হোটেল রুয়ান্ডার পল রুসেসাবেগিনা ওর চরিত্র দিয়ে নাম কুড়িয়েছিল বেশ! সে যাত্রায় টেরি জর্জের ব্যবসাও ৩৩,৮৮২,২৪৩ ডলার। কালোদের পুঁজি করে করা আরো কত কাজই তো দর্শক মাতালো, কাঁদালো; শেখালো! সফল ব্যবসাও করলো।
আদতে, এসব আকস্মিকতার আদ্যোপান্তে নেপথ্যের নায়ক যে ওসকল সাদা দৈত্যরাই; সে খবর আর ক’জন রাখে!
সারেঙ্গ সিনেমায় কালোদের অন্ধকার আকাশ ‘বৃষ্টি’ হয়ে ঝড়েছিল কত লোকের চোখ বেয়ে! ওদের দেশান্তরীর তীব্র বেদনার সুরে কাতর সুশীল লোকের
সংখ্যাও কম কই।
তবে মুদ্রার উল্টোপিঠে ‘বর্ণবাদ’ দংশন করেনি কাকে? কালোদের এই বাস্তুচ্যুতি নাকি আবহমান কালের পৌরানিকেও সত্য! দাসত্ব ওদের আদি-অন্তে!
কিন্তু ক’জন আর জানে- খোদ আফ্রিকার ওই নাইজার, তানজানিয়া, মোজাম্বিক বা মাদাগাস্কারের রক্ত চুষেই আজকের শ্বেতাঙ্গ ‘ওয়েস্ট’! কি ছিলনা ওদের সেখানে! কত ঐশ্বর্য আর ভুবন জয়ের গল্প রঙধনুর রঙের মত লেপ্টে আছে কিলওয়া সালতানাতের মত সমৃদ্ধ সালতানাত গুলোর ওই মাটিতে। অথচ, কত নোংরা এ্যাংলো সেক্সন! ওদের মানবতাবিরোধী বর্ণবাদী দর্শন!
১৫শ শতাব্দীর শুরু থেকেই আফ্রিকায় সাদাদের ঢের আনাগোনা। প্রচলিত আছে, ওদের অবৈধ উপনিবেশ স্থাপনের প্রথম ধাপ অনেকটা এমন ছিল-
বিশ্বের ওপর স্পেন ও পর্তুগালের অধিকার প্রশ্নে পোপ ষষ্ঠ আলেকজান্ডার (১৪৩১-১৫০৩) এই সিদ্ধান্ত প্রদান করেন ১৪৯৪ সালের ৭ জুন। তিনি ইউরোপের বাইরের গোটা দুনিয়াকে বণ্টন করে দেন স্পেন ও পর্তুগালের মধ্যে। ইউরোপ বহির্ভূত দুনিয়াকে তিনি দুই ভাগ করেন। পশ্চিম ভাগ দেন স্পেনকে, পূর্বভাগ পর্তুগালকে। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশ দখল করে শাসন করবে স্পেন (পরবর্তীতে ব্রিটেন এখানে অংশ নেয়)। আর পর্তুগাল দখল ও শাসন করবে আফ্ৰিকা। এরই ধারাবাহিকতায়, ১৪শ শতক থেকেই আফ্রিকায় পর্তুগিজদের গুঞ্জন অপ্রত্যাশিতভাবেই প্রাসঙ্গিক হতে শুরু করে। কিছুকাল পর ফ্রেঞ্চরাও।
ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে তাদের আগমন থাকলেও ধীরে ধীরে স্থানীয় গোত্র সমূহের প্রতি প্রথমত ধর্মান্তরিতকরণ, প্রলোভন ও পরবর্তীতে জঘন্য গণহত্যা ও পাচারের মাধ্যমে মুসলিমদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সমৃদ্ধ ওই সংস্কৃতি ও অর্থনীতিকে দূষণ করতে শুরু করে ওরা।
সেই শুরু!
কার্তিকের কোনো এক শকুনডাকা সন্ধ্যায় হয়তো ওই ধারাবাহিকতায়ই ম্যালকমের পঞ্চম পুরুষের বাড়ি গুড়িয়েছিল ঔপনিবেশিক সেনারা। ভারত-আরব সাগরেও নিশ্চয়ই প্রাণ গেছে ক্লে-দের কত স্বগোত্রের! এজন্যই বোধহয় ক্যারেবিয়ার তীর ঘেঁষে বছর জুড়েই আকাশের কান্না ঝড়ে নিত্য! কত-শতবার সে কান্নার অজস্র ফোটা ম্যালকম এ্যাক্স ও মুহাম্মদ আলী ক্লে-দের শিশু মনের জানলা জুড়ে লেপটে গেছে, তারও ইয়ত্তা নেই!
স্রোত ওদের ভাগ্য নিয়ে ঠেকিয়েছিলো যদিও দুনিয়ার সবচেয়ে কথিত সুশীলদের এক দেশে, তবে মার্কিন মুলুক তো ওদের কাছে ওদের হৃদয়ের ক্রন্দন চোখের চেয়েও বেশি ঝাপসা, অন্ধকার; দাসত্বের!
এরকম এক তাচ্ছিল্যের শৈশব পেড়িয়ে, যদি ভুল না করি, ম্যানহাটনের এক দামী হোটেলে ম্যালকম ও ক্লে-এর আকস্মিক সাক্ষাৎ! রোম অলেম্পিকে সেবার দাবিয়েছিল ক্যাসিয়াস ক্লে (মুহাম্মদ আলীর পূর্ব নাম) ওর অস্বাভাবিক মুষ্টিশক্তির বলে।
সাক্ষাৎ এর প্রেক্ষাপটেও ছিল ঢের বিচিত্র! বিশ্বজয়ী ক্লে ওর অলিম্পিক মেডেল নিয়ে সবেই পা রেখেছে মার্কিনিদের দেশে। সংবাদকর্মীরা ওর অনুভূতি জানতে চাইলে ক্লে -এর সোজাসাপটা উত্তর-
” আমি আনন্দিত! তবে মার্কিন পতাকার প্রতিনিধিত্ব করার ফলে নয়। এই দেশ আমার সাথে কখনোই মানবিক আচরণ করেনি। নিশ্চয়ই আমার মূল ভিন্ন, ভিন্ন দেশ। হয়তো আফ্রিকার কোন এক অঞ্চল থেকে ওরা আমায় জোর করে এনেছিল, মানবিক মর্যাদা দিতে নয়!”
এই বক্তব্যের পরই ক্লে শহরের ওই দামী হোটেলে ঢোকে, যার দরজায় লিখা- Dog and black are not allowed! যথারীতি সেদিনও হোটেলের কিছু সাদা দৈত্যের দ্বারা উত্তপ্ত হয়েছিল ক্লে। প্রতিক্রিয়া সরূপ ওর ভুবনজয়ী মেডেলটারও জায়গা হয়েছিল পার্শ্ববর্তী এক নদীর গহ্বরে! ঘটনাক্রমে, ম্যালকমও সেদিন পুরো ঘটনার সাক্ষী হয়েছিল হোটেলে বসে। তখন থেকেই ওদের শুরু!
পরবর্তীতে, ম্যালকমের হাত ধরে আলীর NOI এর নিকটবর্তী হওয়া, ক্যাসিয়াস ক্লে থেকে মুহাম্মদ আলী ক্লে তে রূপান্তরিত হওয়া,
এলিজা মুহাম্মদ ও ম্যালকমের সম্পর্কে ভাটা পড়ন, জন এফ কেনেডি হত্যা প্রসঙ্গে ম্যালকমের মন্তব্য বা জাতীয় রাজনীতিতে “ম্যালকম-আলী”র কালোদের মধ্যমনি হয়ে উঠা; সে অন্য আলাপ!
ম্যালকম এ্যাক্স মুহাম্মদ আলীকে নিয়ে আদতে মার্কিন মুলুকের জঘন্যতম সাম্রাজ্যবাদের ভিত নড়বড়ে করে দিয়েছে; একথা ধ্রুব সত্য। আর এটাও সত্য- আলীর আধ্যাত্মিক গুরু ম্যালকমই এর রাহবার! জুলুমপূর্ণ সাম্রাজ্যবাদের বর্ণবাদী ব্যবস্থাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি তুলে ম্যালকম হাজির করেছে ভিন্ন ও চিরন্তন এক দার্শনিক ভিত্তি, রাজনৈতিক ম্যাথডলজি, অর্থনৈতিক সমতা; আর ইনসাফপূর্ণ রাজনীতির বয়ান তো বটেই!
পৃথিবীতে তাবৎ অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আওয়াজ তুলেছেন অনেকেই। কিন্তু ম্যালকমের মতো আখলাকী-আধ্যাত্মিক শক্তি দিয়ে অপ্রতিরোধ্য বিপ্লবী জাগরণ কেউ সৃষ্টি করতে পারেনি।
সত্যিকার বিপ্লবের মর্মার্থ সম্পর্কে ম্যালকম বলেন-
“To overturn the system of exploitation that exists on this Earth, We are here…”
মোহাম্মাদ আলী তার প্রথম সাক্ষাতেই গুণমুগ্ধ হয়ে ম্যালকমকে তার জীবনে পাওয়া শ্রেষ্ঠ আধ্যাত্মিক ও জ্ঞানতাত্ত্বিক উস্তাদ বলে সম্বোধন করেন।
পণ্ডিতগণ এর পেছনের কারণ হিসেবে মন্তব্য করেছেন, “ম্যালকম এক্সের আধ্যাত্মিক ও আদালতপূর্ণ রাজনীতিই এভাবে প্রভাব সৃষ্টি করেছে।”
এভাবেই, গত শতাব্দীতে সাম্রাজ্যবাদের বুকের উপর বসে স্বয়ং সাম্রাজ্যবাদকেই ছুড়ির আঘাতকারী ম্যালকম এ্যাক্স ও মুহাম্মদ আলীর BLOOD BROTHERS রচিত হলো!
লেখক- মুশফিকুর রহমান