মুসলিম পোর্ট

বাংলা ও আরাকান সীমান্তগত দিক থেকে শুধু প্রতিবেশীই নয়; বরং চট্টগ্রাম অঞ্চল বিচ্ছিন্নভাবে প্রায় ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দের পূর্ব পর্যন্ত আরাকানের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ফলে বাংলায় ইসলাম প্রচারের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে যেমন চট্টগ্রামে ইসলাম প্রচারের আলোচনা করা হয় তেমনি আরাকানের ইসলামের আগমন আলোচনা করতে হলেও চট্টগ্রামের আলোচনা অপরিহার্য। কেননা তৎকালীন সময়ে চট্টগ্রাম অঞ্চল মূলত আরাকানেরই অংশ ছিল। সে হিসেবে চট্টগ্রামে ইসলামের আগমন অর্থই হলো আরাকানে ইসলাম প্রচারের সূচনা।

হিজরি প্রথম শতকের শেষ দিকে (৯৬ হি.) ৭১২ খ্রিষ্টাব্দে উমাইয়া শাসনামলে সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাসিমের নেতৃত্বে সিন্ধু অঞ্চলে ইসলামের বিজয় নিশ্চিত হবার মধ্য দিয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় রাজনৈতিকভাবে ইসলামের প্রতিষ্ঠা শুরু হলেও মূলত পবিত্র মক্কায় ইসলাম প্রতিষ্ঠার প্রায় সমসাময়িককালে মহানবী (স) এর জীবদ্দশাতেই ভারতীয় উপমহাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিশেষত আরাকান অঞ্চলে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে। কেননা খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর পূর্ব থেকে আরব বণিকেরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাণিজ্যিক পথে ভারত, বার্মা ও চীনের ক্যান্টন বন্দরে বাণিজ্যিক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল।

উল্লেখ্য, দক্ষিণ-পূর্ব বাণিজ্যিক পথ বলতে ভারত মহাসাগরীয় সামুদ্রিক পথকে বুঝানো হয়ে থাকে। এ পথ একদিকে মেসোপটেমিয়া এবং পারস্যোপসাগর থেকে অন্যদিকে মিশর ও লোহিত সাগর থেকে শুরু হয়ে ভারতের পশ্চিম উপকূলে মালাবার পর্যন্ত চলে যেত; সেখান থেকে একদিকে শ্রীলঙ্কা, ইন্দোচীন এবং দক্ষিণ চীন পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। আরবের কুরাইশরাও ইসলামপূর্ব যুগেই এ বাণিজ্যিক পথে তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করে। বিশেষত পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতাব্দীতে পারস্য (ইরান) ও রোমান সাম্রাজ্যের মধ্যে অব্যাহত যুদ্ধবিগ্রহের কারণে আরবদের স্থল বাণিজ্যিক পথ মারাত্মকভাবে বিপদসংকুল হয়ে পড়েছিল। ইয়ামান ও হাজরা মাউতের আরব বণিকদের নৌবাণিজ্যের পূর্ব অভিজ্ঞতার সুবাদে আরবের কুরাইশরাও নৌবাণিজ্যে আগ্রহী হয়ে পড়ে।

সে সূত্রেই মহানবী (স) এর আগমনের পূর্বেই তারা ভারতীয় উপমহাদেশ, বার্মা, কম্বোডিয়া ও চীনের ক্যান্টন পর্যন্ত বাণিজ্যিক যোগাযোগ স্থাপন করেছিল । ষষ্ঠ ও সপ্তম শতাব্দীর সূচনা লগ্নেই তারা দক্ষিণ ভারতের মালাবার, কালিকট, চেরবন্দর, তৎকালীন আরাকানের চট্টগ্রাম ও আকিয়াবের সমুদ্রোপকূলে স্থায়ী বাণিজ্যিক ঔপনিবেশও গড়ে তোলে। পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকেই ইসলাম প্রতিষ্ঠার সমসাময়িক কালের মুসলমানরাও বাণিজ্যিক কারণে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাণিজ্য করতে আসে এবং সপ্তম শতাব্দী থেকে একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত চীনা বাণিজ্যে মুসলিম প্রভাব অব্যাহত থাকে। তৎকালীন সময়ে দক্ষিণ চীনের ক্যান্টন বন্দর ‘খানফু’ নামে পরিচিত ছিল। মুসলিম বণিকগণ এ সময় ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল বিশেষত মালাবার এবং চট্টগ্রাম থেকে কাঠ, মসলা, সুগন্ধিদ্রব্য ও ঔষধি গাছগাছড়া সংগ্রহ করতো। বাণিজ্যিক কারণে মুসলমানরা এসব অঞ্চল সফর করলেও মূলত ইসলাম প্রচার তাদের মুখ্য বিষয় ছিল। কেননা দিনের দাওয়াত দান ও দিন প্রতিষ্ঠার কাজকে প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অত্যাবশ্যকীয় করে দেওয়া হয়েছে। দিন প্রচারের এ অনুভূতির প্রেক্ষিতে তারা বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি ইসলাম প্রচারকে অন্যতম প্রধান কাজ হিসেবে গ্রহণ করার কারণে মহানবীর (স) এর জীবদ্দশাতেই ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারের প্রমাণ পাওয়া যায়।

