দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মূল ভূখণ্ডে অবস্থিত রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৃহত্তম রাষ্ট্র বার্মা বা মিয়ানমার। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীনতা লাভকালে এর নাম ছিল ইউনিয়ন অব বার্মা। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে নামকরণ করা হয় ‘সোসালিস্ট রিপাবলিক অব দ্যা ইউনিয়ন অব বার্মা‘ এবং ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে এর নাম রাখা হয় ‘ইউনিয়ন অব মিয়ানমার‘। আয়তনের দিক থেকে ৬,৭৮,৫০০ বর্গ কিলোমিটার হলেও জনসংখ্যা মাত্র ৫০ মিলিয়ন এর মতো। এর মধ্যে মুসলমানরা এখানকার সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠী। ভৌগোলিক অবস্থানগত দিক থেকে দেশটির প্রাকৃতিক অবস্থান সাদামাটা আকৃতির এবং সুসংঘবদ্ধ। নৃতাত্ত্বিক দিক থেকে মিয়ানমার ভূখণ্ডে মন-খেমার, তিব্বতীয় বর্মী, থাই চীনাসহ আরবীয় মুসলিম জাতির বসবাস রয়েছে। এভাবে বিভিন্ন পার্বত্য উপজাতি, চীনা, আরবীয়, ভারতীয় ও ইউরোপীয় অভিবাসীদের সমন্বয়ে গঠিত জনসংখ্যার সাথে বর্মী জনসংখ্যার একটি মিশ্রণ বহুমুখী সংস্কৃতির সৃষ্টি হয়েছে। মুসলমানগণ তাদের নিজস্ব ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে স্বকীয় সাংস্কৃতিক বলয় নিয়ে বসবাস করলেও কালের চক্রে স্থানীয় প্রভাবে অনেক ক্ষেত্রে তার বিকৃতি সাধিত হয়েছে।
শান, কাচিন, কায়া, কারেন, চিন, মন ও আরাকান বা রাখাইন নামের এ সাতটি প্রদেশের সমন্বয়ে মিয়ানমার রাষ্ট্রটি গঠিত। এর উত্তর ও উত্তর-পূর্ব দিকে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের তিব্বত ও ইউনান প্রদেশ; উত্তর-পশ্চিমে ভারত, দক্ষিণে মার্তবান ও আন্দামান সাগর, পূর্বে চীন, লাওস ও থাইল্যান্ড এবং পশ্চিমে বাংলাদেশ ও বঙ্গোপসাগর। সুতরাং আধুনিক বিশ্বের প্রভাবশালী দুটি দেশ চীন ও ভারতের সাথে মিয়ানমারের সীমান্ত সংযোগ রয়েছে। এর ফলে এ অঞ্চলের দেশগুলোর ভৌগোলিক ও আদর্শগত প্রভাব এদেশে অনস্বীকার্য। ধর্মীয়ভাবে এখানে মোট জনগোষ্ঠীর শতকরা ৮৯ ভাগ বৌদ্ধ, ৪ ভাগ মুসলিম, ৪ ভাগ খ্রিষ্টান, ২ ভাগ এনিমিস্ট, বাকিরা হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মীয় বিশ্বাসের মানুষ। তাদের প্রধান ভাষা বার্মিজ হলেও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী তাদের নিজস্ব ভাষা ব্যবহার করে থাকে।
সপ্তম শতাব্দী থেকেই আরবীয় মুসলমান বণিকগণ মালাবার হয়ে চট্টগ্রাম, আকিয়াব ও ইয়াঙ্গুনসহ চীনের ক্যান্টন বন্দর পর্যন্ত বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে ভ্রমণ করেছেন এবং সে সুবাদে ইসলামের সুমহান বাণী প্রচার করেছেন। ফলে আরবে ইসলামের প্রচার প্রসারের প্রাথমিক পর্ব থেকেই মিয়ানমারে প্রচার প্রসার শুরু হয়। এছাড়া অসংখ্য উলামায়ে কিরাম এসব এলাকায় ইসলাম প্রচারের জন্য আসেন। ফলে ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যেই মিয়ানমারের আরাকান প্রদেশসহ বিভিন্ন স্থানে মুসলিম প্রভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
