশ রাজ্যসরকার সমর্থিত চারজন বেসরকারি সদস্য। রেসিডেন্ট জেনারেলের পদের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘চিফ সেক্রেটারি’ বা মুখ্যসচিব। তিনি যে হাইকমিশনারের অধস্তন কর্মচারী তা বুঝানোর জন্যই পদের নাম পরিবর্তন করা হয়েছিল। বছরে একবার যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিষদের অধিবেশন বসত এবং প্রতি রাজ্যের আয়-ব্যয়ের খসড়া হিসেব তারা পরীক্ষা করত। প্রায় সবগুলো গুরুত্বপূর্ণ নীতি নিয়ন্ত্রণ করত যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিষদ। পক্ষান্তরে রাজ্য পরিষদ বা স্টেট কাউন্সিল-এর এখতিয়ারে ছিল শুধুমাত্র ধর্মীয় বিধিবিধান, মৃত্যু দণ্ডাদেশ এবং বিদেশী অপরাধীর নির্বাসন সংক্রান্ত বিষয়সমূহ। হাইকমিশনার ইচ্ছে করলে রাজ্য পরিষদকে অন্যান্য বিষয়ে মতামত দেবার সুযোগ দিতে পারতেন, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিষদের সভায় সুলতানসহ মুসলমান সদস্যরা অনেকটা মৌনতা অবলম্বন করা ছাড়া আর তেমন কোনো ভূমিকা পালন করতে পারতেন না। বিশেষত একদিকে সভার কর্মকাণ্ড ইংরেজি ভাষায় পরিচালিত হবার কারণে সুলতান ও মুসলিম সদস্যদের ইংরেজিতে যুক্তি উপস্থাপনের যেমন সমর্থ ছিল না অন্যদিকে যেটুকু চেষ্টা মুসলমানদের পক্ষ থেকে করা হতো সে বিষয়ে যথাযথ মূল্যায়নও ছিল না। তাই যুক্তরাষ্ট্রীয় সভার সিদ্ধান্তের অনুমোদন দেয়া ছাড়া তারা বড় কোনো ভূমিকা পালনে সক্ষম ছিলেন না।

মালয় উপদ্বীপের বৃটিশ উপনিবেশিক নীতির পরির্বতনের ধারাবাহিকতায় ফেডারেশন সেক্রেটারি ও সিঙ্গাপুরের বৃটিশ হাইকমিশনারের মধ্যে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। এমনকি এ সময় সুলতানগণ বৃটিশ আধিপত্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠার চেষ্টা করে। তারা বিভিন্ন সময় বৃটিশদের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে জনগণকে সোচ্চার হবার আহ্বান জানান। সে প্রেক্ষিতে ১৯২৭ সালে ফেডারেটেড পরিষদ পুনর্গঠন করা হয় এবং এর উদ্যোক্তা ছিলেন স্টেটস সেটেলমেন্টের লরেন্স গিলমার্ড। এ সময় যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিষদে পাঁচজন ইউরোপীয়, দু’জন চীনা এবং একজন মালাইসহ মোট আটজন বেসরকারি সদস্য ছিলেন। গিলমার্ড সরকারি সদস্যের সংখ্যা বাড়িয়ে ১৩ এবং বেসরকারি সদস্যসংখ্যা এগারোতে উন্নীত করেন। বিভাগীয় প্রধানরা পরিষদে আসন পেলেও সুলতানগণ আসন হারান। তবে হাই কমিশনার ও চিফ সেক্রেটারির সঙ্গে চারজন সুলতানের বার্ষিক বৈঠক বসত। এ যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিষদ পুনর্গঠনে বৃটিশদের শক্তি বৃদ্ধি হলেও মুসলমানদের তেমন কোনো স্বার্থরক্ষা হয়নি।

১৯৩০ সালেও পরিষদের কিছু পরিবর্তন ঘটে। চিফ সেক্রেটারির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ফেডারেল সেক্রেটারি। রেসিডেন্টদের উপর ক্ষমতা খর্ব করে তাকে করা হয় সংযোগ রক্ষক কর্মচারি। কৃষি, শিক্ষা, চিকিৎসা ও পূর্ত বিভাগ সংক্রান্ত কাজের ক্ষমতা রাজ্য পরিষদের হাতে অর্পণ করা হয়। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিষদের দায়িত্বে দেয়া হয় পুলিশ, শুল্ক, সামরিক, প্রতিরক্ষা ও সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ। আইন প্রণয়নের দায়িত্ব পায় রাজ্যপরিষদ। চারটি রাজ্যপরিষদ ও যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিষদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষার জন্যে দুজন যুক্তরাষ্ট্রীয় কর্মচারী নিয়োগ করা হয়। এদের একজনের দায়িত্ব অর্থনৈতিক সমস্যা দেখাশুনা দ্বিতীয় জনের দায়িত্ব হচ্ছে সমস্ত রাজ্য পরিষদের সদস্যপদ সংক্রান্ত আইন দেখাশুনা করা। এছাড়া পূর্বে যারা রাজ্য পরিষদের বেসরকারি সদস্য ছিলেন, তাদেরকে যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিষদে নিয়োগ করা হয়।

