মুসলিম পোর্ট

সম্প্রতি মহান শহীদ ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে হত্যার কিছুদিন পূর্বে ভূমিদস্যু ইজরায়েলি কর্মকর্তারা বলেছিল,

ইয়াহিয়া সিনওয়ারই ছিল হামাসের নেতৃত্বাধীন ৭ অক্টোবর ইজরায়েলে হামলার মূল পরিকল্পনাকারী। তার সাথে থাকে হামাসের সামরিক শাখা কাসাম ব্রিগেডের কমান্ডার মোহাম্মদ দেইফ এবং তার সহকারী মারওয়ান ইসা। 

চলতি বছর আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে দক্ষিণ আফ্রিকা ইজরায়েলের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনলে উলটো হামাস ও বিশেষত ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট জমা দিয়েছিল বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। সাথে গ্রেফতারি পরোয়ানাও প্রার্থণা করে। এই অভিযোগ তুলে পরবর্তীতে দফায় দফায় সরাসরী হামাস নেতাদের লক্ষ্য করে হামলা চালাতে শুরু করে তেলআবিব। যদিও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত এতে খুব একটা পাল্টা পদক্ষেপ না নিয়ে চুপ থেকেছে।

তবে এবিষয়টি স্পষ্ট যে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইজরায়েলের সকল আধুনিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে শহীদ ইয়াহিয়া সিনওয়ারের নেতৃত্বেই হামলা চালিয়েছিল হামাস।

ইয়াহিয়া সিনওয়ারের প্রাথমিক জীবনঃ

ইয়াহিয়া ইবরাহিম হাসান সিনওয়ারের জন্ম ১৯৬২ সালে খান ইউনুসের একটি শরণার্থী শিবিরে এবং এটি তখন মিশরের অধীনে ছিল। তার পরিবার আস্কালান থেকে ১৯৪৮ সালে গাজা উপত্যকায় স্থানান্তরিত হয়। খান ইউনিস সেকেন্ডারি স্কুল থেকে মাধ্যমিকে স্নাতক হওয়ার পর তিনি গাজা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং সেখানে তিনি আরবি স্টাডিজে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।

কর্মজীবন:

আস সিনওয়ারকে প্রথম ১৯৮২ সালে নাশকতামূলক কার্যকলাপের জন্য গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং তিনি ফারা কারাগারে বেশ কয়েক মাস ছিলেন। সেখানে তিনি সালাহ শেহাদসহ অন্যান্য ফিলিস্তিনি কর্মীদের সাথে দেখা করেছিলেন এবং সেখান থেকেই নিজেকে কুদস মুক্তি আন্দোলনের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেন।

দখলদার ইজরায়েলি বাহিনী কর্তৃক ১৯৮৫ সালে তিঁনি আবার গ্রেপ্তার হন। মুক্তি পাওয়ার পর মহান এই মুজাহিদ রাহি মুশতাহার সাথে মুনাজ্জামাতুল জিহাদ ওয়াল-দাওয়া নিরাপত্তাসংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। এ সংস্থাটি ফিলিস্তিনি আন্দোলনে ইজরায়েলি গুপ্তচরদের শনাক্ত করার কাজ করত এবং এটি ১৯৮৭ সালে হামাসের পুলিশ বাহিনী হয়ে ওঠে।

১৯৮৮ সালে ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে দুই ইজরায়েলি সৈন্যকে অপহরণ ও হত্যা এবং চার ফিলিস্তিনি গুপ্তচর হত্যার পরিকল্পনার দায়ে গ্রেপ্তার করা হয় জায়নবাদি ইজরায়েল। পরে হত্যার জন্য দোষীও সাব্যস্ত করা হয়। ১৯৮৯ সালে তাকে চারটি মামলার জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে ২০০৮ সালে দখলদার ইজরায়েলের কারাগারে সাজা ভোগ করার সময় জীবন বাঁচাতে তার মস্তিষ্কে একটি টিউমার অপসারণের জন্য অপারেশন করা হয়েছিল। সিনওয়ার তাঁর সাজা হিসেবে ২২ বছর কাটান এবং ২০১১ সালে ইজরায়েলি সৈনিক গিলাদ শালিতের জন্য বন্দী বিনিময়ে ১,০২৬ জনের মধ্যে মুক্তি পাওয়া সবচেয়ে প্রবীণ ফিলিস্তিনি বন্দী তিঁনিই ছিলেন।

