মুসলিম পোর্ট

ইসলামী অর্থনীতি বর্তমানে একটি বিজ্ঞানে পরিণত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে এ কথাও বলা যায় যে, এ সাবজেক্টের বয়সও খুব বেশি নয়। মাত্র সত্তর বা আশি বছর। এর আগে এটা পলিটিক্যাল সায়েন্সের অন্তর্ভুক্ত ছিল, তখন এটাকে পলিটিক্যাল ইকোনমি বলা হতো।

গত সত্তর বছর ধরে ইসলামী অর্থনীতির ওপর ব্যাপক কাজ হচ্ছে। বেশ কিছু বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, সিনিয়র অর্থনীতিবিদ এই বিষয়ে কাজ করছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন প্রফেসর খুরশীদ আহমদ, ড. নাজাত উল্লাহ সিদ্দিকী, প্রফেসর ড. ওমর চাপড়া, ড. মনজের কাহাফ, ড. তরিকুল্লাহ খান, ড. মুনাওয়ার ইকবাল প্রমুখ। এ ছাড়াও অন্য স্কলাররা এই বিষয়ে অনেকে কাজ করেছেন। ধীরে ধীরে ইসলামী অর্থনীতি একটি পূর্ণ বিজ্ঞানে পরিণত হয়েছে।

ইসলামী অর্থনীতির ওপর আলোচনা করতে গেলে এর যে দর্শন বা কর্মকৌশল সেই বিষয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন। ইসলামী অর্থনীতির দর্শনই হলো এই অর্থনীতির ভিত্তি অথবা তার স্ট্র্যাটেজি বা কর্মকৌশলের ভিত্তি। কেননা, একটি বিল্ডিং যেমন নির্ভর করে তার ফাউন্ডেশনের ওপর, ফাউন্ডেশনটাই বলে দেয় বিল্ডিংটি কী রকম হবে, তেমনিভাবে ইসলামী অর্থনীতির দর্শন বলে দেয় যে, তার কর্মকৌশলটা কী হবে বা কী হওয়া উচিত।

কিন্তু সেই দর্শন এবং কর্মকৌশল আলোচনার আগে আমি মনে করি, বর্তমান বিশ্বে যা চলছে তা সংক্ষেপে আলোচনা করা দরকার। বর্তমানে বিশ্বের সর্বাধিক চলিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হচ্ছে ক্যাপিটালিজম। আমরা যদি এই ক্যাপিটালিজমের সমস্যাগুলো বুঝতে পারি তা হলেই ইসলামী অর্থনীতির গুরুত্ব বুঝতে পারব। এটা এই জন্যই প্রয়োজন যে, বর্তমান রুলিং আইডিওলজি দৃশ্যত খুব শক্তিশালী, খুব সফল বলে মনে হয়। অনেকের এ-ও মনে হতে পারে যে, এর বুঝি কোনো দুর্বলতা নেই। কিন্তু এ কথাটা সত্য নয় এবং এ কথাটাই আমি এখানে আলোচনা করতে চাই।

ক্যাপিটালিজমের বয়স ষোড়শ শতাব্দী থেকে ধরা হয়। প্রায় পাঁচ শ’ বছর এর বয়স। এই পাঁচ শ’ বছরে ক্যাপিটালিজম যে দুনিয়ার অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে তা অস্বীকার করা যাবে না। তেমনি এ কথাও অস্বীকার করা যাবে না যে, ক্যাপিটালিজম বিশ্ব থেকে দারিদ্র্য, অসমতা দূর করতে পারেনি। কাজেই ক্যাপিটালিজম দোষমুক্ত বা সমস্যামুক্ত এটা যেমন অতীতের ক্ষেত্রে বলা যায় না, তেমনি আজকেও বলা যায় না। আজকেও আমরা জাপানের অর্থনীতির মধ্যে একটা নিম্নগতির ধারা, আর্জেন্টিনাতে বিরাট অর্থনৈতিক সঙ্কট দেখি। সেখানে অর্থনৈতিক সঙ্কট নিয়ে পাঁচ-ছয় মাসে চারজন প্রেসিডেন্ট বদল হয়েছে এবং এখনো বিরাট ক্রাইসিস চলছে।

