২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট পরিকল্পনা পেশ হলো। নতুন অর্থবছরের এ বাজেট বাংলাদেশের ৫০ তম বাজেট। করোনাকালীন পরিস্থিতিতে গত অর্থবছরের বাজেট পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ যে চ্যালেঞ্জ ও সংকটে পতিত হয়েছিল, সেটিই এখনো সামলে উঠতে পারেনি; এ পরিস্থিতিতে প্রস্তাবিত নতুন বাজেটকে আমাদের বড় একটি অংশ কার্যত ‘জনগণের বাজেট’ হিসেবেই আখ্যা দিচ্ছেন না, কেউ কেউ ‘দুরবস্থা থেকে উত্তরণের সুনির্দিষ্ট কাঠামো ও পরিকল্পনাহীন একটি গতানুগতিক মৌখিক বাজেট’ হিসেবে আখ্যা দিচ্ছেন।
দেশের বর্তমান পরিস্থিতি যদি পর্যালোচনা করি, BBS এর প্রতিবেদন অনুযায়ী করোনাকালীন সময়ে নতুন করে বেকার হয়েছে ৪ কোটি ৮০ লাখ মানুষ। ফলশ্রুতিতে মোট বেকারের সংখ্যা আট কোটি ছাড়িয়েছে, বেসরকারী সংস্থাগুলোর জরিপে এ তথ্যই উঠে আসে। অন্যদিকে CDP এর হিসাব অনুযায়ী দেশের ৪২% জনসংখ্যা দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। প্রথম আলোসহ অন্যান্য পত্র-পত্রিকা, সংস্থাগুলোর রিপোর্ট পর্যালোচনায় উঠে আসে, ৬ কোটি ৯৯ লক্ষ মানুষ বর্তমানে খাদ্য সংকটে ভুগছে ও সুচিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অন্যান্য সংকটের কথা না হয় বাদ-ই দিলাম!
সামগ্রিক অবস্থার প্রেক্ষিতে দেশের অভ্যন্তরীণ উন্নয়নমূলক একটি বাজেট প্রস্তাবনার প্রয়োজন ছিল, যে বাজেটে প্রাধান্য পেত –
• রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোগত সংকট
• বেকারত্ব
• দারিদ্র্য
এসবসহ অন্যান্য সংকট নিরসনের বিষয়কে সামনে রেখে যদি আমাদের নীতি-নির্ধারকগণ গোছালো প্রস্তাবনা প্রনয়ণ করতেন, তবে করোনাকালীন পরিস্থিতি আমাদের বাজেটে বেকারত্ব দূরীকরণ, দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে বরাদ্দ থাকত। অথচ এসব খাতে বরাদ্দের পরিমাণ মোট বাজেটের তুলনায় নগণ্য, বিশেষ করে নতুন করে বেকার ও দরিদ্র হওয়া মানুষদের যেন উপেক্ষাই করা হয়েছে। করোনাকালীন পরিস্থিতিতে ভেঙ্গে পড়া চিকিৎসা খাতের বাজেটও অপর্যাপ্ত।
এর মূল কারণ কী?
এ বছরের বাজেট ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা, অন্যদিকে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ঘাটতির পরিমাণ ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের অর্ধেক!
