ভারতবর্ষ শাসনের ২০০ বছরে ইংরেজদের দ্বারা লুট করা সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৪০ ট্রিলিয়ন ডলার।
সম্প্রতি এক গবেষণায় উঠে এসেছে ১৭৬৫ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত ২০০ বছরেরও কম সময়ে বৃটিশরা উপমহাদেশ থেকে প্রায় পয়তাল্লিশ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের সম্পদ লুট করেছে। পয়তাল্লিশ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারে হয় ৪,৯৫০ ট্রিলিয়ন টাকা।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাজেট, অর্থাৎ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট ছিলো ৭.৫ ট্রিলিয়ন টাকা।
যেই হিসেবে ব্রিটিশদের পাচারকৃত টাকা দিয়ে বাংলাদেশের ৬৬০ বছরের বাজেট হয়ে যেতো। এই লুট করা ডলারের অংক ব্রিটেনের বর্তমান জিডিপি থেকে প্রায় ১৬ গুণ বেশি।
বৃটিশরা সর্বদাই নিজেদের ভারতবর্ষ উন্নয়নের রূপকার হিসেবে তুলে ধরে। তারা বুঝাতে চায় সাম্রাজ্য গড়ে বরং ভারতের উপকারই করেছে। ইংরেজরা ভারতবর্গে রেল চালু করেছে, বড়ো বড়ো ব্রিজ গড়েছে, স্থাপনা তৈরি করেছে, প্রস্তুত করেছে নানাবিধ আইনকানুন।
তাদের এই উন্নয়নের ফিরিস্তি শুনে আমরা অনেকে আবার হাততালিও দিই। ভারতবর্ষকে দেওয়া ছাড়া তাদের নাকি অর্থনৈতিক কোনো অর্জন নেই। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, তাহলে কি ইংরেজরা ভারতে এসেছিল নিজেদের সম্পদ বিলিয়ে দিতে? টানা ২০০ বছর ধরে এই মহান কাজটি করে গেল তারা?
কিন্তু এই ইংরেজ বদান্যতার গল্প বর্ণনা করে থাকেন থাকেন, তাদের নাকেমুখে পানি ঢেলে দিয়েছে সম্প্রতি প্রকাশিত হওয়া একটি গবেষণা। এই গবেষণাপত্র বেরিয়েছে খোদ কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে- যেখানে দেখানো হয়েছে, প্রায় ২০০ বছরের ভারতবর্ষ শাসনে ব্রিটিশরা এই অঞ্চল থেকে ৪৫ ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যমানের সম্পদ নিয়ে গেছে। এটাকে শুধু সাধারণ চুরি নয়, বড় ধরনের এক লুটপাট বলতে পারেন।
গবেষক উৎসা পাটনায়েক ১৭৬৫ সাল থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত ভারতবর্ষের ট্যাক্স আর বাণিজ্য ডাটা থেকে বিশাল লুটপাটের এই অঙ্ক বের করেছেন।
ইংরেজরা এই অর্থ-সম্পদ লুট করেছে অদ্ভুত এক ট্রেড পলিসি ব্যবহার করে। পূর্ণ কলোনি গড়ার আগে তারা ভারতীয়দের কাছ থেকে টেক্সটাইলস সামগ্রী কিনত রৌপ্যমুদ্রার বিনিময়ে। সে সময় সব দেশের সাথে রুপার মাধ্যমেই বাণিজ্য করত তারা।
কিন্তু ১৭৫৭ সালের পলাশী যুদ্ধের পর ভারতবর্ষ চলে যায় ইংরেজদের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে। বক্সারের যুদ্ধে মির কাসিমের পরাজয়ের পর আরও পোক্ত হয় ব্রিটিশ আধিপত্য। ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ বাণিজ্য তখন তাদের করতলে। সরাসরি রাজস্ব আদায় শুরু করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। আদায় করা অর্থের এক-তৃতীয়াংশ তারা ব্যয় করে নিজেদের ব্যবহার্য ভারতীয় পণ্য কেনার কাজে।
এর অর্থ হলো- ভারতীয় পণ্য কিনতে নিজের পকেট থেকে টাকা দেওয়া লাগছে না। মানে ব্রিটিশরা ভারতীয় পণ্য পেত কোনো রকম মূল্য না চুকিয়েই। আর এই টাকাটা মূলত যেত ভারতের কৃষক আর তাঁতিদের পকেট থেকে।
কিন্তু অসচেতন ভারতীয়রা এই চুরি ধরতেই পারেনি। ধরবেই-বা কী করে; ইংরেজরা ট্যাক্স আদায় করতে যাদের পাঠাত, তাদের আবার ভারতীয় পণ্য কেনায় পাঠাত না। দুটি দল একই হলে হয়তো কিছুটা আঁচ পাওয়া যেত। কিন্তু ধুরন্ধর ইংরেজরা ছিল খুব সতর্ক। এই যে ভারতীয় পণ্য এরা বিনামূল্যে পেয়ে যেত; তার খানিকটা নিজেরা ভোগ করত, বাকি যা থাকত তা আবার রপ্তানি করত তৃতীয় কোনো দেশে। মানে পুঁজি ছাড়া ব্যাবসা আরকি। এইভাবে যে মুনাফা আসত, সেই অর্থ দিয়ে তারা ক্রয় করত শিল্পায়নের গুরুত্বপূর্ণ পণ্য। যেমন : লোহা, পিচ, কাঠ ইত্যাদি। মানে ইন্ডিয়া থেকে চুরি হওয়া অর্থ-সম্পদেই শিল্পায়ন হয়েছে ব্রিটেনে; অথচ তারাই এখন সভ্যতার ধ্বজাধারী।
সিপাহি বিদ্রোহের পরের বছর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে ভারতবর্ষের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় ব্রিটিশ সরকার। তখন থেকেই ভারতবর্ষে শুরু হয় ব্রিটিশ রাজপরিবারের সরাসরি শাসন। এবার ট্যাক্স আদায়ের নতুন নিয়ম এবং ক্রয় সিস্টেম চালু করা হয়। রানির সরাসরি শাসন শুরু হওয়ায় ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এতদিনের একচ্ছত্র ব্যবসা ভেস্তে যায়। অন্যান্য দেশে সরাসরি পণ্য রপ্তানির সুযোগ পায় ভারতীয় ব্যবসায়ীরা।
অবশ্য এখানেও ‘কিন্তু’ আছে। তখনও ব্যাবসার যাবতীয় লেনাদেনা চুকাতে হতো ব্রিটেনের তদারকিতে।
কীভাবে ঘটতো সেটা? কেউ যদি ভারত থেকে পণ্য কিনতে চাইত, তাদের অবশ্যই ‘স্পেশাল কাউন্সিল’ ব্যবহার করতে হতো। এটি মূলত একধরনের কাগজি মুদ্রা, যা ইস্যু করত ব্রিটিশ সরকার। এই বিল তথা কাগুজে মুদ্রা পেতে হলে লন্ডন থেকে সোনা বা রুপার বিনিময়ে ভারতীয় পণ্য কিনতে হতো। বাইরের ব্যবসায়ীরা লন্ডনে সোনাতে দাম পরিশোধ করত, বিনিময়ে পেত এই বিল। সেই বিল দিয়ে তারা দাম শোধ করতো ইন্ডিয়ান রপ্তানিকারক বা উৎপাদকদের। যখন ইন্ডিয়ার ব্যবসায়ী এই বিল স্থানীয় কলোনি অফিস থেকে ক্যাশ করত, তাদের ট্যাক্স কেটে রেখে দেওয়া হতো রুপি, যা কিনা তাদের কাছ থেকেই সংগ্রহ করা হয়েছে। তাই বাস্তবে ভারতীয়দের মূলত মূল্য শোধ করা হলো না; বরং স্রেফ প্রতারণা করা হলো তাদের সাথে।
এর ফলাফল কী দাঁড়াল? পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সাথে ভারতীয়দের যখন ব্যবসায় উদ্বৃত্ত চলছিল, তখন জাতীয় হিসাবপত্রে দেখা গেল বিস্তর ঘাটতি। এটা কেন হলো? কারণ, টাকা তো সব ব্রিটিশদের পকেটে চলে গেছে। এরা বোঝাত, ভারত তাদের জন্য মূলত একটা বোঝা। কিন্তু প্রকৃত চিত্র ছিল একেবারে উলটো। এভাবে ইন্ডিয়ানদের হাতে যা মুনাফা আসার কথা ছিল, তা চলে গেল ইংরেজদের হাতে। মানে ভারতবর্ষ ছিল একটা সোনার ডিম পাড়া হাঁস, আর বাঘডাস হয়ে সেই ডিম ক্রমাগত গিলে খেয়েছে ব্রিটেন। এই কপটতার আরেকটা নেতিবাচক ফল হয়েছিল। যেহেতু পকেটে টাকার ঘাটতি, ফলে ভারতীয়রা আমদানি বাণিজ্যের জন্য ঋণ চাইল ব্রিটিশদের কাছে। এভাবে ভারতীয় জনসংখ্যার বড়ো একটা অংশ সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ল। ব্রিটেন এই চুরি করা অর্থ কাজে লাগাতে শুরু করল নিজেদের সাম্রাজ্য বিস্তারে। শুধু তা-ই নয়; ভারত থেকে লুটপাট করা টাকায় প্রতিদ্বন্দ্বী সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও অন্য বিদ্রোহী ভূখণ্ডের শাসকদের সাথে যুদ্ধ করত তারা।
কাজেই ইংরেজরা ভারতবর্ষ উন্নত করার যে গল্প দিয়ে থাকে, তা তাদের একতরফা দাবি। সেখানে সত্যতার উপস্থিতি নেই; বরং ভারতের ধনসম্পদেই তাজা হয়েছে আজকের ব্রিটেন।
লেখক: মাহদী হাসান