২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে সিনওয়ার গোপনে গাজা উপত্যকায় হামাসের নেতা নির্বাচিত হন এবং ইসমাইল হানিয়াহ’র কাছ থেকে তিঁনি দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মার্চ মাসে মহান এই মুজাহিদ গাজা ভূখণ্ডের হামাস নিয়ন্ত্রিত প্রশাসনিক কমিটি প্রতিষ্ঠা করেন। যার অর্থ হলো, তিনি রামাল্লায় ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সাথে কোনো প্রকারের ক্ষমতা ভাগাভাগির বিরোধিতা করেন এবং তিনি ইজরায়েলের সাথে যেকোনো পুনর্মিলন প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি আরও ইজরায়েল সৈন্য বন্দী করার জন্য হামাস যোদ্ধাদের আহ্বান জানান।

২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মিশরে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনার একটি নতুন দফা শুরু হয় এবং সিনওয়ার গাজা ভখণ্ডে হামাসের প্রশাসনিক কমিটি ভেঙে দিতে সম্মত হন।  অতি সম্প্রতি তিনি গাজায় ২০১৭ সালে নতুন ইজরায়েলি প্রযুক্তি দ্বারা বন্ধ করার আগে মুহাম্মাদ দেইফ যে টানেলগুলি ব্যবহার করে লুকিয়ে ইজরায়েলের যোদ্ধাদের অনুপ্রবেশ করাতে চেয়েছিলেন, সেগুলো বাতিল করে দেন।

২০২১ সালের মার্চে গোপনে অনুষ্ঠিত একটি নির্বাচনে তিনি হামাসের গাজা শাখার প্রধান হিসাবে দ্বিতীয় বার চার বছরের মেয়াদে নির্বাচিত হন। সিনওয়ার গাজায় সর্বোচ্চ পদমর্যাদার হামাস কর্মকর্তা এবং গাজার দে ফাক্তো শাসক। এর সাথে বলা হয়, তিঁনি হানিয়ার পর হামাসের দ্বিতীয় শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব।

শহীদ ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে যেভাবে হত্যা করে ইজরায়েল

ইজরায়েল গাজায় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে শহীদ ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে খুঁজছিল। হামাসের নেতা, যিনি ৭ অক্টোবরের হামলার পরিকল্পনা করার পরপরই গাজায় লুকিয়ে যান।

৬১ বছর বয়সী ইয়াহিয়া সিনওয়ার বেশিরভাগ সময় গাজা উপত্যকার নিচে সুড়ঙ্গের ভেতরে লুকিয়ে ছিলেন।

বলা হচ্ছিল সেখানে তার সুরক্ষার জন্য কয়েকজন দেহরক্ষী এবং ইসরায়েল থেকে আটককৃত কিছু জিম্মি ছিল যাদেরকে ‘মানব ঢাল’ হিসেবে ব্যবহার করা যায়।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত মনে হচ্ছে যখন তিনি দক্ষিণ গাজায় ইজরায়েলি টহলদারদের একটি দলের মুখোমুখি হন তখন তার সাথে খুবই কম সংখ্যক দেহরক্ষী ছিল। কোনও বন্দিও সেখানে পাওয়া যায়নি।

রুটিন টহল

ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী বলেছে, তাদের ৮২৮তম বিসলামাক ব্রিগেডের একটি ইউনিট বুধবার রাফাহ অঞ্চলের তাল আল-সুলতান এলাকায় টহল দিচ্ছিল।

তারা তিনজন সশস্ত্র ব্যক্তি চিহ্নিত করে এবং তাদের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। তাদের সবাই নিহত হয়। সেই সময় সংঘর্ষটি বিশেষ কিছু মনে হয়নি এবং সৈন্যরা বৃহস্পতিবার সকালের আগ পর্যন্ত ঘটনাস্থলে ফিরেও যায়নি।

বৃহস্পতিবার যখন মরদেহ পরীক্ষা করা হচ্ছিল তখন একজনের সাথে হামাসের নেতার অদ্ভুত ধরনের মিল লক্ষ্য করা যায়।

তবে আত্মঘাতী কোনও ফাঁদ থাকার ঝুঁকি বিবেচনায় দেহটি সেখানে রেখেই দেওয়া হয়েছিল। এর পরিবর্তে একটি আঙুলের অংশ কেটে নিয়ে পরীক্ষা করার জন্য ইসরায়েলে পাঠানো হয়।

পরবর্তীতে তার দেহ বের করে ইসরায়েলে নিয়ে যাওয়া হয়।

আইডিএফের মুখপাত্র ড্যানিয়েল হ্যাগারি বলেছে, তার বাহিনী “জানতো না তিনি সেখানে ছিলেন, কিন্তু আমরা কাজ চালিয়ে গেছি।”

তিনি বলে, তার সৈন্যরা তিনজন পুরুষকে বাড়ি বাড়ি ছুটতে দেখেছিল এবং তারা নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার আগেই তাদের সাথে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।

যিনি পরে সিনওয়ার হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন, “তিনি একাই একটি ভবনে দৌড়ে গিয়েছিলেন” এবং তাকে সেখানে ড্রোনের মাধ্যমে চিহ্নিত করে হত্যা করা হয়।

সিনওয়ার যেসব জিম্মিদের মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছিল বলে ধারণা করা হয় তাদের কেউই সেখানে উপস্থিত ছিল না। তার সাথে এতটা ছোট একটা দলের উপস্থিতি থেকে ধারণা করা হচ্ছে হয় তিনি সবার দৃষ্টির অগোচরে চলাফেরার চেষ্টা করছিলেন, অথবা যারা তার সুরক্ষার জন্য ছিল তাদের বেশিরভাগ মানুষকে তিনি হারিয়েছেন।

ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট বলেন, “সিনওয়ার মারা গেছে যখন তিনি হেরে গেছেন, পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। তিনি একজন কমান্ডার হিসেবে মারা যাননি, বরং শুধু নিজের চিন্তা করা একজন মানুষ হিসেবে মৃত্যুবরণ করেছেন। এটা আমাদের সব শত্রুর জন্য একটি পরিষ্কার বার্তা।”

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সিনওয়ার হত্যার শেষ মুহূর্তগুলো ইসরায়েলের প্রকাশ করা ড্রোনের ফুটেজে দেখা গেছে।

ড্রোনটি একটি বিধ্বস্ত ভবনের দ্বিতীয় তলার খোলা জানালা দিয়ে উড়ে ভেতরে ঢুকে যায়। ভেতরে কিছুদূর গিয়ে থেমে যায়। সেখানে মাথা ও মুখমণ্ডল ঢাকা একজন ব্যক্তিকে ধ্বংসস্তূপের মাঝে পড়ে থাকা একটি সোফায় বসে থাকতে দেখা যায়। সোফাগুলোও ধুলায় ধূসর বর্ণ ধারণ করেছিল। ড্রোনের কারণেও কিছুটা ধুলা উড়ছিল।

মুখমণ্ডল ঢাকা যে ব্যক্তিকে সিনওয়ার হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে তাকে দেখে আহত মনে হচ্ছিল। তার হাতে লাঠির মতো একটা কিছু দেখা যায় যেটা তিনি ড্রোনের দিকে ছুড়ে মারেন। এরপর ভিডিওটি শেষ হয়।

একটি বিবৃতিতে, আইডিএফ বলেছে, দক্ষিণে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলিতে “আমাদের অভিযান ইয়াহিয়া সিনওয়ারের গতিপথ সীমিত করে ফেলেছিল যেহেতু তাকে তাড়া করা হচ্ছিল এবং এর ফলশ্রুতিতে তাকে নির্মূল করা হয়েছে।”

সিনওয়ারকে হত্যা করা ইসরায়েলের একটি বড় উদ্দেশ্য ছিল, হামাসের ৭ই অক্টোবরের হামলা থেকে যেটির শুরু। তবে তার মৃত্যুতে গাজার যুদ্ধ শেষ হবে না।

শুক্রবার হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্য বাসেম নায়েম এক বিবৃতিতে বলেন, মনে হচ্ছে ইসরায়েল বিশ্বাস করে আমাদের নেতাকে হত্যা করলেই আমাদের আন্দোলন কিংবা ফিলিস্তিনের মানুষের সংগ্রাম থেমে যাবে। কিন্তু সেটি শেষ করা যাবে না।

শহীদ সিনওয়ারের নাম উল্লেখ কিংবা তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত না করে নায়েম বলেন, প্রিয়জন হারানোটা খুবই বেদনাদায়ক।

প্রতিবেদনঃ রনিকা তাবাসসুম