এ ঘাটতি যে কত বেশি, তা একজন সাধারণ বিবেকসম্পন্ন মানুষের খুব সহজেই অনুমেয়। এ ঘাটতি পূরণ কীভাবে হবে ? আমাদের আয় কোথায় ? রেমিটেন্স খাত ছাড়া আমাদের অভ্যন্তরীণ কোনো শক্তিশালী আয় নেই, থাকলেও তা নগণ্য। আমাদের ভোক্তাবাজার, বৈদেশিক রপ্তানি আয় কমে গেছে, যাচ্ছে। অভ্যন্তরীন উৎসগুলোর আয়ও আমাদের আশার আলো দেখাচ্ছে না।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যে বিষয়, তা হলো অর্থনৈতিক বাজেটে ১১.৪% রাষ্ট্রীয় সুদ প্রদান করা হচ্ছে, অর্থাৎ আমাদের মোট বাজেটের প্রায় ৬৯ হাজার কোটি টাকা শুধু সুদ দেওয়া হচ্ছে। আর এ সুদ যাচ্ছে দেশের বড় বড় হোল্ডিং, জায়নবাদী ব্যাংক এবং লবিদের কাছে। দেশের প্রেক্ষাপটে এটি রীতিমতো আশঙ্কাজনক।
খাত অনুযায়ী বরাদ্দকৃত বাজেট যদি পর্যালোচনা করি, তবে দেখব–
• কৃষির মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে বাজেট দেওয়া হয়েছে মাত্র ৩.৬%।
এদিকে কৃষিনির্ভর অর্থনীতির বাংলাদেশে বর্তমানে ধান ছাড়া মোটামুটি সব ধরণের খাদ্যদ্রব্য বাহির থেকে আমদানি করতে হচ্ছে। আবার যেগুলো দেশে উৎপাদিত হচ্ছে, কৃষকেরা তার ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না। ফলশ্রুতিতে অর্থনৈতিক ভয়াবহ সংকটে দিনাতিপাত করছে তারা। অথচ এ কৃষিই আমাদের সাড়ে সাতশো বছরের ইতিহাসে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল।
• স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে মোট বাজেটের মাত্র ৫.৪%।
করোনাকালীন পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি সংকটে আছে এ খাত। ভেঙ্গে পড়া স্বাস্থ্য খাতের বাজেট অনেক বেশি বাড়ানো দরকার ছিল, কারণ ভেতর থেকে শক্তিশালী করে এমন বিষয়সমূহকে গুরুত্ব না দিয়ে একটি রাষ্ট্র কখনো দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না।
আবার যতটুকু বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে, জনগণ কি তা পুরোপুরি পাচ্ছে? পত্রিকার রিপোর্টসমূহ সাক্ষ্য দিচ্ছে চিকিৎসা খাতে দুর্নীতির মাত্রা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
• সংস্কৃতি ও ধর্ম খাতে মাত্র ০.৮% বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এটি কত বড় দৈন্যতা! এ দেশের যুব সমাজের নৈতিক চিন্তাগত অবস্থানের ভবিষ্যৎ তাহলে কী?
• যোগাযোগ ও অবকাঠামো খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে মোট বাজেটের ১১.৭%।
যে যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে; লক্ষ লক্ষ ঘন্টা অপচয় হচ্ছে; হাজারো মানুষ পঙ্গু, অসহায় হচ্ছে, সে যোগাযোগ খাতে এ বাজেট নগণ্য। আবার দুর্নীতির কারণে এ বাজেটের অর্থও জনগণ পুরোপুরি পায় না, ১% ও পায় কিনা সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
• গবেষণা খাতের জন্য আলাদা কোনো বরাদ্দ নেই। অথচ কঠিন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে প্রয়োজন আলাদাভাবে গবেষণা করে সে অনুযায়ী পরিকল্পনা গ্রহণ, নতুন উদ্ভাবন ও নতুন করে সবকিছুকে সাজানো। কিন্তু এ বিষয়ে আমাদের কোনো পরিকল্পনাই নেই। যে খাত দেশের বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল, সেটি নিয়েই কারো কোনো মাথাব্যথা নেই।
সমাজসেবা খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে মোট বাজেটের মাত্র ৫%। কিন্তু আজকে দেড় বছরের অধিক সময় ধরে চলমান মহামারী পরিস্থিতিতে মানবতা অন্য যেকোন সময়ের চেয়ে বেশি বিপন্ন। এরূপ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র তার অভিভাবক সূলভ আচরণ না করে একদিকে কর আরোপ বাড়িয়ে চলেছে আর অন্যদিকে সমাজসেবা ও জননিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ দিয়েছে মাত্র ৫%। এখানে দ্বিধা দ্বন্দ্ব কাজ করে সত্যিকারার্থে এই ৫% ও কি সমাজসেবায় ব্যয় হবে? যদি হয় তবে কিভাবে হবে? এক্ষেত্রে সরকারের পদক্ষেপসমূহ কি তা আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। অনুতাপের বিষয় আমাদের দেশে অনেক রাজনৈতিক দল বিদ্যমান থাকলেও এরূপ স্পর্শকাতর বিষয়ে প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলই মানবতার পক্ষাবলম্বনে নিজেদের তুলে ধরতে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। যা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য হতাশার।
• বাজেটে প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে ৭.২%, যা পুরোপুরি অযৌক্তিক।
একইভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভয়াবহ অসামঞ্জস্য লক্ষণীয়। অপরদিকে সুদের হার বাড়ছে, কিন্তু মৌলিক উন্নয়নের ক্ষেত্রগুলোর বাজেট দিনকে দিন কমছে। ফলশ্রুতিতে একটি ফাঁদ তৈরি হচ্ছে!
আবার এ বাজেট মূলত একটি মৌখিক বাজেট। মৌখিক কিছু আয় দেখানো হলেও তা মূলত মিথ্যা, কারণ তা ব্যাংক ঋণের সাথে মিলছে না।
তবু যদি এ মৌখিক বাজেট বাস্তবায়িত হতো, তাও একটি কথা ছিল। কিন্তু গত ১০ বছরের বাজেট পর্যালোচনা দেখলে বোঝা যাবে বাস্তবায়নের হার ধীরে ধীরে কমছে, কমে যাচ্ছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাজেটের ৮১% বাস্তবায়ন হয়েছে, যেটি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এসে ৭৬% হয়ে গেছে আর গত অর্থবছরে নেমে এসেছে ৬০%-এ। এভাবে অপচয়, অবৈধভাবে অর্থ লুট, দর্নীতির কারণে বাস্তবায়নের হার ক্রমেই কমছে, অর্থাৎ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোনো বাস্তবতা নেই। অপর দিকে যে বিশাল অঙ্কের সুদ, তা যদি দেশের উন্নয়নের কাজে লাগানো যেত, তবে পরিস্থিতি কেমন হতো তা খুব সহজেই অনুমেয়। কিন্তু কিছুই হবে না!
কোনো রাজনৈতিক দল, কোনো ধর্মীয় গোষ্ঠী, কোনো বিশ্ববিদ্যালয়, কোনো গবেষণা সংস্থা, কোনো বড় ব্যক্তি এসব মৌলিক বিষয় নিয়ে সঠিক পর্যালোচনা তুলে ধরছে না। ফলশ্রুতিতে যুবসমাজ, জনগণ বাজেটের গুরুত্ব সঠিকভাবে পর্যালোচনা এবং প্রস্তাবনার যে আবশ্যকীয়তা রয়েছে, তা থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। বাজেটের বিষয়টি একটি একাডেমিক তত্ত্বীয় বিষয় হিসেবে আমাদের সামনে হাজির হয়েছে। আমরা কেউ ভ্রুক্ষেপ করছি না, আর দেশের অবস্থা যা হওয়ার তাই হচ্ছে।
৯০% মুসলমানের দেশে ১১.৪% রাষ্ট্রীয় সুদ দেওয়া হচ্ছে কোনো কারণ ছাড়াই; অথচ এক ঢাকা শহরেই প্রতি রাতে লক্ষ লক্ষ শিশু না খেয়ে বস্তিতে ঘুমায়। শহরগুলোতে একজন শ্রমিক দৈনিক ১২-১৪ ঘণ্টা কাজ করে মাত্র ৭-৮ হাজার টাকা বেতন পায়। দারিদ্র্যের কারণে অনেক মা-বাবা তাদের আদরের সন্তানকে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। লক্ষ লক্ষ মা-বোন তাদের শরীর বিকিয়ে দিচ্ছে, পতিতাবৃত্তি করছে শুধুমাত্র দু’বেলা খাবারের জন্য। দারিদ্র্য দিনকে দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, বাড়ছে ধনী-গরীবের অর্থনৈতিক ভারসাম্যের দূরত্ব। কর্মসংস্থান তো বাড়ছেই না, বরং কোটি কোটি শিক্ষিত ও কর্মক্ষম মানুষ প্রতিদিন বেকার হচ্ছে, চাকরি হারাচ্ছে। বিনা চিকিৎসায় মানুষ মারা যাচ্ছে, করোনাকালীন পরিস্থিতিতে যা চলে গেছে নিয়ন্ত্রণের বাইরে। খাদ্য সংকট বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবার যে সকল জায়গাতে দুর্নীতি বেশি, যেমন– সামাজিক নিরাপত্তা খাত, সে সকল জায়গাতে ব্যয় বেড়েছে। এতে সত্যিকার্থে জনগণ কোনো ধরনের সুফল পাচ্ছে, নাকি অনিরাপত্তা গাণিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে? এ ক্রান্তিকালেও সেনা বাজেট বাড়ানো হচ্ছে কেন?
যে কৃষি আমাদের ঐতিহ্য, যে কৃষি আমাদের দিয়েছিল পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধনী রাষ্ট্রের মর্যাদা, সে কৃষিকে ধ্বংস করা হয়েছে, বরাদ্ধকৃত বাজেটই যার প্রমাণ। অথচ সুদের পেছনে চলে যাচ্ছে বড় অঙ্কের অর্থ। শুধু কি তাই? এ সুদের পরিমাণ আমাদের শিক্ষা বাজেটের কাছাকাছি! সুদ পরিশোধ করতে হবে, মূল ঋণ তো আছেই! কিন্তু আমাদের আয় কোথায়? আয় না থাকলে ঋণ পরিশোধ হবে কীভাবে? ঋণের সুদ পরিশোধ করতেই তো অবস্থা খারাপ, মূল ঋণ আমরা কখন পরিশোধ করব? অথচ আমাদের দেশের যে সম্ভাবনা, আমাদের খনিজ সম্পদ, আমাদের কৃষি, আমাদের বনাঞ্চল আমাদের যুব-সম্পদ, আমাদের ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেক্টর– এসব নিয়ে ভালোভাবে কাজ করলে মাত্র কয়েক বছরে সব ঋণ পরিশোধ করে আমাদের দেশকে পৃথিবীর অন্যতম ন্যায়ভিত্তিক অর্থনীতির সমৃদ্ধশালী একটি দেশে পরিণত করা সম্ভব। কিন্তু আমরা সেটি করতে পারছি না।
এদিকে বৈদেশিক ঋণ, বৈদেশিক বিনিয়োগও দিনকে দিন কমছে।
সুদভিত্তিক পুঁজিবাদীরা সমগ্র দুনিয়াকে শাসনকালে এমন এক পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করেছে, যেটির কারণে আমরা প্রত্যেকেই প্রত্যক্ষভাবে হোক পরোক্ষভাবে, জেনে হোক বা না জেনে সুদের সাথে জড়িয়ে পড়ছি, জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হচ্ছি। ফলশ্রুতিতে অর্থনৈতিক খাতে মানুষের মুক্তি তো দূরের কথা, গোটা দুনিয়ার ৭০-৭৫% মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে, অনাহারে, অসুখী অবস্থায়, খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির অভাবে জীবনযাপন করতে করতে বাধ্য হচ্ছে। সুদের কারণে পাশ্চাত্য তাদের বাজারকে ঠিক রাখার জন্য লক্ষ লক্ষ টন খাবার ধ্বংস করছে, আবার একই সময়ে আফ্রিকার দেশগুলোতে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যাচ্ছে অনাহারে।
পুঁজিবাদীদের শাসনের ফলাফলের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশেও এ জুলুম ও শোষণ এখনো সমানভাবে বিদ্যমান।
অর্থাৎ আমাদের দুর্দশার অন্যতম মূল কারণ সুদ। অথচ এটি নিয়ে আমরা কেউ কথা বলি না, উল্টো সুদকেই প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে।
সুদের ব্যাপারে ইসলাম কত সুনির্দিষ্ট ও দূরদর্শী মূলনীতি দিয়েছিল, তা আল্লার রাসূল (সাঃ) এর বিদায় হজ্জের ভাষণ পর্যালোচনা করলেই বোঝা যায়। রাসূল (সাঃ) আল্লাহর একত্ববাদের ঘোষণার পরেই যে সকল বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে আলোকপাত করেছেন, তার মধ্যে অন্যতম হলো সুদ। তিনি সবাইকে সুদ থেকে দূরে থাকতে বলেছেন।
