১৪৯২ সালে আন্দালুসিয়ার সর্বশেষ দুর্গ গ্রানাডার পতনের প্রাক্কালে সেখানের মুসলমানগণ তাঁদের সাহায্যের জন্য উসমানী সুলতান দ্বিতীয় বায়েজিদের নিকটে সহায়তা কামনা করে একটি চিঠি প্রেরণ করেন। আজকে আমি আমার আলোচনাকে সেই চিঠির হৃদয়বিদারক কিছু লাইন দিয়ে শুরু করতে চাই। আমি এটাকে কবিতা নয় বরং মার্সিয়া হিসেবে অভিহিত করতে চাই।
- سلام عليكم مِن عبيد تخلّفوا بأندلس بالغرب في أرض غُربة
পশ্চিমে, আন্দালুসিয়ার অপরিচিত ভূমিতে বসবাসকারী বান্দাদের পক্ষ থেকে আপনাকে সালাম।
- سلام عليكم مِن عبيد أصابهم مصاب عظيم يا لها من مصيبة
ভয়াবহ এক বিপদ ও মুসিবতে নিপতিত বান্দাদের পক্ষ থেকে আপনাদের প্রতি সালাম।
- سلام عليكم من شيوخ تمزّقت شيوبهم بالنتف من بعد عِزّة
সম্মানজনক একটি জীবন যাপনের পর পাকা চুলের মাধ্যমে সজ্জিত বৃদ্ধদের পক্ষ থেকে আপনাদের প্রতি সালাম,
- سلام عليكم من وجوه تكشّفت على جملة الأعلاج من بعد سترة
সেই সকল পর্দানশীল যুবতী মেয়েদের পক্ষ থেকে সালাম , জোর করে যাদের হিজাবকে খুলে ফেলা হয়েছে।
- سلام عليكم مِن بنات عواتق يسوقهم اللباط قهرا لخلوة
সেই সকল মুক্ত ও স্বাধীন মেয়েদের পক্ষ থেকে সালাম জানাই সন্যাসীরা যাদেরকে দিয়ে জোর করে তাঁদের যৌন লালসাকে পূর্ণ করতে চেয়েছে।
- سلام عليكم من عجائز أكرهت على أكل خنزير ولحم جيفة
সেই সকল বৃদ্ধ নারীদের পক্ষ থেকে আপনাদেরকে সালাম জানাই যাদেরকে শুকর ও মরা লাশের গোশত খেতে বাধ্য করা হয়েছে।
ঐতিহাসিক মাক্কারী রচিত আযহারুর রিয়াদ ফি আখবারি ইয়ায নামক গ্রন্থে এই ১০০ লাইনের এই মার্সিয়াটি উল্লেখ করা হয়েছে। আন্দালুসিয়ার মুসলমানগণ ক্রুসেডার দ্বারা কিভাবে নির্মম নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হয়েছে তা এই মার্সিয়াতে তুলে ধরা হয়েছে। নির্মমভাবে নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুদের অবস্থাকে তুলে ধরার পাশাপাশি তাঁদেরকে ধর্মান্তর করে খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করার জন্য কিভাবে চাপ দেওয়া হয়েছে সেই চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে। সবশেষে ক্রুসেডারদের নির্যাতন থেকে মুক্তির জন্য কালক্ষেপণ না করে উসমানীদেরকে এগিয়ে আসতে বলা হয়।
মার্সিয়াতে উল্লেখিত অবরোধ ও বর্বরতা সময়ের ব্যবধানে আজ আমাদের গাজা ও ফিলিস্তিনে বসবাসকারী ভাই বোনের উপর যেন পুনরাবৃত্তি ঘটছে। ঐ সময়ের উত্তর আফ্রিকার মুসলিম দেশসমূহ এবং ততকালীন সময়ের শক্তিশালী দুই সালতানাত মামলুকি ও উসমানীরা কেন তাঁদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারলো না এই বিষয় নিয়ে আজও যেমন আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে একইভাবে আজকের মুসলিম দেশসমূহ কেন গাজার নারী ও শিশুদের সাহায্যে এগিয়ে আসছে না এই বিষয় নিয়ে ইতিহাস আমাদেরকে একদিন কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে।
ইতিহাস আমাদেরকে জিজ্ঞাসা করবে দুইশত কোটি মুসলমানের চোখের সামনে এত বড় একটি গণহত্যা কিভাবে পরিচালিত হতে পারে? এত বড় বড় মুসলিম রাষ্ট্র থাকতে নিষ্পাপ শিশু ও অসহায় নারীদের জন্য সাহায্য পাঠাতেও কিভাবে ব্যর্থ হল !
আমরা আমাদের আজকের এই আলোচনায় আন্দালুসিয়ায় ঘটে যাওয়া গণহত্যা ও গাজার গণহত্যার ক্ষেত্রে আমাদের নির্লিপ্ততা ও ব্যর্থতাকে এক সাথে তুলে ধরার চেষ্টা করব।
প্রথমত, ঐ সময়ের মুসলিম উম্মাহ আন্দালুসিয়ার গ্রানাডাবাসীকে উদ্ধার করার জন্য কেন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারেনি?
দ্বিতীয়ত, আর মুসলিম উম্মাহ কেন গাজাবাসীর আহবানে সাড়া দিতে পারছে না?
এই সকল প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার পূর্বে আন্দালুসিয়া নিয়ে আমি কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই।
***
আন্দালুসিয়া ……… কিংবা আমাদের হৃদয়ে স্থানলাভকারী নাম, ‘আমাদের হারিয়ে যাওয়া জান্নাত’ …… ঐ সময়ে শুধুমাত্র ইসলাম কিংবা মুসলমানদের-ই নয় সমগ্র মানবতার গৌরব হিসেবে বিবেচিত হওয়া আমাদের প্রাচীন এক সভ্যতার নাম। এটি এমন এক গৌরবময় সভ্যতার নাম যেখানে বিভিন্ন ধর্ম ও বর্ণের মানুষ ইবেরিয়ান উপদ্বীপে, তুলেইটুলা, কর্ডভা ও ইশবিলিয়াতে একসঙ্গে মিলে মিশে বসবাস করেছে। শুধু তাই নয়, এক সাথে বসবাস করার আখলাক ও আইনের এমন এক দৃষ্টান্তকে বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থাপন করেছিল যা সমগ্র মানবতার জন্য এক গৌরবউজ্জ্বল ইতিহাস তৈরি করেছে।
এই অঞ্চল আলেমগণ ও তাঁদের শিক্ষার্থীদের দ্বারা, চিকিৎসক ও প্রকৌশলীদের দ্বারা এবং দার্শনিক ও লেখকদের দ্বারা এমনভাবে বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল যে, যেন এটি ছিল মানব আকল ও হিকমতের এক অনুপম নমুনা। এটি ছিল এমন এক সভ্যতা যা, পূর্ব ও পশ্চিমকে একত্রিতকারী, আফ্রিকা, এশিয়া এবং ইউরোপকে এক মোহনায় মিলিতকারী অনুপম এক সেতুবন্ধনের নাম।
এই সভ্যতায় দর্শন, বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও স্থাপনা মানুষের সাথে মিলে এমন এক সভ্যতার নজীর তৈরি করেছিল যা ছিল মানবতার জন্য আধ্যাত্মিক ও জাগতিক এক সম্মিলন স্থল।
দ্বীনে মুবিন ইসলাম, আদালত ও মারহামাত এবং জ্ঞান ও হিকমত একটি অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হলে মানবতাকে কি দিতে পারে তাঁর একটি নমুনায়ে ইমতিছাল (অনুপম উপমা) হল আন্দালুসিয়া। এই আন্দালুসিয়া হল, আমাদের ইসলামী সভ্যতার সারাংশ ও আমাদের গৌরব।
কিন্তু আমাদের এই গৌরব, আমাদের হারিয়ে যাওয়া জান্নাত ব্যক্তিগত স্বার্থ ও রাজনৈতিক অভিলাষের কারণে সৃষ্ট হওয়া তাফরিকা (অনৈক্য) –র ফলে ২২ টি ছোট ছোট রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এত ছোট ছোট অংশে বিভক্ত হয়েই ক্ষান্ত হয়নি, এই রাষ্ট্রসমূহ একে অপরের সাথে যুদ্ধেও জড়িয়ে পরে এবং এই সকল রাষ্ট্রের শাসকরা একে অপরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। মূলুকে তাওয়ায়িফ নামে অভিহিত হওয়া এই সময়ে উত্তরের খ্রিষ্টান রাষ্ট্রসমূহ মুসলমানদের মধ্যকার এই অনৈক্য ও বিভাজনের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এই অঞ্চল থেকে মুসলমানদেরকে বিতাড়িত করে নিজেদের আধিপত্য কায়েম করার সুযোগ পায়।
ইউরোপের ইতিহাসে Reconquista নামে পরিচিতি পাওয়া অর্থাৎ আন্দালুসিয়াকে মুসলমানদের হাত থেকে পুনরোদ্ধারের একটি নতুন সময় শুরু হয়। এই ভাবে খ্রিষ্টান রাজারা আন্দলুসিয়ার শহর সমূহকে একের পর এক দখল করে নেয় এবং সকল মুসলমানকে গ্রানাডায় অবস্থান নিতে বাধ্য করে। সবশেষে তারা গ্রানাডায় আশ্রয় গ্রহণকারী মুসলমানদেরকে অবরোধ করে, আজকে যায়নবাদীরা যেমনিভাবে ফিলিস্তিনের মুসলমানদেরকে গাজায় অবরুদ্ধ করে রেখেছে।
ক্যাস্টিলিয়া ও আরাগণ রাজ্যের একীভূত করণ এবং উসমানীগণ কর্তৃক ইস্তানবুল বিজয়ের প্রতিশোধ হিসেবে ইউরোপ থেকে মুসলমানদেরকে বিতাড়িত করার ব্যাপারে পোপের আপোষহীন ও কঠোর মনোভাব এই যুদ্ধের তীব্রতাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকা এই অবরোধের ফলে ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনার মধ্যে দিয়ে গ্রানাডার পতন ঘটে এবং আন্দালুসিয়ার সর্বশেষ দুর্গ এই ভাবে ইতিহাসে তাঁর জায়গা করে নেয়।
মূলত গ্রানাডাবাসীও গাজাবাসীর ন্যায় এক কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তুলে। দীর্ঘ সময় পর্যন্ত তারা সেখানে প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। স্পেনিশরা গ্রানাডাবাসীকে সামরিকভাবে পরাজিত করতে না পেরে কখনো কখনো আপোষের পথ বেঁছে নেয়, আবার কখনোওবা তাঁদেরকে চুক্তির মাধ্যমে প্রতারিত করার চেষ্টা করে। স্পেনিশরা তাদেরকে ওয়াদা দেয় যে, মুসলমানদের শাসনামলে অন্য ধর্মের মানুষরা যে সকল স্বাধীনতা ভোগ করেছিল তাঁদেরকেও সেই একই স্বাধীনতা দেওয়া হবে। তারা নিশ্চয়তা দেয় যে, যদি মুসলমানরা আত্মসমর্পণ করে তাহলে তারা তাঁদের ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করার পাশাপাশি স্বাধীন চিন্তা ও বিশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবে। স্পেনিশরা আরও ওয়াদা দেয় যে, তারা তাঁদের মসজিদ ও গুরুত্ত্বপূর্ণ স্থাপনাকে স্পর্শও করবে না। আর যারা চলে যেতে চায় তাঁরা তাঁদের ধনসম্পদ নিয়ে গ্রানাডা থেকে নিরাপদে চলে যেতে পারবে। কিন্তু চুক্তিতে স্বাক্ষর করে গ্রানাডায় প্রবেশ করার পর তারা তাঁদের দেওয়া ওয়াদাকে ভঙ্গ করে। এবং তারা চুক্তির সকল ধারাকে লঙ্গন করে মুসলমানদেরকে যে কোন তিনটির একটিকে বেঁছে নিতে বলা হয়। সেগুলো হল, ১। মৃত্যু বরণ করা, ২। খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করা, ৩। খালি হাতে নির্বাসনে চলে যাওয়া।
গ্রানাডাবাসী তাঁদের এই ট্রাজেডিকে উসমানী সুলতান দ্বিতীয় বায়েজিদের নিকটে পাঠনো চিঠিতে এই ভাবে তুলে ধরেঃ
- وقلّتْ لنا الأقواتُ واشتدت حالنا أطعناهم بالكره خوف الفضيحة
আমাদের সকল খাবার শেষ হয়ে গেছে, আমরা খুব কঠিন অবস্থায় রয়েছি। নির্যাতনের ভয়ে তাদের আনুগত্যকে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছি।
- وخوفا على أبنائنا وبناتنا مِن أن يؤسروا أو يقتلوا شرّ قتلة
আমাদের যুবক–যুবতীদেরকে ক্রীতদাস বানানো হবে আর না হয় নিকৃষ্টভাবে হত্যা করা হবে এই ভয়ে আমরা আত্মসমর্পণ করেছি।
- فقال لنا سلطانهم وكبيرهم لكم ما شرطتم كاملاً بالزيادة
তাদের শাসকগণ ও নেতৃস্থানীয়রা আমাদেরকে ওয়াদা দিয়েছিল যে, “ তোমাদেরকে যে ওয়াদা দেওয়া হয়েছে সেটা এবং তাঁর চেয়েও বেশী রক্ষা করা হবে”।
- وأبدى لنا كتيبا بعهد وموثق وقال لنا هذا أماني وذمتي
“এই হল তোমাদেরকে দেওয়া আমাদের ওয়াদা ও প্রতিশ্রুতি” এই কথা বলে আমাদেরকে চুক্তিনামা দেখানো হয়
- فلمّا دخلنا تحت عقد ذمامهم بدا غدرهم فينا بالنقض العزيمة
আর আমরা যখনি তাদের অধীনে এসেছি তখন–ই তারা তাদের ওয়াদাকে ভুলে গিয়েছে এবং আমাদেরকে ফিরিয়ে দিয়েছে।
- وخان عهودا كان قد غرّنا بها ونُصرنا بِعنف وسطوة
আমাদেরকে যে চুক্তির নামে প্রতারিত করেছে সেটাকে ভঙ্গ করেছে এবং শক্তি ব্যবহার করে জোর করে আমাদেরকে খ্রিষ্টান বানিয়েছে।
- غدرنا ونُصرنا وبُدّل ديننا ظلمًا وعُوملنا بكلّ قبيحة
আমরা প্রতারিত হয়েছি, পরাজিত হয়েছি, আমাদের দ্বীনকে হারিয়েছি এবং সকল প্রকার খারাপ আচরণের শিকার হয়েছি।
***
মার্সিয়া বা চিঠি থেকে জানা যায় যে, গ্রানাডাবাসী শুধুমাত্র গণহত্যা, ধ্বংসলীলা ও নিপীড়নের শিকার-ই হয়নি। একই সাথে দীর্ঘ আটশত বছর ধরে সমগ্র মানবতাকে আলোকিতকারী একটি সভ্যতাকেও ধ্বংস করা হয়েছে। লাইব্রেরী তো দূরে থাক একটি বইকেও তাঁরা রাখে নাই। হা ভুল শুনেন নাই সকল বইকেই তারা পুড়িয়ে দেয়।
গ্রানাডাবাসী উসমানী সুলতানের নিকট তাঁদের অনুযোগকে এইভাবে তুলে ধরে,
- وأحرق ما كانت لنا من مصاح ف وخلّطها بالزبل أو بالنجاسة
আমাদের হাতে যত কোরআন শরীফ ছিল সকল মুসহাফকে পুড়িয়ে ফেলে এবং সেগুলোর মধ্যে নাজাসাতের মিশ্রন ঘটায়,
- وكلّ كتاب كان في أمر ديننا ففي النار ألقوه بِهُزء وحقرة
দ্বীন সম্পর্কে আমাদের যত বই পুস্তক ছিল সেগুলো নিয়ে উপহাস করে সকল বইকে পুড়িয়ে ফেলে,
- ولم يتركوا فيها كتابا لمسلم ولا مصحفاً يخلى به للقراءة
কোন মুসলমানদের নিকটে একটি বইকে পর্যন্ত রাখার সুযোগ দেয়নি, একজন মুসলমান একাকী থাকা অবস্থায় পড়ার মত একটি মুসহাফও তাঁরা রাখেনি।
- ومن صام أو صلى ويُعلم حاله ففي النار يلقوه على كل حالة
যদি জানতে পারতো যে কেউ নামাজ পড়েছে কিংবা রোজা রেখে ছেতাদের সবাইকে পুড়িয়ে ফেলেছে।
- ومن لم يجيء مِنّا لموضع كفرهم يعاقبه اللباط شر العقوبة
যারাই তাঁদের কুফরীর উপসনালয়ে আসতে অস্বীকার করেছে তাদেরকেই তাঁরা পোপের ফতওয়ার মাধ্যমে শাস্তি প্রদান করেছে।
এরকম একটি যুলুম ও ধ্বংসলীলার মধ্যে বসবাসকারী আন্দালুসিয়ার মুসলমানগণ উম্মতের মুসলিম ভাইদের নিকট থেকে সাহায্যের প্রত্যাশী ছিল। হা, আজকে যেমন গাজার মুসলমান ভাইয়েরা অবরুদ্ধ অবস্থায় প্রতি মুহূর্তে সিনা উপত্যকা ও ভুমধ্য সাগরের দিকে তাকিয়ে অসহায় পলকে তাঁদের মুসলমান ভাইদের নিকট থেকে সাহয্যের অপেক্ষা করছে, যারা তাঁদেরকে যায়নবাদীদের জুলুম থেকে উদ্ধার করবে। অনুরূপভাবে সেই সময়ের গ্রানাডাবাসীও ভুমধ্য সাগর ও জিব্রালটার প্রণালীর দিকে ছাতক পাখির মত তাকিয়ে ছিল।
আন্দালুসিয়ার মুসলমানগণ সেই সময়ে তিন অঞ্চলে তিনটি প্রতিনিধি দল ও তিনটি বার্তার মাধ্যমে সাহায্যের আবেদন জানিয়েছিল।
প্রথম প্রতিনিধি দল, হাফসি ও মারিনিগণের অধ্যুষিত অঞ্চল মরক্কো, তিউনিসিয়া, এবং উত্তর আফ্রিকার অন্যান্য দেশে।
দ্বিতীয় প্রতিনিধি দল, মিশর, শাম ও হারামাইন অঞ্চলকে নিয়ন্ত্রণকারী মামলুকিদের নিকটে।
তৃতীয় প্রতিনিধি দল গিয়েছিল, আনাতোলিয়া ও পূর্ব রোমেলিয়াকে নিয়ন্ত্রণকারী উসমানী সালতানাতের নিকটে।
এখন আমরা আমাদের আসল সমস্যার প্রথমটিতে আসলাম। এই তিনটি বড় বড় সালতানাত গ্রানাডার মুসলমানদেরকে কেন সাহায্য করতে পারেনি? ঐ সময়ে আরও একটি বড় শক্তি ছিল। সেটা ছিল সাফাভী রাষ্ট্র, বর্তমান সময়ে ইরান যে রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করছে। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, এদের কেহ-ই গ্রানাডাবাসীর আহবানে সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসতে পারেনি! এর কারণ কি ছিল?
প্রথমত, ঐ সময়ে উত্তর আফ্রিকার দেশ সমূহে মুসলমান গোত্র সমূহের মধ্যে অনেক বেশী প্রতিযোগীতা ও শত্রুতা বিরাজ করছিল এবং নিজেদেরকে মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ ও যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছিল। একে অপরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। শুধু তাই নয় একে অপরের বিরুদ্ধে স্পেন ও পর্তুগীজের খ্রিষ্টান শাসকদের সাথে লিয়াজু রক্ষা করে চলত এবং তাঁদের প্রতিপক্ষদেরকে নির্মূল করার জন্য জোট করত।
গ্রানাডাবাসীগণ তাদের নিকট সাহায্য চাইলে তাদের প্রত্যাশা পূরণ করার মত কাউকে খুঁজে পায়নি এবং তাঁরা তাদের আচরণে হতাশ হয়ে পড়ে। আজকের গাজাবাসীরা যেমন তাঁদের প্রতিবেশীদের আচরণে হতাশ। এখানে থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, যাদের কাছে সাহায্য চাওয়া হচ্ছিল তারা তাঁদের আখলাকী ও রাজনৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছিল।
দ্বিতীয় প্রতিনিধি দল গিয়েছিল মামলুকিদের নিকটে। আন্দালুসবাসীর সাহায্যের আবেদন মামলুকিদের নিকটে পৌঁছে। মামলুকিরা গ্রানাডার পতনের মাত্র কয়েক বছর পূর্বে ১৪৮৮ সালে উসমানীদের শাসনাধিন আদানা শহরকে অবরোধ করে রেখেছিল। অর্থাৎ তারা বিশ্বাস করত যে আগে উসমানীদেরকে পরাজিত করা প্রয়োজন। এই জন্য তারা গ্রানাডায় যাওয়ার পরিবর্তে আরও দূরে অবস্থিত মুসলিম শাসনাধিন একটি শহরকে অবরোধ করার জন্য সেনাবাহিনী প্রেরণ করে! মামলুকিরা গ্রানাডাবাসীকে সরাসরি সহায়তা করতে ব্যর্থ হয়। কিছু কুটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে পোপকে হুমকি দিয়েই নিজেদের দায়িত্ত্ব শেষ করে। পোপকে উদ্দেশ্য করে বার্তা পাঠায় যে, গ্রানাডায় মুসলমানদের উপর এই জুলুম ও নির্যাতন অব্যাহত থাকলে আমরা মামলুকী রাষ্ট্র হিসেবে মিশর ও লেভান্টে অবস্থানরত সকল খ্রিষ্টানকে হত্যা করব। কিন্তু তাঁদের এই হুমকি হালে পানি পায়নি। কেননা ঐ সময়ে পোপের আশেপাশে যারা ছিল তারা পোপকে বুঝাতে সক্ষম হয় যে, মুসলমানগণ এটা করতে পারবে না। কেননা তাদের যুদ্ধের আখলাকে বেসামরিক মানুষ ও নিরপরাধ নারী, শিশু ও বৃদ্ধদেরকে হত্যা করার কোন বিধান নেই। এই জন্য তারা এই কাজ কখনো করতে পারবে না। এই ভাবে তারা পোপের শঙ্কাকে দূরীভূত করতে সক্ষম হয়। শুধু তাই নয় এর জবাব হিসেবে তারা মামলুকি সুলতানের নিকট মিথ্যা বার্তা পাঠিয়ে বলে যে, গ্রানাডার মুসলমানরা স্বেচ্ছায় খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেছে। এতেও তারা ক্ষান্ত হয়নি, মুসলমানগণ কেন মামলুকিদের নিকটে সাহায্য চেয়ে প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছে এই অপরাধে তাঁদের উপর জুলুম ও নির্যাতনকে আরও বাড়িয়ে দেয়।
তৃতীয় প্রতিনিধি দল যায় উসমানী রাষ্ট্রের নিকটে। আন্দলুসিয়ার মুসলমানগণ উসমানী রাষ্ট্রের কাছে বিভিন্ন ধরণের সহায়তা চেয়ে আবেদন পাঠায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হল, আমি আমার আলোচনাটি যে মার্সিয়ার মাধ্যমে শুরু করেছি সেই মার্সিয়াটি। উক্ত মার্সিয়াটি সুলতান দ্বিতীয় বায়েজিদকে সালাম প্রদানকারী কিছু পংতিমালার দ্বারা শুরু হয়েছে। গ্রানাডাবাসীগণ উসমানীদের ইস্তানবুল বিজয়সহ বিভিন্ন বিজয়গাথা ইতিহাসকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে উসমানী রাষ্ট্রের সুলতান, আলেম উলামা, বিচারক ও প্রশাসকদেরকে গ্রানাডাবাসীর পক্ষে শক্তিশালী অবস্থান নেওয়ার আহ্বান জানান।
আমি তাদের আহ্বানকে হুবুহু আপনাদের সামনে তুলে ধরতে চাই,
- سلام كريم دائم متجدّد أخصّ به مولاي خير خليفة
খলিফাদের মধ্যকার শ্রেষ্ঠ খলিফার প্রতি সালাম,
- سلام على مولاي ذي المجد والعلا ومَن ألبس الكفّار ثوبَ المذلّة
কাফেরদেরকে লাঞ্ছিত ও পরাজিতকারি দৃঢ়তার অধিকারীর প্রতি সালাম,
- سلام على مولاي مَن دار ملكه قسنطينة أكرم بها من مدينة
সালতানাতের রাজধানী ইস্তানবুলের অধিপতির প্রতি সালাম,
- سلام على القاضي ومَن كان مِثلَه من العلماء الأكرمين الأجِلّة
শায়খুল ইসলাম ও তাঁর মত বড় বড় আলেমদের প্রতি সালাম,
- سلام على أهل الدّيانة والتُّقى ومَن كان ذا رأي من أهل المشورة
দ্বীনদার ও আকলে সালীমের অধিকারী শুরার সদস্যদের প্রতি সালাম,
সালাম জানানোর পর উসমানী রাষ্ট্রের প্রতি অনুরোধ জানানো হয় যে তাঁরা যেন খ্রিষ্টানদেরকে চুক্তি মেনে জুলুম বন্ধ করতে বাধ্য করে কিংবা সেখানে বসবাসকারীরা যেন তাদের ধন সম্পদসহ হিজরত করতে পারে এই ব্যবস্থা করে দেয়।
- ودين النصارى أصله تحت حكمكم ومِن ثمّ يأتيهم إلى كلّ كورة
মূলত খৃস্টধর্ম আপনাদের হুকুমের আওতাধীন, তারা সেখান থেকে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে,
- عسى تنظروا فينا وفيما أصابنا لعلّ إله العرش يأتي برحمة
আশা করি যে, আপনারা আমাদের এবং আমাদের উপর যে মুসিবত এসেছে সেটাকে দেখতে পাবেন। আর এই ভাবে হয়ত আরশের রব আমাদের উপর রহম করবেন।
- عسى ديننا يبقى لنا وصلاتنا كما عاهدونا قبل نقض العزيمة
আশা করি যে, চুক্তি ভঙ্গ করার পূর্বে আমাদেরকে যে ওয়াদা দিয়েছিল সেই ওয়াদা মোতাবেক আমরা আমাদের দ্বীনকে পালন করার পাশাপাশি নামাজ আদায় করতে পারব।
- وإلا فيجلونا جميعاً من أرضهم بأموالنا للغرب دار الأحبة
অথবা আমাদেরকে আমাদের ধনসম্পদ সহ আমাদের পছন্দনীয় অঞ্চল উত্তর আফ্রিকাতে যাওয়ার অনুমতি দেয়।
এই মার্সিয়া পড়ার পর আমরা আমাদের যে প্রশ্নে উপনীত হয়েছি তা হলঃ উসমানী সুলতান এই সাহায্যের আবেদনের জবাবে কি করেছিল?
প্রথমত আমি এই কথা বলতে চাই, বিষয়টি এমন নয় যে, উসমানী সুলতান তাঁদের এই সাহায্যের আবেদনে কোন সাড়া দেয়নি। উসমানী রাষ্ট্র কামাল রেইসের নেতৃত্ব ছোট একটি নৌবাহিনী প্রেরণ করে, যদিও তাঁরা মুসলমানদের রক্ষায় কার্যকরী কোন ভূমিকা পালন করতে পারেনি। এছাড়াও গ্রানাডার মুসলমানদেরকে উত্তর আফ্রিকাতে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে উসমানী রাষ্ট্র বারবারসকে সাহায্য করে। গ্রানাডার মুসলিম জাগরণে উসমানী রাষ্ট্র তাঁদের সাহায্যার্থে আলজেরিয়ার উপর দিয়ে যোদ্ধা ও অস্র পাঠায়। অনুরূপ ভাবে ঐ সময়ে আলেজেরিয়ার উপর দিয়ে পাঠানো একটি নৌবহর মারিয়্যা তীরবর্তী অঞ্চলে ভয়াবহ এক ঘূর্ণিঝড়ের শিকার হয়ে ডুবে যায়। এছাড়াও উসমানী রাষ্ট্র ফ্রান্সের সাথে চুক্তি করে স্পেনে অভিযানের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর ফ্রান্স পরবর্তীতে চুক্তি ভঙ্গ করে স্পেনের পক্ষ নেয়। এই কথা বলা যায় যে, উসমানী রাষ্ট্র তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী গ্রানাডার মুসলমাদেরকে সাহায্য করার জন্য চেষ্টা করে। কিন্তু তাঁদের এই প্রচেস্টা গ্রানাডাবাসীকে রক্ষা করার জন্য যথেষ্ট ছিল না।
একই সাথে এই বিষয়টিও ভুলে গেলে চলবে না যে, স্পেন রাজ্য ঐ সময়কার বিশ্বব্যবস্থার মধ্যে পাশ্চাত্যের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র ছিল। ১৫৫২ সাল পর্যন্ত লিবিয়া এবং ১৫৭৪ সাল পর্যন্ত তিউনিশিয়া এই সাম্রাজ্যের দখলে ছিল।
অবস্থা যাই হোক না কেন ফলাফলের দিকে তাকালে দেখা যায় যে, উসমানী রাষ্ট্র আন্দালুসিয়ার মুসলিম ভাইদেরকে রক্ষার ক্ষেত্রে যথেষ্ট যাহায্য প্রেরণ করতে পারেনি। এই বিষয়টি চারটি ফ্যাক্টরের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করা সম্ভবঃ
প্রথমত, উসমানী স্থলবাহিনীর পক্ষে ইউরোপ কিংবা উত্তর আফ্রিকা হয়ে আন্দালুসিয়ায় পৌঁছা খুব কঠিন ছিল। কেননা তখন উসমানী এমন কোন শক্তি ছিল না যার উপর ভর করে ইউরোপের অনেকগুলো দেশ পাড়ি দিয়ে আন্দালুসিয়ায় যেতে পারবে। অপর দিকে উত্তর আফ্রিকা দিয়ে যেতে হলে মামলুকিদের শাসনাধীন মিশর ও সিরিয়া পাড়ি দিয়ে যেতে হত, সেটাও তখন সম্ভব ছিল না।
দ্বিতীয়ত, ঐ সময়ে উসমানী রাষ্ট্র নৌশক্তিতে খুব বেশী শক্তিশালী ছিল না। মূলত কানুনী সুলতান সুলাইমানের সময়ে বারবারস খায়রুদ্দিন পাশার নেতৃত্বে উসমানী রাষ্ট্র নৌশক্তিতে শক্তিশালী অবস্থায় উপনীত হয়। বলা হয়ে থাকে যে এর পেছনেও ছিল আন্দালুসিয়ার চেতনা। অন্য কোন অঞ্চলে যদি এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তাহলে যেন উসমানী রাষ্ট্র তাঁদের পাশে দাঁড়াতে পারে এই জন্যই নৌ-শক্তির প্রতি বিশেষ গুরুত্ত্বারোপ করা হয়। আরও বলা হয়ে থাকে যে, উসমানী রাষ্ট্র কর্তৃক উত্তর আফ্রিকার দেশসমূহের কর্তৃত্ব নেওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ ছিল আন্দালুসিয়াকে পুনরুদ্ধার করা।
তৃতীয়ত, সাফাভীদের কারণে সৃষ্ট গৃহযুদ্ধ। ঐ সময়ে উসমানী রাষ্ট্রকে দুর্বল করে দখল করে নেওয়ার জন্য সাফাভীরা আনাতোলিয়ান অঞ্চলে বিভিন্ন ধরণের বিদ্রোহ ও বিশৃঙ্খলা তৈরি করত। যার কারণে উসমানী রাষ্ট্রকে অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা বজায় রাখতে ব্যাপক বেগ পেতে হয়।
চতুর্থত, হয়তবা এটা সবচেয়ে গুরুত্ত্বপূর্ণ কারণ। সেটা হল, ফাতিহ সুলতান মেহমেদের পুত্র এবং সুলতান দ্বিতীয় বায়েজিদের ভাই, জেম সুলতান ঐ সময়ে পোপের হাতে বন্দী ছিল। আর পোপ জেম সুলতানকে উসমানী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একটি কার্ড হিসেবে ব্যবহার করতো।
এখানে দেখা যাচ্ছে যে, যে সকল কারণে ঐ সময়ে মুসলিম উম্মাহ গ্রানাডাবাসীর পাশে দাঁড়াতে পারেনি আজও একই কারণে তিন মাস ধরে সমগ্র দুনিয়ার সামনে ইসরাইল গাজায় যে ভয়াবহ গণহত্যা চালাচ্ছে, মুসলিম উম্মাহ সেটাকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখছে। শুধু তাই নয় আজকের মুসলমানগণ তৎকালীন সময়ের চেয়ে শক্তিশালী অবস্থানে থাকলেও এই শক্তিকে তাঁরা নিজেদের জনগণের উপর যুলুমের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।
বন্দী সুলতানের ব্যাপারে আসলে, এই কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে ঐ সময়ে একজন জেম সুলতান পোপের হাতে বন্দী ছিল কিন্তু আজকে শত শত সুলতান নিজেদের স্বার্থের কারণে দুশমনের শৃঙ্খলে বন্দী। ঐ সময়ে জেম সুলতান হয়ত সরাসরি বন্দী ছিল কিন্তু আজকের সুলতানরা বিভিন্নভাবে বন্দী। যার কারণে এদের কেহই গাজার নির্যাতিত, মাজলুম ভাইদের পাশে দাঁড়াতে পারছে না।
গাজা আজ সমগ্র মানবতার জন্য এবং একই সাথে সমগ্র উম্মতের জন্য একটি নতুন ইতিহাসের জন্ম দিয়েছে। আমরা হয়তবা এর পরের ঘটনাবলীকে গাজা ট্রাজেডির আগে ও গাজা ট্রাজেডির পরে এই ভাবে বিবেচনা করব। এই কারণে ঐতিহাসিক এই মুহূর্তে আমাদের সকলের উপর অর্পিত দায়িত্বকে আমাদের পালন করতে হবে। সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধানদেরকে দোষারোপ করা এবং যালেমদেরকে অভিশাপ দেওয়া হয়ত আমাদের কাছে বেশী প্রিয় হতে পারে , কিন্তু আমাদের নিজেদের দায়িত্ত্ব ও কর্তব্যকেও ভুলে গেলে চলবে না। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, আমাদের উপর অর্পিত দায়িত্ত্বের ব্যাপারে আল্লাহ অন্যদেরকে নয় আমাদেরকেই প্রশ্ন করবেন। এই কারণে আমাদের নিজেদেরকে পক্ষে যতটুকু সম্ভব সেই দায়িত্ত্বকে সঠিকভাবে পালন করার পাশাপাশি আমরা অবশ্যই আমাদের প্রতিবাদ ও নিন্দাকে অব্যাহত রাখব।
আজকে গাজায় যা ঘটছে সেটা মুসলিম উম্মাহর জন্য এবং একই সাথে সমগ্র মানবতার জন্য একটি ক্রসরোড। মুসলিম উম্মাহ ১৫ শ শতাব্দীতে গ্রানাডা অবরোধের ক্ষেত্রে যে ক্রসরোডের মূখোমূখী হয়েছিল সেই সময়ে প্রত্যাশিত সাহায্যের হাত বাড়িয়ে আন্দালুসিয়ার পতনকে ঠেকাতে পারেনি। আজকেও আমরা একই অবস্থার সম্মুখীন। আজকেও আমরা অপর একটি সভ্যতাকে হারানোর কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছি। সেটা হল নবীদের পূণ্যভূমি কুদস সভ্যতা। এই সভ্যতাকে রক্ষায় মুসলিম উম্মাহর সম্মান ও মর্যাদার প্রতীক গাজার বীর সন্তানরা তাঁদের সর্বস্ব দিয়ে লড়ে যাচ্ছে। আজকে যদি আমরা মুসলিম উম্মাহর এই প্রাণকেন্দ্রকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হই তাহলে সমগ্র ইতিহাসকাল জুড়ে আমাদের মান সম্মানও ধুলায় মিশে থাকবে।
সম্মানিত পাঠক পাঠিকা ভাই ও বোনেরা,
ফিলিস্তিনে আজকে যারা লড়ে যাচ্ছে তাঁরা কেবলমাত্র একটি ভূমিকে কিংবা এই দেশকে রক্ষা করার জন্য লড়ছে না। একই সাথে তাঁরা Absolute Evil তথা দুনিয়ার সবচেয়ে ঘৃণিত একটি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছে। আমাদের এই বীর সন্তানরা এই ঘৃণিত শক্তির আসল চেহারাকে উম্মোচিত করে দিয়েছে। এই ঘৃণিত শক্তি দুনিয়াতে আসলে কি চায় সেটার মুখোশকে উম্মোচন করে দিয়েছে। আজকে যায়নবাদীরা শুধুমাত্র গণহত্যায় চালাচ্ছে না, ফিতরাতের সাথে সম্পর্কিত সকল সুন্দর মূল্যবোধকেও ধ্বংস করে দিচ্ছে। তারা আজ মানব সভ্যতার বিরুদ্ধে ও মানুষের ফিতরাতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করেছে। এই যুদ্ধে হয়ত প্রথমবারের মত বিশ্ববাসী তাঁদের আসল চেহারাকে এত কাছ থেকে অবলোকন করছে। যারা ইবাদতগাহ থেকে শুরু করে হাসপাতাল, স্কুল, মাদারাসা ও আশ্রয়স্থল সহ এমন কোন স্থানে নেই যেখানে বোমা হামলা চালাচ্ছে না।
অপরদিক থেকে ৭ অক্টোবর থেকে নিয়ে এখন পর্যন্ত মুসলিম উম্মাহ ও মানবতা অনেক কিছুই শিখেছে। ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার প্রতি তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তন হওয়ার পাশাপাশি আখেরাতের প্রতি বিশ্বাস, জিহাদ, শাহাদাত ও আল্লাহর প্রতি ভরসাকে নতুন করে শিখেছে। বন্ধু ও শত্রুকে সুস্পষ্টভাবে চিনতে পেরেছে এবং ঐক্যের অর্থকে জানতে পেরেছে। সমগ্র গাজা মাটির সাথে মিশে গেলেও কোমলমতি শিশুদের মুখ থেকে উচ্চারিত হয়েছে হাসবুন্নাল্লাহ ওয়া নি’মাল ওয়াকিল অর্থাৎ আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট আর তিনি কতই না উত্তম অভিভাবক। এই ছোট ছোট শিশুরা আমাদেরকে শিখিয়ে দিল এই কথার অর্থ কি। তাঁরা আমাদেরকে দেখিয়ে দিয়েছে যে, অর্ধেক খেজুর খেয়েও কিভাবে সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকা যায়। সংক্ষেপে বলতে গেলে ঈমান ও ইচ্ছার শক্তি কি করতে পারে এবং ঈমানী শক্তির দেওয়া ধৈর্য , দৃঢ়তা, ইস্তিকামাত সকল শক্তির উপর যে বিজয়ী হতে পারে আমাদেরকে এই শিক্ষা দিয়েছে। তাঁরা আমাদেরকে শিখিয়ে দিয়েছে যে, সকল সংগঠন, মিডিয়া, চিন্তাধারা, জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিল্প ও খেলাধুলা সকল কিছুই আজ একটি গোষ্ঠীর তাবেদার। ন্যাটো ও জাতিসংঘের মত প্রতিষ্ঠানসমূহসহ তথা কথিত মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার মত মূলনীতি সমূহের ক্ষেত্রে যে তাঁরা আন্তরিক নয়, এটা দেখিয়ে দিয়েছে। গ্লোবাল দুনিয়া আমাদের উপর যে সকল চিন্তা, জ্ঞান ও ঘটনাকে সঠিক বলে এত দিন চাপিয়ে দিচ্ছিল সেগুলো যে কৃত্রিমতা ছাড়া আর অন্য কিছু নয় সেটাকে তুলে ধরেছে। গাজা এক অর্থে লিটমাস পেপারের ভূমিকা পালন করেছে, কারা ইনসাফ ও বিবেকের অধিকারী, কারা তাদের ইচ্ছা শক্তিকে হারিয়ে ফেলেছে, কাঁদের হৃদয়ে মোহর মারা হয়েছে এবং কারা অন্ধ হয়ে পড়েছে তাদেরকে বিশ্ববিবেকের সামনে তুলে ধরেছে। পাশ্চাত্যেও যে কত বিবেকবান মানুষ রয়েছে তাঁদেরকে আমাদের সামনে তুলে ধরার ক্ষেত্রে গাজা ওসিলা হয়েছে। ১০৯৬ সালের ক্রসেডের রূহকে খৃস্টান দুনিয়া কিভাবে লালন করে রেখেছে এবং যায়নবাদীদেরকে পাশে নিয়ে মানবতার বিরুদ্ধে কি কি পরিকল্পনা করেছে সেটাকে সুস্পষ্ট করার ক্ষেত্রে গাজা গুরুত্ত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে ।
আমি বিশ্বাস করি যে, আজকের দুনিয়া গাজা নামক এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছে অনেক বেশী ঋণী থাকবে এবং গাজার নিষ্পাপ শিশু, নারী ও আবাল বৃদ্ধা বনিতাদের নিকট থেকে অনেক কিছু শিখবে।
***
আজকে আমরা গবেষণা করছি যে, তৎকালীন সময়ের মুসলমানরা কেন গ্রানাডার পাশে কেন দাঁড়াতে পারে নাই , আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে দোয়া করছি যে আমাদের নাতিদেরকে যেন এই ধরণের গবেষণা করতে না হয়। তাঁদেরকে যেন এই প্রশ্ন না করতে হয় যে, আমাদের দাদারা কেন গাজাবাসীর পাশে দাঁড়াতে পারে নাই। আজকে যদি আমরা আমাদের দায়িত্বকে পালন করতে ব্যর্থ হই তাহলে ইতিহাসের সামনে, ইজ্জতের অধিকারী গাজাবাসীর সামনে আমাদের কোন বাহানাই চলবে না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল আমাদের রবের সামনে আমরা কি জবাব দেব?
লেখকঃ প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ
অনুবাদকঃ বুরহান উদ্দিন