রাজধানী নেপিদসহ সমগ্র মিয়ানমারের প্রত্যেক প্রদেশে মুসলমানদের বসবাস রয়েছে। তবে আরাকান ব্যতীত সমস্ত প্রদেশেই মুসলমানদের সংখ্যা খুবই কম। শুধু রাখাইন স্টেট বা আরাকান প্রদেশেই মুসলমানদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেশি। সমগ্র মিয়ানমারের আরাকান প্রদেশই একমাত্র প্রদেশ যেখানে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অংশীদারিত্বে মুসলমানদের অবস্থান সুদৃঢ় ছিল। ফলে সেখানকার মুসলমানদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবন গোটা মিয়ানমারের মধ্যে ভিন্নতর।
আরাকান অঞ্চলটি বর্তমানে মিয়ানমারের একটি প্রদেশ। মিয়ানমারের পূর্ব নাম ছিল বার্মা। ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ জুন সরকারিভাবে বার্মার নাম পরিবর্তন করে মিয়ানমার রাখা হয়েছে। এমনকি রাজধানী রেঙ্গুনের নামও পরিবর্তন করে রেখেছে ইয়াংগুন (খ্রিষ্টপূর্ব ২৬৬৬ অব্দ থেকে ১৭৮৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর ধরে আরাকান স্বাধীন ছিল। সময়ের ধারাবাহিকতায় মুসলমানগণ এখানকার অর্থনীতি, সমাজ, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে একটি অভিনব এবং স্বতন্ত্র অধ্যায় বিনির্মাণে সক্ষম হয়েছিল। অদ্যাবধি এখানকার মোট জনগোষ্ঠীর একটি বিরাট অংশ ইসলামের অনুসারী; এদের মধ্যে থাম্ভইক্যা, জেরবাদি, কামানচি, রোহিঙ্গা প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন নামে মুসলিম জাতিগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। তবে রোহিঙ্গারা তাদের মধ্যে বৃহত্তম মুসলিম জনগোষ্ঠী।
আরাকান পরিচিতি ও মুসলিম জনসংখ্যা
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তবর্তী একটি অঞ্চল আরাকান। এর উত্তরে চীন ও ভারত, দক্ষিণ ও পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর, উত্তর ও পশ্চিমে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তবর্তী নাফ নদীর মধ্যসীমা এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম। পূর্বে মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী ইয়োমা পর্বতমালা। এ বিশাল পর্বতমালা প্রাচীরের মতো আরাকানকে মিয়ানমার থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। যোগাযোগের সুবিধা ও ঐতিহ্যগত দিক দিয়ে মিয়ানমারের চেয়ে চট্টগ্রামই আরাকানের কাছাকাছি ও বন্ধুপ্রতিম অঞ্চল। প্রকৃতপক্ষে ছোটখাটো পর্বতমালা ও নাফ নদীর ব্যবধান ব্যতীত উভয় অঞ্চলের (চট্টগ্রাম-আরাকান) অভিন্ন ‘গোত্রীয় জনবসতির তেমন আর কোনো অন্তরায় নেই। তাই চট্টগ্রামে অস্টিকাদি জনগোষ্ঠী ও আরাকানে ভোট চীনা গোত্রীয় কিরাত জাতীয় লোকদের আধিক্য পরিলক্ষিত হয়।
মিয়ানমারের সাথে দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থার ফলেই সুদীর্ঘকালব্যাপী আরাকানের রাষ্ট্রীয় স্বাতন্ত্র্য ও নিরাপত্তা অক্ষুণ্ণ রাখা সম্ভব হয়েছিল।