ইসলামী সভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখব, ইসলামের আলেমগণ, নেতাগণ সুদের বিরুদ্ধতা করে গিয়েছেন। তারা জনগনকে সুদবিহীন রাষ্ট্র উপহার দিয়েছেন। কারণ এ সুদ ক্ষুধা এবং দারিদ্র্য যেভাবে ডেকে নিয়ে আসে, সুদ বন্ধ করা ব্যতীত তা কখনোই মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় সুদ ছাড়া অর্থনীতি পঙ্গু। এ অর্থব্যবস্থায় সুদ হলো তেলের মতো। তেল ছাড়া যেমন গাড়ি চলে না, সুদ ছাড়াও অর্থনীতি চলবে না। আবার এটি থাকলেও মুদ্রাস্ফীতি, অর্থনৈতিক সংকট হবেই। অর্থনৈতিক সংকট, বেকারত্ব, শোষণ, সম্পদ বণ্টনে বৈষম্য, বৈদেশিক রাজনীতিতে ভারসাম্যহীনতা, বৈদেশিক ঋণ, সামাজিক অবক্ষয়, যুদ্ধ-বিগ্রহ, পশ্চাৎপদতা, ঘুষ, দুর্নীতি, চারিত্রিক অবক্ষয়সহ সুদের ৭০টির বেশি অপকারিতার কথা বলেছেন রাসূল (সাঃ)।
এসব বর্তমানে আমাদের দেশেও পরিলক্ষিত হচ্ছে।
এভাবে যদি একটি দেশ, একটি জাতি চলতে থাকে, তাহলে সে জাতির মধ্য থেকে কীভাবে মুক্তিকামী ব্যক্তিত্ব উঠে আসবে? রাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর পরিবর্তে অন্তঃসারশূন্যতার দিকে ধাবমান করা, সংস্কৃতিকে পাশ্চাত্যের নীতি-নির্ধারকদের হাতের পুতুল বানানো, চিকিৎসা, কৃষি, খাদ্য, প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র নীতি– সবই ভিন্ন দেশের লবিগুলোর নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়াই তো স্বাভাবিক!
এজন্য আল্লাহর রাসূলের (সাঃ) বিদায় হজ্জের ভাষণ অনুযায়ী, তাঁর দেখানো পথ অনুযায়ী আমাদের মুক্তির পর্যালোচনা, আগামীর নতুন বাংলাদেশ গড়ার পর্যালোচনা ও সুদমুক্ত ন্যায়ভিত্তিক অর্থনীতির ভিশন তুলে ধরা আবশ্যক। আমাদের সচেতনতা ও সংগ্রাম ছাড়া অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন অসম্ভব, সংকট থেকে মুক্তিও মিলবে না।
ঋণ ও সুদনির্ভর অর্থনীতির নিগড় থেকে বের হয়ে, কথিত উন্নয়নের ডায়ালগ বাদ দিয়ে আমাদের ইন্ড্রাস্ট্রি, কৃষি, বন্দর, প্রতিরক্ষাকে উন্নত করতে হবে। শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য, ছোট শিল্প, ছোট উদ্যোগ, মৎস শিল্প, পোল্ট্রি, সবজি উৎপাদন ইত্যাদি ক্ষেত্রের উন্নয়নে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের বন্দর, আমাদের প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক আয় সবকিছু নিয়েই সবাইকে কথা বলতে হবে, সংগ্রাম করতে হবে।
জাতীয় কর্মসংস্থান কৌশল কমিটি, জাতীয় স্বার্থ রক্ষা কমিটি, প্রতিরক্ষা কমিটি, নগর ও স্বাস্থ্য রক্ষা কমিটি এবং জাতীয় উন্নয়ন কমিটি করে আগাতে হবে।
আমাদের রয়েছে–
• ১৩ কোটি কর্মক্ষম মানুষ
• তারুণ্যদীপ্ত প্রতিরক্ষা খাত
• ইন্ডাস্ট্রি কেন্দ্রিক বিশাল সম্ভাবনা
• দুনিয়ার সেরা কৃষি (যার মাধ্যমে আমাদের পক্ষে দশ বছরে সেরা ধনী রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া সম্ভব)
• গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র বন্দর
• বিপুল পরিমাণে খনিজ সম্পদ
• বনাঞ্চল
• মৎসশিল্প ইত্যাদি
এসব নিয়ে মাত্র বিশ বছর ভালোভাবে কাজ করলে এ দেশের বেকারত্ব, দারিদ্র্য, খাদ্য সংকট, চিকিৎসা সংকটসহ যাবতীয় সংকটের সমাধান তো হবেই, যাকাত নেওয়ার লোকও খুঁজে পাওয়া যাবে না; ইসলামী সভ্যতা যার সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ।