বিবিএস এর এক হিসাব অনুযায়ী দেশে এখন মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ হচ্ছে ৬০,০০০.০০ টাকা। আমার পরিবারে এখন ছয়জন সদস্য আছেন, আমরা স্বামী স্ত্রী দুজন, ছেলে, ছেলের বউ ও দুজন নাতনি। এ হিসাবে আমাদের ছয়জনের ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩,৬০,০০০.০০ টাকা। ঋণ নিয়ে বড় লোক হবার ব্যাপারে আমার উপর আমার পিতামাতার নিষেধাজ্ঞা ছিল। আমি নিজেও সুদের কারণে ঋণকে ঘৃণা করি। আমার একটা গর্ব ছিল যে, আমার পরিবার ঋণমুক্ত। কিন্তু আমি চেষ্টা করলে কি হবে? আমি যে রাষ্ট্রের নাগরিক সে রাষ্ট্রই আমার পরিবারকে ঋণী করে ফেলেছে। এই টাকা শোধ করতে হবে আমাদের খাজনা, ট্যাক্স ও টোলের আকারে, যদিও এই ঋণ আমার সামাজিক, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জীবনকে অর্থনৈতিকভাবে কতটুকু উপকৃত করেছে সে সম্পর্কে আমি উল্লেখযোগ্য কিছুই জানি না।
বাংলাদেশের যে বৈদেশিক ঋণ তার অধিকাংশের যোগানদাতা হচ্ছে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, আইডিএসহ আন্তর্জাতিক অর্থ সংস্থা ও দ্বিপাক্ষিক ও বহুমাত্রিক প্রতিষ্ঠান এবং দেশসমূহ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরই এদের উত্থান ঘটেছে। এর আগে উন্নত-অনুন্নত দেশগুলোর মধ্যে ঋণ লেনদেনের খুব একটা নজির ছিল না বললেই চলে। বর্তমানে আমরা যাদের উন্নত দেশ বলি তারাও বিদেশ থেকে ঋণ নিয়ে উন্নত হয়েছে এমন নজির নেই। Development is self development.
নিজস্ব চাহিদা অনুযায়ী নিজস্ব শক্তিতে যে উন্নয়ন তা যেমন ফলপ্রসূ হয় তেমনি টেকসইও হয়। সুদভিত্তিক ঋণ নিয়ে অনুৎপাদনশীল প্রকল্প বাস্তবায়ন করে দেশের উন্নয়ন করা যায় না। এই ঋণ শোধ করতে হয় রাজস্ব আয় থেকে যা ঋণ গ্রহিতা বহু দেশই করতে পারে না। ফলে পুরাতন ঋণ শোধ করার জন্য নতুন ঋণ নিতে হয়। এমনকি পুরাতন ঋণের সুদ পরিশোধের জন্যও নতুন ঋণ নেয়ার নজির রয়েছে। বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা তাদের পৃষ্ঠপোষকতাধন্য বিভিন্ন পণ্য বিক্রি বা সরবরাহের জন্য বিভিন্ন দেশের উপর সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট গছিয়ে দেয়ারও দৃষ্টিান্ত রয়েছে। এগুলো আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা।
এই অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি যে, কিছু কিছু ডোনার এজেন্সি (আসলে ক্রেডিট এজেন্সি) আছে যারা গত চার দশক ধরেই সরকারি এজেন্সিসমূহের কার্যকারিতা ও ব্যবস্থাপনার দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে আসছে। এই প্রশ্নটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রকল্প বাস্তবায়নকে ঘিরে করা হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই যে, অনেক সময় তারা এমন সব পদ্ধতির ব্যাপারে প্রশ্ন তোলেন, যে পদ্ধতিগুলো তাদেরই সুপারিশ ও অনুপ্রেরণায় উদ্ভাবন ও প্রচলন করা হয়েছিল। বলাবাহুল্য ৯০-এর দশক পর্যন্ত বাংলাদেশে শহর ও গ্রামাঞ্চলের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য যত প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে, তার সিংহভাগ অর্থের উৎস ছিল বৈদেশিক সাহায্য এবং এখনো বিদ্যুৎ খাতসহ অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ খাত এই সাহায্যের উপর নির্ভরশীল। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বৈদেশিক সাহায্য পেতে হলে প্রকল্প তৈরি করতে হয় এবং প্রকল্পে অর্থ সংস্থানের অন্যতম প্রধান শর্ত হচ্ছে Consultancy Service তথা বিদেশি উপদেষ্টা নিয়োগ। এই উপদেষ্টারা আসেন দাতা দেশ বা সংস্থা থেকে। তাদের পেছনে ব্যয়িত অর্থের অডিট হয় না। তারা নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী স্থানীয় কাউন্টারপার্টও নিয়োগ দেন। প্রকল্প বাস্তবায়নের গতিকে ত্বরান্বিত করা এবং টেকনোলজি ট্রান্সফার বা প্রযুক্তি হস্তান্তর হচ্ছে তাদের প্রধান কাজ। প্রকল্পের বাস্তবায়ন পদ্ধতি প্রণয়নের ব্যাপারে সরকারকে সাহায্য করাও তাদের কাজ। প্রকল্পের অর্থ ছাড়ও তাদের সুপারিশ বা অনুমোদন সাপেক্ষ বিষয়। উন্নয়ন ঋণ চুক্তি (Development credit Agreement) স্বাক্ষরের পর এর শর্তাবলী পালন করা উভয় পক্ষেরই দায়িত্ব এবং এর বাইরে বিশেষ কোন শর্ত পালন করার জন্য চাপ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে কোনও এজেন্সি যখন তহবিল ছাড় বিলম্বিত করে তখন তাদের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন উঠে।
আমাদের দেশে দাতা এজেন্সিগুলো প্রায়শঃই সরকারি এজেন্সিগুলোর উপর দোষ চাপিয়ে তহবিল ছাড় বিলম্বিত করে, ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ এবং ব্যয় উভয়ই বেড়ে যায়। এ ব্যাপারে উভয় পক্ষের ভূমিকা মূল্যায়ন হওয়া প্রয়োজন।
প্রকল্প বাস্তবায়ন মন্থরতার জন্য এ যাবত যত সমীক্ষা ও মূল্যায়ন হয়েছে সেগুলোতে প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে যে সমস্ত প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত হয়েছে তার মধ্যে প্রকল্পের অর্থ ছাড়ে বিলম্বই হচ্ছে প্রধান এবং এই বিলম্বের জন্য উন্নয়ন সহযোগী নামে পরিচিত দাতা সংস্থাগুলোই বহুলাংশে দায়ী। বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্প বাস্তবায়নে আরো অনেকগুলো সমস্যা আছে। এর মধ্যে রয়েছে প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণের সমস্যা, সাজসরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ে বিলম্ব, ডিজাইনের ত্রুটি এবং সংশোধনের দীর্ঘ প্রক্রিয়া, বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয়ের অক্ষমতা এবং প্রকল্প কর্মকাণ্ডের Sustainability-র অভাব প্রভৃতি।
এই সমস্যাগুলো দীর্ঘ দিনের এবং একটি আরেকটির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এগুলো দূরীকরণের জন্য বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ, ইউএনডিপিসহ সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও এজেন্সি বহু সভাসমিতিতে মিলিত হয়েছে এবং দেখা গেছে যে যখন একটি কার্যকর সমাধান চিহ্নিত হয়েছে তখনি তা বাস্তবায়নের ব্যাপারে দাতাসংস্থাগুলোর আগ্রহ হ্রাস পেয়েছে। তারা নতুন ইস্যু সৃষ্টি করেছেন।
বাংলাদেশের সেচ ও কৃষি খাতের প্রকল্পগুলোর দিকে নজর দিলেই একথা সুস্পষ্টভাবে বুঝা যাবে যে গ্লোবাল স্টেটেজিকে সামনে রেখে এক সময় তারা সমবায়কে কৃষি ও পল্লী উন্নয়নের বাহন হিসেবে সমর্থন দিয়েছে এবং যখনই এ সংগঠনগুলো আত্মনির্ভরতা অর্জন, আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি ও সেবা বিতরণের মজবুত এজেন্সিতে পরিণত হবার পর্যায়ে পৌঁছতে শুরু করেছে তখনি তারা বিভিন্নভাবে এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এখন তারা সমবায়ভিত্তিক কার্যক্রমকে সহায়তা করতে চান না, কারণ এনজিওদের, সাধারণ মানুষের প্রতি যাদের কোন দায়বদ্ধতা নেই। জানা গেছে যে, বিশ্ব ব্যাংকসহ কয়েকটি সংস্থা এখন কমপিটিটিভ বিডিং-এর অজুহাত তুলে গুরুত্বপূর্ণ কিছু খাতের অর্থ ছাড় বিলম্বিত করছে।
সত্তুরের দশক থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত বাংলাদেশে কৃষির আধুনিকায়ন, বিশেষ করে ক্ষুদ্র সেচ ব্যবস্থার উন্নয়নে তারা বাংলাদেশকে বিপুল অংকের প্রকল্প সাহায্য প্রদান করেছে। এই সাহায্য বা ঋণের আওতায় গভীর ও অগভীর নলকূপ, শক্তি চালিত পাম্প প্রভৃতি সরবরাহের জন্য তারা কমপিটিটিভ বিডিং এর অনুসরণ করেনি। বহুজাতিক এজেন্সিগুলোকে টেনে এনে তারা ইঞ্জিন সরবরাহের দায়িত্ব দিয়েছিল। এসব ইঞ্জিনের উল্লেখযোগ্য একটা অংশের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। তারা জবরদস্তি পল্লী উন্নয়ন এবং গভীর নলকূপ-২ প্রকল্পের উপর অচল ডয়েজ, উষা, কিষান ও চায়নীজ ইঞ্জিন চাপিয়ে দিয়েছিল যেগুলো কমিশনিং-এর ১৫ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে অচল হয়ে পড়ে। কৃষকরা/সমবায়ীরা এসব সেচ যন্ত্রের ঋণের বোঝা এখনো পর্যন্ত বয়ে বেড়াচ্ছে। ইঞ্জিনের প্রতিস্থাপন তারা এখনো পায়নি। সত্তুরের দশকের প্রথম দিকে বিশ্বব্যাংকের সাহায্যপুষ্ট পল্লী উন্নয়ন-১ প্রকল্পের আওতায় তাদেরই নির্দেশনায় চাহিদা যাচাই না করেই আমদানিকৃত অনেক কৃষি যন্ত্রপাতি বগুড়া ও ময়মনসিংহ জেলার ৭টি কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতির গুদামে চার দশক ধরে পড়েছিল, নিলামে বিক্রি করতে গিয়েও খদ্দের পাওয়া যায়নি মর্মে রিপোর্ট পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
এই অভিজ্ঞতা থেকে একটা কথা পরিষ্কার যে বিশ্ব ব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোর স্বার্থ ও চাহিদা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের জাতীয় স্বার্থ ও চাহিদার সাথে সঙ্গতিশীল নয়। তাদের অনেকেই প্রকল্প সাহায্যের নামে বহুজাতিক কোম্পানীগুলোর স্বার্থকে প্রমোট করা ছাড়াও ঋণ এবং সুদের মহাজনী করে যা আমাদের নিজস্ব উদ্যোগের বিকাশকে ব্যাহত করে। এই অবস্থায় প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য শুধু বৈদেশিক উৎসের উপর নির্ভরশীল না হয়ে অভ্যন্তরীণ উৎস, বিশেষ করে সরকারি এবং বেসরকারি উভয় খাতকে আমরা কাজে লাগাতে পারি। এতে বিদেশী ঋণ কমবে এবং জনগণের ভোগান্তিও কমবে।