মহানবী (স) এর নবুয়তের পঞ্চম বছরে অর্থাৎ ৬১৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে মক্কার প্রতিকূল পরিবেশে মুসলমানদের ইমান-আকিদা নিয়ে বেঁচে থাকা অত্যন্ত কষ্টকর হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় মহানবী (স) সাহাবিদেরকে আবিসিনিয়ায় হিজরত করার নির্দেশ দেন। মহানবী (স) এর নির্দেশের প্রেক্ষিতে হযরত উসমান ইবনে আফফান (রা)সহ প্রায় ৮৩ জন সাহাবি হাবশার বাদশাহ নাজ্জাশীর দরবারে আশ্রয় নেন। সম্রাট নাজ্জাশীর পুরো নাম আসহামার ইবনে আবহার নাজ্জাশী। তিনি নেমা পরায়ণ শাসক হিসেবে ইতিহাসে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর হযরত মুহাম্মদ (স) গায়েবানাহ জানায় মাদায় করেছিলেন। আলেমগণ কেউ কেউ তাকেসাহাবি আবার কেউ কেউ তাবেঈ মনে করেন। মূলত মুসলমানদের নিরাপত্তা বিধ্যাকে সাহাবি শি ইসলামের সুমহান আদল মক্কার বাইরে প্রচারের সুযোগ সৃষ্টির উদ্দেশেই। পাশাপাশি এ সকল বিজ্ঞ সাহাবিদের আবিসিনিয়ায় প্রেরণ করেছিলেন কারণ এটি ছিল লোহিত সাগরে প্রবেশপথে অবস্থিত একটি উল্লেখযোগ্য অন্যতম বাণিজ্যিক কেন্দ্র। পশ্চিমে মিশর এবং পূর্বে চীন পর্যন্ত বিস্তৃত সমুদ্রপথে চলাচলকারী বাণিজ্যিক নৌবহরসমূহ আবিসিনিয়ায় এসে যাত্রাবিরতি করতো। পূর্ব পশ্চিম উভয় দিকের বণিকরাই এখানকার বাজারে বিপুল পরিমাণে পণ্য বিনিময় করতো। এ গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিককেন্দ্র হতে বিশ্বের খরব আদানপ্রদানের বিশাল সুযোগ মুসলমানদের হাতে আসে। এটা ছিল আবিসিনিয়ায় হিজরতকারী মুসলমানসহ মহানবী (স) এর জন্য ইসলাম প্রচারের সুবর্ণ সুযোগ।

মহানবী (স) মদিনায় হিজরতের পরবর্তী সময়ে আবিসিনিয়ায় প্রায় সকল মুসলিম মুহাজির মক্কা-মদিনায় ফিরে এলেও আবু ওয়াক্কাস (রা) আর ফিরে আসেননি। উল্লেখ্য, আবু ওয়াক্কাস (রা) এর পুরো নাম আবু ওয়াক্কাস মালিক ইবনে ওয়াইব। তিনি রসুল (স) এর মাতা আমিনার আপন চাচাতো ভাই ছিলেন। তিনি কাদেসিয়া যুদ্ধের বিজয়ী সেনাপতি হযরত সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাসের পিতা। তিনি চীনের কোয়াংটা শহরে একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। এরই অদূরে তার মাজার এখনো বিদ্যমান। ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক পরিচালক প্রফেসর মাহমুদ শাহ কোরেশী সে মাজার জিয়ারত করেছেন বলে গবেষককে জানিয়েছেন। উক্ত সাহাবি মহানবী (স) এর নবুয়তের সপ্তম বছরে হযরত কায়স ইবনে হুযায়ফা (রা), হযরত ওরওয়াহ ইবনে আছাছা (রা) এবং হযরত আবু কায়স ইবনে হারেছ (রা) কে সঙ্গে নিয়ে নাজ্জাশীর দেওয়া একখানা সমুদ্র জাহাজে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্যিক পথে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে বের হয়েছিলেন। তাঁরা উক্ত জাহাজে প্রথমত ভারতের মালাবারে এসে উপস্থিত হন এবং সেখানকার রাজা চেরুমল পেরুমলসহ বহুসংখ্যক লোককে ইসলামে দীক্ষিত করে চট্টগ্রামে এসে যাত্রাবিরতি করেন। অতঃপর তাঁরা ৬২৬ খ্রিষ্টাব্দে চীনের ক্যান্টন বন্দরে গিয়ে উপস্থিত হন। আবু ওয়াক্কাস (রা) এর দলটি ৬১৭ খ্রিষ্টাব্দে রওয়ানা দিয়ে প্রায় নয় বছর পর চীনে পৌঁছেন।