আমরা গত বিশ বছরে পুঁজিবাদী বিশ্বের অনেক সঙ্কট দেখেছি। সাউথ ইস্ট এশিয়ায় বিরাট অর্থনৈতিক ক্রাইসিস দেখলাম বিগত শতাব্দীর একেবারে শেষের দিকে এবং সেটি এখনো চলছে। ল্যাটিন আমেরিকাতেও আমরা বিভিন্ন সময় ক্রাইসিস দেখেছি। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতেও আমরা বিভিন্ন সময় ডাউনটার্ন লক্ষ করেছি। এ সম্পর্কে অনেক কথা বলা যায়।

ক্যাপিটালিজম আমরা কম-বেশি সবাই বুঝি। বিভিন্ন অর্থনৈতিক মতবাদ প্রধানত পাশ্চাত্যেই তৈরি হয়েছে। পাশ্চাত্যের পণ্ডিতরাই এর ওপর বেশি কাজ করেছেন। এ কথাগুলো শুধু ক্যাপিটালিজমের ক্ষেত্রেই সত্য নয়, সোস্যালিজমের ক্ষেত্রেও সত্য। ওয়েলফেয়ার ইকোনমিকস নামে যা বিশ্বে চলছে সেটিও পাশ্চাত্যেরই অবদান। পাশ্চাত্যের চিন্তাবিদরাই এসব ধারণা নিয়ে এসেছেন।

ক্যাপিটালিজমের ভিত্তি ছিল বা এর পেছনে শুরুতে কাজ করত খ্রিষ্টান এথিকস বা খ্রিষ্টান নৈতিকতা। কারণ পাশ্চাত্যের যেখানে এর বিকাশ ঘটে সেই সমাজ মূলত খ্রিষ্টান সমাজ ছিল। মৌলিকভাবে জনগণ খ্রিষ্টীয় এথিকসে বিশ্বাস করত। ফলে ক্যাপিটালিজমের অর্থনৈতিক নীতিমালায় যা-ই ত্রুটি থাকুক না কেন, খ্রিষ্টান এথিকস তাকে মডারেট করত, তার খারাপ প্রভাবকে সংযত করত, তাকে নিয়ন্ত্রণ করত।

পরবর্তীকালে কোনো কোনো লেখকের দ্বারা অষ্টাদশ শতাব্দীতে মুক্তবুদ্ধির যে আন্দোলন শুরু হয় তার মূল দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধর্মকে জীবনের মৌলিক কর্মকাণ্ড থেকে বাদ দেয়ারও চেষ্টা করা হলো। এই আন্দোলনের কারণে বাস্তবে সেক্যুলারিজম প্রাধান্য পায় এবং সমাজ সেক্যুলারিস্ট হয়। সেখানে নৈতিকতা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে এবং যুক্তিকে (রিজন) প্রাধান্য দেয়া হয়। এতে মনে করা হলো, যুক্তিই সবকিছুর সমাধান করতে পারে। যদিও আমরা জানি, যুক্তিবাদে অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। এর দ্বারা সব সমাধান করা যায় না। যুক্তিবাদ সত্ত্বেও মানুষের ভেতর মতবিরোধ দেখা দেয় এবং আজকে যেটা যুক্তিসঙ্গত মনে হয় কালকে সেটি যুক্তিসঙ্গত থাকে না। এসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও একটা সময় গেছে যখন যুক্তিকে  প্রায় পূজা করা হতো। আল্লাহর স্থানে, গডের স্থানে যুক্তিকে  নিয়ে আসা হলো। ভ্রান্ত ছিল সেটি, বিভ্রান্তি ছিল, ভুল ছিল।

এনলাইটমেন্ট মুভমেন্টের কারণে (ক্যাপিটালিজমের ভিত্তি হওয়ার কারণে বা এর ফলস্বরূপ) চলে এলো ম্যাটেরিয়ালিজম ভোগবাদ, ব্যক্তিবাদ, স্বার্থপরতার মতো বস্তুবাদের বিষয়গুলো। এর ফলে আসে হাই কনজাম্পশন। অন্য দিকে এটা একটা সামাজিক ডারউইনিজম সৃষ্টি করল। আমরা ডারউইনিজম সম্পর্কে জানি। ডারউইনিজম হচ্ছে জীবজগতের সেই ধারণা যা ডারউইন থেকে এসেছে বা ডারউইন উদ্ভাবন করেছে। অর্থাৎ জীবজগৎ সম্পর্কিত ডারউইনের ধারণাই ডারইউনিজম। এখানেও সোস্যাল ডারউইনিজম বিশ্বব্যাপী গুরুত্ব পেয়েছে। এনলাইটমেন্ট মুভমেন্ট এবং ম্যাটেরিয়ালিজমের বিকাশের কারণে।

ক্যাপিটালিজমের মাধ্যমে এই ধারণা সৃষ্টি হয় যে, অর্থনীতিতেও ন্যাচারাল সিলেকশন হবে এবং এখানে শুধু ফিটেস্টরাই সারভাইভ করবে। যোগ্যরাই বাঁচবে। অর্থনীতিতে যদি তা-ই হয় তা হলে তার মানে হবে প্রকৃতপক্ষে দুর্বলের কোনো স্থান থাকবে না, দরিদ্রের স্থান থাকবে না। যদি থাকেও তা হবে খুব সঙ্কীর্ণ।

সোজা কথায়, বিশ্ব অর্থনীতি বড়লোকের, যোগ্যের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। অর্থাৎ ম্যাটেরিয়ালিজম এনলাইটমেন্ট মুভমেন্টের কারণে সোস্যাল ডারউইনিজমের কারণে পুঁজিবাদ একটি ডকট্রিনে পরিণত হয়। অর্থনীতিতে শুধু যোগ্যরাই টিকে থাকবে তা দর্শনে পরিণত হয়। এতে দরিদ্রের প্রতি খ্রিষ্টান ইথিকসের কারণে যে মায়া-মহব্বত ছিল, তাদের প্রতি যে দায়িত্ববোধ ছিল, সেটি উঠে গেল। এমনকি দর্শনের মাধ্যমে সেটি উঠে গেল। তখন তারা দরিদ্র মারা গেলে কী হবে সে যুক্তি খাড়া করতে পারল না। যোগ্যদের টিকে থাকার ফলে দরিদ্ররা মরে যাবে। এই ধরনের ফলাফল অষ্টাদশ শতাব্দীর মুক্তবুদ্ধির আন্দোলনের কারণে দেখা দিয়েছিল।

ক্যাপিটালিজমের থিওরির পেছনে কতগুলো অগ্রহণযোগ্য ধারণা ছিল যেগুলো কিছুটা আমাদের জানা দরকার। যেগুলো প্রকৃতপক্ষে একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। যেমন তারা বলেন, অর্থনীতির আইনগুলো হচ্ছে ফিজিক্যাল ল-এর মতো। যেমন যেভাবে পৃথিবী ঘুরছে বা সূর্য যেভাবে চলছে নিজস্ব নিয়মে অথবা বায়ুপ্রবাহ-নদী বা সমুদ্রের গতি প্রভৃতি ফিজিক্যাল ল’জ যেমন সঠিক তেমনি ইকোনমিক ল’জ সঠিক। এখানে অর্থনীতির আইন ফিজিক্যাল আইনের মতোই এরকম একটা ধারণা নিয়ে আসা হলো। তারা এগুলো বিশ্বাস করে। কিন্তু এটা একেবারে সত্য নয়। আমরা জানি, বাজার ক্রমাগত পরিবর্তন হতে থাকে। যেই পরিবর্তন আমাদের সোলার সিস্টেমে হয় না বা আমাদের ফিজিক্যাল ল’তে হয় না। অথচ যেকোনো বাজার ব্যাপক পরিবর্তনের সম্মুখীন। সুতরাং এ রকমই একটা ভুল ধারণার ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে ক্যাপিটালিজম।

মানুষের কাজের মোটিভেশন বা কাজ করার প্রেরণাটা কী? সে সম্পর্কে তারা বলে, মানুষের কাজের মোটিভেশন হলো শুধু তার স্বার্থপরতা। মানুষ মূলত স্বার্থপর এবং তার স্বার্থপরতা, স্বার্থ উদ্ধার করাই হচ্ছে তার প্রকৃত মোটিভেশন। এটাকে তারা টেকনিক্যালি বলে, মানুষ হচ্ছে যুক্তিবাদী (র‌্যাশনাল)। এ যুক্তির পরিচয় হচ্ছে সে স্বার্থের জন্য কাজ করে। তবে এ কথা ঠিক, মানুষের মধ্যে স্বার্থপরতা রয়েছে এবং স্বার্থ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

মানুষ কি কেবল স্বার্থের জন্যই কাজ করে? কথাটা মোটেই সত্য নয়। তা হলে দুনিয়ায় এত ত্যাগ মানুষ করতে পারত না। পরিবারের জন্য, সমাজের জন্য মানুষ এত ত্যাগ করত না। এত চ্যারিটি দুনিয়াতে থাকত না।

তৃতীয়ত তারা একটি মূল্যবোধহীন অর্থনীতির জন্ম দিলো। তারা একটি ডকট্রিন খাড়া করল পজিটিভিজম নামে। পজিটিভিজমের কথা হলো, অর্থনীতিতে কোনো মূল্যবোধ নেই। অর্থনীতিতে মূল্যবোধ এলেই অর্থনীতি প্রভাবিত হয়ে যাবে। অর্থনীতি তার ন্যাচারাল কোর্স থেকে সরে পড়বে। অর্থনীতি একটি বিজ্ঞান হিসেবে থাকবে না। কিন্তু অর্থনীতির কার্যক্রমে কোনো মূল্যবোধ থাকবে না, এরকম দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত মারাত্মক। আর তা-ই যদি হয় তা হলে কোন যুক্তিতে আমরা দরিদ্রের জন্য কাজ করব? দারিদ্র্য কেন দূর করব? কেন আমরা বঞ্চিত জনগণের জন্য কাজ করব? এ সবই তো মূল্যবোধের সাথে সম্পর্কিত।
সুতরাং পজিটিভিজমের ধারণা ক্যাপিটালিজমে প্রবেশ করল, যে অর্থনীতিতে কোনো মূল্যবোধ নেই।

ক্যাপিটালিজমের অপর নাম মূল্যবোধহীন অর্থনীতি। এটা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না অথচ এটাই চলছে ক্যাপিটালিজমের নামে। আবার বলা যায়, পুরোপুরি চলছে না। কারণ এগুলো সব আন-ন্যাচারাল (অস্বাভাবিক) ধারণা। এ জন্য হয়তোবা এগুলো থিওরিতে আছে তবে বাস্তবে তা পুরোপুরি কার্যকর করা সম্ভব হয় না।

ক্যাপিটালিজম মার্কেট সিস্টেমের ওপর গুরুত্ব দেয়। মার্কেট সিস্টেমের গুরুত্ব সত্ত্বেও তার অনেক সমস্যা আছে। কিন্তু সেটা তারা স্বীকার করে না। ক্যাপিটালিজমের মার্কেট সিস্টেমের অনেক ভালো দিক আছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অ্যালোকেশন অব রিসোর্সের ক্ষেত্রে মার্কেট ভালো কাজ করে। কিন্তু আমাদের এটা মনে রাখতে হবে যে, ক্যাপিটালিজমে মার্কেট সিস্টেমটাকে যেরকম পুরোপুরি পারফেক্ট মনে করা হয় তা কিন্তু সত্য নয়। বাস্তবে মার্কেট সিস্টেমের মাধ্যমে পুরোপুরি রিসোর্স বা সম্পদের সঠিক বণ্টন হয় না। ন্যায়বিচারমূলক বণ্টন হয় না। তার প্রমাণ বাস্তবে একটা দেশের জনগণের একটা অংশের হাতে প্রয়োজনীয় ক্রয় ক্ষমতা না থাকায় তারা কিনতে পারে না। যেমন, আমাদের দেশে বিপুল সংখ্যক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। তাদের কাছে ডলার বা পাউন্ড নেই। তারা কিনতে পারে না। তারা অর্থের অভাবে প্রয়োজনীয় জীবন সামগ্রী কিনতে পারে না বলে তাদের প্রয়োজনটা মার্কেটেই যায় না, যেতেও পারে না। তাদের দুধ বা ওষুধ দরকার হলেও সেই প্রয়োজন মার্কেটে আসছে না। তাদের বাড়ি দরকার, বাড়ি ভাড়া করা দরকার-সেই প্রয়োজন মার্কেটে যায় না। কারণ তারা সেটা কিনতে পারছে না।

অন্যদিকে মার্কেট সিস্টেমে যাদের টাকা আছে তারা চারটা-পাঁচটা গাড়ি কিনতে পারে। বিরাট বিরাট বাড়ি বানাতে পারে। অন্য দিকে যাদের টাকা নেই তারা দুধ পর্যন্ত কিনতে পারে না। ওষুধ কিনতে পারে না। এই পরিস্থিতিতে দুটো ফল জনগণের হয়। পূর্ণ ও সঠিক ডিমান্ডটা মার্কেটে আসতে পারে না বর্তমান মার্কেট সিস্টেমের কারণে এবং দ্বিতীয়ত অগ্রাধিকার নষ্ট হয়ে যায়। দরকার দুধের অথচ মার্কেট বলছে বিলাস সামগ্রী বানাও। কেননা এর মাধ্যমে বাজারে সেসব দ্রব্যের চাহিদা এসেছে। গাড়ির চাহিদাটাই মার্কেটে আসছে। দুধের চাহিদা আর আসতে পারছে না।

সুতরাং মার্কেট সিস্টেম সঠিক পদ্ধতি নয় যার মাধ্যমে সম্পদের সমবণ্টন হতে পারে। কেননা, সম্পদ চলে যাবে সেই দিকে, যেদিক থেকে মার্কেটে ডিমান্ড আসছে। সম্পদ সেই দিকেই যাবে, যেই ডিমান্ডটি মার্কেটে আসে। ফলে যে ডিমান্ড আসছে না (দুধের ডিমান্ড পুরোপুরি আসছে না) সেদিকে তো সম্পদ রয়েছে। সুতরাং যারা মনে করেন মার্কেট সব সমস্যার সমাধান করবে তারা সম্পূর্ণ ভুল করে, মার্কেটের দাস হয়ে যায়। কিন্তু সেটা হওয়া ঠিক হবে না। বাজার গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু বাজার একমাত্র বিবেচ্য বিষয় নয়।

এই কনটেক্সটে এখন ইসলামের অর্থনীতির যে মূল ভিত্তি বা তার যে কর্মকৌশল সে সম্পর্কে আলোচনা করতে চাই। বর্তমানে রুলিং আইডিওলজি ক্যাপিটালিজমের দুর্বলতা বোঝার কারণে ইসলামী অর্থনীতির কর্মকৌশল ভালো করে বোঝা সম্ভব। ইসলামী অর্থনীতিবিদগণ তিনটি বিষয় বা ধারনাকে মূল ভিত্তি বলেছেন। একটি হলো তৌহিদ। এই তৌহিদ হচ্ছে এই পৃথিবী আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। এটা তাৎপর্যহীন সৃষ্টি নয়। সব মানুষ আল্লাহর সৃষ্টি। সব মানুষের গুরুত্ব রয়েছে এবং সব মানুষকে গুরুত্ব দিতে হবে।

ইসলামী অর্থনীতির দ্বিতীয় ভিত্তি হচ্ছে খিলাফত। খিলাফত হলো মানুষ আল্লাহর খলিফা। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষ। সূরা বাকারা, সূরাতুল ফাতিরে এবং অন্যান্য সূরাতে এ কথা বলা হয়েছে। খিলাফত মানুষকে অত্যন্ত সম্মানিত করেছে। মানুষ কোনো চান্স প্রোডাক্ট নয়। হঠাৎ করে একটা এক্সিডেন্টের মাধ্যমে মানুষের সৃষ্টি সে রকম নয়। মানুষ জন্মগত অপরাধী ও নয়। যেমনটি পাশ্চাত্যে মনে করা হয়। খিলাফতের ধারণা মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করেছে। খিলাফতের তাৎপর্য হলো বিশ্বভ্রাতৃত্ব। অর্থাৎ সব মানুষ ভাই বা ভাই-বোন এবং এ হিসেবে তারা মর্যাদার অধিকারী, সমতার অধিকারী, সমভাবে তাদের দিকে খেয়াল করতে হবে। খেয়াল করার প্রয়োজন রয়েছে। এর আরেকটা তাৎপর্য হলো, মানুষ মূল মালিক নয়। মূল মালিক আল্লাহ পাক এবং সম্পদ একটা আমানত মাত্র। সে সম্পদ মানুষ যেনতেনভাবে ব্যবহার করতে পারে না। সম্পদ ব্যবহার করতে হবে আল্লাহ তায়ালা যেভাবে চেয়েছেন ঠিক সেভাবে। এগুলো হলো খিলাফতের ধারণার গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য।

তৃতীয় ভিত্তি জাস্টিস, ইনসাফ বা ন্যায়বিচার। আদল হলো কুরআনের পরিভাষা। কুরআনের প্রায় একশ’ আয়াত আছে, যেখানে জাস্টিসের কথা বলা হয়েছে। আরো এ কশ’ আয়াত আছে যেখানে জুলুমের নিন্দা করা হয়েছে। তার মানে হলো, অর্থনীতিতে জুলুম থাকলে চলবে না এবং ন্যায়বিচার আনতে হবে।

আরো পরিষ্কারভাবে বলা যায়, ইনসাফের দাবি হলো সব মানুষের প্রয়োজন পূর্ণ করতে হবে। সবার জন্য সম্মানজনক আয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। অর্থনীতি এমনভাবে সাজাতে হবে, এমনভাবে কর্মকৌশল নির্ধারণ করতে হবে যাতে সবার আয়ের ব্যবস্থা হয়। যদি কারোর আয়ের ব্যবস্থা না হয় কিংবা যদি কেউ সম্মানজনক আয়ের ব্যবস্থা না করতে পারে অর্থাৎ যদি তার কোনোরকম শারীরিক বা মানসিক দুর্বলতা থাকে বা অর্থনৈতিক কোনো বিপর্যস্ত অবস্থা থাকে সে অবস্থায় অনেকে হয়তো ইনকাম করতে পারল না; তা হলে তাদের ব্যবস্থা প্রথমে করতে হবে তার পরিবারের বা আত্মীয়-স্বজনদের। আর তারা যদি না পারে তা হলে রাষ্ট্রকে করতে হবে। এই হলো ন্যায়বিচার বা ইনসাফের দাবি।

এরপর ইসলামী অর্থনীতির কর্মকৌশল সম্পর্কে বলতে হয়। চারটি প্রধান কর্মকৌশলের কথা আমাদের অর্থনীতিবিদরা বলেছেন। এর মধ্যে একটা হলো নৈতিক ছাঁকনি। অর্থাৎ রিসোর্সের একটা পয়েন্ট অব টাইম বা কোনো নির্দিষ্ট সময়ের একটা সীমা আছে এবং এর ডিমান্ড প্রায় সীমাহীন। ফলে এ দুটির মধ্যে মিলাতে গেলে ডিমান্ডের ওপর এমন এক ছাঁকনি দরকার যাতে ডিমান্ডগুলো একটু কমে আসে, সংযত থাকে।

একটি ছাঁকনি হলো প্রাইস, যেটা আধুনিক ক্যাপিটালিজমে আছে প্রাইসের মাধ্যমে ডিমান্ড সংযত করা হয়। আমার টাকা কম সুতরাং আমি কিনতে পারব না- এটা হচ্ছে এক ধরনের ছাঁকনি বা ফিল্টার, যার মাধ্যমে এটা হয়। ইসলাম এই প্রাইস ফিল্টার মেনে নিয়েছে। আবার মেনে নেয়ার সাথে সাথে আরেকটা জিনিস সে নিয়ে আসে। সেটাকে বলা হয় নৈতিক ফিল্টার। অর্থাৎ মানুষের মধ্যে ইসলাম এমন একটা নৈতিকতা সৃষ্টি করেছে, এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েছে যে, মানুষ যেন অপব্যয় না করে। অতিভোগ যেন না করে। অতিরিক্ত ভোগের দিকে যেন তার নজর না যায়। নৈতিক ছাঁকনির গুরুত্ব অনেক। কেননা, মূল্য ছাঁকনি দ্বারা কেবল দরিদ্র মানুষের দাবি কমানো যায়। সুতরাং এই একটা স্ট্র্যাটেজি ইসলামী অর্থনীতিবিদরা সাজেস্ট করেছেন। মূল্য ছাঁকনি ছাড়াও কর্মকৌশলের অংশ হিসেবে একটা নৈতিক ছাঁকনি নিয়ে আসা। যাতে করে ডিমান্ড সংযত হয়। প্রাইসের মাধ্যমেও আমরা ডিমান্ডকে সংযত করব, অন্য দিক নৈতিক ছাঁকনির মাধ্যমে আমরা অতিরিক্ত ভোগ নিয়ন্ত্রণ করব। যত বেশি ভোগ করব, তত বেশি আল্লাহর কাছে দায়ী হবো। আমাদের জবাব দিতে হবে। এর জন্য চ্যারিটি করতে হবে। এসব মাধ্যম ডিমান্ড এর দাবি কমিয়ে এনেছে। যাতে কি না আমাদের কোনো একটা নির্দিষ্ট সময়ের রিসোর্সের প্রাপ্যতার সাথে ডিমান্ডের সংঘাতটা কমে আসে।