আরাকানের আয়তন নির্ণয় খুবই কষ্টসাধ্য। বাংলার সাথে আরাকানের সীমা প্রায়ই পরিবর্তন হতো। বাংলাদেশের কক্সবাজার, রামু ও চট্টগ্রামসহ একটি বিশাল অংশ দীর্ঘদিন যাবৎ আরাকানের শাসনাধীনে ছিল। ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দে শায়েস্তা খান (১৬৬৩-৭৭; ১৬৭৯-৮৮ খ্রি.) কর্তৃক চট্টগ্রাম বিজয়ের পর থেকেই কেবল এর আয়তন সঠিক অর্থে নির্ধারিত হয়। এ হিসেবে ব্রিটিশ শাসন পর্যন্ত আরাকানের আয়তন ছিল ২০,০০০ (বিশ হাজার) বর্গমাইল। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীনতা উত্তর পার্বত্য আরাকান বার্মার চীন প্রদেশে এবং দক্ষিণ আরাকানের কিছু অংশ লোয়ার বার্মার ইরাবতী অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত করায় বর্তমানে এখানকার আয়তন ১৪,২০০ বর্গমাইল।
আরাকানের দৈর্ঘ্য ৩৬০ মাইল কিন্তু প্রন্থে স্থান বিশেষে ভিন্নতা রয়েছে। উত্তর আরাকান অঞ্চলটি বেশ প্রশস্ত; যার প্রস্থ প্রায় ১০০ মাইল এবং আরাকানের দক্ষিণাংশে নিচের দিকে ক্রমশ সরু, যার প্রস্থ প্রায় ২০ মাইল। সমগ্র আরাকান অঞ্চল উত্তর- পশ্চিমে ১৭১ মাইলব্যাপী নৌ ও স্থল সীমারেখা সহকারে বাংলাদেশ দ্বারা পরিবেষ্টিত। আরাকানে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নদী আছে যেমন- নাফ, মায়ু, কালাদান, লেমব্রু, অনন, তানগু, স্যান্ডোয়ে প্রভৃতি। এর মধ্যে নাফ, কালাদান, লেফ্র ও মায়ু আরাকানের প্রধান প্রধান নদী। নাফ নদী প্রন্থে ছোট মনে হলেও বেশ খরস্রোতা। এটি বাংলাদেশ ও আরাকানের মধ্যকার আন্তর্জাতিক সীমারেখা হিসেবে কাজ করে। নাফ নদীর পূর্ব তীরে আরাকানের মংডু টাউনশিপ এবং পশ্চিম তীরে বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার টেকনাফ অঞ্চল।
আধুনিক আরাকান অঞ্চলটি সুদূর অতীতে চারটি ভৌগোলিক সীমানায় বিভক্ত ছিল। সীমানাগুলো হচ্ছে ধন্যাবতী, রামাবতী, মেখাবতী এবং দারাবতী। তৎকালীন ধন্যাবতী অঞ্চলটিই বর্তমান আরাকানের রাজধানী এলাকা। এছাড়া রামাবতী বর্তমান রামব্রি দ্বীপ, মেখাবর্তী বর্তমান চেদুবা এবং দারাবতী বলতে আধুনিক স্যান্ডোয়েকে বুঝানো হয়ে থাকে। এখানকার সমুদ্রতট সংলগ্ন দ্বীপসমূহের মধ্যে রামব্রি ও চেদুবা সবচেয়ে বড়। রামব্রি উপকূলে একটি গভীর প্রাকৃতিক পোতাশ্রয় আছে যা চবপিউ শহর থেকে মাত্র কয়েক মাইল উত্তর-পূর্বে অবস্থিত। আরাকানে প্রায় ছোট বড় ১৭টি শহর আছে। শহরগুলো হলো আকিয়াব,
পিউকতাউ, পোন্নগিউ, ‘মেবন, মেনাং, রামব্রি, রাথিদং ও অন প্রভৃতি। এ শহরগুলোর রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক গুরুত্ব ব্যাপক থাকলেও মূলত স্যান্ডোয়ে, সিটওয়ে, মায়ু এবং কিয়াকপাউ- এ চারটিই আরাকানের প্রশাসনিক ইউনিট। আকিয়াব শহরটি কালাদান নদীর মোহনায় অবস্থিত।
বর্তমানে এটি উত্তর আরাকানের প্রধান সমুদ্র বন্দর। আরাকানের পরিবহণ ও যোগাযোগের জন্য নদীপথই প্রধান। যাতায়াতের জন্য গোটা আরাকানে কোনো রেলপথ নেই। ফলে আরাকানের মূল জনগোষ্ঠী বার্মা থেকে অনেকাংশে বিচ্ছিন্ন। আরাকানের জমি খুব উর্বর। সমুদ্রের তীরবর্তী হবার কারণে এখানকার আবহাওয়া মধ্যম প্রকৃতির; যা কৃষিকাজের জন্য বেশ উপযোগী। ধান আরাকানের প্রধান উৎপাদিত ফসল। এছাড়াও এখানে ভুট্টা, আখ, তামাক, চীনাবাদাম, আলু, বেগুন, টমেটো, বাঁধাকপি, ফুলকপি, গাজর, রসুন, পিঁয়াজ, আম, কাঁঠাল, পেঁপে, কলা, লিচু, বরই, কমলালেবু, বাতাবি লেবু, তরমুজ, জলপাই প্রভৃতি শস্য, শাকসবজি ও ফলমূল জন্মে। কৃষির পাশাপাশি আরাকানের একটি উল্লেখযোগ্য জনগোষ্ঠী মাছ শিকারকে তাদের প্রধান পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে। আরাকানের মংডু থেকে শুরু করে ওয়াচং হয়ে ইরাবতি বিভাগের থাবাং সীমান্ত অঞ্চল কিয়াকচামচং পর্যন্ত প্রায় ৩৬০ মাইলব্যাপী মনোরম সমুদ্রোপকূলীয় অঞ্চল। এসব অঞ্চলের বিভিন্ন মোহনায় পর্যাপ্ত সামুদ্রিক মাছ ধরা পড়ে। এছাড়া নদীমাতৃক আরাকানের নদীসমূহেও পর্যাপ্ত মাছ পাওয়া যায়। বিশেষ করে নাফ নদী ও কালাদান নদীর উপকূলীয় চিংড়ি ঘের থেকে পর্যাপ্ত উন্নতমানের চিংড়ি উৎপন্ন হয়। আধুনিককালে পুকুর ডোবাতেও মাছ চাষ বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। আরাকানের জনসংখ্যার সঠিক পরিসংখ্যান প্রদান করা খুবই কষ্টসাধ্য। সামরিক জান্তা শাসিত রুদ্ধদ্বার দেশ হিসেবে সেখানকার অভ্যন্তরীণ পরিবেশ পরিস্থিতি এবং জনসংখ্যার বিন্যাস উভয় ক্ষেত্রেই অস্পষ্টতা রয়েছে। তাছাড়া স্বাধীনোত্তর মিয়ানমারের আরাকান অঞ্চলে কোনো আদমশুমারিও হয়নি। ফলে এ বিষয়ে মতপার্থক্যের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।
এক. বাংলাদেশের পত্র/পত্রিকার ভাষ্য ও আরাকানের মুসলিম লেখকদের মতানুসারে আরাকানের মোট জনসংখ্যা ৫০ (পঞ্চাশ) লক্ষ। তন্মধ্যে ৩০ (ত্রিশ) লক্ষ মুসলমান; যা প্রায় সমগ্র জনগোষ্ঠীর ৬০%।
দুই. ড. আবদুল করিম তাঁর “The Rohingyas; A short Account of Their History and Culture’ গ্রন্থে আরাকানের মোট জনসংখ্যা ৪০ লক্ষ, তন্মধ্যে ২০ লক্ষ মগ-বৌদ্ধ, ১৪ লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলমান, ৪ লক্ষ সর্বপ্রাণবাদী এবং ২ লক্ষ হিন্দু – ও খ্রিষ্টান বলে উল্লেখ করেছেন।
তিন. US Committee for Refugees এর ভাষ্য “Arakans Population is estimated to be 3 to 3.5 million persons of whom approximately 1.4 million are Rohingya.”
আরাকানি মুসলিম লেখকদের মতানুসারে, প্রায় ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা মুসলমান বিভিন্ন সময় নির্যাতনের মুখে আরাকান থেকে বিতাড়িত হয়েছে। এর মধ্যে সৌদি আরবে ৫ লক্ষ, পাকিস্তানে ২ লক্ষ ৫০ হাজার, বাংলাদেশে ৩ লক্ষ ৩০ হাজার, গালফ স্টেটসমূহে ৫৫ হাজার, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে ৪৩ হাজার এবং অন্যান্য দেশে ১০ হাজারেরও বেশি মুসলমান আরাকান থেকে বিতাড়িত হয়েছে। এছাড়া ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দের গণহত্যার সময় লক্ষাধিক মুসলমানকে হত্যা করা হয় এবং ৫ লক্ষাধিক মুসলমান দেশ থেকে বিতাড়িত হয়।
তৎকালীন ব্রিটিশ প্রশাসন বর্তমান গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ থানার সুবিরনগরে এবং কক্সবাজারের সমুদ্রোপকূলে শরণার্থী ক্যাম্প তৈরি করে এদের পুনর্বাসনের চেষ্টা চালায়। এভাবে বিভিন্ন সময় হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন ও বিতাড়নের ফলে মুসলমানদের সংখ্যা অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। তদুপরি আরাকানি মুসলিম লেখকদের পরিসংখ্যানটি উত্তর আরাকান বিশেষত বুচিদং ও মংডু এলাকার পরিসংখ্যানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সে সাথে দুই ও তিন নম্বরের পরিসংখ্যানের সাথে বিতাড়িত ও নিহত মুসলমানদের সংখ্যা যোগ করলে আরাকানি মুসলিম লেখকদের পরিসংখ্যানের সাথে মিলে যায়।
কেননা ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দের আদমশুমারি মোতাবেক আকিয়াবের মুসলমান ছিল ৩৩%। অনুরূপভাবে ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের আদমশুমারি অনুযায়ী আরাকানের লোকসংখ্যা হচ্ছে ১২,৯৯,৪১২ জন। এর মধ্যে বৌদ্ধ ৮,৭৮,২৪৪ জন, মুসলমান ৩,৮৮,২৫৪ জন, হিন্দু ৩,২৮১ জন, খ্রিষ্টান ২,৭৫৩ জন এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বী ছিল ২৫,৮৮০ জন। সুতরাং মোটামুটিভাবে বলা যায়, বর্তমানে আরাকানের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০% লোক মুসলমান। আরাকান নামটি ল্অল;;নেক পুরাতন হলেও বর্তমানে সরকারি নথিপত্রে এ নামটি এক বিলুপ্ত প্রায়। মিয়ানমারের সামরিক শাসক নে উইন ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে আরাকানের নাম এবং পরিবর্তন করে ‘রাখাইন স্টেট’ নামকরণপূর্বক এটিকে একটি অঙ্গরাজ্যের মর্যাদা দিয়েছে। সে অবধি সরকারিভাবে আরাকানকে ‘রাখাইন স্টেট’ নামে অভিহিত করা যারে হয়। ঠিক কখন থেকে এ রাজ্যটি আরাকান নামে পরিচিত তাও সঠিকভাবে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তবে প্রাচীনকালে আরাকানিরা তাদের জন্মভূমিকে রখইঙ্গ নামে অভিহিত করতো। এ রখইঙ্গ শব্দটি সংস্কৃত ‘রক্ষ’ এবং পালি ‘যক্কো’ অর্থাৎ রক্ষ ও যক্ষ শব্দ হতে উৎপন্ন হয়েছে বলে মনে করা হয়। কেননা বৌদ্ধরা লঙ্কা বা সিংহল অর্থাৎ আধুনিক শ্রীলঙ্কা জয় করবার পূর্বে আরাকানের আদিম অধিবাসীদের রক্ষ বা যক্ষ নামেই অভিহিত করতো। অনুরূপভাবে ভারতীয় আর্যরা আরাকানের দ্রাবিড় ও মঙ্গোলীয়দের বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হবার পূর্বে এ নামে অভিহিত করতেন।
রাখাইং শব্দের অর্থ হলো দৈত্য বা রাক্ষস। রাখাইংরা তাদের জন্মভূমিকে রাখাইংপে বা রাখাইং ভূমি বলত। রাখাইন বলতে আরাকানের অধিবাসী আর পে (Phi) বলতে দেশ বুঝানো হতো। ঐতিহাসিক ও ভূগোলবিদদের বর্ণনায় আরাকানের বিভিন্ন নাম পাওয়া যায়। ঐতিহাসিক আর্থার ফেয়ার আরাকানকে রাখাইং নামের বিকৃতি বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি পেগুতে রাখাইন নামের এক জনগোষ্ঠীর সন্ধান পেয়েছেন। কিন্তু রাখাইন নামের উক্ত জনগোষ্ঠীর ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে আরাকানি বৌদ্ধ রাখাইনদের ধর্মের কোনো সাদৃশ্য নেই। তবে রোহিঙ্গা মুসলমানদের মতে আরাকান নামটি অনেক পুরানো। এ নামের বিকৃতিতেই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উচ্চারণ হয়েছে। আরাকান শব্দটি মূলত আরকান; যা আরবি আররেকন বা আররুকন শব্দের অপভ্রংশ। রুকন শব্দের অর্থ হলো স্তম্ভ বা খুঁটি। ইসলামের পাঁচটি বুনিয়াদকে রুকন বলা হয়। তাই তাদের ধারণা, সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দীতে তৎকালীন মুসলমানরা আরাকানকে ইসলামের বুনিয়াদের দিকে খেয়াল রেখে আরাকান নামকরণ করেছেন।
চলবে…
-সংকলণঃ মুশফিকুর রহমান