এ থেকে অনুমান করা যায় যে, এ নয় বছর তাঁরা পথিমধ্যে বাণিজ্যিক কেন্দ্রসমূহে ইসলাম প্রচারের কাজে ব্যয় করেছেন। কারণ চীনে আগমনের জন্য আরব দেশ থেকে রওয়ানা করলে বাতাসের গতিবেগের কারণে বিভিন্ন স্থানে নোঙর করতে হতো। বিশেষত বণিকেরা এক্ষেত্রে মালাবার, চেরর, চট্টগ্রাম, আকিয়াব, চীনের ক্যান্টন প্রভৃতি স্থানে জাহাজ নোঙর করতো। অতএব অনুমান করা যায় যে তিনি মালাবারের পর চট্টগ্রাম ও আকিয়াবেও জাহাজ নোঙর করে ইসলাম প্রচারের কাজ করেছেন এবং সে সূত্রেই হিন্দের (বৃহত্তর ভারতের কোনো অঞ্চলের) জনৈক রাজা কর্তৃক মহানবী (স) এর নিকট হাদিয়া তোহফা প্রেরণের উল্লেখ পাওয়া যায়।

হযরত আবু সাঈদ খুদরি (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, হিন্দের জনৈক শাসক মহানবী (স) এর কাছে এক পোটলা হাদিয়া প্রেরণ করেছিলেন; যার মধ্যে আদাও ছিল। মহানবী (স) সাহাবিদেরকে তার (আদার) এক টুকরা করে খেতে দিয়েছিলেন এবং (রাবি বলেন) আমাকেও এক টুকরা খেতে দেওয়া হয়েছিল।

হিন্দের কোন শাসক মহানবী (স) এর নিকট হাদিয়া প্রেরণ করেছিলেন সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানা যায় না।

তবে রুহমি  রাজ্যের শাসকগণ বহুকাল পূর্ব থেকেই ইরানের শাসকের কাছে মূল্যবান হাদিয়া তোহফা প্রেরণ করতো। সম্ভবত এ রুহমি রাজাদেরই কোনো এক রাজা মহানবী (স) এর নিকট হাদিয়া প্রেরণ করেছিল। উল্লেখ্য, রুহমি রাজ্য সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের তথ্য থাকলেও অধিকাংশ ঐতিহাসিক রুহমি বলতে আরাকান রাজ্যকে বুঝিয়েছেন। কেননা আরাকানের পূর্ব নাম ‘রোখাম‘। এটি আরবি শব্দ; যার অর্থ শ্বেতপাথর এবং আরাকানের প্রাচীন রাজধানী ম্রোহংয়ের পূর্বনাম কায়ক। এটি বার্মিজ শব্দ; যার অর্থও শ্বেত পাথর। এদিক থেকে কায়াক অঞ্চল ও রোখাম একই অঞ্চল হেতু রুহমি বলতে রোখাম বা আরাকানকেই বুঝানো যায়। মনে করা হয় যে, রোখাম শব্দটির বিকৃতরূপই রুহমি। তবে কেউ কেউ রুহমি বলতে রামুকে বুঝিয়েছেন। যদি এটা ধরে নেওয়া হয় তবুও আরাকানই হয়। কেননা তখন রামু আরাকানেরই অংশ ছিল। তাছাড়া হাজার বছরের স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আরাকানের ঐতিহ্যও অস্বীকার করা যায় না।

নাইম বিন হাম্মাদ এর উদ্ধৃতিতে রুহমি রাজা কর্তৃক খলিফা উমর বিন আব্দুল আজিজকে (৭১৭-৭২০ খ্রি.) চিঠি প্রেরণের তথ্য পাওয়া যায়। সে চিঠিতে বলা হয়েছে-

রুহমি শাহেনশাহের পক্ষ থেকে যিনি হাজার বাদশাহর অধস্তন পুরুষ, যার স্ত্রীও হাজার বাদশাহের অধস্তন কন্যা এবং যার হাতিশালায় সহস্র হাতি ও যার রাজ্যে দুটি নহর রয়েছে সেগুলোতে উদ থাকে। এছাড়া কপুর, করমচা ও বাদাম গাছও রয়েছে এবং যার প্রতিপত্তি ১২ শত মাইল দূর থেকেও পাওয়া যায়। এর পক্ষ থেকে আরবের বাদশাহ যিনি আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করেন না তার প্রতি। অতঃপর আমি আপনার নিকট কিছু হাদিয়া প্রেরণ করছি। বস্তুত এটি হাদিয়া নয়; বরং কৃতজ্ঞতা। আমি আশা করি আপনি আমার নিকট এমন একজন ব্যক্তিকে প্রেরণ করবেন যিনি ইসলাম বুঝাবেন ও শুনাবেন। আস সালাম।

অনুরূপভাবে রুহমির বাদশাহ কর্তৃক বাগদাদের খলিফা আবু আবদুল্লাহ আল মামুনের নিকট লিখিত চিঠি ও খলিফা মামুন কর্তৃক তার প্রতিউত্তরের বিবরণও পাওয়া যায়। এসব বিবরণের দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মহানবী (স) এর নবুয়তের পূর্ব থেকেই আরাকানের সাথে আরব বণিকদের যোগাযোগ অব্যাহত ছিল এবং সে সুবাদেই মহানবীর (স) এর জীবদ্দশাতেই সুমহান আদর্শের দাওয়াত পৌঁছে।

এ অঞ্চলে ইসলামের আরাকানের চন্দ্র-সূর্য বংশের প্রথম রাজা মহৎ ইঙ্গ চন্দ্র (৭৮৮-৮১০ খ্রি.) ৭৮৮ খ্রিষ্টাব্দে বৈশালীতে রাজধানী স্থাপন করে শাসনকার্য পরিচালনা শুরু করেন। তার উদারনীতির কারণে মুসলমানরা ইসলাম প্রচারের ব্যাপক সুযোগ পায় এবং সে সূত্রেই আরব মুসলিম বণিকগণ রাহাম্বি বন্দরসহ আরাকানের নৌবন্দরসমূহে ব্যাপকভাবে বাণিজ্যিক ও ইসলাম প্রচার মিশন পরিচালনা করতে থাকে। এ রাজার শাসনামলেই কয়েকটি আরব মুসলিম বাণিজ্যবহর রাহাম্বি দ্বীপের পাশে বিধ্বস্ত হলে জাহাজের আরোহীরা রহম বলে চিৎকার করতে থাকে। এ সময় স্থানীয় লোকজন তাদেরকে উদ্ধার করে রাজার কাছে নিয়ে যায়। রাজা তাদের বুদ্ধিমত্তা ও উন্নত আচরণে মুগ্ধ হয়ে আরাকানেই স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি দান করেন। আরব বণিকগণ কেউই স্ত্রী- পুত্রসমেত সপরিবারে বাণিজ্য করতে আসেননি। তারা স্থানীয়ভাবে  মহিলাদেরকে বিয়ে করে। ফলে মুসলমানকোনে সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। এভাবে অষ্টম শতাব্দী থেকে দশম শতাব্দী পর্যন্ত আরাকানের উপকূলীয় অঞ্চল হতে শুরু করে মেঘনা নদীর পূর্ব তীরবর্তী বিস্তীর্ণ বন্দরসমূহে আরব বণিকদের কর্মতৎপরতায় মুখরিত হয়ে ওঠে। এমনকি মুসলমানদের সুমহান আদর্শের প্রতিও শাসকগণ মুনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে দুর্বল হয়ে পড়ার নিদর্শন পাওয়া যায়। কেননা দ্বিতীয় উমর নামে খ্যাত উমাইয়া খলিফা উমর বিন আবদুল আজিজ (৭১৭-৭২০ খ্রি.) এবং আব্বাসীয় খলিফা মামুনকে (৮১৩-৮৩৩ খ্রি.) রুহমির রাজা পত্র লিখেছিল। যদি রুহমি বলতে আরাকান বুঝানো হয়ে থাকে তবে তখন আরাকানে শাসক যথাক্রমে রাজা সূর্যক্ষিতি (৭১৪-৭২৩ খ্রি.) এবং সূর্য ইঙ্গ চন্দ্র (৮১০-৮৩০ খ্রি.) কর্তৃক এ পত্রগুলো লেখা হয়েছিল। তাঁদের পত্রের মাধ্যমে ইসলামের প্রতি ভালোবাসা ও মুসলমানদের প্রতি নমনীয়তার প্রমাণ মেলে।

দশম ও একাদশ শতাব্দীতে আরব বণিক ও সুফি দরবেশদের মধ্যে বদরুদ্দিন (বদর শাহ) নামে ইসলাম প্রচারক এ অঞ্চলে আসেন এবং ধর্মীয় ও সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেন। তার নামানুসারে আসামের সীমা থেকে শুরু করে মালয় উপদ্বীপ পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে ‘বদর মোকাম’ নামে মসজিদও নির্মিত হয়েছে।

অদ্যাবধি মাঝি মাল্লা ও নাবিকরা বদরকে মাঝিমালার রক্ষাকর্তা বা দরিয়া পির বলে স্মরণ করে থাকে। এভাবে চট্টগ্রাম এবং আরাকানে আগত ও বসতি স্থাপনকারী আরব বণিক সম্প্রদায়, নাবিক, সুফি, দরবেশ শ্রেণি এবং ত্রয়োদশ শতকের পর থেকে তুর্কি, পাঠান ও মুঘলদের শাসনামলে বাংলা থেকে আগত মুসলমানদের সাথে এ অঞ্চলের (চট্টগ্রাম- আরাকান) নিম্নবর্ণের হিন্দু ও বৌদ্ধদের সংমিশ্রণ ঘটে এবং তারা ব্যাপক হারে ইসলামে দীক্ষা গ্রহণ করে। সে সাথে চট্টগ্রাম অঞ্চল ছিল বাংলা, আরাকান, ত্রিপুরা ও বার্মার লক্ষ্যস্থল এবং আরাকান রাজ্যের অধীনে চট্টগ্রাম দীর্ঘদিন শাসিত হবার ফলে চট্টগ্রামে বসবাসরত জনগোষ্ঠী, নবদীক্ষিত মুসলমান, বহিরাগত ইসলাম প্রচারক-বণিক, সুফি- দরবেশ, উলামা সম্প্রদায় অবাধে আরাকানে ইসলাম প্রচারের জন্য যাতায়াত করতেন। ফলে চট্টগ্রামের মতো আরাকানেও একটি ইসলামি পরিবেশ সংবলিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল।

পর্দাপ্রথা, খাদ্যাভ্যাস, রান্না পদ্ধতি, এমনকি মানবীয় আচরণেও ইসলামের প্রভাব লক্ষ করা গেছে। পরবর্তীতে বরেণ্য পীর-দরবেশগণের মধ্যে চকপিউ এর মুনশি আবদুন নবী, আকিয়াবের শাহ মোনায়েম (বাবাজি), হায়দার আলী শাহ (কাহারু শাহ), নূরুল্লাহ শাহ (কৈলা শাহ), আজল উদ্দীন শাহ (আজলা শাহ) এবং সিরিয়মের পাঁচ পীর ও কাইয়েমর সরদার পাড়ার সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয়সহ অনেকের নাম উল্লেখযোগ্য। বদরুদ্দীন বদরে আলম যাহিদী নামক একজন অলি তিন/চারশত অনুগামী ইসলাম প্রচারক নিয়ে ভারতের মারাঠাবাদ থেকে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে এসেছিলেন। তিনি ১৩৮০ খ্রিষ্টাব্দে বিহারে চলে যান এবং ১৪৪০ খ্রিষ্টাব্দে সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। তারা নানারূপ বিকৃত বৌদ্ধ-হিন্দুয়ানি আচরণ ও প্রথা রহিত করে মুসলমানদের ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন সত্যিকারের ইসলামি মূল্যবোধের আলোকে গড়ে তোলার জন্য আমরণ চেষ্টা করেছেন। এভাবে আরাকানের সামাজিক অবকাঠামোগত ভিত্তিতে ইসলামের সম্পৃক্ততা দ্রুত বৃদ্ধি পায়।

-সংকলনঃ মুশফিকুর রহমান