ইসলামী অর্থনীতিবিদগণ দ্বিতীয় যে কর্মকৌশলের কথা বলেছেন সেটা হলো প্রপার মোটিভেশন। আমাদের প্রপার মোটিভেশন থাকতে হবে, সৃষ্টি করতে হবে। ক্যাপিটালিজম এই মোটিভেশনকে একমাত্র স্বার্থ বলেছে। কিন্তু ইসলাম বলেছে, না, স্বার্থ ঠিকই আছে কিন্তু এই স্বার্থপরতাকে বিস্তার করে দিতে হবে। অর্থাৎ ক্যাপিটালিজম যেখানে দুনিয়াভিত্তিক স্বার্থের কথা বলে সেখানে ইসলামী অর্থনীতি দুনিয়া ও আখিরাতের স্বার্থের কথা বলে। এ দুটো মিলে যাতে লাভ সেটাই স্বার্থ। এডুকেশনের মাধ্যমে, মিডিয়ার মাধ্যমে, প্রচারের মাধ্যমে, ওয়াজের মাধ্যমে, দাওয়াতের মাধ্যমে- সর্ব উপায়ে এটা করতে হবে। জনগণের মাঝে উপযুক্ত মোটিভেশন সৃষ্টি করতে হবে। অর্থনৈতিক কাজকর্মে কেবল দুনিয়ার স্বার্থ দেখলে চলবে না। দুনিয়ার স্বার্থ এবং আখিরাতের স্বার্থ দেখতে হবে। সুতরাং ইসলাম-মোটিভেশনের স্বার্থপরতাকে বিস্তৃত করে দিয়েছে। বেসিক কর্মকৌশলের মধ্যে এটা রয়েছে।

উপরের বিষয়গুলো বাস্তবায়নে সময় লাগবে। এ জন্য ইসলামী অর্থনীতিবিদরা তৃতীয় কর্মকৌশলও নির্ধারণ করেছেন (Social economic financial re-structuring) নামে। এবং এই বিষয়টিকেই তারা খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে অভিহিত করেছেন। এর মাধ্যমে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং ফাইন্যান্সিয়াল ব্যবস্থার পুনর্গঠন করতে হবে। এর সাহায্যে ব্যাংকিং সিস্টেমের মনিটারি পলিসির ফিসকেল সিস্টেমে পরিবর্তন করতে হবে। ব্যাংকের টাকা সৃষ্টির ক্ষমতাকে সংযত করতে হবে। পূর্ণ কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে ও মিডিয়াম শিল্পের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। কৃষি এবং গ্রামীণ অর্থনীতির ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। শুধুমাত্র আরবান বেসড হলে চলবে না। এ সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা ইসলামী অর্থনীতিবিদরা করেছে।

কর্মকৌশলের চতুর্থ দিক হলো (Social re-structuring, Economic Re-Structuring Ges Financial re-structuring) এর কাজটি করতে হবে সরকারকে। ইসলামের অবস্থা সমাজতন্ত্রের মত নয় যে, সরকার সব করবে। আবার পুঁজিবাদের মতোও নয় যে, মার্কেটই সব করবে। ইসলাম বলে, মার্কেটকে আশি ভাগ আর সরকারকে বিশ ভাগ করতে হবে (এ হার পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে পরিবর্তন হতে পারে)। এটাই হচ্ছে, সরকারের ভূমিকা। আর এই চারটিই হলো ইসলামী অর্থনীতির মূল কর্মকৌশল।

লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার।