মুসলিম উম্মাহর সম্মিলিত অর্থনীতির পরিমাণটা ঠিক কেমন? কোন দেশই বা অর্থনীতিতে তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড়? বৈশিষ্ট্যগত দিক বিবেচনায় মুসলিম উম্মাহর অর্থনীতির চরিত্র এবং এর নিয়ামকগুলো কী কী?
এই সমস্ত প্রশ্নের ক্ষেত্রে সাধারণত নির্দিষ্ট করে উত্তর দেয়াটা কঠিন, উত্তর পেলেও তার সংখ্যাটা খুবই নগন্য। মুসলিম উম্মাহর সম্মিলিত জনসংখ্যা সম্পর্কিত একটা ধারণা আমাদের থাকলেও পৃথিবীতে মুসলিম রাষ্ট্রের প্রকৃত সংখ্যাটা কত তার উত্তরটা নিয়েও মাঝে মাঝে বিভ্রান্তিতে পড়তেই হয়– একেক জায়গায় একেক সংখ্যা উপস্থাপনের কারণেই এই সমস্যার সৃষ্টি হয়।
এই প্রশ্নের উত্তরটা দিয়েই শুরু করলে দেখা যায়, বিভিন্ন মিডিয়ায় বিশ্বব্যাপী মুসলিম রাষ্ট্রের সংখ্যা ইসলামী সহযোগীতা সংস্থার (OIC) সদস্যরাষ্ট্রের হিসাব অনুযায়ী ৫৭ কিম্বা ৫৮ দেখানো হয়। কিন্তু ওআইসি ভুক্ত রাষ্ট্রসমূহের তালিকা আমলে নিলে এখানে একপ্রকার দোটানার তৈরীও হয়। কেননা ওআইসির সদস্যরাষ্ট্র গুলোর মধ্যে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র ছাড়াও উল্লেখযোগ্য মুসলিম জনগোষ্ঠী সম্বলিত রাষ্ট্রগুলোও রয়েছে। যেমনটা নাইজেরিয়া এবং মোজাম্বিক মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ না হয়েও ওআইসি’র সদস্যরাষ্ট্র।
সম্ভবত সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য তালিকাটি পাওয়া যায় Pew Research Centre এর ২০১০ সালের একটি জরিপ থেকে, যেখানে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রের সংখ্যা দেখানো হয় ৪৯ টি। অমুসলিম দেশসমূহ সহ বৈশ্বিক মুসলিম জনসংখ্যার হিসাবে এটি এখন প্রায় ১.৯ বিলিয়ন, যা বৈশ্বিক জনসংখ্যার বিবেচনায় ২৪.১%।
ভূখন্ডের ক্ষেত্রে বিশ্ব মানচিত্রের প্রায় ২১.৭ % মুসলিম বিশ্বের অধিভুক্ত, যেখানে ভৌগলিক আয়তনের হিসাবে সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র কাজাখস্তান। এরপরের অবস্থানগুলোতে আছে আলজেরিয়া, সুদান, সৌদি আরব এবং ইন্দোনেশিয়া।
আরব দেশসমূহে মোট মুসলিম জনসংখ্যার শতকরা হার কাছাকাছি ২০%, যেখানে বাকি মুসলিম রাষ্ট্রসমূহে প্রায় ১.৪ বিলিয়ন মুসলিমের বসবাস রয়েছে।
সবচেয়ে জনবহুল মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে রয়েছে ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশ যেখানে বৈশ্বিক মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রায় ৩৬ শতাংশ বাস করে। ২০২৪ এর হিসাবমতে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম মুসলিম দেশ দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপে রয়েছে ৫ লক্ষাধিক মুসলিম জনগোষ্ঠীর বসবাস।
২০১৩ সালের এক সমীক্ষায় DAWN প্রকাশ করে ৪৮ টি মুসলিম রাষ্ট্রের সম্মিলিত অর্থনীতির বাজারে জিডিপি পরিমাণ ছিল ১২.৯৭ ট্রিলিয়ন ডলার। ২০১৬ সালে The Express Tribune প্রকাশিত হিসাবে বলা হয় বিশ্ব অর্থনীতিতে মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের অবদান ৮%। ২০২২ সালে ওআইসি ভুক্ত ৫৭ টি দেশের সম্মিলিত জিডিপির পরিমাণ ছিল ২৩.৯৪৮ ট্রিলিয়ন ইউএস ডলার। ইসলামী বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তি হচ্ছে ইন্দোনেশিয়া যার জিডিপি(নমিনাল) ১৩৭১.১৭ বিলিয়ন ডলার। এরপরের অবস্থানগুলোতে রয়েছে রয়েছে তুরস্ক ($১,১১৪ বিলিয়ন), সৌদি আরব ($১০৬৭.৫ বিলিয়ন), সংযুক্ত আরব আমিরাত ($৫০৪.২ বিলিয়ন)। ইরানের ক্ষেত্রে তা ২০২৩ সালের শেষনাগাদ ৪০৩.৫ বিলিয়ন ডলার।
মুসলিম জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ৩য় হলেও, অর্থনীতির আকার বিবেচনায় মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে এর অবস্থান ৬ষ্ঠ।
পরিমাণ বিবেচনায় মুসলিম বিশ্বের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে তেল উৎপাদনকারী রাষ্ট্রসমূহ। ২০১০ এর সমীক্ষায় যার পরিমাণ ছিল মসলিম দেশসমূহের সম্মিলিত অর্থনীতির প্রায় ৭৩%। মুসলিম দেশসমূহের তেল হতে উৎপাদিত অর্থনৈতিক হিসাব বাদ দিলে বাকি যে পরিমাণটা থাকে তা বৈশ্বিক অর্থনীতির মাত্র ৪%।
তেল উৎপাদনকারী দেশসমূহ বাদ দিলে মুসলিম বিশ্বে সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ তুরস্ক। পরের অবস্থানগুলোতে রয়েছে মালয়েশিয়া এবং বাংলাদেশ। ইন্দোনেশিয়া খুবই বৈচিত্র্যময় অর্থনীতির দেশ হলেও, এর জিডিপির ক্ষেত্রে একটা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে তেল।
১৯৮০ সাল থেকে সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ হচ্ছে কাতার (১৯৮০-২০২২ এই সময়কালে কাতারের অর্থনীতি বৃদ্ধি পেয়েছে ৩০.২ গুণ), বাংলাদেশ (২৪.৬ গুণ), মিসর(২২ গুণ), ওমান (১৯.১ গুণ), ইন্দোনেশিয়া(১৮.৯গুণ), মালয়েশিয়া(১৬.৬ গুণ), তুরস্ক(১৬.১গুণ)। এই সময়ে পাকিস্তানের বর্ধিত অর্থনীতির পরিমাণ ১৪.৪ গুণ। যেখানে এই সময়ে বিশ্ব জিডিপি বৃদ্ধি পেয়েছে ৮.৮ গুণ।
সামগ্রিকভাবে ওআইসিভুক্ত দেশসমূহের মাথাপিছু আয় $৪,৮৬৯(২০২১), যা বৈশ্বিক মাথাপিছু আয়ের ৩৯.৫২ শতাংশ মাত্র। যা উন্নত বিশ্বের (উচ্চ আয়ের দেশসমূহ) মাথাপিছু আয়ের তুলনায় ১১%। যদিও এক্ষেত্রে মুসলিম দেশসমূহের মাঝে ব্যাপক ভিন্নতা আছে, অনেক মুসলিম দেশই এই দৌড়ে বেশ এগিয়েও আছে।
মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ধনী তিনটি হচ্ছে কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ব্রুনাই। সর্বশেষ ২০২২ সালের হিসাবে এসব দেশের মাথাপিছু আয় ছিল যথাক্রমে $৮৭,৬৬১.৪৫, $৫,৩৭০৭.৯৮ এবং $৩৭,১৫২.৪৮।
এছাড়াও, মুসলিম উম্মাহর সবচেয়ে বড় পণ্য ও সেবা রপ্তানিকারক রাষ্ট্রগুলো হচ্ছে সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং তুরস্ক। মার্কিন ডলারের হিসাবে যথাক্রমে তাদের রপ্তানির(২০২২) পরিমাণটা $৪৪২.৫৬ বিলিয়ন, $৩৭৮ বিলিয়ন, $২৯১.৯ বিলিয়ন এবং $২৫৪.১৯ বিলিয়ন। তেল-বিহীন রপ্তানিতে শীর্ষে আছে মালয়েশিয়া এবং তুরস্ক।
মালয়েশিয়া প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত ও অগ্রসর দেশ। ২০২৩ সালে মালয়েশিয়ার উচ্চপ্রযুক্তি পণ্যের রপ্তানির পরিমাণ ছিল $১১৯.০৪ বিলিয়ন। ইন্দোনেশিয়া, কাজাখস্তান এবং তুরস্ক প্রযুক্তিপণ্য রপ্তানিতে মালয়েশিয়ার থেকে বেশ অনেকটাই পিছিয়ে আছে।
শিক্ষাক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আছে মধ্য এশিয়ার ‘স্তান’- দেশসমূহ, কাজাখস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান এবং উজবেকিস্তান বিশ্বমানের প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষা নিশ্চিত করতে পেরেছে। অন্তত ৯ টি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার হার ৯০% এর বেশি। যেখানে ২০২১ সালের শুমারিতে বাংলাদেশের এই শিক্ষার হার ৭৬.৪ %।
বৈশ্বিক উন্নয়ন সূচকের একটি অংশ হিসাবে স্বাস্থ্যখাতে জিডিপির সবচেয়ে বেশি অংশ ব্যয় করা রাষ্ট্রটি আফগানিস্তান। ২০২৪ এর সাম্প্রতিক রিপোর্টে এর পরিমাণ জিডিপির প্রায় ১৫.৫ শতাংশ। যেখানে বাংলাদেশের অবস্থান একদমই তলানিতে। বাংলাদেশে এর পরিমাণ (২.৬%), বাংলাদেশের নিচে কেবলমাত্র ব্রুনাই অবস্থান করছে(২.৪%)।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণা এবং উন্নয়ন সূচকে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করে তুরস্ক– জিডিপির প্রায় ১.৩২% (২০২২ সালে)। দ্বিতীয় অবস্থানে মালয়েশিয়ার এই পরিমাণটা ছিল জিডিপির ১.০৮%। তিউনিসিয়ার ব্যয় ছিল ০.৬১ শতাংশ। সেখানে পরিকল্পনা কমিশন তথ্য অনুযায়ী ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের এই সূচকে ব্যায় ছিল মাত্র ০.০৩ শতাংশ।
– আব্দুল্লাহ আল মারজুক