মুসলিম পোর্ট

সেদিনের (২৭ জুন ২০২১)মগবাজারের বিস্ফারণ, বিভিন্ন ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ও নিহতদের ছবি দেখে প্রায়ই ভাবি, আমরাও তো এ শহরের বাসিন্দা, এখানেও যদি এই মহাদুর্ঘটনা ঘটে, তাহলে কী হবে?

২০১৯ সালে পুরান ঢাকার চকবাজারে আগুন লাগলো, ফায়ার সার্ভিসের ৩৭ টি ইউনিট সারা রাত চেষ্টা করেও সময়মতো আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি, বিশাল গাড়ি নিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করতে হয়েছে। গ্যাস সিলিন্ডার থেকে সূত্রপাত হওয়া আগুন নেইল পলিশ ও পারফিউমের কেমিক্যালের গোডাউনে ছড়িয়ে পড়ে। এ আগুন যেন ফায়ার সার্ভিসের পানিকে পাত্তাই দিতে চায়নি! পুরোটা জ্বলে, জ্বালিয়ে তারপর নিভেছে প্রায় ৮ ঘন্টা পর! মৃতের সংখ্যা ছিলো ৯৬, আহত অর্ধশত। প্রিয় বন্ধু আশরাফ সেদিনই দগ্ধ হয়ে মারা গিয়েছিলো।

শুধু সেদিনের (২৭ জুন ২০২১) মগবাজারের ঘটনা বা ২০১৯ এর চকবাজারের ঘটনা নয়, প্রায়ই ঘটছে এমন ঘটনা। আসলে ঢাকার মানুষেরা বহু আগে থেকেই মাইনফিল্ডে বসবাস করছে; যে কোনো সময় ঘটতে পারে যে কোনো ধরণের দুর্ঘটনা।

আমরা কতটা নিরাপদ? ট্রান্সফর্মার, মাকড়সার জালের মতো বিভিন্ন তার, ভাঙ্গা ড্রেন, মেয়াদবিহীন গাড়ি ও বিল্ডিং নিয়েই তো আমাদের নগরী! প্রতিনিয়ত যে রাস্তায় চলছি, যে গাড়িতে চড়ছি, সেগুলো কতটা নিরাপদ? পরিবেশ দূষণ, ভয়াবহ মাত্রার বায়ু দূষণ, নদী ও ড্রেনেজ সিস্টেমের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাব, অপরিকল্পিত গ্যাস সিলিন্ডারের এ শহর ভয়ঙ্কর মরণফাঁদ নিয়ে অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। এখানকার অধিকাংশ বিল্ডিংও অপরিকল্পিত!

নিমতলী ট্রাজেডি থেকে আমরা শিক্ষা নেইনি, কোনো নগর আন্দোলন ও কর্মসূচি গড়ে উঠেনি, উঠে আসেনি কোনো দাবী ও নগরীর ডিজাইন প্রস্তাবনা! সুতরাং একের পর এক উচিত শিক্ষা প্রকৃতিই দিবে, এটিই নিয়ম।

এখানে একটি ভয়াবহ ভূমিকম্প হলেও কোনো উদ্ধার অভিযান সম্ভব নয়, যেখানে ছোট্ট এক রানা প্লাজার জন্য অসংখ্য মানুষ নিরলস খেটেও কিছু করতে পারেনি! সেই সাথে আছে গ্যাসের লাইন, ইলেকট্রিসির লাইন; যা পুরোপুরিই অপরিকল্পিত এবং অগোছালো।
আমাদের ঢাকা এক ভয়াবহ শহর, আমাদের দেশ এক অনিরাপদ দেশ।

কিন্তু এই যে এক ভয়াবহ নিরাপত্তা সংকট, তা আমরা কয়জন উপলব্ধি করতে পারছি?

কোটি মানুষের শহরে মাত্র ১০ ফুটের রোড, ড্রেনের উপর চলতে পারলে যেন ফুটপাত বা রাস্তারও প্রয়োজন নেই!
মানুষ আলো-বাতাস পাবে কিনা, পরিচ্ছন্ন পরিবেশ পাবে কিনা– এসব নিয়ে ভাবনা নেই, দরকার হলো একটি বাড়ি বানানো, ভাড়া উঠানো!
ইন্ডাস্ট্রি, গোডাউন, বাসা সব একসাথে ভাড়া দিবো, তবে অনেক বেশি টাকা পাওয়া যাবে! বাড়িঘর, হোটেল, ইন্ডাস্ট্রি কোথাও ইমারজেন্সি এস্কেপ রাখবো না এ যুক্তিতে– এসব দুর্যোগ বা দুর্ঘটনা তো ঘটে ৫-১০ বছরে একবার, ওই একবারের জন্য এত জায়গা নষ্ট করবো কেন!

আধা ঘন্টার রাস্তায় চার ঘন্টা জ্যাম! রাস্তার পাশের ডাস্টবিনের গন্ধ, ধূলা, বৃষ্টির পানি জমে যাওয়া তো অতি পরিচিত ঘটনা। যদিও এগুলো সিটি কর্পোরেশনের অধীনস্থ রাস্তা!
আবার ট্রান্সমিটার, মাকড়সার জালের মতো বৈদ্যুতিক তার, ভাঙ্গা ড্রেন, মেয়াদবিহীন গাড়ি ও বিল্ডিং নিয়ে তো আমরা মাথাই ঘামাই না!

সরকার, রাষ্ট্র অথবা রাজনৈতিক আন্দোলনগুলোর কাজ নিয়ে কিছুই না বলি আজ।

আমাদের দেশ ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশ। নগরায়নের কতোই না শ্রেষ্ঠতর উদাহরণ আমাদের ইসলামী সভ্যতা! আমাদের নকশাগুলো নকল করে আমেরিকা-ইউরোপ আজ তাদের নগর/শহরগুলোকে সাজিয়েছে। আমাদের পরিচ্ছন্ন ও পরিকল্পিত রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, মসজিদ, মজবুত নয়নাভিরাম স্থাপত্যকর্ম এবং পরিকল্পিত নগরগুলো যেন ছিলো জান্নাতি বাগান! সেই সমৃদ্ধশালী মুসলিম বাংলায় আজ আমাদের নগরীর এ কী হাল?

শহর, নগর, অর্থনীতি, রাজনীতি, পরিবেশ বাদ দিয়ে শুধুমাত্র ধর্মতত্ত্বে ইসলাম খুঁজলে এমন হওয়াই তো স্বাভাবিক!
বুয়েটে ভর্তি হয়ে সেলফি তুলে অতঃপর ক্যারিয়ারমুখী জীবন পার করলে কেই-বা দিবে ঢাকা, চট্টগ্রামের নগর প্রস্তাবনা, কারাই-বা করবে শহরগুলোর আখলাকপূর্ণ ডিজাইন?
আলেমরা যদি ইবনে খালদুনের নগরতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা না করে তিনি মুতাজিলা নাকি কাফির ছিলেন তা নিয়ে গবেষণা করে, আগামীর প্রজন্ম ইসলাম বলতে ‘ফতোয়া আর বিদ্বেষ’কে বুঝবে– এটিও তো স্বাভাবিক!

আমরা সর্বোচ্চ কী করি? ইসলামীর সভ্যতার পরিকল্পিত নগরায়ন, শহরব্যবস্থার ইতিহাসকে ইউরোপের সম্পত্তি ভেবে এবং বর্তমানে আমাদের করণীয় তথা পরিকল্পনা বাদ দিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিই ‘নাসাঈ শরীফে আছে, আগুনে পুড়ে মারা গেলে শহীদ’!

আর এ ভয়াবহ নিরাপত্তাহীনতার জন্য একমাত্র দায়ী যে ‘রাষ্ট্রব্যবস্থা’ তা ভুলেও চিন্তা করি না, বলিও না; জাতির সামনে এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো ব্যাপকহারে তুলে ধরা তো বহু দূরের পথ!
তাই প্রতিটি ঘটনাই কিছু ছবি আর খবরের মাধ্যমে মিডিয়ার শিরোনাম হয়ে থাকে কিছুদিন, তারপর নতুন ইস্যুর ভীড়ে হারিয়ে যায়।

নিরাপত্তা সংকট, নগর সভ্যতা, রাষ্ট্রব্যবস্থার মহাদুর্বলতার আমাদের এ নগরীর ক্ষেত্রে তাই মনে পড়ে “ইসলামী সভ্যতার শহর ও স্থাপত্য” বইয়ের লেখক প্রখ্যাত স্থপতি উস্তাদ তুরগুত জানসেভের সেই কথা, “তুমি যদি শহর গড়ে তোলার সময় সেখানে কেমন মানুষেরা জন্ম নিবে সে চিন্তা না করেই গড়ে তোলো, তাহলে এমন এক প্রজন্ম জন্ম নিবে, যারা তোমার গড়ে তোলা শহরকে ধ্বংস করে দিবে।” [নগরায়ন, নন্দনতত্ত্ব (এসথেটিকস) আখলাকের একটি অংশ, আর আখলাক হলো ঈমানের একটি অংশ।]