মালয় উপদ্বীপের নেগ্রিসেমবিলান, পাহাং, মিনাংকাবু, সেলেংগার, কেলানতান, ত্রেংগানু, কেদাহ, পারলিস এবং জোহরসহ মোট ৯টি রাজ্যের মধ্যে ৪টি রাজ্য অর্থাৎ নেগ্রিসেমবিলান, পাহাং, মিনাংকাবু, সেলেংগার এ ফেডারেটেড মালয় রাজ্যের সাথে যুক্ত হলেও অন্য ৪টি রাজ্যে কেলানতান, ত্রেংগানু, কেদাহ, পারলিস বৃটিশ উপনিবেশিক নীতি কৌশলগত কারণে ছিল ভিন্নতর।

কেলানতান, ত্রেংগানু, কেদাহ এবং পারলিসের অবস্থান ছিল মালয় উপদ্বীপের উত্তরাঞ্চলের শ্যামদেশের সীমান্তবর্তী। এ রাজ্যগুলোতে অনেকাংশে শ্যাম আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত ছিল। ১৮৮৬ সালে উত্তর বার্মায় বৃটিশ উপনিবেশের মধ্যবর্তী অঞ্চল শ্যামদেশটিকে বৃটিশরা মধ্যবর্তী রাষ্ট্রের মতো রাখার পক্ষপাতি ছিল, যে কারণে বৃটিশরা শ্যামদেশের সাথে একাধিক মৈত্রী ও সহাবস্থান চুক্তি করে। এর ফলে থাইদের জন্যে যেমন ফরাসিদের বিপক্ষে বৃটিশ সহযোগিতা পাওয়া নিশ্চিত হয়, তেমনি বৃটিশদের জন্যও মালয় উপদ্বীপের উত্তরাঞ্চলের চারটি কথিত থাই করদরাজ্যে বৃটিশদের আধিপত্য বিস্তারের পথ উন্মোচিত হয়।

১৯০২ সালে ইঙ্গ-শ্যাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তির শর্ত ধার্য করা হয় যে, কেলানতান ও লেংগানুর সুলতানরা শ্যামদেশের মাধ্যমে তাদের বিদেশনীতি পরিচালনা করবে। এই দুই রাজ্যে শ্যামদেশ একজন করে উপদেষ্টা সহকারী উপদেষ্টা নিয়োগ করবে। শুধুমাত্র মালয়ের ধর্ম ও প্রথা বাদ দিয়ে শাসন বিভাগের সব ক্ষেত্রেই উপদেষ্টাদের উপদেশ গৃহীত হবে। উপদেষ্টা, সহকারী উপদেষ্টার নিয়োগ হবে বৃটিশ সরকারের সম্মতিতে। তাছাড়া শান্তি, শৃংখলা বজায় থাকলে দুই রাজ্যের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে বৃটিশ সরকার হস্তক্ষেপ করবে না। সে অনুযায়ী ১৯০২ সালের ইঙ্গ-শ্যাম চুক্তি অনুযায়ী উপদ্বীপের উত্তরাঞ্চলের কেলানতান ও ত্রেংগানু রাজ্য দুটিতে শ্যামদেশের উপদেষ্টা, সহকারী উপদেষ্টা নিয়োগ করা হয়। তবে উক্ত দুই উপদেষ্টা ছিলেন শ্যামদেশের অধীনে বৃটিশ কর্মচারী।

বিংশ শতাব্দির প্রথম থেকেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাণিজ্য ও ঔপনিবেশিক নীতিতে ইউরোপীয় দুই শক্তি ফ্রান্স ও বৃটেন পূর্বের বৈরী নীতি ত্যাগ করে পারস্পরিক সমঝোতার দিকে অগ্রসর হয়। উভয় দেশই শ্যামের সাথে সীমান্ত সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে এবং ভিন্ন ভিন্ন চুক্তি স্বাক্ষর করে। ১৯০৪ ও ১৯০৭ সালে ফ্রান্স ও শ্যামদেশের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯০৪ সালে শুরু হয় ইংল্যান্ড ও শ্যামদেশের আলোচনা এবং ১৯০৯ সালে ইঙ্গ-শ্যাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুসারে মালয় উপদ্বীপের উত্তরাঞ্চলের সীমান্তবর্তী ৪টি করদরাজ্য কেলানতান, ত্রেঙ্গানু, কেদাহ ও পারলিসে শ্যামদেশ তার সমুদয় অধিকার ত্যাগ করে বৃটিশ অধিকারে ছেড়ে দেয়। রাজ্যগুলোর সাথে বৃটিশদের আলাদা আলাদা চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে বৃটিশ উপদেষ্টা ও কর্মচারী নিয়োগ করা হয়।

১৯০৯ সালের ইঙ্গ-শ্যাম চুক্তি অনুযায়ী কেলানতান, ত্রেংগানু, কেদা ও পারলিসে বৃটিশ আধিপত্য স্বীকৃত হয়েছিল, কিন্তু আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয় ধীরে গতিতে। ১৯০২ সালের ইঙ্গ-শ্যাম চুক্তি অনুযায়ী কেলানতান ছিল শ্যামের অধিভুক্ত। স্বাভাবিকভাবেই অন্যান্য রাজ্যের ‘চেয়ে শ্যামের সাথে কেলানতানের ভালো সম্পর্ক ছিল। ১৯০৯ সালে কেলানতান বৃটিশ আধিভুক্ত হওয়ার পর সেখানে একটি রাজ্য পরিষদ গঠন করা হয়।

সুলতানকে রাজ্য পরিষদের সভাপতি করা হয়। বৃটিশ উপদেষ্টা ছাড়াও স্বল্প সংখ্যক বৃটিশ রাজকর্মচারী বিভিন্ন দপ্তরের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে নিয়োগ করা হয়।

১৯১০ সালে মালয়ের ত্রেংগানু বৃটিশ অধিকার মেনে নেয়। বৃটিশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পূর্বে ত্রেংগানু শ্যাম দেশের অধীনে ছিল এবং তারা শ্যাম-সার্বভৌমত্বের দাবি অনেকদিন ধরে অগ্রাহ্য করে আসছিল। তারপর ত্রেংগানু সুলতান বিদেশনীতি নির্ণয়ের বৃটিশ অধিকার মেনে নেয়। সুলতান সীমিত সংখ্যক বৃটিশ প্রতিনিধি গ্রহণ করতে রাজি হন। কেলানতানের মতো ত্রেংগানুতেও শাসনতান্ত্রিক সংস্কার সাধন করা হয়। সেখানে রাজ্য পরিষদ গঠন করা হয় এবং একজন বৃটিশ উপদেষ্টা নিয়োগ করা হয়। রাজ্য পরিষদে মালাই সদস্য ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। এ পরিষদের সভাপতি ছিলেন মেন্ট্রি বেসোয়ার। সুলতান ছিলেন রাজ্যের আইনানুগ প্রধান। শাসন কাজের জন্য অল্পসংখ্যক বৃটিশ কর্মচারী নিয়োগ করা হয়। রাজ্যের প্রায় সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে পরামর্শ দাতার সঙ্গে আলোচনা করা হত।

১৯১০ সালে কেদাহ সুলতান শাসককার্যে বৃটিশ উপদেষ্টারও সাহায্য গ্রহণ করেন। কিন্তু বৃটিশদের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হন দীর্ঘদিন পর অর্থাৎ ১৯২৩ সালে। ১৯২৩ সালের চুক্তির ধারা অনুযায়ী কেদাহতে একটি রাজ্য পরিষদ গঠন ও একজন উপদেষ্টা নিয়োগ করা হয়। স্বয়ং সুলতান ছিলেন এ পরিষদের সভাপতি। অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন বৃটিশ উপদেষ্টা, সুলতান নিযুক্ত এবং ফেডারেটেড মালয় স্টেটসের হাইকমিশনার অনুমোদিত তিনজন মালাই সদস্য। এ চুক্তিতে স্পষ্ট ভাষার উল্লেখ করা হয় যে, সুলতানের সম্মতি ছাড়া অন্য কোনো রাজ্য বা উপনিবেশের সঙ্গে কেদাহকে সংযুক্ত করা যাবে না।

১৯১৩ সালে ক্ষুদ্র রাজ্য পারলিসেও বৃটিশ আধিপত্য স্বীকৃত হয়। ইঙ্গ-শ্যাম চুক্তি বলে শ্যামদেশীয় উপদেষ্টার স্থান দখল করে বৃটিশ উপদেষ্টা। ১৯৩০ সালে নতুন চুক্তি অনুযায়ী শাসন বিভাগে বৃটিশ উপদেষ্টার ভূমিকা প্রসারিত হয়। অন্যান্য বিভাগে বৃটিশ কর্মচারী নিয়োজিত ছিল, কিন্তু আমলা বাহিনীতে মালাইদের প্রধান্য ছিল।

বৃটিশদের ফেডারেটেড মালয় রাজ্যগুলো থেকে বিভিন্ন কর্মচারী কেলানতান, ত্রেংগানু, কেদা এবং পারলিসে পাঠানো হয় প্রশাসনিক সুবিধার্থে। কেলানতান ও ত্রেংগানু রাজ্যদুটিতে শ্যামদেশের প্রভাব সবচেয়ে বেশি থাকায় বৃটিশরা এ দুটি রাজ্যের, উপদেষ্টার সাহায্যে রাজ্য পরিষদের সভাপতি বা সুলতান ও সদস্য সবাই ছিল মালয়ী, কিন্তু বৃটিশ রেসিডেন্ট রাজ্য পরিষদের সভায় যোগ দিয়ে প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক উপদেশ ও নির্দেশনা দিতেন। অন্য দুটি রাজ্য কেদাহ ও পারলিসে বৃটিশ উপদেষ্টা ও স্বল্প সংখ্যাক বৃটিশ কর্মচারী নিয়োগ করা হয়েছিল এবং বৃটিশরা কিছু শাসনতান্ত্রিক সংস্কার করলেও রাজ্য পরিষদ গঠন করেনি।

কেলানতান, ত্রেংগানু, কেদাহ এবং পারলিস এই ৪টি রাজ্যে শ্যামদেশের স্থলে বৃটিশ আধিপত্য বিস্তৃত হলেও ফেডারেটেড মালয় স্টেট (নেগ্রিসেমটিলান, পাহাং, মিনাংকাবু, যেলেংগার) এর তুলনায় এখানে বৃটিশ আধিপত্য ছিল অপেক্ষাকৃত কম। এ চারটি রাজ্যের সুলতান ফেডারেটেড মালয় স্টেট-এর সংগে সংযুক্ত হতে আগ্রহী ছিলেন না। তারা তাদের স্বাধীনতা হারাতে চায়নি। এছাড়া রাজ্য চারটি অর্থনীতি, শাসন কাঠামো, সনাতনী প্রথায় সুলতানদের স্বতন্ত্র চলার নীতি এবং ফেডারেটেড মালয় রাজ্যগুলোর কেন্দ্রীয় শাসন থেকে নিয়ন্ত্রণ মুক্ত থাকার ইচ্ছা, উপরন্তু মালয় উপদ্বীপের দক্ষিণের রাজ্যগুলোর জনগোষ্ঠীর সাথে উত্তরাঞ্চলের মালয়ীদের বৈরী মনোভাবাপন্ন নীতির কারণেও ৪টি রাজ্য ফেডারেটেড মালয় স্টেট-এর সাথে যুক্ত হয়নি। অন্যদিকে বৃটিশ কর্তৃপক্ষও চায়নি ফেডারেটেড রাজ্যগুলোর কেন্দ্রীয় দপ্তর কুয়ালালামপুরের সাথে আনফেডারেটেড মালয় রাজ্যগুলোকে একই শাসনাধীনে আসুক। কেননা মালয় জাতিসত্তার মধ্যে ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক সচেতনতা অথবা বৃটিশ উপনিবেশিক শাসন বিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে উঠতে পারে।

মালয় উপদ্বীপের মোট ৯টি রাজ্যের মধ্যে নেগ্রিসেমবিলান, পাহাং, মিনাংকাবু, সেলেংগার মিলে ফেডারেটেড রাজ্য এবং ৪টিতে কেলানতান, ত্রেংগানু, কেদাহ ও পারলিস মিলে আনফেডারেটেড রাজ্য নামে বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। অবশিষ্ট জোহর রাজ্য ফেডারেটেড এবং আনফেডারেটেড কোনো রাজ্যেই যোগদান করেনি। জোহর রাজ্যের অবস্থান ছিল মালয় উপদ্বীপের সর্বদক্ষিণে। রাজ্যটির দক্ষিণাঞ্চলের প্রণালীর নিম্নে তুমাসিক থেকে ১৮১৯ সালে সিঙ্গাপুর নগররাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে জোহর রাজ্য এবং সিঙ্গাপুরের মধ্যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। উনবিংশ শতাব্দির মধ্যভাগ থেকে জোহর রাজ্যের কর্তৃত্ব নিয়ে দুই রাজপুত্র টংকু আলী এবং তেমেংগার ইব্রাহীমের মধ্যে গৃহবিবাদ শুরু হয়। টংকু আলী ছিলেন সুলতান হুসেইন এবং তেমেংগং ইব্রাহীম ছিলেন তেমেংগং আব্দুর রহমানের পুত্র। টংকু আলী এবং তেমেংগং ইব্রাহীম উভয়ই ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পেনশনভোগী। জোহরের প্রশানিক ক্ষমতা ও রাজ্যস্বের উপর নিয়ন্ত্রণাধিকার নিয়ে উভয়ের মধ্যে বিবাদ শুরু হয়। জোহরের সুলতান হিসেবে টংকু আলী কোম্পানির কাছে স্বীকৃতি চেয়েছিলেন কারণ তার যুক্তি ছিল কোম্পানির প্রতিনিধিরূপে র‍্যাফেলস তার পিতাকে সুলতান হিসেবে মেনে নেন। আর তেমেংগং ইব্রাহীমের দাবি হচ্ছে তিনিই হচ্ছেন জোহরের প্রকৃত শাসক।

অবশেষে ১৮৫৫ সালে দুই রাজপুত্র এবং স্ট্রেট সেটেলমেন্টের কর্তৃপক্ষের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী টংকু আলীকে সুলতান উপাধি প্রদান এবং কিছু অর্থ ও বর্ধিত পেনসন এবং কেসাং ও মুয়ার নদীর মধ্যবর্তী ভূখণ্ডের মালিকানা দেয়া হয়। অন্যদিকে তেমংগং ইব্রাহীম সিঙ্গাপুরের বৃটিশ গভর্নর কর্তৃক জোহর রাজ্যের শাসক নির্বাচিত হন।

তেমেংগং ইব্রাহীম জোহর রাজ্যের শাসক হলেও বংশধরদের নিয়ে বাস করতেন সিঙ্গাপুরে এবং বৃটিশদের সহায়তায় সেখান থেকে জোহর রাজ্যের শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। ১৮৬২ সালে তেমেংগং ইব্রাহীম মারা যান। তার মৃত্যুর পর ছেলে আবু বকর জোহর রাজ্যের শাসক হন। ১৮৬৮ সালে তিনি এসে স্টেটস সেটেলমেন্টের গভর্নরের সাথে পরামর্শ করে মহারাজা উপাধি গ্রহণ করেন। এরপর ১৮৮৫ সালে মহারাজা সুলতান উপাধি ধারণ করেন এবং ইংরেজদের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ হন। সেইসাথে কনসাল পদে একজন বৃটিশ কর্মচারী গ্রহণ করেন।

সুলতান আবু বকর সিঙ্গাপুরের চীনা সম্প্রদায়ের সাহায্যে জোহর রাজ্যে কফি, চা, লবঙ্গ, গোলমরিচসহ বহুমুখী কৃষিপণ্য উৎপাদনের ব্যবস্থা করেন। সুলতান আবু বকর বৃটিশ আইনজীবীর সহায়তায় একটি লিখিত শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করেন। শাসনতন্ত্রে সুলতানকে সাহায্য প্রদান করার জন্য একটি মন্ত্রিপরিষদ ছিল। মন্ত্রিরা সবাই ছিলেন মালাই ও মুসলিম। একটি রাজ্য পরিষদ ছিল এবং এ পরিষদের সব সদস্যই ছিলেন জোহরের নাগরিক। মন্ত্রী পরিষদের সম্মতি নিয়েই সুলতান রাজ্য পরিষদের সদস্যদের নিয়োগ করতেন। মন্ত্রী পরিষদের সদস্যরা পদাধিকার বলে রাজ্য পরিষদের সভাপতি ছিলেন। রাজ্য পরিষদ আইন প্রণয়ন করত আর তাতে স্বাক্ষর করতেন সুলতান। ১৮৯৫ সালে সুলতান আবু বকর মৃত্যুবরণ করলে তার পুত্র ইব্রাহীম সুলতান নিযুক্ত হন। ১৯১২ সালে সুলতান ইব্রাহীম শাসনতন্ত্রের সংশোধন করে একটি কার্যনির্বাহী কাউন্সিল গঠন করেন এবং সুলতান এর সদস্যদের নিয়োগ করতেন। সুলতানের সভাপতিত্বে প্রতি সপ্তাহে একবার এ কাউন্সিলের বৈঠক বসত। এছাড়া কাউন্সিল দৈনন্দিন শাসন দেখাশোনা করত এবং নতুন আইনের প্রস্তাব পেশ করত।

১৯১৪ সালে শাসনতন্ত্রে আরো কিছু পরিবর্তন সাধন করা হয়। জোহরের নাগরিক ছাড়া অন্য যে কেউ এমনকি বৃটিশ কর্মকর্তারা রাজ্য পরিষদের সদস্য হতে পারত। শাসনকার্যের শীর্ষে সুলতানের অধীনে একজন মালাই মন্ত্রী নিযুক্ত করা হয়। উচ্চ পদের বিভাগীয় দায়িত্ব দেয়া হয় মালাই ও বৃটিশ রাজকর্মচারীকে। ১৯১৪ সালের সংবিধান অনুযায়ী জোহর রাজ্যের শাসনকার্যে নিয়মিত বৃটিশ উপদেষ্টা গ্রহণ করা হয়। মালয় উপদ্বীপ ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪১ সালে জাপানি দখলের পূর্ব পর্যন্ত জোহর রাজ্যটি এভাবে শাসিত হয়।

উল্লেখ্য যে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মালয় উপদ্বীপের সর্বদক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত একটি দ্বীপ সিংগাপুর। এর অফিসিয়াল নাম ‘দ্যা রিপাবলিক অব সিংগাপুর’ আর রাজধানীর নাম সিঙ্গাপুর সিটি। মাত্র ৫৪৪ বর্গকিলোমিটারের এ দ্বীপরাষ্ট্রটি মুসলিম সালতানাত জোহরের অংশবিশেষ বাণিজ্য বন্দর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল।

১২৫০ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে এটি সুমাত্রার আর্যপালংবাঙ্গের অংশ হিসেবে ছিল। স্থানীয় ভাষায় এর নাম ছিল তুমাসিক। এটি মাজাপহিত রাজ্যের অংশ হিসেবেও কিছুদিন শাসিত হয়েছিল। মালাকার বাণিজ্য নগরীর উত্থানের মধ্যদিয়ে এ নগরীর গুরুত্ব কমে গেলেও ১৫১১ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগিজ কর্তৃক মালাক্কা দখলের পর মালাক্কার সুলতান পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং সেখান থেকেই পরবর্তীতে ১৫২৬ খ্রস্টাব্দে জোহর রাজ্যের উত্থান ঘটান। এ সময় থেকেই তুমাসিক জোহরের অধীনে একটি বাণিজ্যবন্দর হিসেবে আবারো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

তবে ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দের ৬ ফেব্রুয়ারি টমাস স্ট্যামফোর্ড ব্যাফেলস ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষ হতে জোহর সুলতানকে জোরপূর্বক চুক্তিতে সম্মত হতে বাধ্য করেন। সেই চুক্তির ভিত্তিতেই ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে পুরো দ্বীপের দখলদারিত্ব কায়েম করে বৃটিশরা। মুসলিম জনবসতির এ অঞ্চলটিতে এখন মুসলমান সংখ্যা মাত্র শতকরা ২৫ ভাগ। জাতীগোষ্ঠীর দিক থেকে প্রায় ৭৭ ভাগ চীনা, ১৫ ভাগ মালী, ৬ ভাগ ভারতীয় এবং ২ ভাগ অন্যান্য জাতীগোষ্ঠীর লোক বসবাস করে। সেখানে এখন ইংরেজি, মালয়ী, তামিলসহ বিভিন্ন ভাষা ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

ইসলামের সূচনা শতাব্দিতেই তুমাসিক বা সিঙ্গাপুরে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে। বাণিজ্যিক তৎপরতার কারণে যেমন মুসলিম বণিকদের সংস্পর্শ পেয়েছে তেমনি ইসলাম প্রচারকগণও এসব অঞ্চলে এসেছেন ইসলামের দাওয়াত নিয়ে। তবে ত্রয়োদশ শতাব্দির পূর্বে রাষ্ট্রীয়ভাবে দক্ষিণ-পূর্ব ইশয়ায় ইসলামের প্রসারের কোন তথ্য পাওয়া যায় না। এ শতাব্দির শেষ দিকে পাসাই অঞ্চলে রাষ্ট্রীয়ভাবে সালতানাত প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইসলাম প্রতিষ্ঠার ইতিহাস জানা যায়। পরবর্তীতে পঞ্চদশ শতাব্দির সূচনাতেই মালাক্কা রাজ্যের মুসলিম সানতানাত প্রতিষ্ঠা হলেও তুমাসিক বাণিজ্য কেন্দ্রের গুরুত্ব অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছিল। তবে এ বন্দরের গুরুত্ব বৃদ্ধি করার জন্য ১৫১১ খ্রিস্টাব্দের পূর্ব পর্যন্ত মালাক্কার মুসলিম সুলতানের পক্ষ থেকে ‘শাহ বন্দর’ বা বন্দর কর্মকর্তা নিযুক্ত করা হয়েছিল। মূলত জ্বালানি কাঠ, পানি, খাদ্যদ্রব্যসহ প্রয়োজনীয় রসদপত্র এখানে বেশ সহজলভ্য ছিল।

তুমাসিকের লোকবসতি ছিল খুব কম। এখানে বসবাসকারী লোকসংখ্যা ছিল মাত্র এক হাজারের মতো। তাদের অধিকাংশই মুসলমান ছিল এবং ‘শাহ বন্দর’ বা বন্দর কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানেই তারা জীবনযাপন করতেন। সামান্য কিছু কৃষিজীবীর দখলে ও অধিকাংশই ছিল বাণিজ্যিক উপায়ে জীবিকার নির্বাহকারী।

১৪০৩ খ্রিস্টাব্দে মালাকা রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা পরমেশ্বর তুমাসিকের শাসককে হত্যা করে সেখানে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালানোর কারণে তার সাথে তুমাসিকের স্পর্শ ভালো ছিল না। তবে পরবর্তীতে এটি মালাক্কা নিয়ন্ত্রিত বন্দর হিসেবেই পরিচালিত হয়েছিল বলে জানা যায়। মালাক্কার সমৃদ্ধির উচ্চশিখরে পৌঁছে সুলতান মাহমুদ শাহের শাসনামলে। তিনি ১৪৮৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৫১১ খ্রিস্টাব্দ অর্থাৎ পর্তুগিজদের মালাক্কা দখল পর্যন্ত শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। মালাক্কার সমৃদ্ধির জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন মালাক্কার বেলদাহারা বা প্রধানমন্ত্রী তুন পেরাকে। তাঁর প্রচেষ্টায় যেমন মালাক্কার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এসেছিল তেমনি তুমাসিক বন্দরের কর্মকাণ্ড ও মুসলমানদের তৎপরতা অব্যাহত ছিল, কিন্তু পর্তুগিজ কর্তৃক মালাক্কা দখল হয়ে গেলে মালাক্কা থেকে তুমাসিক বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তবে ১৫২৬ সালে সুলতান মাহমুদ কর্তৃক জোহর রাজ্যের উত্থান হলে তুমাসিক আবারো মুসলিম বণিকদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে।পরবর্তীতে জোহর সুলতানগণ এটাকে অন্যতম বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিণত করেন। এ সময় এখনকার অধিবাসীদের মধ্যে আরবি ও ভারতীয় মুসলিম বণিকদের যেমন বসতি গড়ে উঠেছিল তেমনি মালয়ী জনগণের প্রাধান্যও ছিল উল্লেখ করার মতো। অধিবাসীদের প্রায় সকলেই ইসলামের অনুসারী ছিল।

১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে বৃটিশের একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবার পরপরই তারা নতুন কৌশল অবলম্বন করে। তারা মুসলিম বণিকদের প্রভাব হ্রাস করার নিমিত্তে চাইনিজদের বসতি গড়ার জন্য নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করে। মাত্র দুই দশকের মধ্যেই সেখানে চীনা নাগরিকের আধিক্য লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। বৃটিশরা তাদের বাণিজ্যিক আনুকূল্যসহ পুঁজি বিনিয়োগের মতো পৃষ্ঠপোষকতাও প্রদান করে। ফলে শুধুমাত্র ঘটিবাটি সহকারে শ্রমিক হিসেবে এসেও তারা অচিরেই বণিক ও শিল্পপতিতে পরিণত হয়।

অন্যদিকে মুসলমানদের বিতাড়িত করার কৌশল হিসেবে নানাবিধ বাণিজ্যিক ‘ইমবাগ’ জারি করে। এমতাবস্থায় মুসলমানগণ এ বন্দর ছেড়ে অন্য কোনো বন্দরে গিয়ে জায়গা করে নেয়। ঐতিহাসিক M. Ali Kettani বলেন, Singapur, was part of the Muslim state of Johore when the British made a bid for its conquest. Pressures on the Sultan of Johore in 1819 forced an agreement on ceding the island to the British. The latter took over effectively in 1824. By then the island had a small population, but was totally Muslim. The British opened the door wide open to Chinense immigration which resulted in the dwarfing of the original population. ফলে ব্যবসায়-বাণিজ্যের প্রায় সবটাই ইউরোপীয় ও চীনা বণিকদের হাতে চলে যায়। হাতেগোনা কিছু আরবীয়, ভারতীয় ও মালয়ী মুসলিম জনগোষ্ঠী থাকলেও তারা সেখানে পশ্চাদপদ সমাজের অংশিদার হয়ে পড়ে।

উপর্যুক্ত আলোচনায় দেখা গেল যে, মালয় উপদ্বীপের রাজ্যগুলোর শাসনতান্ত্রিক রূপান্তর প্রক্রিয়ায় নানা রকম রূপ পরিগ্রহ করলেও বৃটিশদের দ্বারা প্রবর্তিত শাসন ব্যবস্থাকে ২য় বিশ্বযুদ্ধকাল পর্যন্ত তিনটি প্রক্রিয়ায় প্রকাশ করা যায়-

প্রথমত, সিঙ্গাপুর, পেনাং, মালাক্কা এবং ওয়েলসলি প্রদেশ ছিল সরাসরি বৃটিশ উপনিবেশ। এগুলোকে স্টেট সেটেলমেন্ট বা প্রণালী উপনিবেশ বলা হয়।

দ্বিতীয়ত, পেরাক, সেলাঙ্গোর, নেগ্রীসেমবিলান এবং পাহাং নিয়ে ফেডারেটেড মালয় স্টেটস বা মালয় রাষ্ট্রসমূহের ফেডারেশন গঠিত হয়। সাংবিধানিকভাবে এখানে বৃটিশদের পরোক্ষ শাসন প্রবর্তনের কথা বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে এ ফেডারেশনে ছিল প্রত্যক্ষ বৃটিশ শাসন।

তৃতীয়ত, কেদাহ, পারলিস, কেলানতান, ত্রেংগানু এবং জোহর রাজ্যগুলোকে বলা হয় আনফেডারেটেড মালয় স্টেটস বা বিযুক্ত মালয় রাষ্ট্রসমূহ। এ রাজ্যগুলোতে ইংরেজদের পরোক্ষ শাসন চালু থাকলেও তাদের প্রকৃত অবস্থা ছিল আশ্রিত রাজ্যের মতো।

পরিশেষে বলা যায়, মালয়ের বিভিন্ন রাজ্যের শাসনব্যবস্থায় নানা রকম রূপান্তর লক্ষণীয়। তবে বাস্তব কথা হলো সমস্ত রূপান্তরের মূলে ছিল বৃটিশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠার কৌশল। তাদের প্রবর্তিত শাসনতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতিটি স্তরে অর্থাৎ রাজ্য পরিষদ, ফেডারেটেড পরিষদসহ রাজ্যের বিভিন্ন বিভাগে বৃটিশদের সরব উপস্থিতি ছিল। এমনকি সিঙ্গাপুরের গভর্নরের সভাপতিত্বে ফেডারেটেড পরিষদে গৃহীত আইনই রাজ্য পরিষদে এবং রাজার মাধ্যমে রাজ্যগুলোতে প্রয়োগ করা হত। বিচারিক কর্মে ম্যাজিস্ট্রেট হত ইংরেজ এবং বিচার পরিচালিত হত বৃটিশ-ভারতীয় দণ্ডবিধি, ফৌজদারি ও দেওয়ানি আইন দ্বারা। রাজ্য প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ, পুলিশ বিভাগ, ঋণদান পদ্ধতি নিয়ন্ত্রিত হত বৃটিশদের দ্বারা। রাজ্যগুলোর রেলপথ, ভূমি আইন, খনিজ আইন, জমি জরিপ, চিকিৎসা, কৃষি, বন বিভাগের সম্প্রসারণে বৃটিশদের নিরঙ্কুশ আধিপত্য ছিল। এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরেও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বৃটিশরা মালয়.. উপদ্বীপের সমগ্র রাজ্যগুলোকে একই ফেডারেশনের মাধ্যমে একত্রীভূত করে নির্বিঘ্নে শাসন-শোষণ পরিচালনা করার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত উপস্থাপনে সক্ষম হয়।

সংকলন- জোবায়দা জাফরিন সুবহা